শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২২

0
1608

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২২
#আমিনা আফরোজ

অভিজাত রেস্টুরেন্টের কোন এক টেবিলের বসে আছে রোদেরা। পাশেই বসেছে বাকিরা। পুরো রেস্টুরেন্টে লাল-নীল আলোক বাতির সমাহার। পুরো রেস্টুরেন্ট জুড়ে অভিজাত্যের ছোঁয়া বিদ্যমান।সকলের সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখা পেল তার চিরপরিচিত মুখ।
পরিচিত মুখটি দেখে হঠাৎ অসহ্য ব্যাথা শুরু হলো রোদের। এই রোগের ঔষধ হয়তো নিজেরও জানা নেই রোদের। সাদা শার্ট পরিহিত ছেলেটিকে ওদের দিকে আসতে দেখেই সেদিকে চলে গেল রোদ। রোদ যত সামনের দিকে যাচ্ছিল ততই যেন অজানা অনুভূতিগুলো আবারো হানা দিচ্ছিল ওকে।

নিজের সামনে রোদকে দেখে নেহাল ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞাসা করল,

–” এভাবে সামনে এসে দাড়ালে কেন?”

–“আমারো তো একই প্রশ্ন আপনি এখানে কি করেন?”

–“রেস্টুরেন্টে মানুষ কি করতে আসে?”

–“একাই এসেছেন নাকি?”

–“আশে-পাশে আর কেউ যেহেতু নেই সেহেতু একাই এসেছি।”

–“আপনি এমন বাঁকা বাঁকা কথা বলেন কেন?”

–“তুমি প্রশ্ন বাঁকা করলে আমার কি দোষ?”

–“আপনি সব সময় আমার সাথে এমনভাবে কথা বলেন কেন?”

নেহাল কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,

–“এর কারণ তুমি একটা তারছেঁড়া পাগল মেয়ে তাই।এখন সামনে থেকে সরো তো আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।”

–“আপনাকে কাজ করতে না করেছি নাকি আমি। আপনি আপনার কাজ করতেই পারেন কিন্তু তার আগে বলেন আপনি আমাকে পাগল মেয়ে বললেন কেন?”

–“তোমার ভুল হয়েছে বলতে আমি শুধু তোমাকে পাগল মেয়েই বলি নি বলেছি তার ছেঁড়া পাগল মেয়ে। যার অর্থ তোমার মাথার সবগুলো তার ছেঁড়া। বুঝতে পেরেছো নাকি আরো বুঝিয়ে বলতে হবে?”

নেহালের কথা শুনে রোদ রেগে মনে মনে বলল,

–“এই ছেলে আসলেই বজ্জাত লোক। সব দোষ তোর নিজের রোদ ,তুই কেন এই বজ্জাত লোকটার সাথে কথা বলার জন্য দৌড়ে এলি।জানিসই লোকটা কেমন? আজ থেকে এমন লোককে নিয়ে আর কিছু ভাববি না তুই।”

রোদকে চুপ করে থাকতে দেখে নেহাল বলল,

–” কি হলো কি এত ভাবছো তুমি নাকি আবার কোন বদ মতলব আটছো মনে মনে। এইবার যদি এমন কিছু করো তাহলে আগের শাস্তি থেকে এই বারের শাস্তি কিন্তু আরো ভয়ানক হবে ।”

–“আমার বয়ে গেছে বদ মতলব আট্টতে।আমি মোটেও ওমন মেয়ে নই। আমি খুব শিন্তশিষ্ট মেয়ে।”

নেহাল রোদের কথার প্রতি উত্তরে কিছু বলার আগেই পিছন থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনতে পেল।কন্ঠস্বরের মালিক যে রোদের বেশ পরিচিত তা বেশ বুঝতে পারল নেহাল। নেহাল ও রোদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে পিছন ফিরে তাকালো।কন্ঠস্বরের মালিক টি আর কেউ না স্বয়ং সন্ধ্যা।সন্ধ্যা অনেকক্ষণ যাবত খেয়াল করছিল রোদ একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। তবে ছেলেটি রোদের সামনা-সামনি থাকায় ওর মুখ দেখতে পারছিল না শুধু পিছন থেকে সাদা শার্টটিই চোখে পরছিল। শুরুতে এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামিচ্ছিল না ও। কিন্তু পরবর্তীতে ভাবল ব্যপারটা শ্রাবণের চোখে পড়লে হয়তো হীতে-বিপরীত হতে পারে।তাই সন্ধ্যা নিজেই চলে এলো ওদের কাছে। সন্ধ্যা যদি জানত রোদের সাথে থাকা ছেলেটি আর কেউ নয় স্বয়ং নেহাল তাহলে বোধহয় এভাবে নেহালের মুখোমুখি এসে দাড়াতো না। কিন্তু নিয়তি বোধহয় ওদের দুজনকে আবারো একই দ্বারপ্রান্তে টেনে এনেছে।

সন্ধ্যাকে নিজের সামনে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল নেহালের। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আবারো ফিরে পেয়েছে তাকে।এবার আর হারিয়ে যেতে দিবে না ও ওর শ্যামলতাকে। হৃদয়ের হৃদ মাঝারে নিজের করে আগলে রাখবে সারা জীবন।

অন্যদিকে সন্ধ্যা নেহালকে দেখে সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে উদ্রেক হলো হাজারো প্রশ্নের সেই সাথে হানা দিল অনুতাপের বোঝা।আচ্ছা এখন যদি নেহাল ওকে ঠকানোর কৌফিয়ত চায় তাহলে কি বলবে ও নেহালকে? নেহাল যদি জোর করে ওকে নিয়ে যেতে চায় তাহলে বা কি হবে? সর্বোপরি শ্রাবণ যদি নেহালের বিষয়ে জানতে পেরে ওকে ভূল বুঝে? না না এসব কি ভাবছে ও শ্রাবন কিছুতেই ওকে ভুল বুঝতে পারে না ওকে। যে করেই হোক নেহাল কে বুঝাতেই হবে ওকে।সন্ধ্যার এসব উদ্ভট ভাবনার অবসান ঘটল রোদের ডাকে। সন্ধ্যাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করল,

–“কি ব্যপার ভাবি তুমি ঐখানে এমন করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?এদিকে আসো , তোমার সাথে একজনকে পরিচয় করে দেই।”

সন্ধ্যা বুঝতে পারছে না রোদের সাথে নেহালের কি করে পরিচয় হলো? তাহলে কি নেহাল সন্ধ্যার থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই রোদকে ব্যবহার করছে? না আর কিছু ভাবতে পারছে না ও। মাথাটা কেমন চিনচিন করে ব্যাথা করছে সন্ধ্যার।

–“কি হলো ভাবি এদিকে এসো?”

রোদের ডাকে আবারো সম্ভিত ফিরে পেলো ও। তাই ওর ভাবনাটাকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে রোদের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সন্ধ্যা।

অন্যদিকে নেহাল রোদের মুখে সন্ধ্যাকে ভাবি ডাকা দেখেই ভ্রু-কুচকে রোদের দিকে তাকালো ও। বুঝতে চেষ্টা করল এই মেয়ের মাথাটা কি সত্যিই গেছে নাকি সে ভুল শুনেছে।তাই ও সন্দিহান স্বরে রোদকে জিজ্ঞাসা করল ,

–“তুমি ওনাকে ভাবি বলে ডাকছো কেন?”

রোদ নেহালের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,

–“ভাবিকে ভাবি বলবো না তো কি বলবো শুনি? আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমার মাথার তার ছেড়া নয় আপনার মাথার তারগুলো ছেড়ে গেছে। ”

–“কবে বিয়ে হয়েছে ওনার?”

রোদ হেসে বলল,

–” দুই দুই বার বিয়ে হয়েছে ওদের।”

–“মানে?”

–” ও আপনি বুঝবেন না।বাদ দিন।তার চেয়ে বরং আপনাকে আমার ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় চলুন।”

সন্ধ্যাও ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে ওদের কাছে ।রোদ সন্ধ্যাকে কাছে ডেকে বলল,

–“ভাবি এনিই হচ্ছে আমাদের সেই নেহাল স্যার যার কথা আমি তোমাকে বলেছিলাম।”

সন্ধ্যা একবার নেহালের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল।ঐ চোখে চোখ রাখার মতো সাহস নেই সন্ধ্যার। কিন্তু নেহাল তখনো একদৃষ্টিতে তার শ্যামলতার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় হঠাৎ প্রিয়ন্তীর ডাকে রোদ বলল,

–“তোমরা কথা বল আমি এখনি আসছি।”

–“আরে আমাকে এভাবে রেখে কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

কিন্তু সন্ধ্যার কথাগুলো রোদের কান অব্দি আর পৌঁছলো না। কারণ রোদতো ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে। এদিকে দুজনের মাঝেই তখন নিরবতা বিরাজ করছে।কেউ কোন কথাই বলছে না।নিরবতার রেশ কাটিয়ে নেহাল বলে ওঠল,

–” আমি কি খুব খারাপ ছিলাম শ্যামলতা যে আমাকে ছেড়ে চলে আসলে?কি করি‌ নি আমি তোমার জন্য বলো? নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছি,নিজের গ্রাম ছেড়েছি,নিজের আপনজনদের ছেড়ে চলে এসেছি।এত কিছু করেও তোমাকে পেলাম না । কেন বলো তো?আমি কি এইটার যোগ্য ছিলাম।”

নেহালের কথা শুনে সন্ধ্যা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

–“আমার করার কিছুই ছিলো না। আপনার নিয়তিতে হয়তো আমি ছিলাম না। সময় কখন কারো জন্য থেমে থাকে না।আপনার জন্য আমার থেকেও ভালো মেয়ে আসবে। তাকে নিয়েই আপনি আপনার নতুন জীবনের সূচনা করুন।যেখানে কোন অতিত থাকবে না।”

–“এত সহজ নয় শ্যামলতা।তোমাকে ভুলতে পারবো না আমি।তবে তোমার করা প্রতিটি ভুলের মাসুল তো তোমাকে দিতেই হবে।”

কথাগুলো বলে নেহাল সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,

–” শুধু শুধু তোমার জন্য আরেকটা নিরপরাধ মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে।এর জন্য কিন্তু সম্পূর্ণ দায়ী থাকবে তুমি।”

নেহালের কথা শুনে সন্ধ্যা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

–“মানে?”

–“প্রশ্নটা না হয় আপাতত তোলা থাক অন্য কোন দিন এর উত্তর দিব।”

কথাগুলো বলে নেহাল সন্ধ্যাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল ওর গন্তব্যর দিকে। আপাতত কিছুটা সময় একান্ত নিজেকে সময় দিতে চাই ও। এত বড় ধাক্কা সামলানোর জন্য কিছুটা সময় চাই ওর। তবে সন্ধ্যাকে এত সহজে হারিয়ে যেতে দিবে না এজন্য যা করতে হয় করবে ও।

রাত তখন মধ্যরাত। আজকেও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতায় একাকী দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। মাথায় ঘুরছে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু সেই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর জানা নেই ওর। আগামী দিনগুলো যে ওর জন্য খুব একটা সুখকর হবে না সেটাও খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে সন্ধ্যা। নেহাল ওকে পাবার আশায় আবার কোন ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠে কে জানে।

অন্যদিকে রোদ ও তখন জেগে থেকে রাতের নিস্তব্ধতার সাথে কথা বলে চলেছে। রাতের এই নিস্তব্ধতাকেই জানিয়ে দিচ্ছে তার লুকানো অনুভূতিগুলো।

সন্ধ্যা আর রোদের মতো নেহাল ও রাতের এই নির্জন প্রহর কাটাচ্ছে ধোঁয়ার নেশায়। আপাতত এই নেশাতেই ওর ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টা পোড়াচ্ছে ।কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছে ধোয়ার মাধ্যমে। এতে যদি কিছুটা কষ্ট লাঘব হয়ে ওর। এই ব্যথা যে আর সহ্য করতে পারছেনা ও। নিজের প্রিয়তমাকে অন্য কারো সাথে কিভাবেই বা মানতে পারবে ও।

রাতের নির্জন আকাশের একাকি চাঁদটা ও হেলে পড়েছে পূব আকাশের দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো একটি নতুন দিনের সূচনা ঘটবে। সেই নতুন দিনের অপেক্ষাতেই রয়েছে তিন তিনটি মানব – মানবি। ভাগ্যের ফেরে তিনজনের জীবন এখন এক সুতোয় গাঁথা হয়ে গেছে।

চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।তারা নিরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ???)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here