#যখন_তুমি_এলে
লেখা: জাহান লিমু।
পর্ব: ৩৩।
“বিরুপুর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে ভাইয়ু! চোখেমুখে একরাশ উদবেগ নিয়ে কথাটা বললো সাচী।”
” কিন্তু সাচীর উদবেগকে পাত্তা না দিয়ে, সায়াহ্ন বললো,
বিয়ে আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে মানে কি?
হয় হয়ে গেছে,না হয় হবে। কথাটা বলে একটু চুপ করে রইলো সে। পরক্ষণেই বললো, আর বিয়ের বয়স হয়েছে,বিয়ে হবে। এটাই তো স্বাভাবিক। তো এসব আমাকে বলছিস কেন?”
সায়াহ্নর কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো সাচী। মনে মনে ভাবলো,সত্যিই কি তোমার কিছু আসে যায় না ভাইয়ু?
কিন্তু মুখে বললো,অন্য কথা। তোমার সাথে কি আলাপ করতে পারিনা বিরুপুর বিষয়ে? আমাদের প্রতিবেশি। আর প্রতিবেশি বলছি কেন,নিজের মানুষের মতই। এতো বছর ধরে আমাদের এখানে আছে। আমাকে বোনের মত ভালোবাসে,স্নেহ করে। তোমাকে বড় ভাইয়ের মত রেসপেক্ট করে। এই কথাটা সাচী সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত বললো। ভাই ডাক শুনে সায়াহ্নর রিয়্যাকশান দেখার জন্য। কথাটা বলেই আঁড়চোখে ভাইয়ের রিয়্যাকশান দেখার চেষ্টা করলো সে। সায়াহ্নর কুঁচকানো ভ্রু আর বিরক্তিমাখা মুখ দেখে,সাচীর পেট ফেটে হাসি আসছিলো। অনেক কষ্টে হাসি সংবরণ করলো সে।
তখন সায়াহ্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” ঐ কালো মানিকের সাথে বিয়ে হচ্ছে নাকি?”
সাচী প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলনা,কালো মানিক কাকে বললো ভাই। তবে পরক্ষণেই বুঝে গেলো। আরাদকে কালো মানিক বলছে ভাই। সাচী হাসলো বুঝতে পেরে। সায়াহ্নকে আরেকটু খোঁচানোর উদ্দেশ্যে বললো,
” সে কালো মানিক,তাহলে কি বিরুপুর তোমার মত ফর্সা মানিককে চয়েস করা উচিত?”
সায়াহ্ন থতমত খেয়ে গেলো পুরো। সাচী আজকে ওকে বাগে পেয়েছে একেবারে। খালি উল্টাপাল্টা কথা বলছে। সায়াহ্ন নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো,
” সেটাতো তোর বিরুপুই ভালো জানে।”
কথাটা শুনে সাচী সন্দেহের চোখে তাকালো সায়াহ্নর দিকে। তবে সায়াহ্ন সাচীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে,সেখান থেকে চলে গেলো। সাচীও সায়াহ্নর পিছু নিলো। আজকে ওকে বুঝতেই হবে সব। সাচীকে আবার ওর পিছু আসতে দেখে,সায়াহ্ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর আবার নিজের কাজে লেগে গেলো। সাচী দেখতে পেলো,ওর ভাই অনেকগুলো পোর্টেট এঁকে রেখেছে। সবগুলোই মেয়ের। এ কয়মাসে বেশ ভালোই শিখে গিয়েছে দেখা যায়। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই আর্ট পারতো। তবে মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন আবার শুরু করেছে। একটা পোর্টেট দেখে, সাচীর চোখ আঁটকে গেলো। ছবিটা আঁকা এখনো শেষ হয়নি বোধহয়। শুধু চোখ দুটো,আর চুল আঁকা। পুরো মুখ অবয়ব এখনো আঁকা হয় নি।
তবে চোখ দুটো ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। সাচী সেই ছবিটার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। ছবিটার দিকে তাকিয়ে জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললো,
এই ছবির মেয়েটাকে আমি কোথাও দেখেছি। বিজ্ঞের মত করে কথাটা বললো সে। সায়াহ্ন কোন কথা বলছেনা। সে নিশ্চুপ। ওকে চুপ থাকতে দেখে সাচীই বলে উঠলো,
এই ছবিটা আঁকা শেষ হলেই,সাথে সাথে আমাকে দেখাবে। কোন চিটিং করবেনা বলে রাখলাম। সায়াহ্ন ঘাড় নাড়ালো কেবল। ভাইকে বিশ্বাস হতে চাইছেনা সাচীর। তাই পোর্টেটটার একটা ছবি তুলে নিলো ফোনে। যেন কোন চেঞ্জ করতে না পারে। সাচী বের হয়ে গেলে,সায়াহ্ন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। উফফ…এরকম বোন থাকলে,গোয়ান্দার দরকার পড়বেনা কারো।
অসম্পূর্ণ ছবিটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো সে। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করেও,এই ছবিটা সে শেষ করতে পারছেনা। আঁকতে নিলেই,সব এলোমেলো হয়ে যায়। মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনুভূতিরা বন্দি থাকতে থাকতে অনশন শুরু করেছে। শেকল দিয়ে বেঁধেও তাদের আঁটকে রাখা যাচ্ছে না আজকাল। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়তে চাইছে প্রতিনিয়ত।
ঐ মলিন চোখদুটোতে ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণা ব্যতীত কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। ঐ করুণ চাহনি আমার ভেতরটা ধুমড়ে-মুচড়ে দেয়। হৃদয় বাঁধা মানতে চায় না। কিন্তু আমার হাত পা যে বাঁধা বিরু পাখি!
.
পার্কে বসে আছে আরাদ,বিরুনিকা। বিরুনিকাই আরাদের সাথে বাইরে কোথাও বসে কথা বলতে চাইছিলো। বিরুনিকা কি বলবে,তার কিছুটা অবশ্যই আরাদ অনুমান করতে পারছিলো। তবুও বিরুনিকার সব কথা শুনলো। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
” আচ্ছা,আমি না হয় বিয়ে ভেঙে দিলাম। কিন্তু আপনার মা তো আর থেমে থাকবেনা। উনি অন্য পাত্রের খোঁজ অবশ্যই করতে থাকবে। আর আপনি তাকে ভালোবাসেন,সে তো আর আপনাকে বাসে না। তাহলে আপনি কোন ভরসায় একের পর এক বিয়ে ভাঙবেন। সেও যদি আপনাকে ভালোবাসতো,তবে না একটা কথা ছিলো৷ কিন্তু এভাবে মাঝ নদীতে একা নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকলে তো,কোন পথ খুঁজে পাবেনই না। বরং ডুবে যাওয়ার চান্স আছে। ”
আরাদের কথা শুনে বিরুনিকার চোখ টলমল করছে। কোন কথা বলতে পারছেনা সে। এটা সে নিজেও জানে। এতোকিছুর পরও অপর দিক থেকে কোন রেসপন্স না পেলে,তখন আশা করাটা তো বোকামি ব্যতীত কিছুই নয়।
কিন্তু মন তো সেসব বুঝতে চায় না। হিসাব,নিয়মের বাইরে গিয়ে মন নিজের প্রাপ্তিটুকু বুঝে নিতে চায়৷ নিজের ভালোবাসা পাওয়াতে যে মন বড্ড স্বার্থপর,বড্ড একরোখা। সব কিছু বুঝেও,বুঝতে চায় না। জেনেও, জানতে চায় না। সে মাঝ নদীতেই বৈঠাহীন একা বসে থাকতে চায়৷ কেউ তাকে নিতে আসবে,সেই আশায়। বিরুনিকাও সেরকম অদ্ভুত একটা আশা নিয়ে বসে আছে। সে জানে, এটা অনেকটা অলীক। তবুও সে এই অলীক স্বপ্নটাই মনে বুনে রেখেছে। যদিও মনে বয়ে চলেছে আতঙ্কের ঝড়৷
আরাদ বিরুনিকাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।
আর মনে মনে ভাবছে, এই মেয়েগুলো বোকার মত নিঃস্বার্থভাবে কি করে ভালোবাসে?
যেখানে ছেলেগুলো ওদের অনুভূতির মূল্যই দিতে পারেনা।
এক সাচী। যে ব্রেকআপ হওয়ার পরেও,এক্সকে এখনো এতো ভালোবাসে। আচ্ছা, ওরটা না হয় মানা যায়। যেহেতু তুহিনের কোন দোষ নেই।
আরেক এই মেয়ে। নিজের মনে ভালোবাসার সমুদ্র সাজিয়ে বসে আছে, অথচ যার জন্য সাজালো, সে ঐ সমুদ্রে পা ভিজাতেও আসলোনা। তবুও এরা ভালোবাসে। যত্ন করে ভালোবাসে। ভীষণ যত্নে ভালোবাসাকে আগলে রাখে।
বিরুনিকা আরাদের কাছে অনুনয় করতে লাগলো, বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য। আরাদ বিরুনিকাকে আশ্বস্ত করলো।
যদিও বিরুনিকা আরাদকে পুরোপুরি ভরসা করতে পারলনা।
ভরসা না করার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারন রয়েছে। সাচীর শর্টফিল্মের কাজ করতে গিয়ে,আরাদ বিরুনিকার সাথে অনেকটা ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করছে। যেটা বিরুনিকার না চাইতেও,মায়ের জন্য সহ্য করতে হচ্ছে। ছাদে,বাসার নিচে,সিঁড়িতে যেকোন জায়গায় আরাদ বিরুনিকার গা ঘেষে থাকছে একদম। ভাবটা এমন যে,তাদের অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। নিউলি ম্যারিড কাপোলের মত বিহেভ করছে সে। কখনো বিরুনিকার চুল ঠিক করে দিচ্ছে, কখনো হাত ধরছে। ক্ষোভে ফেটে পড়লেও,মুখ বুজে সেসব সহ্য করছে সে। কিন্তু আর পারছেনা সে। আরাদকে জাস্ট অসহ্য লাগছে ওর। তাই আজ সব সত্যি বলে দিলো সে। এখন যা হওয়ার হবে।
বিরুনিকা চলে যাওয়ার পর,আরাদ পার্কের আকাশ-বাতাস কাপিয়ে হাসলো।
বিরুনিকা জানেনা যে,আরাদ কাজগুলো ইচ্ছাকৃত করছে।
আর সেটা ওর ভালোর জন্যই করছে। তবে আরাদের মনে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। যদি ওদের ট্রিকস কাজ না করে,তবে আরাদকেই বিপদে পড়তে হবে। সেটা ভেবে আরাদের গলা শুকিয়ে আসলো।
বিড়বিড় করে বললো,
নিজে প্রেমের ধারেকাছে না গিয়েও,সবার প্রেম ঠিক করার মত গুরু দায়িত্ব নিয়ে বসে গেছিস। আগে প্রেম ভাঙতি,এখন ঠিক করিস। সুপারভ!
একেই বলে প্রকৃতির খেল। ভোগ ব্যাটা!
.
রাতে খাওয়ার পর ল্যাপটপ অন করে বসলো সাচী। আজকে রুই মাছের কালিয়াটা বেশিই মজা হয়েছে। নুরী আপার রান্নার হাত বেশ ভালো। ইচ্ছে করলে একটা রেস্টুরেন্ট দিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু সামর্থ নেই,এই যা। সাচীর অনেক টাকা হলে,নুরী আপাকে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট করে দিবে সাচী। বয়স খুব বেশি না উনার। এই ত্রিশ প্লাস। স্বামী রিকশা চালায়। দুইটা মেয়ে আছে জমজ। স্কুলে পড়ে মেয়েগুলো। নবম শ্রেণীতে পড়ে। দুটোই ভীষণ ট্যালেন্টেড। এ বয়সেই টিউশনি করায়। যেখানে সাচী আজও একটা টিউশনি করালো না। অবশ্য শফিকুরই মেয়েকে করতে দেন নি। একমাত্র মেয়ে,একটু বেশিই আদরের। সাচীও এতোটা জোর দেয় নি। কারন সে ছাত্রী হিসেবে ততটা খারাপ না হলেও,টিচার হিসেবে ততটাই খারাপ। পড়ানোর ধৈর্য খুঁজে পাই না সে।
এ পর্যন্ত যতটুকু অংশ শ্যুট করা হয়েছে,সেটা দেখছিলো সাচী। আর এডিটিং করছে। হঠাৎ আরাদের বলা কথাগুলোতে বুঁদ হয়ে গেলো সে। সে যতটা স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছিলো,আরাদ তার বাইরে গিয়ে নিজের মত করে সংলাপ বলেছে। ভিডিও শ্যুট করার সময়,অতটা খেয়াল করে শুনেনি। তাই এখন শুনছে।
কথাগুলো কিছুটা এমন;
আরাদ সোহানীকে উদ্দেশ্য করে বলছে।
তুমি নিজের জন্য কবে বাঁচতে শিখবে মেয়ে?
বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে দিলো,তুমি সুইসাইড করতে চলে গেলে। স্বামী তালাক দিলো,তুমি সুইসাইড করতে চলে গেলে।
কেন তুমি মৃত্যুটাকেই সবকিছুর সমাধান ভেবে নাও?
তার চেয়ে উঠে দাঁড়াও। ভেঙে ফেলো সব শিকল।
নিজের জন্য বাঁচো। নিজের পরিচয়ে বাঁচো। নিজেকে ভালোবাসো সবার আগে। সবার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে করতে,তুমি তোমাকেই ভুলে যাও। অনেক হয়েছে,এবারতো নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন বুনো।
আরাদের সংলাপ বলা দেখে, সাচী বাকরুদ্ধ পুরো। মনে হচ্ছে, সবটাই সত্যি। এটা কোন নাটক নয়। আরাদের এক্সপ্রেশান অনেকটা দক্ষ অভিনেতাদের মত। একটিং ক্যারিয়ার হিসেবে নিলে,মন্দ হতো না। যাকগে,যার যার লাইফ,যার যার চয়েস।
সকাল সকাল গোসল করে নিলো আজ সাচী। রাত জেগে কাজ করেছে, তাই ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো। ফজরের নামাজ পড়ে, তারপর ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েছে। আজকে আবার একজায়গায় যাবে শ্যুটের জন্য। আউটডোর শ্যুটিং আছে আজকে। তাই সকাল সকাল উঠতে হলো। হাতে সময়ও কম। আগামী একমাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। পাউরুটি আর জ্যাম নিয়ে খেতে লাগলো হেঁটে হেঁটে। ব্যাগ গোছাতে লাগলো। চুল এখনো ভেজা। তাই খোলাই রাখলো। ফোন হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো। নয়টা বেজে গেছে। আচমকা ফোনে উল্টাপাল্টা চাপ লেগে রেডিও অন হয়ে গেলো। তাড়াহুড়োর মধ্যে, আরো ঝামেলা সৃষ্টি হয়। সাচী মহাবিরক্ত হয়ে রেডিও বন্ধ করতে উদ্ধত হলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে স্তব্দ হয়ে গেল!
#চলবে….