#যখন_তুমি_এলে।
#পর্ব- ১৫।
#লেখা- জাহান লিমু।
এভাবে হাতেনাতে ধরা খেয়ে যাবে, সেটা আরাদ একবিন্দুও অনুধাবন করতে পারেনি। যদিও সে সাচীর সাথে কথা বলতেই, ওকে অনুসরণ করছিলো। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর আরাদ কেমন যেন হয়ে গেছে। নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগে। আর সেটাই ওকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। তবে সে সাচীকে সরি বলতে আসেনি। কারণ এখন সাচীকে সরি বলা, অনেকটা জুতো মেরে, গরু দান। আর আরাদ সেটা কখনোই করবেনা। আরাদ সেটাই করবে,যেটা ওর করা উচিত। আর আরাদ খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছে,এইমুহুর্তে ওর করনীয়। কিন্তু সাচীর সামনে আসার সাহস, কেন যেন করতে পারছিলনা। সাচীকে ভয় পাচ্ছে, এমনটা নয়। তবে কোথায় যেন একটা বাঁধা। সেটা ডিঙাতে পারছিলোনা সে। অবশ্য আরো কিছু কারণ ছিলো। যে কারণে বেশ কিছুদিন সময় দরকার ছিলো।
আরাদ সাচীকে ফলো করে আসলে কথা বলতে চাইতো। কিন্তু সাচীর মুখোমুখি হতে পারছিলোনা। প্রায়ই সাচীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে একসময় চলে যেতো। সাচীকে ফলো করেই, সাচীর বাসা খুঁজে বের করেছে সে। যদিও এভাবে কারো বাসা বুঝা সম্ভব না। তবে সাচী যখন বাসার ভেতর ঢুকে,তখন একটা পিচ্চি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে এটাই সাচীর বাসা। মেয়েটা অবশ্য খুব পিচ্চিও না। পনের, ষোল বছর হবে। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। সিল্কি চুল কোমড় ছাড়িয়ে পড়ে। লং ড্রেস পরা ছিলো,তাই আরেকটু বড় বড় লাগছিলো। সাচীর কথা জিজ্ঞেস করাতে, মেয়েটা আরাদের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়েছিলো। তবে আরাদ সেদিন ঠিকানা জেনে, সেখানে আর দাঁড়ায়নি। তবে এরপর নিয়ম করে আসতো বিকাল দিকে। তবে সাচীর সামনে যেতে পারছিলোনা। কিন্তু আজকে একেবারে সাচীর সামনে সে দাঁড়িয়ে। চাইলেও আর লুকোতে পারবেনা।
আজকে যখন দাঁড়িয়েছিল সাচীর বাসার সামনে,তখন সাচী পেছন থেকে আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায়। আরাদ তখন সাচীর বাসার দিকে উঁকিঝুঁকি মারছিলো। সাচী সেটা অনেক দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তবে লোকটা যে আরাদ, সেটা সাচীও ভাবতে পারেনি। সাচী নিজেও আরাদকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো।
টুকটাক কেনাকাটা করতে মার্কেটে গিয়েছিলো সাচী। যখন গিয়েছিলো,তখন বৃষ্টি ছিলো। এখনও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে জোড়ে বাতাস বইছে। ছাতা হাতে নিয়েই একেবারে আরাদের সামনে দাঁড়ায় সে। এই ছেলেকে একদম সহ্য করতে পারেনা সাচী। আর সেই কিনা এখন ওকে ফলো করছে?
আরাদের হাতেও ছাতা ছিলো। তবে আচমকা সাচীকে সামনে দেখে ছাতা হাত থেকে ছুটে উড়ে চলে গেছে দূরে। আরাদ বৃষ্টিতে ভিজছে। কোন কথা বলছেনা। সাচীই প্রথম কথা বললো।
” কি চাই এখানে? আরো কিছু কি বাকী রয়েছে? নিজেকে কি মনে করেন? এভাবে আপনি মানুষের ব্রেকআপ করিয়ে দিলেই,মানুষ আলাদা হয়ে যাবে? আর আপনি খুব মহৎ কাজ করে বেড়াচ্ছেন এটা?
সাচীর শেষের কথাটা শুনে আরাদ চমকে তাকালো। এটা কি বললো মেয়েটা?
সাচী কি তাহলে আরাদের পুরো কথাই শুনে নিয়েছিলো সেদিন?
তাহলে তো বিপদ,ঘোর বিপদ!
আরাদ গালে হাত ধরে, একঢোক গিললো। আরাদের গালে হাত ধরার কারণ বুঝতে পেরে হুঁট করেই সাচীর কিছুটা হাসি পেলো। তবে সেটা সে চেপে গেলো। কারণ এই রোবটের সামনে হাসার কিছু নেই। আরাদ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে সাচী যতটুকু জেনেছে,তাতে রোবট নামটাই পার্ফেক্ট মনে হলো। কারণ ভার্সিটির তেমন কারো সাথেই আরাদের সখ্যতা নেই। ঐদিনের ঐ মেয়েটা ছাড়া। সবাই চিনে ওকে,কিন্তু তেমন সম্পর্ক নেই। আর আরাদের চালচলন সম্পর্কে যতটুকু জেনেছে,তাতে একটা উদ্ভট চরিত্রই মনে হয়েছে। তা না হলে কেউ শুধু শুধু কারো সাথে কেন এমন করবে?
নিশ্চয়ই মাথায় সমস্যা আছে ব্যাটার। যাকগে, সেসব বাদ। এখন কেন ফলো করছে, সেটা জানা যাক।
আরাদ যখন ভাবনায় বিভোর, তখন সাচী আরাদের সামনে তুবড়ি বাজালো হাতে। আরাদের ঘোর কাঁটলো। সাচী আবারও রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
” কথা নেই কেন মুখে? এতো বড় বড় কাজ করতে পারেন,আর কথার বেলায় ফুঁস? কথা বলুন,নয়তো ফুটুন এখান থেকে। এমন আবর্জনা মার্কা মানুষের সাথে কথা বলার কোন রুচিবোধ আমার নেই আর।”
আরাদ তখনো চুপ দাঁড়িয়ে ছিলো। আজকে সাচী ওকে আপনি করে কথা বলছে,আর ঐদিন!
ভালোবাসা কি একটা মানুষকে দৈব শক্তি প্রদান করে?
একটা মেয়ে হয়ে আচমকা আমাকে যেভাবে পেঁচিয়ে ধরলো,জাস্ট ভাবা যায় না। এরকম মেয়েও আছে? হুঁট করে এভাবে তুই তুই করে চড়-থাপ্পড় লাগানোর মত সাহস সচরাচর কোন মেয়ের দেখা যায় না। আরাদের কেন যেন ভালো লাগলো বিষয়টা। যদিও এটা ওর চরিত্রের সাথে যায় না। তবে মেয়ে মানেই দুর্বল,এমনটাই হতে হবে কেন?
আগে যতগুলো ব্রেকআপ আরাদ করিয়েছে,কোন মেয়েই এমন ছিলো না। ইনফেক্ট ব্রেকআপ করেই, সাথে সাথে অনেকে নতুন সম্পর্কে চলে গেছে। আবার কেউ কেউ বিয়েও করে ফেলেছে। আর ছেলেরা তো আরো উপরে। সবাই না,তবে বেশিরভাগ। আমি নিজে ছেলে হওয়া স্বত্তেও এটা বলছি। ছোটখাটো কারনে ব্রেকআপ করে,তারা দুজন দুজনের মত আলাদা পথ বেঁছে নিয়েছে। দুজনের দুজনের প্রতি কোন বিশ্বাসই ছিলো না তাদের। আর নয়তো আমার ছোট্র একটা কথায় মুহুর্তেই তারা ব্রেকআপ কিভাবে করে দেয়?
আমি জানি, আমি যে কাজটা করি সেটা ঠিক না। অন্তত আর দশটা মানুষের চোখে। তবে আমার কাছে ঠিকই মনে হয়। সেটার যথেষ্ট কারনও আছে।
মূলত ঐসব ছেলেমেয়েদের কোন পিছুটানই নেই। আর যেখানে পিছুটান নেই,সেখানে কোনদিনই ভালোবাসা ছিলোই না।
এসব সম্পর্ক গুলো মেকি,লোক দেখানো।
এই প্রথম কোন মেয়ে তার ভালোবাসার জন্য এমন করেছে। তবে ছেলেটা কি সত্যিই মেয়েটাকে ভালোবাসে?
বাসলে,অন্তত একটা সুযোগ তো দেওয়ার কথা।
তা না করে এভাবে নিরুদ্দেশ!
বিষয়টা একটু জটিল।
আরাদকে এখনো চুপ থাকতে দেখে বিরক্তি নিয়ে, সাচী সামনে চলে যেতে নেই। তখন আরাদের হুঁশ আসে। কিন্তু সাচী একপা সামনে এগুতেই আরাদের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায়। সাচীর হাত থেকেও ছাতাটা ছুঁটে যায়। মুহুর্তেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সাচীর কুঁকড়া চুলে শিশিরের মত জমে যেতে থাকে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
চোখেমুখে বিস্ময় আর খুশির ঝিলিক নিয়ে, আরাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,” কে বলেছে আপনাকে?”
তুহিনের খোঁজ পেয়ে সাচীর অবস্থা বেসামাল। কিন্তু এই রোবট কি করে তুহিনের খোঁজ পেলো?
.
ঐদিন তানিমের ফোন রেখে দেয়ার পর,রোহানীও আর রাগে ফোন দেয়নি। ওর বাবা তানিমের কথা জিজ্ঞেস করলে,রোহানী কিছু না বলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। রায়হান সাহেব বোকার মত তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। মেয়ের এমন আচরণের কোন কারন খুঁজে পেলেন না। তবে মেয়ের চোখে জলের উপস্থিতি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।
তবে কি সেই ছেলে আমার মেয়েকে ধোঁকা দিলো?
রায়হান সাহেব ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু তিনি ছেলেটার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাই যোগাযোগ করাও সম্ভব না। কিন্তু একটা বিহিত তো করতে হবে। এভাবে ঝুলে থাকার তো কোন মানে নেই।
একবার সোহানীর সাথে কথা বলে দেখবেন?
দেখা যেতে পারে। সে হয়তো জানলে জানতেও পারে ছেলেটার ব্যাপারে। যেই ভাবা সেই কাজ। সোহানী তখন মনোযোগ দিয়ে আগের দিনের একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলো। অভিনয় শেখার ব্যাপারে সে ভীষণ সিরিয়াস। আগের দিনের নায়িকারা কিভাবে এক্সপ্রেশান দিতো,কিভাবে কথা বলতো সব সে অনুসরণ করে।
হঠাৎ কান থেকে হেডফোন খোলায়, সোহানী চমকে যায়। পাশে তাকিয়ে দেখে বাবা। বেশ অবাক হয় সে। এভাবে বাবা তেমন কথা বলতে আসেই না। সময়ই পায় না। এখন কয়েকদিন যাবত বাসায় আছে। সোহানী ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো। বাবাকে দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন দরকারী কথা বলতে এসেছেন। রায়হান সাহেব বললেন,
” তোমার বোনের ব্যাপারে কিছু জানার ছিলো।”
এটা শুনে সোহানী মুহুর্তেই বুঝে গেলো। তবে সেও সব সত্য বলে দিলো যা যা জানে তানিমের ব্যাপারে। রায়হান সাহেব সব শুনে তানিমের ঠিকানা নিলেন। ছেলে ভালো হলে উনার কোন আপত্তি নেই। টাকা পয়সা উনারও আছে। কিন্তু মানুষের সুখটাই আসল। তবে আমরা বোধহয় সুখ পেলে টাকা খুঁজি,টাকা পেলে সুখ। টাকা,সুখ দুটো একসাথে খুব কমই ধরা দেয়। কিছু অপূর্ণতা যে জীবনে থেকেই যায়।
রায়হান সাহেব পরদিন সকালেই তানিমদের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন। শুক্রবার ছিলো,তাই তানিম বাসাতেই থাকবে। কলিংবেল বাজাতেই একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুললেন। রায়হান সাহেব সালাম দিলেন। ভদ্রমহিলা উনাকে ভেতরে যেতে বললেন। ভেতরে গিয়ে রায়হান সাহেব তানিমের খোঁজ করতে লাগলেন। তানিম তখন ড্রয়িংরুমের দিকেই আসছিলো। ভদ্রমহিলা তানিমের দিকে ইশারা করে বললেন,এটাই তানিম। উনার ছেলে। তানিম রায়হান সাহেবকে সালাম দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে রায়হান সাহেব উঠতে নিলেন। তানিমের মা নাস্তা এনে রাখলেন সামনে। রায়হান সাহেব খেতে চাইছিলেন না। কিন্তু এভাবে না খাওয়াটাও অভদ্রতা দেখায়। তাই তিনি কয়েক টুকরা আপেলের স্লাইস খেলেন। তানিম বাসার গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো উনাকে। গেইটের কাছে এসে রায়হান সাহেব বললেন,” আমি রোহানীর বাবা। তানিম খুব বেশি অবাক হলো বলে মনে হলো না। কারন সে কিছুটা অনুমান করতে পারছিলো। তবে উনি শেষপর্যন্ত নিজের পরিচয় দেন কিনা, সেটা দেখতে চাইছিলো সে।
সেদিন রাগারাগির পর তানিম বা রোহানী কেউ কাউকে একটা ফোন,মেসেজ কিছুই দেয়নি। সেজন্য তানিম মনে মনে একটা প্ল্যান করলো। তার জন্য অবশ্য সোহানীর হেল্প লাগবে।
রায়হান সাহেবের তানিমকে পছন্দ হয়েছে বেশ। ভীষণ বাস্তববাদী ছেলে। তানিমকে বললো যেন ওর মা প্রস্তাব নিয়ে যায়। তার আগে তানিম রোহানীকে সারপ্রাইজ দিতে চায়।
#চলবে…