শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১৯
#আমিনা আফরোজ
প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। শ্রাবণ ও ততক্ষনে খাবার নিয়ে রুমে এসেছে।সন্ধ্যাকে লাল রঙের শাড়িতে দেখে শ্রাবণ একদৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল।সদ্য গোসল করে আসায় সন্ধ্যার চুল থেকে তখন ও পানি ঝরছিল। মুখে ছিল অন্যরকম স্নিগ্ধতা । যে স্নিগ্ধতার নেশায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল শ্রাবণ।এদিকে শ্রাবণকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যার অসস্তি যেন আরো বেড়ে গেল।কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে বলল,
–“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
সন্ধ্যার কথা শুনে ঘোর ভাঙল শ্রাবনের। এতক্ষণ যেন অন্য জগতে ছিল ও।সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
–“এসো খেয়ে নাও আগে।সারাদিন তো বোধহয় খাও নি কিছু।”
সন্ধ্যা শ্রাবণের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলে।এই বদরাগী লোকটা ওকে নিয়ে এত ভেবেছে।আবার ওর জন্য খাবার নিয়েও এসেছে।এ যেন সন্ধ্যার কাছে রিতিমত অবিশ্বাস্য ঘটনা।
সন্ধ্যাকে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবন ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞাসা করল,
–“এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?খেতে বললাম তো।”
সন্ধ্যা শ্রাবণের কাছে এগিয়ে এলো।তারপর শ্রাবণের হাত থেকে খাবার নিয়ে বিছানায় বসল। শ্রাবণ ও সন্ধ্যার পাশে গিয়ে বসল। শ্রাবণকে বসতে দেখে সন্ধ্যা বলল,
–“আপনি খাবেন না?”
–“আমি আপাতত খাবো না। তুমি খেয়ে নাও। দ্রুত খাওয়া শেষ করে বারান্দায় আসো। তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।”
শ্রাবণ কথা গুলো বলে বারান্দার দিকে চলে গেল। সন্ধ্যা মুখে না বললেও শ্রাবণ বুঝতে পেরেছে যে ও এখানে থাকলে সন্ধ্যা কিছুতেই স্বস্তিতে খেতে পারবে না। তাই নিজেই চলে গেল রুম থেকে। সন্ধ্যা দ্রুত খাওয়া শেষ করে বারান্দার দিকে চলে গেল।
রাত তখন প্রায় বারোটা বাজে। জ্যোৎস্না -প্লাবিত রাত, চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আকাশের গোল চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারিদিক। চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে।সেই সাথে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে হাসনাহেনা ফুলের কড়া মিষ্টি গন্ধ। বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। দু’জনের মধ্যে এখন নিরবতা বিরাজ করছে।নিরবতার রেশ কাটিয়ে শ্রাবণ নিজেই বলল,
–” এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ হয়ে গেল?”
–“জি।”
–“আচ্ছা সন্ধ্যা তোমার কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে?”
–“না তো খারাপ লাগবে কেন?”
–“আসলে তোমার মতো আমিও বিয়েটা আর একটু দেরিতে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠল না। যদিও এইটা আমাদের দ্বিতীয় বার বিয়ে তবুও আরো সময় লাগতো তোমার আমার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য।”
–“আমাদের দ্বিতীয় বার বিয়ে মানে?আর শুধু আমারই সময় লাগত আপনার লাগত না বুঝি?”
–“না আমি আমার বউ সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ জানি।বাকি অজানা কথা গুলো না হয় জীবন চলার পথে জেনে নেওয়া যাবে।”
–“তাই বুঝি।পরে আবার আফসোস করবেন না তো?”
–” আফসোস করলে কি দুই দুই বার কবুল বলে বিয়ে করতাম নাকি।”
–“আমি তো একথা আগে জানতাম না।”
–“আমি তো নিজেই জানতাম না। তুমি এ বাড়িতে আসার পর জানতে পারলাম।এজন্যই আম্মু আমাকে অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাতে না করত। আমি তো তখন অত কিছু বুঝতাম না কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছি।”
–“তারমানে আপনি জেনে বুঝে আমার সাথে এমন করতেন? আপনার মনে কি একটু দয়া লাগে নি?”
–“না লাগে নি। তোমার মাথা গোবর পোড়া হলে আমার কি দোষ এতে বলতো?”
সন্ধ্যা কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। লোকটার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। অহেতুক যুক্তি দিয়ে কথা ঘুরাতে পটু এ লোক।কিছুতেই সে নিজের দোষ স্বীকার করবে।এমন একগুঁয়ে লোকের সাথে কথা না বাড়ানোই ভালো ওর জন্য।
সন্ধ্যা থেকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রাবণ আবারও বলে উঠলো,
–“সে যাই হোক , এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি জানি আমাদের বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে তবুও তোমাকে এ সংসারের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। সংসারটা এখন তোমার একান্তই নিজের। তাই নিজের সংসারটা নিজেকেই আগলিয়ে রাখতে হবে তোমায়। পরিবারের সকল সদস্যকে আপন করে নিতে হবে ঠিক যেমনটা তুমি তোমার পরিবারের সকল সদস্যকে আপন করে নিয়েছিলে। দেখো আমার পৃথিবী বলতে আমার পরিবারের লোকজন ছিল যেখানে এখন তুমিও আমার পৃথিবী হয়ে গেছো। আমার পরিবারের কারো কথায় যদি তুমি কষ্ট পেয়ে থাকো তবে তা আমাকে জানাবে । সে বিষয়টা আমি দেখব তবুও তুমি নিজের মুখে তাদেরকে কিছু বলবে না।”
–“আপনি এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। এই সংসার টা এখন থেকে আমার। তাই এই সংসারের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্বটাও আমার। আজ থেকে এই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব আমি নিজেই নিয়ে নিলাম।”
–“শুধু সংসারের দায়িত্ব পালন করলে তো হবে না। সংসারের পাশাপাশি আরো কিছু দায়িত্ব আছে তোমার।”
–“আর কি দায়িত্ব আছে?”
–“আমার দায়িত্বটাও তো তোমাকে নিতে হবে তাই না। দেখো অর্ধাঙ্গিনী অর্থ অঙ্গের অর্ধেক।তাই আমার ভালো লাগা খারাপ লাগার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে তোমার। শুধু আমার ভালোলাগা নয় তোমার ভালো লাগা খারাপ লাগা গুলোও আমার সাথে শেয়ার করতে হবে।আমাদের তো বাকি জীবন টা একসাথে চলতে হবে । এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন একে অপরকে বিশ্বাস করা আর ভালোবাসা। বিশ্বাস আর ভালোবাসা ছাড়া কোন কিছুই ঠিক থাকে না। জীবন চলার পথে তো কষ্ট আসবেই তাই বলে আমার হাত ছেড়ো না।আমার কাধে তোমার বিশ্বাসের হাতটা রেখো আমি সব সামলিয়ে নিবো। বুঝতে পেরেছো তো আমার কথা।”
এতক্ষণ শ্রাবণের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল সন্ধ্যা। এক দৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে ও। আজ যেন অন্য এক শ্রাবনকে দেখছে সন্ধ্যা । যে শ্রাবণ এর সাথে আগের শ্রাবণ এর কোন মিল নেই। অন্যরকম এক ভালো লাগার সৃষ্টি হলো সন্ধ্যার মনে।
সন্ধ্যাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল,
–“আজ কি আমাকে দেখতে বেশি সুন্দর লাগছে নাকি? ইয়ে না মানে কেউ একজন আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে তার জন্য আমার লজ্জা লাগছে।”
শ্রাবণের কথা শুনে সন্ধ্যার মুখে আবারো লজ্জার আভা দেখা গেল।সন্ধ্যাকে লজ্জা পেতে দেখে শ্রাবণ এগিয়ে এলো ওর দিকে। তারপর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
–“আজ কি সারা রাত চন্দ্র বিলাস করেই কাটিয়ে দিবা নাকি?আমার কিন্তু তোমার শহরে হারিয়ে যেতেও কোন আপত্তি নেই ।”
–“আমার শহরটা কিন্তু বিবর্ণ। এই বিবর্ণ শহরে এসে নিজেকে যদি হারিয়ে ফেলেন।”
–“আমার রঙ্গিন রঙে না হয় তোমার বিবর্ন শহরটাকে রাঙিয়ে দিব। তারপর সেই রঙিন শহরের কোন এক অজানা রাস্তায় হারিয়ে যাব দুজনে।তুমি কি আমার রঙে নিজেকে রাঙাতে প্রস্তুত মায়াবতী।”
শ্রাবণের কথা শুনে সন্ধ্যা লজ্জায় শ্রাবনকে জরিয়ে ধরল। আজ যেন নিজেকে বড় বেশি ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে ওর।মনে হচ্ছে সময়টা যদি এখানেই থমকে যেত। সন্ধ্যা আচমকা জরিয়ে ধরায় শ্রাবণ মুচকি হেসে সন্ধ্যাকে কোলে তুলে ঘরের দিকে চলে গেল।পূর্নিমার চাঁদ তখন ঢলে পড়ছে পুব আকাশে। স্মিত হয়ে আসছে তার আলো।এই স্মিত চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখেই নতুন এক জীবনের পথে পা বাড়াল একজোড় কপোতি।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।জানি না আজকের পর্ব কেমন হয়েছে।আশা করি সবাই মতামত জানাবেন।যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ???)