#যখন_তুমি_এলে
#পর্ব- ০৬।
#লেখা- জাহান লিমু।
শরৎ এর সাদা সাদা তুলোর ন্যায় মেঘের মত উড়ছে সাচীর মনের প্রজাপতিরা। মনের এ কোন থেকে, ও কোন, বিরামহীন ছুটে চলেছে তারা। যেন থেমে গেলেই,সব শেষ!
সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। সে দিনটাই সাচীর ভুবনকে রাঙিয়ে দিলো। এখনো বিশ্বাস হতে চাই না। সাচীর আগে থেকেই বৃষ্টি পছন্দ ছিলো। সেদিনের পর থেকে সাচী বৃষ্টিকে ওর লাকি চার্ম ভাবতে লাগলো। সবকিছু মনে হতেই,সাচী লজ্জায় মুখ ঢাকলো। ব্যালকুনির সোফায় বসে ছিল সে। গত একটা মাসে ঘটে যাওয়া সব স্মৃতি রোমন্থন করছিলো, চা খেতে খেতে। কফির বদলে চা খাওয়া শিখে গেছে সাচী। ভালোবাসার মানুষের অভ্যাস আমাদের প্রভাবিত করেই।
আমাদের মনের অজান্তেই আমরা প্রভাবিত হয়।
সেদিন ‘শো’ চলাকালীন অফলাইনে যাওয়ার পর,তুহিন সাচীকে পর্যবেক্ষণ করেছে। একঘন্টা সময়ের মধ্যে যতবার অফলাইনে গেছে,ততবারই তুহিন খেয়াল করেছে সাচী ভীষণ বিচলিত বোধ করছে। প্রথমে তুহিন ভেবেছিল,হয়তো প্রথমবার লাইভে সেজন্য। কিন্তু যখন অন এয়ারে কথা বলছিলো,তখন সাচী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিল। তখন সাচীকে একটুও বিচলিত বোধ করছে বলে মনে হচ্ছিল না। সেটাই তুহিনের একটু খটকা লাগছিলো। অবশ্য আরো অনেক অনেক কারন ছিলো খটকা লাগার।
সেগুলো তুহিন সাচীকে বলেই নি। তবে অন্য আরেকজনের কাছে ঠিকই সব বলেছে। বলেছে বললে ভুল হবে,বলতে বাধ্য হয়েছে। যেদিন তুহিন প্রথমবার সাচীদের বাসায় আসলো, সেদিন বিরুনিকার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। সেই পুঁচকি মেয়েটা তুহিনের পেট থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সব বের করে ফেলেছে। তুহিন বিরুনিকার উচ্চতা দেখে পিচ্চি ভেবেছিল। কিন্তু যখন দেখলো স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়ে,তখন মোটামুটি শক খেলো। তবে মেয়েটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী,সেটা কথাতেই বুঝা যায়। আর সাচীকে তুহিন বুঝতে পারেনা। কেমন একটা পাযল মনে হয় তাকে। যার সমাধান তুহিন খুব সহজে করতে পারবে বলে মনে হয় না।
সাচী তুহিনকে নিয়ে গিয়েছিল অবশ্য ভিন্ন কারনে। ওর বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। তবে দুর্ভাগ্যবশত বাবা সেদিন সেইমুহুর্তে বাসায়ই ছিলো না। আর সাচী বাবাকে কোনকিছু না জানিয়েই,সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। যদিও বিষয়টা একটু বিস্ময়কর-ই বটে। তবে বাবা মেয়ের বন্ডিংটাই এমন। বন্ধুর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই কোন সম্পর্কে যাওয়ার সাথে সাথেই সাচী বাবার সাথে সবটা শেয়ার করবে,সেটা আগে থেকেই প্রমিস ছিলো। কোন প্রকার লুকোচুরি প্রেম সাচী করতে চায় না। সাচীর ধারণা, আমরা মন থেকে একজনকেই ভালোবাসতে পারি। আর বাদবাকী সব মস্তিষ্ক থেকে আসে। সেখানে হৃদয়ের কানেকশন টা পড়ে তৈরি হয়।
আগস্টের তিন তারিখ তুহিন সাচীকে হুঁট করেই প্রপোজ করে বসে। এর আগে অবশ্য ওদের নিয়মিত চ্যাটিং হতো। যেদিন সাচী রেডিও স্টেশনে গিয়েছিল,সেদিনই তুহিন সাচীর রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে। আগে থেকেই রিকুয়েষ্ট দেয়া ছিলো,তবে এতো রিকুয়েষ্টর ভেতরে সেটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও সাচী প্রতিদিন রিকুয়েস্ট ক্যানসেল করে, আবার নতুন করে পাঠাতো। তবে গত এক সপ্তাহে উত্তেজনায় সেটা করতে ভুলে গিয়েছিল। তাই তখন আবার নতুন করে রিকুয়েস্ট পাঠালে তুহিন এক্সেপ্ট করে। ঐদিনের হজম না হওয়া কান্ডগুলোর মধ্যে, এটাও একটা ছিলো। সাচীর কাছে মনে হচ্ছিল সে কল্পনায় মেঘের ভেলায় ভাসছিল তখন।
সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে গেল যে কেমন জানি ঘোর লাগার মত। মনে হয় এটা বুঝি স্বপ্ন, সাচী হয়তো ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভেঙে গেলেই, স্বপ্নগুলো কাঁচের ন্যায় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে। জীবন কি সত্যিই এতো সুন্দর?
নাকি এই সুন্দরের মাঝেও কোন কিন্তু থেকে যায়!
ভার্সিটির ভেতর এলোমেলো ঘুরাঘুরি করছিলো সাচী। ক্লাস করতে মন চায়ছেনা আজকে। আমলকী খেতে খেতে এদিক-সেদিক ঘুরছিলো। সহসা একটা কিছু দেখতে পেয়ে, হাতের আমলকী গুলো তাড়াতাড়ি ব্যাগের সাইড পকেটে ভরলো। তাড়াতাড়ি ক্যামেরাটা ধরে, ফটাফট দুই-তিনটা ক্লিক করলো।
ঐখানে দাঁড়িয়েই ছবিগুলো ঠিকঠাক এসেছে কিনা, সেটা দেখতে লাগলো। হুম,একটা ছবি মনমতো এসেছে। কেউ একজন যে সাচীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত, সেটা বোধহয় সাচী ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। আর পাবেই বা কি করে?
সে তো এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও,মস্তিষ্ক এখানে নেই।
ছবি গুলো নিয়ে গবেষণায় ডুবে আছে। ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে, ব্যাগ থেকে আরেকটা আমলকী বের করলো। যেই সামনে এগুতে নিবে, মূর্তির মত কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাত ফঁসকে আমলকীটা পড়ে গেল। মাত্র একটা কামড় বসিয়েছিল,আমলকীটার দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রইলো সে। যেন আমলকী টা ওকে বলছে, তুই আমাকে এভাবে ফেলে দিতে পারলি?
সাচী ঐদিকে তাকিয়েই বলতে লাগলো,আমি ফেলেনি বিশ্বাস কর। তুইতো জানিস,তুই আমার কত প্রিয়। তবুও যেন আমলকী অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখলো।
সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তি বুঝতে পারলনা,এই মেয়ে কার সাথে কথা বলছে। মাথায় সমস্যা আছে নাকি?
” হ্যালো,স্কিউজমি?” সাচী এতোক্ষণে সামনের লোকটার দিকে তাকালো। একটা এ্যাশ কালার শার্ট,ব্লু জিন্স, হাতে ব্লু ব্রেসলেট, উচ্চতা বড়জোর পাঁচ ফিট ছয়-সাত হতে পারে। সাচী পাঁচ ফিট তিন,তাই ছেলেটাকে ওর খুব বেশি লম্বা মনে হচ্ছে না। তবে ওর সামনে এভাবে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছে কেন,সেটা বুঝতে পারছেনা। কোনদিন দেখেছে বলেও মনে হচ্ছে না। সাচী ব্যাগ থেকে আরেকটা আমলকী বের করে, তাতে কামড় বসাতে বসাতে বললো,
” ডু ইউ নো মি?”
” বাংলায় বলবেন দয়া করে?” সাচী এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। আমলকীটা দুই কামড়ে খাওয়া শেষ করে বললো,এতোটুকু ইংলিশ বুঝেননা,ভার্সিটিতে পড়েন?
আর তাছাড়া আপনিও তো ঐটা ইংরেজিই বললেন,যদি কানে ভুল না শুনে থাকি। এটাতো আর ফেব্রুয়ারী মাস না,এতো ভাষাপ্রীতি দেখানোর কিছু নেই।”
” কথাটা মনে হয় বেশ লাগলো ছেলেটার। তাই হুঁট করে প্রসঙ্গ পাল্টালো। আচমকা সাচীকে বলে বসলো,
” কারো ছবি তুললে তার অনুমতি নিতে হয়,এতোটুকু জানেননা ভার্সিটিতে উঠে গেছেন। সাচী যেন আকাশ থেকে পড়লো। কার ছবি তুলেছে সে,যে অনুমতি নিতে হবে? সাচী কিছু না বুঝতে পেরে আরেকটা আমলকী বের করলো। তারপর বললো,
আমি কার ছবি তুলবো,তার জন্য আপনার অনুমতি নিবো কেন শুনি? আপনি কোথাকার কোন গডফাদার,হুহ!
ছেলেটা বোধহয় বেশ অবাকই হলো সাচীর কথা শুনে। তাই হুঁট করেই সাচীর গলা থেকে ক্যামেরাটা টান মেরে নিয়ে নিলো। এতে অবশ্য একটা ঝামেলা হলো। সাচীর মাথার চুলের ফিতা খুলে, পুরো চুল মুখ জুরে ছড়িয়ে পড়লো। সাচী পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। অর্ধেকটা আমলকী যেটা হাতে ছিলো,সেটা রাগে কঁচলাতে লাগলো। কিছুক্ষণ কি ঘাটাঘাটি করে,ছেলেটা চুপচাপ ক্যামেরা আবার সাচীর গলায় ঝুঁলিয়ে দিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো। সাচীর এতোক্ষণে হুঁশ ফিরলো। কি হলো বিষয়টা?
বুঝার সাথে সাথে সাচী ছেলেটার পেছন পেছন ছুঁটতে লাগলো। সাচী সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো বেশ কয়েকবার। বোতল বের করে একটু পানি খেল এবার। আমলকী খাওয়ার পর, সাদা পানি খেলে শরবতের মত লাগে পানিটা। সেজন্যই সাচী বাইরে বের হলেই, আমলকী খায়। অন্য মেয়েদের ব্যাগে যেখানে ম্যাকআপ কিটস,চকোলেট থাকে,সেখানে ওর ব্যাগে আমলকী থাকে।
তবে এই ছেলেটার কাজ কারবার সাচী কিছুই ঠাহর করতে পারলনা। সাহস কত বড়,গলা থেকে ক্যামেরা টেনে নেয়!
সাচী এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে ছেলেটার সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটা বোধহয় এবার বেশ বিস্মিতই হলো। তাকে বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সাচী আরেকটা ভয়ানক কাজ করে বসলো। ছেলেটার সামনে থেকে কয়েক কদম পিছালো ধীরে ধীরে। ছেলেটা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সাচীর দিকে তাকিয়ে রইলো। আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক তখনি ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠলো। ছেলেটা ছোট চোখ দুটি, আরো ছোট করে ফেললো। যেন কি ঘটছে,কিছুই বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ একটা শীতল মৃদু বাতাস বয়ে গেল। মাটিতে ঝরে থাকা শুকনো পাতাগুলো সেই বাতাসে এদিক-ওদিক উড়ছিলো। ছেলেটা দেখলো,মেয়েটা চলে যাচ্ছে। বাতাসে তার এলোমেলো চুল, আরো অবাধ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মেয়েটা এটা কি করলো!
ভার্সিটির পুকুরের পাশেই সাচী রেগে মেগে বসলো। বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছে। এতোবড় সাহস,আমি আমি সাচীর গলা থেকে ক্যামেরা নিয়ে নেয়। আবার জিজ্ঞেস করে,আমি নাকি অনুমতি ছাড়া কার ছবি তুলেছি। আমার ক্যামেরা,আমি ছবি তুলবো,তার জন্য তোর অনুমতি নিবো কেন রে ছোঁকড়া? তুই কোথাকার কোন লডকার্জন?
আসছে আমাকে রুলস শিখাতে। নিজেকে যে কি ভাবে এরা। বাংলার হিরো আলম। হিরো হতে গেলে তো আরেকটু হাইট থাকতে হবে। দেখে তো মনে হচ্ছিল আমার সমানি। দুই-তিন ইঞ্চি বেশি হতে পারে বড়জোর। আর চেহারার দিকে আর না যায়। তুহিনের সামনে জাস্ট উড়ে যাবে। আর সে আসছে,আমি সাচীর সাথে রেস লড়তে। দিয়েছি একেবারে ঝামা ঘষে। এখন দেখুক কেমন লাগে। এতোদিন দেখে এসেছে ছেলেরা মেয়েদের ছবি তুলে,আজ দেখলো মেয়েরাও ছেলেদের ছবি তোলার সাহস রাখে। অবশ্য সাচীর ক্যামেরায় নিজের ছবি উঠানো, সৌভাগ্যই বটে। সাচী একটা ভাব নিলো কথাটা বলে।
কাজটা করে মনটা বেশ ফুরফুরা লাগছে। সেই খুশিতে আরেকটা আমলকী বের করে মনের খুশিতে খেতে লাগলো।
#চলবে…