#অনাদৃত
২য়_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
একজন আগন্তুক ফোনের ওপাশ থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
মোঃ রৌদ্র হোসেন আপনার কি হয়?
আমার স্বামী।
আপনার স্বামীর এক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় বাস রাস্তায় উনাকে চাপা দিয়ে চলে গেছে। স্পট ডেড। আপনি দ্রুত সরকারি হাসপাতালে চলে আসুন। বডি নিয়ে যান।
স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম,
আচ্ছা।
লাইন কেটে গেলো। অচেনা লোকটির গলার স্বর আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে টু টু টু জাতীয় শব্দ হচ্ছে। কি আশ্চর্যের বিষয়! আমার একদমই কান্না আসছিলো না। একদমই না। মানুষ অতি বিস্ময়কর প্রাণী। অধিক সুখে তারা কাঁদতে পারে কিন্তু অধিক শোকে তারা কাঁদতে ভুলে যায়। আমি সেদিন কাঁদতে ভুলে গেছিলাম।
এক বুক সাহস নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। উৎসুক কিছু পথচারীদের বলতে শুনলাম, ওর হাতে নাকি এক গুচ্ছ গোলাপ ছিলো। কথাটি যেনো আমার বুকে হুলের মতো গিয়ে ফুটলো! খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো, গোলাপের সংখ্যা কতটি ছিলো? একশ একটি?
মর্গে ঢুকলাম। নিজেই নিজেকে বলে উঠলাম, ওইতো! ওইতো! রৌদ্র ঘুমিয়ে আছে। কে বলেছে ও মৃত? কে বলেছে? আমি ডাকলেই ও জেগে উঠবে। ঠিক জেগে উঠবে।
ওর রক্তাক্ত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
রৌদ্র আর কত ঘুমাবে? জেগে উঠো। আমার ভয় লাগছে। খুব ভয় লাগছে।
রৌদ্র আমার কথা শুনলো না। ও আরামে ঘুমিয়ে রইলো। আমি অবুঝের মত অনুরোধ করে গেলাম। গোটা হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সরা আমাকে বোঝাতে পারলো না, মৃত মানুষের ঘুম কখনো ভাঙ্গে না।
আমার জীবনের গল্পটা এখানে শেষ হলেও পারতো। কিন্তু না। জীবনের গল্পের কোনো শেষ নেই। আর আমার জীবনের মূল গল্পের শুরুটাই এখান থেকে। একজন অনাদৃতার গল্প।
? ভাদ্র মাসের দুপুর।
সূর্য একদম মাথার ওপর। গত কদিন ধরে রোদের দাহ্যতা অধিক। মাটি ফেটে যাচ্ছে। ফসল মরে যাচ্ছে। নিয়ম করে পানি দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। জানালার লাল গ্রিলে একটি ছোট্ট প্লাস্টিকের বাটি বেঁধে দিয়েছি। বাটিতে পানি। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পাখিগুলো ক্ষণিককাল জানালার ওপাশে বসে বিশ্রাম নেয়। ডানে বামে তাকিয়ে সতর্কতার সাথে বাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে পানি পান করে। ভীষণ সুন্দর লাগে দেখতে!
জানালার গ্রিলে বাটি বেঁধে পাখিদের পানি খাবার সুযোগ করে দেওয়ার পন্থা আমাকে রৌদ্র শিখিয়েছিলো। মোহাম্মদপুরের সেই ছোট্ট বাসার বারান্দায় গুনে গুনে ঠিক পাঁচটি বাটি বেঁধে দিয়েছিলো। আমি ওর সাথে সে কি রাগ!
পাখিগুলো বারান্দা নোংরা করে ফেলতো। এদিক সেদিক মলে ছড়াছড়ি। দুর্গন্ধ। রৌদ্র আমার কোমড়ে ধরে গালে আলগোছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলতো,
বাহিরে কি রোদ দেখেছো?
দেখেছি।
আশে পাশে ছিটে ফোটা পানি নেই। পাখিগুলো কি খেয়ে বাঁচবে বলো?
তাই বলে বারান্দা নোংরা করে রাখবো?
পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়?
বারবার পরিষ্কার করতে অবশ্যই কষ্ট হয়।
আচ্ছা রাতে অফিস থেকে ফিরে আমি বারান্দা পরিষ্কার করবো।
সত্যি সত্যি ছেলেটা অফিস থেকে ফিরে বারান্দা পরিষ্কার করতে শুরু করলো। রৌদ্রর এমন ছোট ছোট কাজগুলো ছিলো ছোঁয়াচে। প্রথমে বিরক্ত হয়েছিলাম ঠিকই তবে সময়ের সাথে সাথে আমিও এসবে আসক্ত হয়ে যাই। একদিন পাখিগুলো না আসলে মন উতলা হয়ে যেতো। সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করতাম জোড়া শালিক দুটোর জন্য।
এক ছুটির বিকালে বারান্দায় বসে আমি আর রৌদ্র মুড়ি-বাতাসা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে দুটো শালিক এসে পানি খেতে শুরু করলো। পানি খাওয়া শেষে আমাদের সামনেই একত্রে এদিক সেদিক উড়তে লাগলো। রৌদ্র আমায় পাখিদুটো দেখিয়ে বলল,
এই জোড়া শালিক হলো আমাদের প্রতিবিম্ব।
এখনো জানালার ওপারে দুটো শালিক পাখি বসে আছে। পাখিদুটো প্রতিদিন এদিকটায় আসে। জানালার গ্রিলে বসে পানি খায়। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে, এই পাখিগুলো রৌদ্রর দেখানো সেই জোড়া শালিক কিনা!
দরজায় ক্যাড় করে শব্দ করে উঠলো। মা ঘরে ঢুকলেন। অন্য কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরেই হয়তো শালিক দুটো উড়ে গেলো। জানালার গ্রিলে বাটি বেঁধে রাখার বিষয়টি আমার মা পছন্দ করেন না। কারণটা পরিচিত। জানালা পাখিদের মলে সুসজ্জিত থাকে।
আমার মা মনোয়ারা বেগম। যথেষ্ট ক্ষোভ নিয়েই তিনি বললেন,
তোর এই স্বভাব যাবে না? অসভ্য পাখিগুলোর আস্তানা গড়ে তুলেছিস। জানালার কাছে যাওয়া যায় না। মলের গন্ধ!
স্বভাব যাবে। রোদের তাপ কমুক। আশে পাশের জলাশয় গুলো ভরে উঠুক। আর গ্রিলে পানি ভর্তি বাটি বেঁধে দিবো না।
কি যে পাগলামি করিস তুই।
পাগলামি করি না মা। অবুঝ প্রাণীর উপকার করছি।
পাখিদের উপকার করে কি লাভ?
লাভ ক্ষতির হিসেব করে দুনিয়া চলে?
খালি মুখে মুখে তর্ক করিস সবসময়।
আচ্ছা। আর করবো না। তুমি বসো।
মা বসলো। তার মুখ দেখে ভীষণ চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে এসেছেন। হাসিমুখে বললাম,
মা কিছু বলবে?
না মানে বলছিলাম যে, রাতে মেহমান আসবে।
মেহমান আসবে! আগে বলো নি তো। কারা আসবে?
তোর বাবার বিজনেজ পার্টনার ও তার ওয়াইফ।
ভালো তো। রান্না কি নিজে করবে নাকি বাইরে থেকে আনবে?
দু একটি আইটেম নিজে করতে চাচ্ছি। বাকিটা তোর বাবা বাইরে থেকে আনবে। আসমানি থাকলে আরো কিছু আইটেম নিজে রান্না করতাম। ফাজিল মেয়ের বাড়ি থেকে আসার নাম গন্ধ নেই। দশ দিন হয়ে গেলো বাড়িতে গিয়েছে। ছুটি নিয়েছিলো সাত দিনের।
অনেক দিন পর বাড়িতে গিয়েছে তাই হয়তো।
এসব কিছুই না। মেয়ে বেশি শেয়ানা হয়ে গেছে। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বলছিলো, ফ্লেক্সিলোডের দোকানদারের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
খারাপ কি? মানুষের সাথে হেসে কথা বলতেই পারে।
হেসে কথা বলা মানে অনেক কিছু। বিষয়টা এত হালকা ভাবে নেয়ার মতন না। দেখা যাবে অন্য কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ভাবছি নতুন কাজের মেয়ে রাখবো।
ঠিকাছে রেখো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা আগ্রহভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
অনা, তোকে গত ইদে যে শাড়িটা কিনে দিলাম সেটা তো একবারো পরে দেখলি না।
রৌদ্র মারা যাওয়ার পর থেকে আমি শাড়ি পরি না। মাঝে মাঝে পুরাতন শাড়িগুলো বের করে গন্ধ শুঁকি। আমার প্রতিটি শাড়িতে ওর গায়ের গন্ধ লেগে আছে। তারপর আবার আগের স্থানে যত্ন করে রেখে দেই।
আমি মাকে বললাম,
তুমি তো জানো আমার শাড়ি পরতে ভালো লাগে না।
আজকে ওই শাড়িটা পরিস।
কেনো?
কেনো আবার? বাড়িতে মেহমান আসবে। ভালো মন্দ পরে সামনে যেতে হবে। শাড়ি পরে সামনে যাবি। কথা বলবি।
সালোয়ার কামিজ পরে তাদের সামনে যাওয়া যাবে না?
তোর বাবা শাড়ির পরতে বলেছে।
বাবার বিজনেস পার্টনার আসছে তার ওয়াইফকে নিয়ে। এর সাথে আমার শাড়ি পরে সামনে যাওয়ার সম্পর্ক কি?
মা উঠে দাঁড়ালো। রাগান্বিত গলায় বলল,
সেটা তোর বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আমি এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না। এত প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না।
মায়ের আচমকা রেগে যাওয়ার কারণ আঁচ করতে পারলাম না। আমাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগও দেওয়া হলো না। মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
আমি জানি কেনো আমাকে শাড়ি পরে বাবার বিজনেস পার্টনারের সামনে যেতে হবে। তবুও অবুঝের মত আচরণ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি জানি না এর কারণ কি। রৌদ্র কি জানে?
৩য় পর্বঃ https://www.facebook.com/549603828864534/posts/1027535601071352/