অনাদৃতা পর্বঃ ১

0
958

ফুলশয্যার রাতে ওর মুখটা আমার কানের খুব কাছে এনে ফিসফিস করে বলেছিলো, আমি মারা গেলে দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করো না যেনো! সেদিন আমি মুখ চাপিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠি।

কেনো দ্বিতীয় বিয়ে করলে সমস্যাটা কোথায়?

আমার কষ্ট হবে।

তুমি মারা গেলে দুনিয়ার খবরাখবর তোমার কাছে কে পৌঁছে দিবে শুনি?

বড্ড ভালোবাসি তোমায়। কারো পৌঁছে দিতে হবে না। ঠিক বুঝতে পারবো। আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমায় স্পর্শ করবে তা ভাবতেও আমার বুকে সূঁচ ফোটে। তুমি বুঝবে না।

ওর কথা শুনে আমি আরেক দফা হাসির পর্ব শেষ করি। তবে আজকাল মনে একটি প্রশ্ন চড়কির মতো ঘুরে বেড়ায়। সেদিন যদি ওর কথা শুনে না হাসতাম, কথাগুলোর ভাবার্থ যদি একটু বুঝতে চাইতাম, মানুষটা কি আজ বেঁচে থাকতো?

এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কিভাবে যেনো কেটে যায় ভাদ্র মাসের ক্লান্ত দুপুরগুলো। প্রতিটি সুন্দর মুহুর্তগুলোর শেষটা কেনো সুন্দর হয় না – অথবা যা চিরজীবন আগলে রাখতে চাই তা কেনো আজীবনের জন্য হারিয়ে যায় – এ জাতীয় প্রশ্নগুলো আমার কাছে ধাঁধার মতো। যতই খুঁজি না কেনো, উত্তর মেলে না।

আমি অনাদৃতা। ডাক নাম অনা। বয়স ত্রিশের কোটা পেরোলো সবে। তবে অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ বড়। সেই ঝুলিতে কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো অধিক। আমার জীবনের সুখগুলো ছিলো ক্ষণস্থায়ী। ভেসে আসা মেঘের মতো। আকাশ সেজে একবার এসেছিলো। তার পর থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে অবিরত।

রৌদ্রর সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিলো পাঁচ বছর আগে। প্রেমের বিয়ে। কত খড়কুটো পুঁড়িয়ে পরিবারকে রাজি করালাম। বিয়ের দিন আমি আর কি কাঁদবো? সে ছেলেই কেঁদে কেটে একাকার!
কি হল্লা করেই না বলছিলো,
আমার অনা! আমার অনা! আজীবনের জন্য পেয়ে গেলাম তাকে।
অথচ তার জীবনের সময়কাল কতটাই না অনিশ্চিত ছিলো!

যে যুগে ছয় ডিজিটের বেতনের ব্যাপক চাহিদা, সে যুগে আমি স্বামীর পাঁচ ডিজিটের স্বল্প আয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিলাম। মাথার ওপর ছাদ ছিলো। শুধুমাত্র ফ্যানটার গটর গটর শব্দে মাঝে মধ্যে খানিকটা বিরক্তি ভাব চোখে মুখে ফুটে উঠতো। রৌদ্র তখন হেসে বলতো,

ইশ! ম্যাডামের চোখে মুখে কি বিরক্তি!

দেখো না! কেমন বিচ্ছিরি গটর গটর শব্দ। একদম মাথায় গিয়ে লাগে।

আর কটা দিন সবুর করো। প্রমোশনটা হোক। নতুন ফ্যান নিয়ে আসবো।

মোহাম্মদপুরের দুই রুমের সেই ছোট্ট বাসার বারান্দায় বসে দুই টোনাটুনি গল্প করতাম। সব সাংসারিক বিষয়!
খরচ বাঁচাতে মাঝে মাঝে একটি মাত্র চায়ের কাপে পালাক্রমে দুজন ঠোঁট ছোঁয়াতাম। রাতের আঁধারে মাদুরে বসে রৌদ্রর কাধে মাথা রেখে সুখ দুঃখের হিসেব করতাম। ও শক্ত করে আমার হাত ধরে বলতো,
তোমাকে আজীবনের জন্য পেয়ে গেছি। আমি সুখী। ভীষণ সুখী।

আমি আজও ভাবি, ওর সুখ কতটা ক্ষণস্থায়ী ছিলো!

প্রথম বিবাহবার্ষিকী আমরা একসাথে কাটালাম। অফিস থেকে ফিরে আমার দিকে একটি শাড়ির প্যাকেট আর একটি গোলাপ ফুল এগিয়ে দিলো। বলল,
প্রমোশনটা হোক। একশ একটি গোলাপ তোমায় উপহার দিবো।
আমি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শুধু প্রকাশ্যে বলি নি,
একশ একটি গোলাপের চেয়ে তার শার্টে লেগে থাকা স্বেদ এর ঘ্রাণ আমার কাছে কতটা দামী!

দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীর দিন আমায় অফিস থেকে টেলিফোন করে বলেছিলো সুখবর আছে। তবে তা বাসায় ফিরে বলবে।
আমি মোহাম্মদপুরের সেই ছোট্ট বাড়ির বারান্দায় তার আসার অপেক্ষায় বসে ছিলাম। সেকেন্ডের পর সেকেন্ড যায়। মিনিটের পর মিনিট। ঘন্টার পর ঘন্টা। মধুর অপেক্ষা অস্থিরতায় রূপ নেয়। কিন্তু ও আসে না!
আসে না। এবং আসে না।
রাত বারোটায় হসপিটাল থেকে ফোন আস

#অনাদৃতা
পর্বঃ ১
#আতিয়া_আদিবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here