ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ১২ ki
* * ৩৩ * *
কলকাতায় ফিরেছি এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। এই একসপ্তাহে এমন একটা দিন হয়নি যেদিন সুজাতাকে আমি ফোন করি নি। হ্যাঁ আমিই ওকে ফোন করি। ও আমাকে নিজে থেকে কোনোদিনও ফোন করে না, মেসেজও না। ফোন করলেও রাতে সাড়ে দশটার পর। ওর বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে গেলে। এখনও ওর কিসের বাধা বুঝতে পারি না। কবে যে সেই প্রাচীর ভাঙতে পারবো তাও জানি না। এই যেমন কাল ওকে রাতে ফোনে ইচ্ছা করেই বললাম যে আগামী সপ্তাহে আমি জার্মানী চলে যাবো, আবার কবে দেখা হবে জানি না! কারণ ফিরে এসেও শ্যুটিং-এ ব্যস্ত থাকবো। সিনেমা রিলিজের আগে আর মা বাবার কাছে আসবো না। আমি দেখতে চাইছিলাম ও কি বলে এটা শুনে। ওর উত্তর এলো ওহ্ আচ্ছা! ভাগ্যে থাকলে দেখা হবে!
মানে! ভাগ্যে থাকলে দেখা হবে মানে টা কি? আমি রজত মিত্র, আমার ভাগ্য আমি নিজে তৈরী করেছি। আর সুজাতার সঙ্গে আমার দেখা আবার হবে, আর আমার চেষ্টাতেই হবে। সুজাতাকে রোজ ফোন করে আকারে ঈঙ্গিতে আমার মনের কথাটা বোঝাবার অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু সুজাতা যেন কিছুতেই বুঝতেই চায় না। আমি জানি না ঠিক কবে কিভাবে ও বুঝবে!
এদিকে ফেরার পর থেকে শুরু হয়েছে আরেক উৎপাত। আমার নতুন সিনেমার যে হিরোইন পল্লবী, ওকে নিয়ে। মেয়েটা ব্যবসায়ী বড়লোক বাপের আদুরী মেয়ে। দুবাই থেকে এখানে এসেছে হিরোইন হতে। আর প্রথম ছবিতেই আমার অপোজিটে ব্রেক পেয়েছে। অভিনয় খারাপ করে না। তবে বড্ড গায়ে পড়া। শ্যুটিংয়ের সময় যেচে আমাকে ডিনারে যাওয়ার জন্য ইনভাইট করত বারবার। না বলে বহুবার ইগনোর করেছি, তাও পিছু ছাড়েনি। তাই বাধ্য হয়ে দু-বার ওর সঙ্গে ডিনারে যেতে হয়েছে। ব্যাস্! মিডিয়া তো বসেই আছে এসব মশলাদার খবর লোফার জন্য। বেশ কটা ম্যাগাজিনে নিউজে বেরিয়েছে আমরা নাকি সিক্রেটলি ডেট করছি। মুভি প্রোমশনের সময় তো আমাদের বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাও করা হয়েছে, আমরা রিলেশনে আছি কি না! ডেট করছি কি না! যদিও আমি আর পল্লবী দুজনেই হেসে ব্যাপারটা ইগনোর করেছিলাম। কিন্তু মিডিয়া করেনি। গসিপ খবর করে ছেপেছে। এদিক থেকে বলতে হয় আমাদের সিনেমার হিরো হিরোইনদের কপাল এক দিকে বড়ই খারাপ। মিডিয়া আমাদের প্রাইভেসির গুষ্টির ষষ্টিপুজো করে ছেড়ে দেয়। সুজাতা মহারাণী এসব পড়লে আমার সম্বন্ধে কি ভাববে কে জানে! অবশ্য আমি ওকে যতটুকু চিনেছি সিনেমা বা গ্ল্যামারওয়ার্ল্ড নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ও এসব পড়ে না। কিন্তু লোকমুখে শুনতে তো পারে! একেই আমার মনের কথা ওকে এখোনো বুঝিয়ে উঠতে পারিনি, সবে বন্ধুত্ব হয়েছে। বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিনত হওয়ার আগে যদি ও এসব শুনে আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়!? কি হবে! আমাদের গল্প শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে তো! উফ্! না না এসব কি ভাবছি! থিঙ্ক পজেটিভ রজত। থিঙ্ক পজেটিভ। সব ঠিক হবে। ভালো হবে।
* * ৩৪ * *
গত সপ্তাহে জার্মানী এসেছি। তিন সপ্তাহের জন্য। আসার আগে সবাইকে দেখে এসেছি, শুধু সুজাতা বাদে। কারণ তিনি তখনও বাপের বাড়ী বসে। আমি এখানে আসার পর তিনি কলকাতায় ফিরবেন। হয়ত এখন ফিরেও গেছেন। ভাল্লাগে নাকি! সেই কবে তিন সপ্তাহ আগে দেখেছি। আর এক সপ্তাহ আগে শেষ কথা হয়েছে। ভাগ্যিস সেদিন ছবিগুলো তুলেছিলাম। এখন যখন ম্যাডাম ব্যস্ত থাকেন, আমার ফোন ধরতে পারেন না। তাই যখন আমার ওনার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করে আমি তখন ওর ফোটোর সাথে কথা বলি। লোকে শুনলে হাসবে। ভাববে সুপারস্টার রজতকুমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। সত্যি বলতে দোষ নেই, সেই প্রথম দিন থেকেই সুজাতার প্রেমে আমি পাগলই হয়ে গেছি। তবে গত সপ্তাহ থেকে তো কথাও বন্ধ। ওনার ফোনে নাকি আই.এস.ডি কল হবে না। এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস ছবিগুলো ছিলো। নইলে সারাদিনে একবারও না দেখে না কথা বলে থাকবো কি করে! কাজেই তো মন বসবে না তাহলে!
ওদিকে পল্লবী আর আমাকে নিয়ে গসিপ মাত্রা ছাড়িয়েছে। সৌজন্য পল্লবী। আমার এখানে আসার আগের দিন আমাকে ফোন করেছিলো। নরমাল কথা হচ্ছিলো, কাল আউটডোর শ্যুটিং-এ জার্মানী যাচ্ছি, কটায় ফ্ল্যাইট, কখন যাবো। ইত্যাদি ইত্যাদি। ওমা! পরদিন এয়ারপোর্টে পৌছে দেখি পল্লবী এসে হাজির। আমাকে নাকি সি অফ করতে এসেছে। ব্যাস! পাপারাৎজির ক্যামেরায় বন্দি হয়ে গেলাম দুজনে তৎক্ষনাৎ। সাধে কি বলেছি গায়ে পড়া মেয়ে! কি প্রয়োজন ছিলো ওর এয়ারপোর্টে আসার? ফালতু কন্ট্রোভার্সি যত্তসব। আর পল্লবী? ওর যেন এসবে কোনো যায়ই আসে না! মাঝে মাঝে মনে হয় ও যেন এসব ইচ্ছা করেই মিডিয়াকে দেখিয়ে করছে!
তারমধ্যে আবার আরেক জ্বালা। আজ মা কে ফোন করেছিলাম। সেটা বড় কথা নয়, সে রোজই করি সময় পেলে। দুরে থাকলে ওদের জন্য চিন্তা হয়। কিন্তু আজ মা যা বলল তাতে তো আমার চিন্তা আরোও বেড়ে গেলো! বাবা মা কে নিয়ে নয়। অন্য একজন কে নিয়ে, পল্লবী। ও নাকি বাবা মায়ের ফ্ল্যাটে গেছিলো আলাপ করতে! নিজে থেকেই! কি মেয়েরে বাবা! একে আমি ইন্ডাস্ট্রিতে আমি ওর সিনিয়র, তার ওপর আমি ওকে আমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাই নি, আর যাবোও না। বাবা সব সময় বলে ব্যক্তিগত ও পেশাদারী জীবন মেশানো উচিৎ নয়। আর বাবার এই উপদেশ আমি সব সময় মেনে চলি। আমার কর্মজগৎ ও পরিবার প্রিয়জনেদের একে অপরের থেকে দুরেই রাখি। কিন্তু এই মেয়েটা এতই গায়ে পড়া যে ও নিজেই হাজির হয়েছে আমার বাবা মায়ের কাছে! তাও আবার কখন? না আমি যখন বিদেশে! এরপরও মিডিয়া গল্প বানাবে না? মেয়েটা কি চায় বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি ওকে আমার পোষায় না। কলকাতা ফিরে ওর একটা ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে।
* * ৩৫ * *
গরমের ছুটি শেষ হতেই কলকাতায় ফিরে এলাম। এই একমাস বেশ অন্যরকম কাটলো। ছুটি শুরুর আগে কি জানতাম? যে সুপারস্টার রজতকুমার আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিজেই এগিয়ে আসবে! শুধু তাই নয়, সেদিনের পর এমন একটাও দিনও যায় নি যেদিন উনি আমাকে ফোন বা মেসেজ করেন নি। সত্যি বলতে কি আমিও এখন দিনের শেষে ওনার ফোনের অপেক্ষা করি। গত এক কয়েকদিনে আমার অভ্যেস বদলেছে। এখন দিনের শেষে ওনার সঙ্গে কথা না বললে আমারও যেন মনে হয়, কি হলো না! কি করলাম না! যদিও গত কিছুদিন যাবত কথা বলা বন্ধই আছে। কারণ উনি বিদেশ গেছেন কাজে। তাই যেন খুব খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে আবার কবে ওনার সাথে কথা হবে। আচ্ছা আমি কি ওনার প্রতি……….. না না। ধ্যাত! তা কি করে হবে? উনি কোথায় আর আমি কোথায়। উনি রোজ নিজে থেকে ফোন মেসেজ করেন, কথা বলেন তাই এরকম হচ্ছে। উনি যখন ভুলে যাবেন, আর ফোন করবেন না তখন আর আমার কিছুই মনে হবে না। হবে না নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, হ্যাঁ। হবে না, হবে না। তবে হ্যাঁ আমি নিজে থেকে ওনাকে কোনোদিনও ফোন করি নি। কি জানি করলে আবার যদি আমাকে গায়ে পড়া ভাবেন! যদি ভাবেন আমিও ওনার ফ্যানেদের মত আমি ওনার সঙ্গে সানিধ্য লাভে মরিয়া হয়ে উঠেছি! না না বাবা! দরকার নেই। উনি ফোন করলেই কথা বলব। নইলে নয়। সে যতই আমার মন কেমন করুক ওনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি একজন টিচার, আমাকে পাপাইয়ের মত এসব টিনেজ উচ্ছ্বাস মানায় না।
পাপাইয়ের কথায় মনে পড়ল, কলকাতায় ফিরে পাপাইয়ের ল্যাপটপে লুকিয়ে রজতকুমারের দুটো সিনেমা দেখেছি। কৌতুহল বশতই আরকি! মানে একটা লোকের সঙ্গে রোজ কথা বলছি, অথচ লোকটা কি করে জানবো না! মানে জানাটা তো দরকার। সাধারণ জ্ঞানের জন্য। তবে লুকিয়েই দেখতে হবে। কারণ আমি সিনেমা দেখছি, তাও আবার রজতকুমারের, এটা জানলে পাপাই-ই বাড়ী মাথায় করবে, আর আমার লজ্জার শেষ থাকবে না। যে সিনেমা দুটো দেখলাম তার মধ্যে একটা আবার নাকি প্রচুর প্রাইজও পেয়েছে, পাপাইয়ের কাছে শুনেছিলাম। প্রাইজ পাওয়া সিনেমা শুনেই কৌতুহলে দেখতে বসেছিলাম। তবে সত্যি বলব? টপ সিক্রেট। সিনেমা দুটো আমার না ভালো লাগেনি। যেটা প্রাইজ পেয়েছে সেটা তাও কিছুটা ভালো। কিন্তু অন্যটা একদম বাজে। যদিও এসব কথা রজতকুমারের কানে উঠলে ওনার খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে এসব সিনেমার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না। লজিকই নেই এসব গল্পের। পাপাই যে কি আনন্দ পায় এসব সিনেমা দেখে ওই জানি। আমি তো বলব এর থেকে বই পড়া ভালো। অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়।
কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে জয়তি আন্টির সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। খুব ভালো মিশুকে মানুষ। আমাকে বললেন আমি কেন যাই না ওনাদের ফ্ল্যাটে। কি আর বলবো, বললাম যে ছিলাম না কলকাতায়। বাড়ী গেছিলাম। শুনে বললেন ওনার ছেলেও উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গেছিলো। দার্জিলিং। তার মানে রজতকুমার বাড়ীতে কিছুই বলেন নি! আশ্চর্য! নিজের বাড়ীর লোককেও সত্যি জানায় না! কি লোক রে বাবা! যাক গে! ওদের পরিবারের ব্যাপার। আমার কি! এসব ব্যাপারে আমার কথা বলা সাজে না, আর আমি কিছু বলবও না। তাই কাকিমাকে হ্যাঁ যাবো, কেমন আছেন? ভালো আছি মার্কা কয়েকটা ফর্মাল কথা বলে পালিয়ে এসেছি একরকম। বেশী কথা বললে যদি আবার মুখ ফসকে সত্যিটা বেড়িয়ে যায়!
(চলবে)