ভালোবাসা পর্ব ৩

0
611

ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ৩ ko

* * ৬ * *

সেদিন মেয়েটার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সেই যে মেয়েটা কেবিন ছেড়ে বেড়িয়ে‌ গেলো, তারপর আর দেখিনি ওকে। পরদিনই বাবাকে ডিসচার্জ করিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরিয়ে এনেছি। এখন আমিও নিউটাউনের ফ্ল্যাটেই রয়েছি বাবা মায়ের সাথে। অনেকেই এসে যেচে আলাপ করে গেছে আমাদের সাথে। কাল তো কতগুলো স্কুল-কলেজে পড়া ছেলে-মেয়ে এসেছিলো আমার অটোগ্ৰাফ নিতে, সঙ্গে যাবার আগে বলে গেছে বাবা মায়ের কোনো অসুবিধা হলে ওদের ডাকতে, ওরা সব করে দেবে। আর করবে না ই বা কেন। সুপারস্টার রজতকুমারের বাবা মা বলে কথা। তাদের কদরই যে আলাদা হবে সে আর বলে দিতে হয় না। তবে বাবার বাড়ী ফেরার পর চারদিন হয়ে গেলো ওই মেয়েটাকে আর দেখিনি। সেক্রেটারী পৃথ্বীশবাবু বলছিলেন যে ওরা এই স্যোসাইটিরই এ ব্লকে থাকে। তবে সেদিন হসপিটালের পর আর ওদের দেখিনি, না মেয়েটাকে আর না ওর পিসেমশাইকে। কি জানি আর দেখতে পাবো কি না।

আজ বিকেলে ডক্টর আবার এসে বাবাকে চেক করে গেলেন। এখন বাবা অনেকটা বেটার আছে। ডক্টরকে পার্কিং অবধি পৌছে দিয়ে যখন ফিরছি এমন সময় দেখতে পেলাম তাকে, যাকে এসে থেকেই এতদিন আমার চোখ খুঁজে চলেছে। স্যোসাইটির মেন গেট দিয়ে একটা হলুদ-নীল রঙের শাড়ী পড়ে হেঁটে আসছে আমারই দিকে। চোখে সেই দিদিমনি মার্কা চশমা, আর ঠোঁটের নীচের তিল। দ্রুত পায়ে সে আমার দিকেই এগিয়ে এলো। তারপর যেমন এলো তেমনই আমাকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়েও গেলো এ ব্লকের দিকে। একবারও আমার দিকে দেখলো অবধি না। এটা কি হল! সুপারস্টার রজতকুমারকে এরকম পাশ কাটিয়ে কেউ বেড়িয়ে যেতে পারে আমার জানা ছিলো না। মেয়েটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে এরকম চলে গেলো! এটা আমার স্টারডমের অপমান। ভাবেটা কি নিজেকে? ওই তো গম্ভীর দিদিমনি মার্কা দেখতে। ওর থেকে কত সুন্দরী আমার একবার দেখা পাওয়ার জন্য মরে, আর ও আমাকে পাত্তাই দিলো না!? হুহ! আমারও বয়ে গেছে ওকে পাত্তা দিতে। আমিও আর ওখানে একমুহুর্ত দাঁড়াইনি। সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছি।

* * ৭ * *

সেদিনের অপমানটা যেন এখনও ঠিক হজম হচ্ছে না! আমাকে! রজত মিত্রকে! সুপারস্টার রজতকুমারকে কেউ ইগনোর করতে পারে! নাহ্ ওই একটা মেয়ে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সেদিন থেকে। দুসপ্তাহ মতন কেটে গেছে, বাবা এখন পুরো সুস্থ। এখন আমি সাথে নিয়ে স্যোসাইটির বাগানে হাঁটাই বিকেলে। ওই মেয়েটার পিসেমশাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে ভালো করে। ভদ্রলোকের গারমেন্টসের বিজনেস আছে। এখানে স্ত্রী কন্যা নিয়ে থাকেন। তবে সুজাতার সম্পর্কে বেশী কিছু জানতে পারিনি। বাবাও জিজ্ঞেস করেনি, আর ভদ্রলোক অযাচিত কৌতুহল ভাবতে পারেন ভেবে আমিও কিছু বলি নি। আর জিজ্ঞেস করবই বা কেন। যে আমাকে পাত্তা দেয় না তাকে আমিও পাত্তা দিই না, ব্যাস।

মা কদিন ধরেই বলছে যে বাবার জন্য সত্যনারায়ণ পুজো দেবে। আমি যদিও এসব পুজো-টুজো থেকে নিজেকে শতহস্ত দুরে রাখি, কিন্তু এবার আমার নিজের স্বার্থ আছে। মা স্যোসাইটির যাদের যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে সবাইকে এই পুজোয় নিমন্ত্রন জানাচ্ছে দেখে আমি একটু যেচে পড়েই সুজাতার পিসেমশাইদের নামটা বললাম। এতে মা আবার আমাকে কিরকম ফেলুদা মার্কা চোখে দেখলো। ওনাদের সাথে তো আমাদের আলাপ পরিচয়ই নেই, তুই আবার ওদের নাম বলছিস কেন? মা বলল। এই রে! মা আবার কিছু সন্দেহ টন্দেহ করল নাকি? আমারই বা এত পাকামী মারার কি দরকার ছিলো কে জানে। মা নির্ঘাৎ এটা নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। কথায় বলে না, ছেলে-মেয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট‌ হয়ে গেলেও বাবা মায়ের কাছে ছোটো বাচ্ছাই থাকে। আমার বাবা মায়ের কাছেও আমি এখনও তাই। তবে যাই হোক! বাবা ম্যানেজ দিয়েছে। বলেছে বিকালে হাঁটতে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাই মা রাজী হলো। যাক বাবা! এবার! সুজাতা সেন বুঝবে মজা। রজত মিত্রকে ইগনোর করার ফল।

* * ৮ * *

স্কুল থেকে ফিরেই পাপাইয়ে রজতকুমার বন্দনা শুনে শুনে মাথা ধরে গেছিলো। তাই বাধ্য হয়ে স্যোসাইটির ছাদে গেছিলাম একটু হাওয়া খেতে। এমনিই সারাদিন স্কুলের কাচ্চা-বাচ্চাগুলো কাঁওতালীতে মাথা ঝিমঝিম করে। তার ওপর পাপাইয়ের বকবক। উফ্! তবে এই ছাদটা আমার খুব প্রিয়। এখান থেকে অনেক দুর অবধি আকাশটাকে দেখা যায়। এখানে কটা অর্কিড এনে লাগিয়েছিলাম বাড়ী থেকে। অবসরে সেগুলোর পরিচর্যা করি আর ওদের সাথে গল্পও করি। ওরা আমার পাহাড়ের স্মৃতি। ওদের সাথে থেকে আমি যেন পাহাড়ের গন্ধ পাই। যখন ফিরে যাবো, তখন ওদের কি হবে ভেবে কষ্ট পাই। রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ছাদে আসি এই অর্কিড গাছগুলোর টানে।

আজও ছাদে ঘুরে গাছগুলোর সঙ্গে সময় কাটিয়ে নীচে নেমে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঢুকতেই সামনে দেখি সোফায় জয়তি আন্টি বসে আছেন। আমি ঢুকতেই পিসি আমাকে দেখিয়ে বলল ওই তো এসে গেছে। আয় সুজাতা, তোর খোঁজই করছিলেন দিদি।
আমি অবাক ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই জয়তি আন্টি নিজেই একগাল হেঁসে আমাকে ওনার পাশে বসতে বললেন। তারপর বললেন সেদিনের পর তো আর এলে না দেখা করতে?
-না আন্টি আসলে সময় পাই নি। আর আপনি তো আঙ্কেলকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আর কি!
-বাহ রে তাই বলে কি আস্তে নেই? সত্যি বলছি সেদিন তুমি যেভাবে আমাকে পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছ আমি তোমার ঋনী হয়ে গেছি।
-এমা! ছি ছি! এরকম কেন বলছেন আন্টি। আমি তো সেরকম কিছুই করি নি। যা করার তো পিসেমশাই আর পৃথ্বীশকাকুই করেছেন।
-হুম। কিন্তু পাশে থেকে ভরসা জোগানোটাও একটা বড় কাজ মা। সেটা তুমি করেছ। আমাকে সামলেছ।
-না না আন্টি, আমি সেরকম কিছু করি নি!
-থাক। আচ্ছা বেশ। তবে তোমার এই আন্টির কিন্তু তোমার কাছে একটা আবদার আছে। রাখবে তো?
-এমা এরকম বলছেন কেন। অবশ্যই রাখবো বলুন‌না।
-আগামীকাল আমাদের ফ্ল্যাটে সত্যনারায়ণ পুজো আছে। তুমি তোমার পিসি, পিসেমশাই আর বোনকে নিয়ে অবশ্যই যাবে। কথা দাও।
-ঠিক আছে আন্টি কথা দিলাম যাবো। আমার কথা শেষ হতে না হতেই পিসি হেঁসে বলল চিন্তা করবেন না দিদি আমরা তিনজনে তো যাবোই। তবে আমার কর্তাটির দায়িত্ব নিতে পারছি না। উনি সারাদিন ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। উনি আদৌ পারবেন কিনা জানি না। পিসির কথা শুনে আন্টিও হেঁসে বললেন সে ঠিক আছে, কিন্তু আপনি এই দুই মেয়েকে নিয়ে অবশ্যই সকাল সকাল পৌছে যাবেন কিন্তু।
-অবশ্যই দিদি, নিশ্চয়ই যাবো।
-আসলে আপনি আমি আর সুজাতা যে একই জেলার মেয়ে। তাই আপনাদের সঙ্গে আত্মিক যোগটাও যেন পেলাম। আমি যে শিলিগুড়ির মেয়ে। আর আপনারা ঘুম। আপনারা পাহাড়ের আর আমি পাহাড়ের পাদদেশের, এটাই যা তফাৎ আমাদের।
-হাহাহাহা। ভালো বলেছেন।
-ঠিক আছে দিদি আজ তবে আসি। আরেকদিন নয় এসে গল্প করবো। আজ অনেক কাজ আছে, কালই তো পুজো। এই বলে হাস্যময়ী জয়তি আন্টি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নমস্কার জানিয়ে চলে গেলেন। আর আমিও ঘরে এসে বসলাম। পাপাই টিউশন গেছে তাই রক্ষে। নইলে রজতকুমারের মায়ের আসার আনন্দে ওনার গুষ্টির পি এইচ ডি করে থিসিস পেপার আমাকে জমা দিয়ে দিত। যাই হোক। কাল আবার ওনাদের বাড়ী যেতে হবে। রবিবার তাই বাঁচোয়া। নইলে আমি আবার ছুটি ম্যানেজ করতাম কি করে কে জানে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here