ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ২
* * ৪ * *
নার্সিংহোমে পৌছে বুঝলাম আমাদের ধারনাই সঠিক। ভদ্রলোকের সত্যিই হার্ট অ্যাটাকই করেছে। তবে সঠিক সময়ে নার্সিংহোমে আনা গেছে বলে হয়ত উনি প্রাণে বেঁচে যেতেও পারেন। ভদ্রমহিলা মানে জয়তি আন্টি বললেন উনি নার্সিংহোমে পৌছেই ওনাদের ছেলেকে ফোন করে দিয়েছেন, তিনি মুম্বাই থেকে শিগগিরই ফিরবেন। হয়ত কাল সকালের মধ্যে এসে যাবেন। ততক্ষণ আমি আর পিসেমশাই থাকবো নার্সিংহোমে। আমাদের স্যোসাইটির সেক্রেটরি পৃথ্বীশকাকুও এসেছেন। উনি আর পিসেমশাই সব সামলাচ্ছেন, আর আমি জয়তি আন্টিকে।
সারারাতের চেষ্টার পর ভোরের দিকে ডক্টর এসে জানালেন যে পেশেন্ট ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। তবে গিয়ে আমরা সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ডক্টর ওনাকে কেবিনে শিফ্ট করে দিলে আমরা জয়তি আন্টিকে বাড়ী গিয়ে ফ্রেশ হতে বললাম। উনি যদিও যেতে রাজী হচ্ছিলেন না কিছুতেই। তবু ওনাকে খানিক জোর করেই পাঠানো হলো বাড়ীতে, ফ্রেশ হয়ে আসার জন্য। পিসেমশাইও সঙ্গে গেলো। কারণ কাল থেকে পিসেমশাইয়েরও অনেক ধকল যাচ্ছে। আমি আর পৃথ্বীশকাকুই থেকে গেলাম নার্সিংহোমে।
খানিকক্ষণ পরে ভদ্রলোকের জ্ঞান ফিরলে আমরা ওনার সাথে দেখা করে আলাপ করলাম। ওনার নাম রমেন কুমার মিত্র। শুধু এটুকু বলতেই পৃথ্বীশকাকু ওনাকে আর কিছু না বলতে দিয়ে থামিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এখন উনি পুরোপুরি সুস্থ নন তাই ওনাকে রেস্ট নিতে হবে, ওনার স্ত্রী সারারাত নার্সিংহোমেই ছিলেন, ভোরবেলা উনি সুস্থ জেনে বাড়ী গেছেন ফ্রেশ হতে। খানিক পরে আবার আসবেন। উনি সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেলে বাকী কথা হবে।
এরপর আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো বলে পৃথ্বীশকাকুকে ওখানে বসিয়েই বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে কেবিনের দরজা খুলতেই দেখি একটা অচেনা লোক আমাদের পেশেন্ট রমেন কুমার মিত্রের বেডের সামনে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে কি যেন করছে। ঘরে কোথাও পৃথ্বীশকাকুকে খুঁজেও পেলাম না। কোথায় গেলো কাকু? আর এই লোকটা কে! এসব ভাবতে ভাবতেই চিৎকার করে উঠলাম কে? কে আপনি? এখানে কি চাই? আমার চিৎকার শুনে লোকটা সটান আমার দিকে ঘুরে অবাক চোখে তাকালো, তারপর বলল এক্সকিউজ মি!
লোকটার বেশী বয়স নয়, এই তিরিশ বত্রিশ হবে, ফর্সা, লম্বা, পেটাই চেহারা। দেখে মনে হয় নিয়মিত শরীর চর্চা করে। চুলগুলো এখনকার ফিল্মি কায়দায় ছাঁটা, আর ডান দিকের ভ্রুতে একটা বহু পুরোনো কাটা দাগ। লোকটার পোশাক দেখেই বোঝা যায় যথেষ্ট যে ইনি যথেষ্ট শৌখিন ও ধনী লোক। তবে কোনো কারনে শৌখিন সাজপোশাক একটু বিদ্ধস্ত হয়ে আছে। সবচেয়ে গভীর লোকটার চোখ দুটো।
লোকটাকে আপাদমস্তক দেখে আবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? এখানে কি করছেন? আমার চিৎকারে এবার বাইরে থেকে নার্স এসে হাজির হয়ে বলল কি ব্যাপার পেশেন্টের ঘরে এত চিৎকার চেঁচামিচি কিসের?
আমি নার্সকে দেখে ওই লোকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম দেখুন পেশেন্টের ঘরে এই লোকটা হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। আর কে কি চাই জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
আমার আঙুলের নির্দেশ অনুসরণ করে নার্স লোকটার দিকে তাকিয়েই কেমন আনন্দে উত্তেজিত স্বরে বলল আরেহ্! স্যার আপনি এখানে? আমাদের কি সৌভাগ্য! আপনার দেখা পেলাম আজ। বলুন স্যার বলুন কি প্রবলেম।
আমি নার্সের এরকম গদগদ ভাব ভঙ্গী দেখে একটু ঘাবড়েই গেছিলাম তবে আমার ভুল ভাঙলো যখন লোকটা নার্সকে বলল যে পেশেন্ট রমেন কুমার মিত্র ওনার বাবা, তখন বুঝলাম যে এই লোকটাই রমেন আঙ্কেল আর জয়তি আন্টির মুম্বাই ফেরত ছেলে। কিন্তু তাকে দেখে নার্সের এরকম গদগদ ভাবের কারণ কি তখনও আমার ঘটে ঢোকে নি।
খানিকপরে কেবিনের দরজা ঠেলে পৃথ্বীশকাকু ঢুকে লোকটাকে কেবিনে দেখে আমাকে পাশ কাটিয়ে হাসি মুখে লোকটার দিকে এগিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বলল আরে! সুপারস্টার রজতকুমার যে! ফাইনালি আপনার দেখা পেলাম। হ্যালো! আমি গ্ৰিন ভিলা স্যোসাইটির সেক্রেটরী পৃথ্বীশ বাসু।
তারমানে এটাই পাপাইয়ের সেই সুপারস্টার রজতকুমার! আর এই রমেন কুমার মিত্র আর জয়তি মিত্র আদতে রজতকুমারের বাবা-মা! বাপরে! হাইফাই ব্যাপার সব! যাই হোক পৃথ্বীশকাকু আমার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো লোকটার। কিন্তু লোকটা কিরকম হাঁ করে আমাকে দেখছিলো। কি অদ্ভুত আর অস্বস্তিকর! আমার ওখানে নিজেকে কেমন বেমানান লাগছিলো, তাই কোনো রকমে হাত জোর করে নমস্কার জানিয়ে পৃথ্বীশকাকুকে বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম।
* * ৫ * *
মায়ের ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছি না। কি হলো বাবার? আসার আগেও তো সুস্থ দেখে এলাম। এইকদিনে কি হয়ে গেলো! নাহ এক্ষুনি বেরোতে হবে, আমি ছাড়া কলকাতায় মা অসহায়। প্রোডিউসর সুখওয়ানি আর ডিরেক্টর সম্বরণদাকে বলেই বেরিয়ে যাবো। আর যতদিন না বাবা সুস্থ হচ্ছে কোনো শ্যুটিং ডেট নয়।
ফ্লাইটে উঠে গেছি, মাকে বলে দিয়েছি সকালের মধ্যে পৌছে যাবো। তবু মন মানছে না। মায়ের গলাটাও ধরা ধরা শোনাচ্ছিলো। কিন্তু আমাকেও তো ক্লিয়ারলি কিছু বলল না! উফ্!! এত টেনশন নিতে পারছি না আর জাস্ট। যত ফ্লাইট মুম্বাই থেকে কলকাতার দিকে এগোচ্ছে ততই যেন বুকের ভেতর হাজারটা ড্রাম বাজছে। কি জানি কলকাতায় কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
ফ্লাইট থেকে নেমে কোনোমতে একটা ক্যাব নিয়ে সোজা মায়ের বলে দেওয়া নার্সিংহোমে এসেছি। চারপাশের লোকজন কৌতুহলী হয়ে আমাকেই দেখছে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার এখন এসবে কোনো আগ্ৰহ নেই। রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জানলাম বাবাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। যে ডক্টর বাবাকে দেখছে তার কাছে আমাকে যেতে বলা হলো রিসেপশন থেকে। তাড়াতাড়ী আশেপাশের কৌতুহল উন্মাদনা অগ্ৰাহ্য করে গেলাম ডক্টরের কাছে। ওনার থেকে বাবা আউট অফ ডেঞ্জার জেনে তবে বুকের ভেতর থেকে একটা বড় ভার যেন নেমে গেলো। উফ্! শান্তি। ডক্টরের সাথে করা বলে বাবার কেবিনে এসে ঢুকলাম। ডক্টর যে বলল মা, আর গ্ৰিন ভিলা স্যোসাইটির আরও তিনজন বাবাকে এনে এখানে ভর্তি করেছে কিন্তু কই কেবিনে তো কেউ নেই। বাবাকে একা ফেলে সব গেলো কোথায়? মা ও তো নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই বাবার বেডের দিকে এগিয়ে গেলাম ধীর পায়ে। ঘুমোচ্ছে এখন। এই একরাতে বাবার শরীর যেন অনেকটা ভেঙে পড়েছে। এই সদা আনন্দময় আমার বাবাকে এরকম নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে আমার যেন চারদিক শূন্য লাগছিলো।
বোনের বিয়ের পর বাবা মা যাতে একা না থাকে তাই জন্যই ওদের কলকাতায় নিয়ে এসেছিলাম আমার কাছে। যে আমার কাছে থাকলে আমিই দেখাশুনা করব। কিন্তু আমার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটটা ওয়ানবিএইচকে বলে এখানে একটা থ্রিবিএইচকে কিনে দিয়েছি বাবা মাকে। মাঝে মাঝে আমিও চলে আসব এখানে আর বোনকেও ওর শ্বশুরবাড়ী দিল্লী থেকে এসে আর শিলিগুড়ি যেতে হবে না। এখানেই থাকতে পারবে। কিন্তু একেই বলে ডেস্টিনি, ঠিক আমি যখন মুম্বাই গেলাম তখনই বাবার এরকম হলো।
এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় বিভোর হয়ে বাবাকে যখন দেখছি তখন হঠাৎই পিছন থেকে মেয়েলী কন্ঠে কে? কে আপনি? এখানে কি চাই? শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা বছর তেইশ কি চব্বিশের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমাকে প্রশ্ন করছে। একবার দেখেই কেমন যেন মনের ভেতর অবধি নাড়া দিয়ে উঠল আমার। আমি সুপারস্টার রজতকুমার, লাখো মেয়ে মহিলা আমার ফ্যান, কিন্তু কেউ আমাকে এভাবে অভিভূত করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু এই মেয়েটার কি সম্মোহনী শক্তি কে জানে যে আমি ওর ওই চশমা পরা গভীর কালো চোখদুটোয় যেন হারিয়ে গেলাম। মেয়েটা দিদিমনি সুলভ চোখ বড় বড় করে কি যেন বলছিলো, কিন্তু একটাও কথা যে কানের ভেতর দিয়ে গিয়ে আমার মরমে ঢুকছিলো না সে বলাই বাহুল্য। আমি যেন শুধু ওর চশমার আড়ালের গভীর কালো চোখ আর ঠোঁটের নীচের কালো তিলটার অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ।
হুঁশটা আমার ফিরলো ঘরে নার্স ঢোকার পর। হয়ত ও একটু বেশীই চেঁচিয়ে ফেলেছিলো। তাই নার্স ছুটে এসেছে। নার্সটিকে আমার পরিচয়, মানে পেশেন্ট যে আমার বাবা সেটা বলতেই দেখলাম ওর মুখের ছবি যেন দ্রুত বদলে গেল। এর মধ্যে আরেক ভদ্রলোক এসে কেবিনে ঢুকলেন নিজের পরিচয় দিলেন গ্ৰিনভিলার সেক্রেটারী বলে, আর ওই মেয়েটির সাথেও পরিচয় করালেন। ওর নাম সুজাতা! সুজাতা সেন।
(চলবে)