ভালোবাসা
পায়েল ব্যানার্জি
পর্ব ১
অ্যাই দিদি! দিদি! জানিস আমাদের এই স্যোসাটির বি ব্লকে কে ফ্ল্যাট কিনেছে?
-কে? প্রধানমন্ত্রী?
-ধ্যাত তুইও না! আরে! সুপারস্টার রজত কুমার রে! রজত কুমার!
-সেটা আবার কোন হুলো!
– ধুররর!! কাকে বলছি। এ তো সিনেমাই দেখে না! ওরে দিদিরেএএএ! বই থেকে মুখ তোল। বাইরের জগৎটা দেখ। সুপারস্টার রজত কুমারকে চিনিস না! তোর তো জন্মই বৃথা রে!
-ফাজলামী কম মার। নইলে পিসিকে বলে দেবো কাল তুই পড়া কামাই করে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গেছিলিস। তাও আবার একা একা!
-এই দিদি লক্ষীটি মাকে বলিস নি, মার খেয়ে মরে যাবো।
-হাহাহাহা। পথে এসো মা! সত্যিই বাবা কি যে রসকষ পাস ওই সব সিনেমাতে যে একা একাই চলে যাস বুঝি না।
-ওহ্ মেরী নাদান দিদি! এক সিনেমা কি কিমত তুম কেয়া জানোগি সুজাতা বেবী, সুপারস্টারোও কা সর কা তাজ হোতা হ্যায় ইয়ে সিনেমা, লাখো করোরোঁ ফ্যানস জান হোতি হ্যায় ইয়ে সিনেমা।
-হুম্। বুঝলাম। এবার তুমি দুর হও। আমাকে গল্পটা পড়তে দে।
-ধুর! পড় তুই। খালি সারা দির নিজেও পড় আর বাচ্ছাগুলোকেও পড়িয়ে পড়িয়ে মাথা খা।
-পাপাই!! তুই কি যাবি? নাকি আমি পিসিকে ডাকবো? পিসিইইইইই!!!!
-উফ্ উফ্ উফ্!! যাচ্ছি যাচ্ছি। এমনিও আমার এখন অনেক কাজ। রজতকুমারের হিস্ট্রি বার করতে হবে। টাটাআ।
এই বলেই ঘর থেকে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলো পাপাই। ওরফে সমর্পিতা পাল। আমার একমাত্র পিসতুতো বোন। সিনেমা পাগলী একটা। এবছর টেনথ এর বোর্ড এক্সাম দিয়েছে।সবে এক্সাম শেষ করেছে রেজাল্ট বেরোয়নি, তাই এখনও ছুটির মুডে আছে। পড়াশোনায় খুবই ভালো। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে একটাই হবি। সিনেমা দেখা। হলিউড, বলিউড, টলিউড সব খবর ম্যাডামের কাছে পাওয়া যায়।সব কটা সিনেমা রিলিজ করলেই উনি দেখতে ছোটেন। সঙ্গী পেলে ভালো, নইলে “একলা চলো রে” নীতি নিয়ে একাই যান। বললে বলে সিনেমা দেখতে গেলে সঙ্গী লাগে না দিদি! লাগে দুটো চোখ, দুটো কান, একটা মাথা, আর একটা মন। সেগুলো থাকলেই সিনেমা দেখা, শোনা, বা বোঝা যায়। বুঝুন একবার! যেমন এখন ছুটলেন কোন সুপারস্টারের খোঁজে। হাহাহাহা।
ওই দেখুন পাপাইয়ের চক্করে আমি আমার নিজের পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। আমি সুজাতা। সুজাতা সেন। পাপাইয়ের মামাতো বড়দিদি। যদিও বর্তমানে কলকাতার নিউটাউনে পিসি রুমা পাল ও পিসেমশাই অবিনাশ পালের আশ্রয়ে বসবাস করছি ও দমদমের একটি বেসরকারী স্কুলে পড়িয়ে নিজের উপার্জনে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি।
এখন কলকাতা নিবাসী হলেও আদতে আমি পাহাড়ের বাসিন্দা। আমার বাড়ী ঘুমে। না না ঘুমের দেশে নয়! মেঘের দেশে। দার্জিলিংয়ের পার্শ্ববর্তী জনপদ হলো এই ঘুম। ওখানে আমার বাবা সমর সেন ও ছোটো ভাই সুজয় সেন থাকে। মা ৺প্রতিভা সেন ছোটো বেলাতেই আমাদের একা করে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে বাবাই আমাদের দুই ভাইবোনকে একা হাতে মানুষ করেছে। বাবার দার্জিলিং-এ হোটেলের ব্যবসা আছে। একটা ছোটো হোটেলও আছে। ভাই ছোটো, ক্লাস এইটে পড়ে। পড়াশোনার ফাঁকে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্যও করে। আগে আমিও করতাম। তারপর এম.এ পড়তে কলকাতায় চলে এলাম তখন থেকে ভাইই আমার কাজগুলো করে। এম.এ পড়তে পড়তেই এই চাকরীটা পেয়েছিলাম। এখন পড়া শেষ হয়ে গেলেও পড়ানো চলছে। তবে এবার ভাবছি দার্জিলিং-এ গেলে ওখানের স্কুলগুলোয় এপ্লাই করবো। যাতে বাড়ী থেকেই চাকরীও করতে পারি আর বাবাকেও সাহায্য করতে পারি।
* * ২ * *
-সব খবর পেয়ে গেছি! বলেই এসে পাপাই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
-কার? কি খবর?
-আরে ওই আমাদের নতুন প্রতিবেশী, রজতকুমারের।
-হায় ভগবান! সারাদিন তুই এইসব করেই কাটালি? আর পড়াশোনা? এলেভেনে তুই নাকি সাইন্স নিয়ে পড়বি! তার পর তুই বলেছিস মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়বি, তা সারাদিন এরকম সিনেমাস্টার দের পেছনে ঘুরলে পড়বি কখন?
-পড়ব পড়ব। সব পড়ব। এখন শোন না, কি খবর পেলাম। রজতকুমার আমাদের বি ব্লকে ফ্ল্যাট কিনেছে ঠিকই তবে নিজে এখানে থাকবে না। লোকটার আসলে বাড়ী তোদের ওদিকেই। শিলিগুড়িতে। ওখানে বাবা মা আছে, বোন ছিলো, বিয়ে হয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাটটা কিনেছে বাবা মায়ের জন্য। ওনারা মাঝে মাঝে এসে এখানে থাকবেন। রজতকুমারের নিজের ফ্ল্যাট আছে টালিগঞ্জের কাছে। ও ওখানেই থাকবে। এখানে আসবে বা থাকবে কিনা কেউ জানে না!
-বাব্বা লোকটার ঠিকুজি কুষ্ঠি বার করে এনেছিস তো যে! তা কার থেকে পেলি এত খবর?
-বি ব্লকের সিকিউরিটি গার্ডটার থেকে।
-বাহ! খুবই ভালো। যাই হোক।প্যাকিং করবি কি? যাবি কি কাল আমার সাথে ঘুমে?
-হ্যাঁ যাবো তো!
-তবে সব তাড়াতাড়ী গুছিয়ে নে। আমার কিন্তু অল ডান।
-ওক্কে মাই স্যুইট দিদি।
-থাক থাক! আর ঢং করতে হবে না। যা যা। কাজ কর।
পাপাইও আমার ধমক খেয়ে কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে কোনো ফিল্মি গান গুণগুণ করতে করতে প্যাকিং করতে লেগে গেলো।
ওহ্! হ্যাঁ বলাই হয়নি কাল আমরা এক সপ্তাহের জন্য ঘুম যাচ্ছি। আসলে স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেছে, রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে, এবার নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে এক সপ্তাহ বাড়ী থেকে ঘুরে আসবো। তারপর আবার সেই গরমের ছুটির আগে যেতে পারবো না। তাই চললুম বাড়ী। অন্যান্য বার একাই যাই।কিন্তু এবার পাপাইটা জেদ ধরেছে যাবে। তাই ওটিকেও ট্যাঁকে করে নিয়ে যেতে হবে। ওরও গত দুবছর ধরে সেরকম কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি, তাই আমিও আর আপত্তি করি নি। পিসি পিসেমশাইও যাবে আমাদের সঙ্গে।
* * ৩ * *
ট্যাক্সি থেকে নেমে সবে পিসেমশাইয়ের সাথে লাগেজ গুলো নামাচ্ছি, এখনও ভাড়া দেওয়া বাকি এমন সময় কমপ্লেক্সের গার্ডেনের দিক থেকে হইহই শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। পিসি আর পাপাই আগেই ওপরে উঠে গেছে। আমি আর পিসেমশাই-ই আছি এখানে। শব্দ শুনে আমি আর পিসেমশাই দৌড়ে গেলাম যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে সেদিকে।
গার্ডেনের একটা জায়গা ঘিরে আমাদের কমপ্লেক্সেরই কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে ঢুকে দেখি একজন বৃদ্ধ মানুষ একটি বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, আর দরদর করে ঘামছেন। বুকের ওপর তার একটা হাত ফেলা। কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করতে বি ব্লকের সাঁই কাকু বলে বলে উঠলেন, ভদ্রলোক সম্প্রতি এসেছেন আমাদের কমপ্লেক্সে। আমরা যখন ঘুম-এ ছিলাম তখন। উনি আর ওনার স্ত্রী থাকেন। সকালে উঠে স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটতে ও বাজার করতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে এই গার্ডেনে বসে ছিলেন খানিকক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আচমকাই পড়ে যান, আর তারপরই জ্ঞান হারান।
আমরা যখন এসব কথা বলছি একজন মহিলা প্রায় দৌড়তে দৌড়তে এলেন ওখানে। মনে হয় ভদ্রলোকের স্ত্রী। উনি এসেই কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। সবাই মিলে ওনাকে শান্ত করতে উনি বললেন ভদ্রলোক হাইপ্রেশারের রুগী। তবে মাঝে মাঝেই ওষুধ খেতে ভুলে যান। শুনে আমদের সন্দেহ হলো নির্ঘাৎ স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক করেছে ভদ্রলোকের। আর অপেক্ষা করি নি, পিসেমশাই-ই বললো যে আমাদের যে ট্যাক্সিটা এখনও কমপ্লেক্সে দাঁড়িয়ে আছে ওতে করেই ওনাকে হসপিটাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হোক। সবাই এতে সম্মতি জানাতে ভদ্রমহিলা বললেন উনিও যাবেন। ওনার ছেলেও কলকাতাতেই থাকে তবে কাজের জন্য এখন মুম্বাইতে গেছে, আর কেউ নেই এখানে ওনাদের পরিচিত, তাই উনিও যাবেন। অগত্যা ওই ট্যাক্সিতেই ওই ভদ্রমহিলা আর আমি, ভদ্রলোককে নিয়ে পেছনের সীটে উঠে বসলাম, পিসেমশাই আমাদের লাগেজ গুলো আমাদের ব্লকের সিকিউরিটির হাতে দিয়ে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌছে দিতে বলে এসে ট্যাক্সিতে উঠলো। নিয়ে চললাম ওনাকে নার্সিংহোমে।
(চলবে)
[শুরু হলো নতুন ধারাবাহিক “ভালোবাসা” । দুই ভিন্ন জগতের মানুষের ভালোবাসার গল্প। লকডাউনের এই কষ্টকর সময়ে একটু ভালোবাসার হাওয়া ছড়িয়ে দিতে এই প্রচেষ্টা।
এই প্রচেষ্টা আপনাদের কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না যেন। সাবধানে থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরুবেন না। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই দুঃসময়ও ঠিক কাটিয়ে উঠবো।]