দিয়া(শেষ পর্ব)

0
1031

#দিয়া(শেষ পর্ব)
© প্রিয়াংকা শী
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দিয়া দেখে অর্নব বেড টি করে নিয়ে এসেছে।গতরাতের কথা ভেবে দিয়া মনে মনে একটু লজ্জা পায়।কিন্তু নিজের থেকেও বেশী অর্নবের মুখের খুশী দেখতে পেয়ে দিয়া যেন আরো শান্তি পায়,হয়তো এই শান্তিটা পাওয়ার জন্যই,হয়তো অর্নবের মুখের এই খুশীর হাসিটা দেখার জন্যই দিয়া এত পাগলামী করে।আনমনা দিয়া আবার নিজেকে প্রশ্ন করে,যখন আমরা নিজের থেকে বেশী অন্যের সুখ দুঃখের পরোয়া করি,কারোর মুখের একচিলতে হাসি দেখার জন্য মনে হয় সব করতে পারি,তখন তাকেই ভালোবাসা বলে না?দিয়া অর্নবের দিকে অপলক তাকিয়েই থাকে।অর্নব সাইডটেবিলে বেড টি টা রেখে দিয়ার কাছে ঘেঁষে বসে দিয়ার কপালে একটা চুমু খায়।দিয়া যেন সেই সুখের সাগরে ভাসছিল তখন।মনে মনে শুধু একটা কথাই ভাবতে থাকে দিয়া,অর্নবের কী কিছু বলার আছে তাকে? কিন্তু দিয়ার তো অনেককিছু শোনার আছে অর্নবের কাছ থেকে।তাহলে অর্নব কিছু বলছে না কেন? কিন্তু তাসত্ত্বেও দিয়ার ভীষন ভালো লাগছিল সেই মুহুর্তটাকে,মনে হচ্ছিল।কিছু অনুভূতি ভাষায় বোঝানো সম্ভব হয় না, কিন্তু মুখে কিছু না বলেও কত সুন্দর হয় সেই মুহুর্তগুলো!অর্নব দিয়ার কোলে মাথা রেখে বলে, জানো দিয়া বাবা যখন মারা গেল সবে এইচ.এস দিয়েছি তখন। ইন্জিনিয়ারিং এ চান্স পেলাম, কোনোরকমে কিছুটা লোন নিয়ে,কিছুটা মায়ের গয়না বিক্রি করে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম,মা সবসময় বলতো,যত কষ্টই হোক কারোর কাছে হাত পাতবো না,কারোর সাহায্য নিলে যে আজবাদে কাল মাথাটা তার কাছে নোয়াতে হবেই,তাই আমরা কারোর সাহায়্য নিইনি কখনও, কিন্তু সংসার ভীষন কষ্টেই চলতো,রিন্টু তখনও ছোটো, স্কুলে পড়ে।জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল,কীভাবে সমস্ত সমস্যার সমাধান করবো,কিন্তু এই কর্ত্তব্য আর দায়িত্বের হিসেব মেলানোর চেষ্টায় কখন আর কীভাবে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম,ভুলেই গেলাম আমারও তো একটা জীবন ছিল,আমিও তো একলা ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালোবাসতাম,আমিও তো জীবনটাকে বাঁচতে ভালোবাসতাম প্রানভরে, কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সব বুঝতেই পারলাম না,আস্তে আস্তে যখন নিজের সমস্ত দায়িত্বগুলো পূরণ করতে থাকি।তখন কিছুটা শান্তি পাচ্ছিলাম,মনে হচ্ছিল যাক একটা কাজ তো হল, কিন্তু জীবনটা ততদিনে বড্ড মেকি আর একঘেয়ে হয়ে গেছে,বুঝতেই পারিনি যে জীবনটা বাঁচছি,যে হাসিটা হাসছি তা যে বড্ড নকল আর সাজানো,তারপর তুমি এলে আমার জীবনে,মা বললো বিয়ে কর,তোর সংসার দেখে আমি মরেও শান্তি পাই।আমি তখনও না বলতে পারলাম না।মায়ের লিউকোমিয়া ধরা পরে গেছে ততদিনে,মৃত্যুপথযাত্রী মাকে কিভাবে না বলতাম! কিন্তু জানো আমি বিয়ের জন্য একদম রাজি ছিলাম না।বিয়েতে হ্যাঁ বলাটাও ছিল,মাকে দেওয়া কথা রাখা।দিয়া এতক্ষনে কথা বলে ওঠে,”সেটাও কর্ত্তব্য ছিল তাইতো?”
“হ্যাঁ,বলতে পারো অনেকটা সেরকম”
“আর যখন আমায় দেখতে গেছিলে প্রথমদিন,তখন কী ভেবেছিলে? নিশ্চয়ই একদম পছন্দ হয়নি,খুব খারাপ কিছু ভেবেছিলে,আ্যাম ড্যাম সিওর আ্যাবাউট দ্যাট”
অর্নব হাসতে থাকে,”খানিকটা‍ তাই।টিভিতে একটা সিরিয়াস নিউজ চলছিল সেসময়,সবাই সেসময় তা নিয়েই আলোচনা করছিল।কিন্তু তোমার কোনো মনই ছিল না ওদিকে।এমনকি আমি যে পাত্র হয়ে দেখতে গেছি,সে ব্যাপারেও খুব একটা বিশেষ ভ্রুক্ষেপ ছিল না তোমার,তুমি আমার সাথে একটা কথাও বলোনি।”
“তুমিও তো বলোনি”
“আমি তো ভাবছিলাম কী বলবো!এমনিতে তো বিয়েতে রাজি ছিলাম না,তারপর তোমায় দেখে মনে হল,খুব ননসেন্স একটা মেয়ে দেশের পলিটিক্স,ইকোনমিক্স কোনো কিছুতেই ইন্টারেস্ট নেই,নিশ্চয় ভীষন ইমম্যাচিওর,টিভির খবরে কোনো ইন্টারেস্ট নিল না,আনমনা হয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে,তার কিছুক্ষনের মধ্যেই তুমি মাকে জিজ্ঞেস করলে তুমি একটু ভেতরে যাবে কিনা? ততক্ষণে আমাদের বাড়ির সবার মনে এই ভাবনা শুরু হয়ে গেছে,এই মেয়ের নিশ্চয় কোনো লাভার আছে,নাহলে কেন এত মন উরু উরু..ঝিমলিদি তো আমার কানে কানে বলেই দিলো,বুঝলি টুবাই এই মেয়ের কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়!আমি মনে মনে ভাবলাম,ভালোই হয়েছে মেয়েটা দেখতে এত সুন্দর হলে হবে কী ভীষন ছেলেমানুষ আর ইমম্যাচিওর।কিন্তু তোমার ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমারও একটু টয়লেট যাওয়ার দরকার পড়ে,তোমাদের ওয়াশরুমে যাওয়ার সময়েই আড়চোখে তোমাদের ব্যালকনিটা চোখে পড়ে,তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে নিজের পোষা খরগোশগুলোর সাথে গল্প করছিলে,সম্ভবতঃ ওদেরকে ইংলিশ বলা শেখাচ্ছিলে না?”
দিয়া এবার হি হি করে হাসতে থাকে,হ্যাঁ মাঝেমাঝে তো ওদেরকে আমি চাইনিজ, জাপানিজ বলাও শেখাইগো, কিন্তু ব্যাটাগুলো এমন অবাধ্য বাংলা ছাড়া কিছু বলতেই চায় না,আমায় চোখ রাঙিয়ে বলে কিনা তোমরা বাঙালি হয়েও মাতৃভাষার অপমান করতে পারো সারাক্ষন গড়গড় করে ইংরেজি বলে, কিন্তু আমরা ওসব পারবো না বাপু,তো আমিও খুব রেগে গিয়ে বললাম,বলিস কীরে হতভাগা!ইংরেজি তো আমাদের কাজের ভাষা,তাইতো এত ইংরেজিতে সবসবময় গড়গড় করতে হয়, কিন্তু তাও ওরা কথা শুনবে না জানো,বলে না..না..আমরা কিছুতেই শুনবো না,আমরা আমাদের মাতৃভাষার বিরোধিতা করতে পারবো না,তাই অগত্যা আমি আমার পোষা টিয়াটাকে ইংরেজি শেখাতে যাই,ও আবার কী বললো জানো?
অর্নবের খুব মজা লাগছিল দিয়ার কথা শুনে,”কী বললো?”
বললো,”ওদের নাকি আবার মাতৃভাষার প্রতিও টান নেই, পুরোহিত ঠাকুর পুজো করতে এসে যে সংস্কৃত মন্ত্র আওড়ায়।ওদের নাকি আবার সেসবের প্রতি ভীষন টান,আমায় মুখস্থ করে দেখালোও জানো,কীরকম গড়গড় করে দু চারটে সংস্কৃত মন্ত্র আওড়ে গেল।আমি ভাবলাম বোঝো ঠেলা।এবার আমি কোথায় তাহলে আমার জ্ঞানের বোঝা খালি করবো,তাই ঠাম্মাকে ইংরেজি শেখাতে গেছিলাম, কিন্তু ঠাম্মা কী করলো জানো?
অর্নব আবার জিজ্ঞেস করলো,”কী করল?”
“ঠাম্মি কে বললাম,ঠাম্মি হাই,হাউ আর ইউ
ঠাম্মি বললো,কী?মিউমিউ? হ্যাঁ বিড়াল ডাকে মিউমিউ
আমি বললাম,উফ্!ঠাম্মি তুমি যে কিনা!
ঠাম্মি আবার কী বুঝলো জানিনা!
আমায় জিজ্ঞেস করলো,হ্যাঁরে পাত্র কেমন?মানে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো,তো আমি বললাম, পু….রোওওও হ্যান্ড-সাআআআআম
ঠাম্মি কী বললো জানো,অর্নব এবার হাসতে হাসতে বললো,কী বললো?
দিয়া একটু ভয়ে কাচুমাচু মুখ করে বললো,ঠাম্মি একটু জোরে চেঁচিয়ে বললো,কীইইইইই?বুড়ো?..বুড়োওওওওওও ভাম”অর্নব এবার আর নিজের হাসিটা চেপে ধরে রাখতে পারছিল না,মনে হচ্ছিল হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে যাবে,দিয়া সেসময়ে বলে উঠলো,আসলে কী বলোতো,ঠাম্মি না ‘পুরো’কে বুড়ো শুনেছে আর হ্যান্ড শুনতেই পায়নি,সামকে ভাম শুনেছে.. ঠাম্মি না যা বলা হয় তার প্রথমের দিকটা শুনতে পায় আবার পরের দিকটা শুনতে পায়না।আবার কখনও মাঝেরটা শুনতে পায় আবার পরেরটা শুনতে পায় না,আবার যেগুলো শুনতে পায় আমরা ভাবি,সেগুলোও যে আবার ঠিক কী শুনতে পায়,তার আবার ঠিক কেউ বুঝতে পারে না।তাইজন্য জানোতো আমি আর কাউকে ইংরেজি শেখাতে যাই না।অর্নবের হাসি তখনো থামছিল না দিয়ার বকবকানি শুনে।দিয়া থামলে অর্নব আবার বলতে শুরু করে,জানো দিয়া মা চলে যাওয়ার পর ভাবিইনি কখনো জীবনটা আবার বদলাবে,তুমি আমার জীবনটা সত্যিই বদলে দিলে জানো,সেদিন যখন দেখলাম তুমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খরগোশগুলোর সাথে গল্প করছো,তখন মনে হলো কী জানি জীবনকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখি,কিছু ভুল নাওতো হতে পারে!হয়তো সেদিন সেই মুহুর্তে তোমায় দেখে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিল আমার।দিয়া আবার ভীষন এক্সাইটেড হয়ে বলে উঠলো,”মানে!তুমি সেসময় আমায় দেখে আমার প্রেমে পরে গেছিলে তাইতো?কীগো বলো তাইতো!”
অর্নব এবার একটু মৃদুস্বরে উত্তর দিলো, হুঁ,মনে মনে ভাবলো কীজানি আবার কী মনে মনে ভাবছে এই পাগলি!ঠিক সেইসময় আবার দিয়া বলে উঠলো পুরো ড্রামাকুইনদের বলার কায়দায়”ইস্!আমি যদি জানতাম গো!”
“কী জানতে?”
“এই যে তুমি খরগোশের সাথে কথাবলা দেখে আমার প্রেমে পরে গেছো।তাহলে তো আমি বাগানের কাঠবিড়ালিগুলোর সাথে যে কথাগুলো বলি, সেগুলোও শোনাতাম তোমায়।জানো ওদের সাথে কী কথা বলি?”
অর্নব জিজ্ঞেস করলো,”কী বলো?”
“ওদের সাথে আমি বলিউড মুভি নিয়ে কথা বলি”
অর্নব আবার অবাক হয়ে যায়,”বলিউড মুভি?”
“হ্যাঁ,বলিউড মুভি মানে মোস্টলি ভিলেনদের ডায়লগ,যেমন,আমি বলি,কিতনে আদমি থে?
ওরা বলে,মোঘাম্বো খুশ হুয়া
আমি বলি আউ ললিতা
ওরা বলে,খামোশ
আমি বলি,ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর
ওরা বলে,মেরে করন অর্জুন আয়েঙ্গে
আমি বলি,আজ খুশ তো বহত হোগে তুম
ওরা বলে,মেরে পাস বাঙ্গলা হে,গাড়ি হে,নকর হে,চাকর হে,তুমহারে পাস ক্যা হে!
আমি খুব গর্ব করে বলি,মেরে পাস ঠাম্মি হে
ব্যস!যেই না বলা,ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়,কেন জানো?
অর্নব পেটে গুড়গুড় করা হাসিটাকে চেপে রেখে জিগ্গেস করে,কেন?কেন?
দিয়া এবার যাহ্:বুঝতেই পারলে না,এত সহজ ব্যাপারটা,এরকম ভাব করে বলে ওঠে,কারন ঠাম্মির ইংরেজিকে ওরাও ভীষন ভয় পায়।দিয়ার চোখ মেরে বলার কায়দায় অর্নবের এত হাসি‌ পায়, সে হাসি থামতেই চায় না।
রবিবার দুপুরবেলা অর্নবের ছুটির দিন।অর্নবের ইচ্ছে ছিল দিয়াকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে।কিন্তু দিয়া আগে থাকতেই জানিয়ে রেখেছিল,কোথায় যাওয়া হবে,সেটা আগে থাকতেই দিয়া ঠিক করে রেখেছে।দিয়া অর্নবকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেসব কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিয়া অর্নবকে নিজের স্কুটিতে বসিয়ে ছুটতে থাকে, কিন্তু দিয়া কোথায় নিয়ে যাচ্ছে,সেসব সাসপেন্স রিভিল হোওয়ার আগেই দিয়া অর্নবকে নিয়ে হাজির হয় হাতিবাগানের পাখির বাজারে।অর্নব খুব অবাক হয়ে যায়,”কীগো এখানে এলাম কেন?এখানে কী করবে তুমি?পাখি কিনবে?”
দিয়া একটু জ্ঞানী জ্ঞানী অভিব্যক্তি মুখে ফুটিয়ে বলল,”হ্যাঁ,তাতো কিনবোই, কিন্তু”
“কিন্তু কী করবে?”সাসপেন্সে আবার অর্নবের চোখগুলো গোল গোল হয়ে যায়,দিয়ার যা মাথা খারাপ বলা‌ যায় না কী করবে!”
দিয়া দুটো পাখির খাঁচা কিনে ফেললো পাখির বাজার থেকে।অর্নব অবাক হয়ে বললো,এত পাখি নিয়ে কী করবে দিয়া?
দিয়া একটু খিলখিল করে হেসে বললো,খেলবো..
অর্নব আবার অবাক হয়ে যায়,মনে মনে ভাবে,নিশ্চয় ওদেরকেও আবার জাপানিজ, চাইনিজ,ইংলিশ বলা শেখাবে, কিন্তু মুখে আর কিছু বলে না অর্নব। চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে দিয়ার পাগলামি দেখতে থাকে।আজকাল যে দিয়ার সমস্ত পাগলামিই বড্ড ভালো লাগতে শুরু করেছে অর্নবের। কিন্তু অর্নবের বেশী কিছু ভাবার আগেই দিয়া এবার অর্নবের হাতটা ধরে বলে,”এই যত পাখি আছে এই খাঁচাগুলোতে,খাঁচা খুলে সবাইকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দাও,”অর্নব খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দিয়ার দিকে,এত টাকা দিয়ে এই পাখিগুলো কিনলে,এখন সবাইকে উড়িয়ে দিতে বলছো?”
“হ্যাঁ,বলছি,কেনো জানো?কারন আমরা মানুষরাও যে বড্ড বন্দী গো নিজের জীবনে,প্রত্যেকদিন আমরা আমাদের জীবনের রোজকার কত টেনশন ফ্রাস্টেশনের কাছে হেরে গিয়ে একটা বন্দী জীবন কাটাই,এই যে তুমি রোজ অফিস থেকে ফেরো একটা করে কাজের চিন্তা মাথায় নিয়ে।দিয়া প্রোমোশন না পেলে কি হবে!দিয়া অফিসে কাজের ভীষন চাপ,একটার পর একটা কাজের ডেডলাইন চলছে,বাবা মারা যাওয়ার পর তুমি সেই যে অত খারাপ পরিস্থিতি দেখেছিলে,তারপর থেকে তোমার মনে ভয় ঢুকে গেছে যদি আবার সেই খারাপ পরিস্থিতিতে তোমায় বাঁচতে হয়,তাই এত দমবন্ধ হয়ে বাঁচছো তুমি,ছেড়ে দাও,সব চিন্তা মন থেকে ছেড়ে দাও!”
অর্নবের আবারও ঘোর লেগে যাচ্ছিল দিয়ার কথা শুনে,মুখে কিছু না বলতেই দিয়া কি করে এতকিছু বুঝে যায়!দিয়া এবার অর্নবের হাত দিয়ে সবকটা পাখির খাঁচা খুলে ওদেরকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়।অর্নব অবাক হয়ে দেখছিল পাখিগুলো কেমন মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।সত্যিই তো ওদের জীবন,ওদের মুক্তির স্বাদ তো আকাশে‌ আর কার না ইচ্ছে করে জীবনে সব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে।সেসময় দিয়া বলে ওঠে,এই যে পাখিগুলোকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দিলে,জানো কীহল এতে?অর্নব আবার মাথা নাড়িয়ে বললো,না সেতো জানেনা কী হয়েছে!দিয়া বললো,ঠিক এইভাবে তুমি তোমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট চিন্তাকে মুক্তি দিয়ে দিলে,ঠিক যেভাবে ওই পাখিগুলো মুক্ত আকাশে মুক্তি পেয়ে গেল,আর স্বাধীনতা কার না ভালো লাগে বলো,অর্নব অপলক দৃষ্টি তে দিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে,অর্নবের শুধু একটা কথাই মনে হতে থাকে,ভালোবাসার অপর নাম বোধহয় দিয়া..

আরেকদিন দুপুরবেলা।দিয়া বেড়াতে গেছে মামীশাশুড়ির বাড়িতে। কিন্তু ওদেরবাড়ির সবার একটা বদ অভ্যাস হলো, দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া সারার পর একটা ভাতঘুম দেওয়া,যেটা আবার দিয়ার মোটে পছন্দ নয়।অর্নবের অবশ্য নির্জন দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে একটু ঝিমুনি লাগছিল। কিন্তু দিয়া অর্নবের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ওকে ঘুম থেকে তুলে বললো,চলো এক্ষুনি।অর্নব সদ্য কাঁচা ঘুম থেকে উঠে দিয়ার কথা শুনে বললো,কোথায় যাবো? কিন্তু দিয়ার মুখ দেখে অর্নবের বুঝতে বাকি রইল না দিয়ার মাথায় নিশ্চয় আবার কোনো দুষ্টুমি বুদ্ধি ঘুরছে, কিন্তু দিয়াকে থামাবে এহেন সাধ্য কার!অর্নব তবু কোনোমতে একটু বোঝানোর চেষ্টা করলো দিয়াকে,দিয়া প্লিজ..এখানে এসব কিছু করতে যেও না,এরা কিন্তু ভীষন সিরিয়াস,কেউ তোমার পাগলামি বুঝবে না।দিয়া এবার একটু কপটরাগ করে বললো, পাগলামি?কে বললো আমি পাগলামি করছি?তাহলে কী করছো দিয়া?দিয়া আবার একটু ওভারস্মার্ট এর আ্যাটিটিউড নিয়ে দেখালো,ওই এতদিন যেটা করে এসেছি,সেটাই করছি,তোমায় জীবন কীভাবে বাঁচতে হয়,সেটা শেখাচ্ছি।অর্নব আবার মাথায় হাত দিয়ে বললো,ওরে বাবা!তাহলে তো খুব মুশকিল!এখানে আবার কী কান্ড বাঁধিয়ে বসবে,বুঝতে পারছিনা,আর তাছাড়া সেসব তো তুমি আমায় অনেক শিখিয়েছো,আবার কী দরকার দিয়া!দিয়া তবু নাছোড়বান্দা,আরে বাবা!এটা লাস্ট লেসন,এটা হয়ে গেলেই সিলেবাস কম্প্লিট,তারপরই আমি রেজাল্ট ডিক্লেয়ার করে দেব,”তুমি ফেল করলে না পাস?”অর্নব বুঝতে পারলো এই পাগলির হাত থেকে রেহাই পাওয়া তো এত সহজ ব্যাপার নয়,তাই ওর হাতে নিজেকে সারেন্ডার করে দিয়ে বললো,বলো কি করবে?দিয়া মুখে আর কিছু বললো না,শুধু বড় বড় দুটো চোখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে খিলখিল করে হাসলো।অর্নবের আর বুঝতে বাকি রইল না দিয়া নিশ্চয় কিছু একটা গন্ডগোল পাকাতে চলেছে।দিয়া অর্নবের হাত ধরে চুপিচুপি ছাদে নিয়ে এলো।সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে তখন।অর্নব ফিসফিস করে বললো,এখানে কী করবে দিয়া?দিয়া মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললো, সকালবেলা দেখেছিলাম,এখানে দিদান আচার শুকোতে দিয়েছিল।অর্নব এবার খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো দিয়ার দিকে,”তো?”
“তো কিছুই না,ওই আচারটা আমরা এবার চুরি করে খাবো”দিয়ার প্রত্যেকটা পাগলামীর মত এবারো অর্নবের ভীষন হাসি পেলো দিয়ার কান্ডকারখানা দেখে,প্রত্যেকবারের মত এবারও একটা অদ্ভুত ম্যাজিক কাজ করছিল।দিয়া অর্নবকে লুকিয়ে লুকিয়ে আচার চুরি করা খেতে শেখালো, শুধু আচার নয় দিদানের তৈরী আমসত্ব খেল ওরা চুরি করে
অর্নবের যে খুব আচার খেতে ভালোলাগে তা নয়, কিন্তু দিয়ার কোনো পাগলামিতে ওর আর বাধা দিতে ইচ্ছে করছিল না,আচ্ছা দিয়া এভাবে লোকের বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে খাওয়া উচিত?
“আরে দূর বাবা!লোকের বাড়ি কোথায়!এতো তোমার নিজের মামারবাড়ী আর শোনো ছোটোবেলায় কী তুমি কখনও বাড়ির কোনো খাবার চুরি করে খাওনি বলো?”
অর্নব একটু ভেবে বললো,”হ্যাঁ, খেয়েছি।একবার তো এইকারনে মায়ের কাছে বেধারক পিটুনিও খেতে হয়েছিল

দিয়া এবার চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,তো?কী মনে হল?মনে হল কিছুক্ষনের জন্য ছোটোবেলায় ফিরে গেছি
অর্নব এর উত্তর পাওয়ার আগেই দিয়া আবার বলতে শুরু করলো,আমি তো জানো,আমসত্ত্ব,আচার, তেঁতুল,গুঁড়োদুধ কতকিছু চুরি করে খেয়েছি।
অর্নব এবারে সত্যিই খুব জোরে জোরে হাসতে থাকে,তুমি সত্যিই আর বড় হলে না দিয়া।দিয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ণবের দিকে,”তুমি জানো তোমার এই হাসিটা ফিরিয়ে আনার জন্য আমি কত কান্ড করেছি,এই হাসিটাকে কোনোদিন হারিয়ে যেতে দিও না অর্নব,এটাই তুমি,এটাই হল সত্যিকারের আসল তুমি।অর্নব দিয়াকে কাছে টেনে ওর দুচোখে চুমু খায়,তারপর জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা তুমি যে বললে এটা লাস্ট লেসন।তাহলে আমার টেস্ট নেবে তো এবার?
“ওসব তো আমার সিলেবাস কম্প্লিট করতে করতেই নেওয়া হয়ে গেছে”
“তাহলে বলো পাস না ফেল?”
“দিয়া খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিলো,যদি যা যা শেখানো হল তোমায়, সেগুলো কোনোদিনও তুমি নিজে থেকে ট্রাই না করো,তাহলে তুমি ফেল,আর যদি এইসব কান্ড কিছু সময় অন্তর অন্তর তুমি আমার সাথে রিপিট করতে থাকো,তাহলে তুমি পাস”
অর্নব দিয়াকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলে,তুমি আমার কাছে থাকলে আমি যে এই পাগলামিগুলো চেয়েও ভুলতে পারবো না দিয়া।দূরে আকাশে তখন ভেসে যাচ্ছে..আজ হাওয়া বেপরোয়া দিল সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই বিকেল আর বেলফুল হৃদমাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন‌ লাগলো লাগলো নীল দিগন্তে
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগলো,বসন্তে …..
কিছু স্বপ্ন কিছু মেঘলা
কিছু বই টই ধূলোলাগা
কিছু ইচ্ছে ধরা দিচ্ছে
এই বসন্ত রাতজাগা
ভালো লাগলে গল্পের নাম ও লেখিকার নামসহ শেয়ার করতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here