#ক্যানভাস
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৭)
ইরা মেঘের পাশে বসতেই মেঘ ইরাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে। মেঘ সচরাচর কাঁদে না। হুটহাট মেঘের এমন কান্না কেমন যেন সন্দেহজনক লাগল ইরার কাছে। ইরা জানে মেঘের ভেতরে কিছু না কিছু চলছে। তাই মেঘ এইভাবে চোখের জলে সব ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। ইরা ধীরেধীরে মেঘের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করে। মেঘ নিজে থেকেই মুখ খুলে। কারণ ইরা-ই একমাত্র ব্যক্তি যে মেঘকে খুব বুঝে। মেঘের প্রতিটা সুখ দুঃখের সাক্ষী ইরা। সুখের দিন আর দুঃখের দিনের একমাত্র ছায়া সঙ্গী এই ইরা। বলা না বলা সব কথা-ই ইরার জানা। ইরার কাছে সব শেয়ার করলে মনের ভেতরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি পায় মেঘ। তাই ইরার কিছু জানার জন্য মেঘকে কোনো প্রকার প্রশ্ন করার প্রয়োজন হয় না। ইরা খুব ভালো করেই জানে মেঘ নিজে থেকেই সব বলবে। তাই ইরাও মেঘের মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে। ইরাকে জড়িয়ে ধরেই মেঘ বলল,
_ইরা বল না বোন, অতীতের সামান্য একটা ব্যাপার এখন কেন বর্তমানে এসে আঘাত করছে?
_সামান্য হলেও অতীতটা অতীত-ই থাকে মেঘ। তবে তোর এই অতীতটা তেমন ভয়ংকর না আবার তেমন সুখেরও না। মানুষ চাইলে সবই করতে পারে। আমি জানি তুই আবিরের ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছিস। দেখ আবিরকে এইভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে না। আবির তো পুরোপুরি নাগালের বাইরে। কীভাবে খুঁজে বের করবো আমরা?
_আবির আমার নাম্বার পেল কোথায় সেটাই খুব ভাবাচ্ছে?
_দেখ তোর নাম্বারটা আমাদের চেনা পরিচিত সবার কাছেই আছে। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে আমাদের মাঝের কেউ তোর ক্ষতি করতে চাইছে। যে তোকে আর আবিরকেও চিনে। এমনকি সব ঘটনার সাক্ষীও।
_আমার চেনা পরিচিত সবাই তো ঢাকায়। গ্রামের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। এমনকি সব বন্ধুদের সাথেও আজকাল যোগাযোগ হয় না। তাহলে আবির কীভাবে এতদূর পৌঁছালো?
_সবটা আমরা তখনই জানবো যখন আবির আমাদের সামনে আসবে। আবির তো গা ঢাকা দিয়ে আছে। তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস। আবির কিছুই করতে পারবে না।
_খুব ভয় হচ্ছে ইরা।
_একদমই ভয় পাবি না। তুই তো কোনো অন্যায় করিসনি তাহলে ভয় কেন পাবি?
_আমার ভয়টা তো শ্রাবণকে নিয়ে।
_ভয়টা দূর করে নে।
_কীভাবে?
_কথা বল ভাইয়ার সাথে। আমি নিচে আছি। চাচ্চু ডেকোরেটরকে ডাকিয়েছে।
৪২!!
ইরা মেঘকে রুমে রেখে নিচে চলে আসে। মেঘ ভয়ে ভয়ে শ্রাবণকে ফোন করতে যায়। মোবাইলটা হাতে নিতেই টুং করে ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল। মেঘ ম্যাসেজটা সিন করে দেখে অপরিচিত নাম্বার থেকে আজকেও আরেকটা ম্যাসেজ। মেঘ ম্যাসেজটা পড়তে শুরু করে।
_বিয়ে করতে যাচ্ছো শ্রাবণ মাহমুদকে। বিয়ে করো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সব কথা শ্রাবণ জানে তো? আই মিন তোমার আর আমার ব্যাপারে সব। না জানলে এখনি সব জানাও। পরে যেন তোমাকে এর জন্য আফসোস না করতে হয়। এক কাজ করি, তোমার কাজটা আমিই সহজ করে দেই। তোমার হয়ে সব কথা শ্রাবণকে আমিই বলছি। এতে শ্রাবণ খুব সহজেই তোমাকে ভুল বুঝবে। তাহলে তো আর তোমাদের বিয়েটাও হবে না। আগের নাম্বারটা চেঞ্জ করেছি আর এখন এইটাও করবো। মনে রেখো আমি তোমার অতীত, তোমার খুব কাছেই আমার চলাফেরা। তুমি চাইলেও আমাকে ছুঁতে পারবে না।
মেঘ ম্যাসেজটা দেখে আর সাহস পায় না শ্রাবণকে কল করার। আবিরের এমন এমন কাণ্ডকারখানাতে মেঘ ভীষণ প্যারাময় সময় পার করছে। কী করবে কিছুই ভেবে না পেয়ে ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। ইরাকে সামির রুমে যেতে বলে নিজেও সামির রুমে যায়। তিনজনে মিলে ম্যাসেজটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। সামি ফোন বের করে পুলিশকে আবিরের দু’টো নাম্বার দিয়ে দেয়। আর এই নাম্বার গুলোর লোকেশন জানতে চায়। সামির চাচ্চু পুলিশ অফিসার তাই তিনি বলে দেন এই ব্যাপারটা তিনিই হ্যান্ডেল করবেন। তবে এই ক’দিন মেঘকে পাক্কা সিকিউরিটি দিয়ে রাখা হবে। যাতে আবির কোনোভাবে মেঘের কাছাকাছি আসতে না পারে।
তিনজনে মিলে সব সমস্যার সমাধান করলেও শ্রাবণকে নিয়ে একটা চিন্তা মেঘের ভেতরে রয়েই যাই। শ্রাবণকে হারানোর ভয়টা মেঘকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। ইরা আর সামি মিলে মেঘকে যথেষ্ট প্রটেক্ট করার চেষ্টা করছে। মেঘের চিন্তাভাবনা আর ইরা সামির চিন্তাভাবনা সবই এখন শ্রাবণকে নিয়ে। মেঘ ওদের দুজনকে বলল,
_আমাকে আগলে রাখলি ঠিক আছে কিন্তু শ্রাবণের ব্যাপারটা কী হবে? আবির তো শ্রাবণ অবধি যেকোনো সময় পৌঁছে যাবে। আর একবার শ্রাবণকে কাছে পেলে জানি না কী বলবে।
মেঘের এমন ভয় ভয় কথা শুনে সামি মুচকি হাসলো। তারপর বলল,
_তোমার কাছে তো সেদিনের সেই প্রমাণ গুলো আছে।
_হ্যাঁ আছে। এসব দেখিয়ে কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ আজ-কাল সবই কম্পিউটার গ্রাফিক্স।
_পিকচার গ্রাফিক্স হলেও ভিডিও তো গ্রাফিক্স হবে না। তুমি এক কাজ করো ওই ভিডিওটা আমার কাছে দাও। আমি ভিডিওটা এক্ষুণি চাচ্চুর কাছে শেয়ার করছি।
_ঠিক আছে।
মেঘ নিজের রুম গিয়ে আলমারি থেকে অন্য একটা মেমোরি নিয়ে আসে। সেই মেমোরিটা সামির হাতে দেয়। সামি মেঘের ল্যাপটপে মেমোরিটা প্যানড্রাইভ দিয়ে কানেক্টে করে নেয়। তারপর সবগুলো প্রমাণ চেক করতে থাকে। সামি শিওর হওয়ার জন্য ভিডিওটা অন করে। সামি ইরা ভিডিও দেখে ভীষণ অবাক, ছোট মেঘের সারাহাতে রক্তের দাগ। সামি এই রক্তমাখা মেঘের হাত দেখে মেঘকে জিজ্ঞেস করল,
_এইটা কী তুমি?
_হ্যাঁ।
_তুমি-ই তো প্রকৃত সাক্ষী।
_তাতে কী? আদালত প্রমাণ চাইবে।
_আবিরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এই প্রমাণটাই যথেষ্ট। কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢুকছে না। আবির কেন তোমাকে মারলো না?
_আবির আমাকে বিয়ে করতে চায়।
_ওহ, তাই তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবির খুব ভালো করেই জানে তুমি মুখ খুললে সে আবারও জেলে ঢুকবে। তাই তোমার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। আর তোমাকেও বার বার ভয় দেখাচ্ছে।
_সেদিনের সেই ঘটনাটা যখন মনে পড়ে তখন মনে হয় আমি নিজেই ওই শয়তানটাকে মেরে ফেলি। কিন্তু আইন হাতে নিবো না বলে সেদিন ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ও তো সাহস দেখিয়ে পালিয়ে এলো। হাঁদারাম পুলিশগুলোও যে কী করে কে জানে?
_আবিরের মতো গুণ্ডাপাণ্ডাদের হাত অনেক লম্বা থাকে। যা তুমি আমি চাইলেও ধরতে পারবো না। আপাতত এই ভিডিওটা আমি চাচ্চুকে পাঠাচ্ছি বাকিটা চাচ্চু দেখে দিবে। আর এই ক’দিন বাড়িতে সিকিউরিটি থাকবে। আমি চাচ্চুকে জানিয়ে দিচ্ছি।
_তাহলে তো আবির এখানে আসার সাহস করবে না।
_এক্সেক্টলি। চিন্তা করো না। যাও এবার শান্তিতে জিজুর সাথে প্রেমালাপ করো।
_আর প্রেমালাপ। সারাদিন পেরিয়ে গেল আজ একবারও ফোন করলো না। কী যে করে সারাদিন ভেবে পাই না।
এইবলে মেঘ ইরাকে রেখেই সামির রুম থেকে চলে আসে। সামি ইরার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে ইরাকে বলল,
_এই মেয়ে তুমি এখানে বসে আছো কেন? যাও টেবিলে খাবার সাজাও। জানো না আমার একটু পরেই ঔষধ খেতে হবে।
_হুহ্।
ইরা সামির উপর রাগ দেখিয়ে রুম থেকে চলে যায়। সামি পিছন থেকে মুচকি হাসে। তারপর চাচ্চুকে ফোন করে কড়া সিকিউরিটির কথা জানিয়ে দেয়। মেঘের ক্ষতি হোক কেউ-ই চায় না। সবাই মেঘকে ভালোবাসে তাই যে কেউ মেঘের বিপদে এগিয়ে আসে নির্দ্বিধায়।
রাতের খাবার খেতে বসে সবাই মেঘকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। সবার চেহারার মাঝেই কেমন যেন টেনশনের চাপ। ভয় আর মেঘের ক্ষতির আশংকা। যা কাউকেই ঠিকমতো রেহাই দিচ্ছে না। মেঘের বাবা খাবার সামনে নিয়ে মুখভার করে বললেন,
_কাল তো মেঘের গায়ে হলুদ। সারা বাড়ি জুড়ে মেহমানরা থাকবেন। যদি কোনোভাবে আবির এখানে পৌঁছে যায় তখন মেঘকে আমরা লুকাবো কোথায়?
মেঘের বাবার এই যুক্তিসঙ্গত কথা শুনে সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। সামি মেঘের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
_আংকেল চিন্তার কোনো কারণ নেই। ইরা, নওরিন সবসময় মেঘকে ঘিরে থাকবে। আজকেই চাচ্চু একটা টিমকে পাঠাবেন। কখন আবির চলে আসে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই চাচ্চুকে বলে দিয়েছি আজকে থেকে কড়া সিকিউরিটি দিতে। সারা বাড়ি জুড়ে যখন পুলিশের পাহারা থাকবে তখন আবির সামনে আসার চেষ্টাও করবে না।
_ঠিক আছে বাবা তাহলে তাই হোক। আমার মেয়ের জীবন রক্ষার্থে আমরা সবরকম চেষ্টা করে যাবো।
_চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
_কাল তো ডেকোরেশনের কাজ শুরু হবে। সারা বাড়ি আলোকসজ্জায় সাজানো থাকবে। সেই সুযোগে আবির কিন্তু নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে এখানে আসবে। যদি কড়া পাহারা ডিঙিয়ে আবির একবার এখানে পৌঁছে যায় তাহলে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া খুবই সহজ। এতসব পাহারা থাকার পরেও আবির কাল এখানে আসার কথা ভাববেই। তাই মেঘকে এই দু’দিন দেখে রাখতে হবে। পরিচিত বাইরের কাউকেই এলাও করা হবে না। সেদিকে আমাদের সবার লক্ষ্য রাখতে হবে।
_জ্বি আংকেল। আমরা সবাই মিলে এই দু’দিন মেঘের দিকে পাক্কা নজর রাখবো।
সামি এই কথা বলে মেঘের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। সামির হাসি দেখে সবাই হাসাহাসি শুরু করে। আর মেঘ রাগে ফুলতে থাকে। টেবিলে ঠাস করে চামচ দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
_আমি কারো সাথে পালিয়ে যাচ্ছি না যে, আমাকে এইভাবে পাহারায় রাখবে তোমরা। আমারই বিয়ে অথচ আমাকেই কি না ঘর বন্দি, ভাবা যায় এসব?
মেঘের রাগ দেখে মেঘের মা মেঘকে বললেন,
_আবিবের জন্যই তো তোকে এইভাবে নীরব থাকতে হবে। কখন যে আঘাত হানে কে জানে। তার থেকে ভালো তোর একটু সাবধানতা অবলম্বন করা।
_এইভাবে ক’দিন আমাকে পাহারা দিবে। বিয়ের পরে যে আবির আমার উপর অ্যাটাক করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? যা হবে সেটা পরে দেখা যাবে। প্লিজ এইভাবে আমাকে পাহারায় রেখো না।
_এই সিদ্ধান্ত আমাদের সবার। তাই তোকে এইভাবেই সিকিউরিটি নিয়ে বিয়ের পীড়িতে বসতে হবে।
_কী আজব কাণ্ডকারখানা তোমাদের! মেজাজটাই গরম করে দাও।
মেঘের কোনো কথাই কেউ শুনতে রাজী না। তাই মেঘ আর কাউকে এই নিয়ে জোর কাটায় না। কারণ মেঘ ভালো করেই জানে, আবির এই দু’দিনের সুযোগটাই কাজে লাগাবে। আর এই দু’দিন আবিরের থেকে নিজেকে যেভাবে হোক আড়াল রাখতেই হবে। কাউকে এই বিষয়ে জোর করাটা বড্ড বোকামি হবে। তাই মেঘ সবার সিদ্ধান্ত মতো বিয়ের পীড়িতে বসতে রাজী।
৪৩!!
ডিনার শেষে মেঘ ঘুমোতে যাওয়ার আগে নওরিনকে ফোন করে। অনেকক্ষণ ধরে নওরিন ফোন তুলছে না। মেঘ কল দিতে দিতে বিরক্তবোধ করছে। বাধ্য হয়ে ফোনটা রেখেই ঘুমোতে যায় মেঘ। কিছুসময় পরেই মেঘের ফোনটা কেঁপে উঠে। ভাইব্রেশনে থাকায় ফোনের কাঁপুনির তালে মেঘ হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে। ভেবেছিলে নওরিনের ফোন, কিন্তু শ্রাবণের নাম্বার দেখে মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল। রিসিভ করে শান্ত গলায় বলল,
_আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী খবর আপনার?
_আমার খবর তো খুব ভালো। ও হ্যাঁ আপনার জন্য কাল একটা সারপ্রাইজ আছে।
_জ্বি মহারানী বলুন কী সারপ্রাইজ রেখেছেন?
_আগে তুমি করে বলেন তারপর বলব।
_সত্যি বলবে।
_হ্যাঁ বলবো।
_তাহলে বলো।
_আচ্ছা আমি যেন তোমার কী?
_তুমি?
_হ্যাঁ আমি।
_তুমি আমার কেউ-ই হও না।
_কী!
_হ্যাঁ, সত্যি কী তুমি আমার কেউ হও? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে?
_ইয়ার্কি মারছো?
_মোটেও না। এই মুহূর্তে ইয়ার্কি মারার মুডে আমি নেই। আচ্ছা বলো তোমার সারপ্রাইজটা ঠিক কী?
_বলবো না। আর সারপ্রাইজ বলে দিলে সেটা আর সারপ্রাইজ থাকে না।
_এইমাত্র না বললে বলবে।
_ভুল শুনেছো। কাল তোমার সকাল শুরু হবে আমার দেওয়া সারপ্রাইজে।
_কী সারপ্রাইজ বলো না। আমার যে মনটা বড্ড ব্যকুল হয়ে আছে।
_সামলাও নিজের চঞ্চল মনটাকে। আর এখন চুপচাপ ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়।
_এজ ইউওর উইশ ডিয়ার।
_গুড নাইট, আল্লাহ হাফেজ।
_আল্লাহ হাফেজ।
মেঘ ফোন রেখে ভাবনায় পড়ে যায়। সারপ্রাইজ আছে বলে তো দিল। কিন্তু কী সারপ্রাইজ দিবে সেটাই তো এখনও ভাবা হলো না। কাল সকাল হলেই তো শ্রাবণ সারপ্রাইজটার জন্য অপেক্ষা করবে। কী সারপ্রাইজ দিবে এইসব ভেবে ভেবে মেঘ একেবারে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
_আইডিয়া…
মেঘের চিৎকারে ইরা কানে বালিশ চাপা দিয়ে মেঘকে ধমক দিয়ে বলল,
_রাখ তোর আইডিয়া। ঘুমোতে দে। নইলে বাসার সবাইকে জড়ো করে বলব তুই এই বিয়েতে রাজী না।
_কী!
_হ্যাঁ।
মেঘ রাগে ইরার গলা টিপে ধরে। আস্তে করেই গলায় টাচ করে যাতে ইরা ব্যথা না পায়। রাগ চেপে রেখে ইরাকে বলল,
_তোর জেলাস ফিল হচ্ছে আমাদের বিয়ে হচ্ছে দেখে।
_হ্যাঁ হচ্ছে। তুই তাড়াতাড়ি বিয়ে করে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই আমি প্রাণে বাঁচি।
ইরার এমন কথায় মেঘ একটু ঘাবড়ে যায়। ভাবে ইরা হয়তো মেঘকে দূরে সরাতে এই কথা বলছে। তাই ইরার থেকে দূরে সরে মন খারাপ করে বিছানায় একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। ইরা মেঘের এমন অবস্থা দেখে বুঝতে পারে সে মেঘকে কতটা হার্ট করেছে এই কথা বলে। ইরা তো মেঘকে কষ্ট দিতে এই কথা বলেনি। ইরা শুধু মজা করার ছলে এই কথা বের করেছিল। কিন্তু ইরার ভাবনা ছিল ভুল। ইরার এই সামান্য কথা মেঘকে কাঁদাতে যথেষ্ট ছিল। ইরা মেঘের দিকে খানিকটা এগিয়ে দেখে মেঘ চোখের জল মুছছে। মেঘের কান্না দেখে ইরার ভেতর ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে। পিছন থেকে মেঘকে হাল্কা হাগ দিয়ে জড়িয়ে ধরল ইরা। তারপর বলল,
_তুই চলে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাব মেঘ। বড্ড একা হয়ে যাব। আমার কথায় কষ্ট পাস না রে। আমি তো শুধু মজা করতে এই কথা বলেছি। সত্যি কী জানিস? আমি তোকে ছাড়া এই বাড়িতে একটা মুহূর্তও কাটাতে পারব না। খেলার সাথী বলিস আর ঝগড়ার সাথী বলিস, সবই যে ছিলি তুই। তোকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো কীভাবে মেঘ?
দুইবোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে কেবল কাঁদতেই থাকে। এই কান্না যে আপনজনকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কান্না। ভাই-বোন, বাবা-মা, আআত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে ছেড়ে একা একা ভালো থাকা যায় না। তবুও প্রতিটা মেয়েকে শক্ত মন নিয়ে তৈরী থাকতে হয়। কারণ আজ না হয় কাল তাকে বাবার বাড়ি, মায়ের আঁচল সব ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। সবসময় শুধু মেয়েদেরকেই এই ত্যাগটা করতে হয়। এই ত্যাগের বিনিময়ে সে অন্য এক পরিবার পায় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত বাবা-মা হওয়ার সুখে কেউ দিতে পারে না। মেয়েগুলো একটা সময় সেই অচেনা পরিবারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার পথ খুঁজে। ধীরেধীরে সে এই পরিবারের সাথেই নিজেকে মানিয়ে নেয়। তৈরী করে এক নতুন সুখের রাজ্য।
মেঘের ভেতরেও ঠিক এমনই তোলপাড় চলছে। বাইরে থেকে মেয়েটা যতটা শক্ত ভেতরে ঠিক তার থেকে দ্বিগুণ দুর্বল। প্রতিটা মেয়েরই এক না একটা দুর্বলতা থাকেই। আর মেঘের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখন ওর মিথ্যে পরিচয়টা। কীভাবে সবকিছু সামলে মেঘ শ্রাবণের মুখোমুখি সেই ভাবনায় মেঘের ভেতরে হাজারো চিন্তার ছড়াছড়ি। ইরা মেঘকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘুম পাড়ায়।
৪৪!!
বৃহস্পতিবার সকালটা শুরু হয় হৈচৈ হাসিঠাট্টার মাধ্যমে। মেঘ ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবে তখনই আদনান দৌঁড়ে আসে মেঘের রুমের দিকে। বের হতেই দুজনে মুখোমুখি হয়। মেঘ আদনানের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
_আমার জিনিসটা দাও। আমি এখনি বের হতে হবে।
_এই নাও। তুমি কী এখনি বের হবে?
_হ্যাঁ, কেন?
_তোমার তো বাইরে যাওয়া বাড়ন। আমার কাছে দাও আমি পৌঁছে দিব।
_একদম না। বাইরে যাওয়া বাড়ন আছে সেটা ঠিক। কিন্তু এখন তুমি ছাড়া কেউ-ই জানবে না আমি বাইরে যাচ্ছি।
_বাইরে পুলিশের পাহারা। তুমি তাঁদের ডিঙিয়ে বাইরে যাবে কীভাবে?
_সে চিন্তা তোমার না করলেও চলবে। তুমি ব্যস সবাইকে সামলাও। আমার ফিরে আসতে মাত্র দু’ঘণ্টা লাগবে।
_ঠিক আছে। সাবধানে যাও।
মেঘ আদনানকে বলে রাখা জিনিসটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি রুমে যায়। বোরখা পরে মুখটা সম্পূর্ণ ঢেকে রাখে। তারপর চুপিচুপি রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। চারিদিকে এতো হৈচৈ যে পুলিশ গুলো খেয়ালও করল না মেঘ যে পালিয়ে গেল।
চলবে…