#বৃষ্টি _ভেজা _গোলাপ
#পর্ব_৭
#নবনী_নীলা
” আগে তুমি এটা ঠিক করো আমি মানুষ নাকি রাক্ষস? তারপর আমি তোমায় বোঝাবো আমি অসভ্য নাকি রক্ত চোষা।”, এগিয়ে আসতে আসতে বললো আহান। তারপর হাতের থাকা বালিশটা রুহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। রুহি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে রাগ কমাচ্ছে।
রাতে খাওয়া শেষ করে রুহি তাড়াতাড়ি রূমে এসে বিছনায় শুয়ে পড়লো। যদিও এতো তাড়াতাড়ি সে ঘুমায় না তাও এসে শুয়ে পড়লো। বিছানা দখল করতে হবে বলে কথা। সে এমন ভাবে শুয়ে আছে যেনো ঘুমে তলিয়ে গেছে। আহান রুমে এসে রুহিকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করছে রুহি আদোও ঘুমিয়েছে নাকি ঘুমানোর ভান করছে। আহানের বুঝতে বেশি দেরী হলোনা যে এইসব নাটক। জেগে জেগে ঘুমানোর ভান হচ্ছে। ঠিক আছে কতক্ষণ এই নাটক চলে সেও দেখবে। হাত পা ছুরে পুরো বিছানাটা দখল করে আছে। এই মেয়ের নাটক শেষ হয়না।
আহান ফোন, ওয়ালেট এগুলো টেবিলে রেখে তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। আহানের যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুহি উঠে বসল।
” ধুর ছাই এতক্ষণ কি এইভাবে মরার মতন পরে থাকা যায় নাকি? সবে তো সাড়ে দশটা বাজে।”, রুহির বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। কিন্তু মাথায় কিছু এলো না। তারপর কাথাটা গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে রইলো তবে তার চোখে খোলা। মাথায় তার নানা চিন্তা সাত মাস পর কি হবে? লোকে তাকে কি বলবে? যদি নানু জানতে পেরে যায় এইসব? নানু তো সহ্য করতে পারবে না।
একমাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আর মাত্র ছয়মাস।
তাকে কেউ অনেক ভালোবাসবে এই স্বপ্নটা হয়তো কোনদিন পূরণই হবে না তার। অবশ্য যার মা যাকে ভালোবাসে নি তাকে অন্য কেউ যে তাকে ভালোবাসবে সেটা ভাবা সম্পূর্ণ বোকামি সেটা সে জানে। সে জেনে শুনে তার মায়ের পথটাই বেছে নিয়েছে। কিন্তু তার পরিণতি তার মায়ের মত হবে না সেটা সে জানে, সে একই ভূল করবে না। এতোটা বোকা সে নয়,
এইসব ভাবতে গিয়ে রুহির মন খারাপ হয়ে গেলো। তারপর চোখ বন্ধ করতেই ঘুমে তলিয়ে গেলো।
আহান মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। তারপর কফি নিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর পর রুহিকে দেখলো। এভাবে শুয়ে আছে কিভাবে এতক্ষণ ধরে?
আহান কাজ শেষে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘুমাতে এসে দেখে রুহি আহানের বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আহান আস্তে করে বালিশটা রুহির থেকে সরিয়ে আনলো তারপর একপাশে বালিশটা রেখে আস্তে করে শুয়ে পড়লো। বালিশে মাথা রাখতেই আহানের চোখ গেলো রুহির দিকে কি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। সামনের ছোটো ছোটো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের সামনে এসে পড়েছে। আহান নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে মুখের সামনে থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। তারপর রুহির থেকে চোখ সরিয়ে এনে চোখ বন্ধ করতেই হটাৎ কারোর স্পর্শে চোখ খুললো আহান। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো রুহি তার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। হাতটাকে বালিশ ভেবেছে হয়তো। আহান হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলো নাহলে আহানকেই সকালে কথা শুনবে এই মেয়ে। আহান হাত সরিয়ে নিতেই রুহি আবার জড়িয়ে ধরলো হাতটা। আহান রুহির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তারপর আর হাতটা সরালো না। কেনো জানি সরাতে ইচ্ছেও করছে না তার।
সকালে রুহির ঘুম ভাঙ্গার আগেই আহানের ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু রুহি হাত ধরে আছে বলে সে উঠতে পারছে না। তারপর শেষে উপায় না পেয়ে আস্তে করে হাতটা সরাতে গেলো আহান। তখন রুহি নড়ে চড়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলতে লাগলো। আহান হাত সরাতে গিয়ে থমকে গেলো। ঘুম ভাঙ্গলেই এলাহি কাণ্ড করে ছাড়বে। রুহি চোখ খুলে কিছুক্ষণ আহানের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে নিজের দিকে তাকাতেই রুহি আহানের হাত ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো। আহান কাধ ধরে হাতটা নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
ঘুম থেকে উঠে মারাত্মক শক খেয়েছে রুহি। তারওপর প্রচন্ড রাগ লাগছে রুহির।
” কি করেছেন কি আপনি আমার সাথে। আপনার কত…….”, রাগে বাকিটুকু বলতেই পড়লো না রুহি।
” এক্সকিউজ মি! এই প্রশ্নটা আমার তোমাকে করা উচিৎ। আমার হাতের তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ।”, হাতটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল আহান।
রুহি বড় বড় চোখে আহানের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি করেছি মানে? আমি কি করেছি? আপনি ঘুমের মধ্যে আমার সুযোগ নিয়েছেন। এবার আমাকে দোষ দিচ্ছেন।”, চোখ লাল করে বললো রুহি।
আহান রুহির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো,” তাই বুঝি? সারারাত তুমি আমার হাত জড়িয়ে ঘুমালে এখন আমাকে বলছো আমি তোমার সুযোগ নিয়েছি।দিস ইজ রেডিকুলাস”, বলতে বলতে আহান উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
রুহি হা করে বসে রইলো। তারপর নিজের দিকে তাকালো কিছু করেছে বলে তো তার মনে হচ্ছে না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে রুহি থ মেরে বসে রইলো।
???
বিকেলে আহান রাতুল মানে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের সাথে খোলা জায়গাটায় কিছু পেপার নিয়ে কথা বলছিলো। কন্ডিশন গুলো আহান পড়ছিলো এমন সময় বাম দিকে তাকাতেই দেখলো রুহি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে।
” রাতুল ওদিকে খেয়াল রাখো যতক্ষণ না আমি কন্ডিশনগুলো পড়ে শেষ করছি।”, আহান রাতুলকে বললো।
” ম্যাডামের দিকে নজর রাখবো স্যার?”, হাসি মুখে প্রশ্ন করলো রাতুল।
আহান পাতা উল্টাতে উল্টাতে হা সূচক মাথা নাড়ল। রাতুল রুহিকে চোখে চোখে রাখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হটাৎ রাতুল স্যার স্যার বলে চেঁচিয়ে বললো,” ম্যাডামকে দেখতে পাচ্ছি না। জঙ্গলের ভেতরে চলে গেছে মনে হলো।”
আহান ফাইলটা রেখে হুড়মুড়িয়ে দাড়িয়ে পড়লো তারপর বামদিকে তাকাতেই দেখলো ফাকা কেউ নেই।
” কোনদিকে যেতে দেখেছো? “, বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো আহান।
” স্যার বাম দিকে সোজা গিয়ে জঙ্গলের ভিতরে চলে গেলো।”, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো রাতুল।
আহান ছুটে সেদিকে গেলো বাম দিকে । এগিয়ে গেলো চারিদিকে দেখলো কোথাও নেই। জঙ্গলে যাওয়ার কি প্রয়োজন পড়লো এই মেয়ের। আহান অস্থির হয়ে উঠলো। কোনোকিছু না ভেবেই সে জঙ্গলের ভিতরে চলে এলো। চারিদিকে শুধু গাছপালায় ভরা। এ জঙ্গলে রুহিকে এবার সে কোথায় খুঁজবে? কিছুক্ষণ পর পর পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর সে শব্দ ভয়ানক লাগছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে তখন কিভাবে খুঁজবে সে রুহিকে। অজানা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো আহান। রুহি রুহি বলে ডাকতে লাগলো সে। কোনো সাড়া নেই। নিস্তব্ধ জঙ্গল আশে পাশে থাকলে অবশ্যই সাড়া পাওয়া যেতো কিন্তু কোনো সাড়া নেই তাহলে কি আরো গভীরে চলে গেছে রুহি।
এদিকে রুহি ভয়ে শেষ পেঁচার ডাক, শিয়ালের ডাকে ভয়ে তার আত্তা কেপে উঠছে। কোনদিক দিয়ে এসেছিলো তার মনে নেই। তার মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেছে এবার কি চিল শকুনের খাবার হতে হবে ভেবেই চোখে পানি চলে এসেছে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। চারিদিক অন্ধকার এর মাঝে শুধু আকাশের দিকে তাকাতেই চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদের ঝাপসা আলোয় চারিদিকটা আরো ভয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। রুহি ভয়টা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। মনোবল সে এখনো হারায়নি। গলা শুকিয়ে গেছে তার। হটাৎ দূর থেকে একটা আলো দেখতে পেলো সে। রুহি উঠে দাঁড়ালো, ভয়ে ভয়ে সেই আলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। একটু কাছে যেতেই আহানের অবয়ব দেখতে পেলো সে। এইবার নিজেকে সুরক্ষিত মনে হচ্ছে তার। আহানকে দেখে রুহির চেহারায় একঝিলিক হাসি ফুটে এলো। রুহি ছুটে গিয়ে আহানকে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। আহান ফোনের টর্চ দিয়ে পাগলের মতন খুঁজছিলো রুহিকে। হটাৎ পিছন থেকে কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় আহান থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। আহানের বুঝতে দেরী হলোনা এটা রুহি। আহান মাথা নিচু করে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললো তারপর রুহির জড়িয়ে রাখা মুষ্টি বন্ধ হাতের উপর হাত রাখলো।
রুহি হাপাতে হাপাতে বললো,” আপনি কি আমার কুম্ভকর্ণ?”
আহান এই সিচুয়েশনে দাড়িয়ে নিঃশব্দে হেসে ফেললো রুহির কথা শুনে তারপর নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে রুহির দিকে ফিরে বললো,” হুম। তুমি ঠিক আছো?” বলে রুহির দিকে টর্চ মারতেই চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো।
আহান আরেক হাত দিয়ে রুহির মুখটা ভালো করে দেখতে লাগলো। কিছু কামড়ায় নি তো। রুহি হাত দিয়ে টর্চ মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললো,” আরে আলো চোখে লাগছে তো?”
আহান রুহিকে দেখে অবাক হচ্ছে মেয়েটা এতো সাহসী। দেখে মনে হচ্ছে মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। আহান তো ভেবেছিলো কেঁদে কেটে হয়তো বন্যা করে দিয়েছে। চোখের কোনে জল ছল ছল করছে ঠিকই কিন্তু তেমন কান্না করেনি রুহি।
” তোমার ভয় করেনি?”, আশে পাশে তাকিয়ে বলল আহান।
আহান রুহির হাত শক্ত করে ধরে আছে।
” হ্যা করেছিলো, পেঁচার ডাকে বাতাসে পাতা নড়ার শব্দে পরে ভাবলাম ভয় পেয়ে করবো টা কি? যা কপালে আছে তো হবেই। নিজেকে না বিয়ার গ্রিলস মনে হচ্ছিলো। খালি কোনো ক্যামরামান ছিলো না সাথে।”, স্বাভাবিক ভাবেই বললো রুহি।
আহানের বিস্ময়ের সীমা রইলো না তারপর আহান একটা ভ্রু তুলে প্রশ্ন করলো,” এখন ভয় করছে না?”
” না এখন তো আপনি আছেন ভয় কেনো পাবো?”, হেসে আহানের দিকে তাকাতেই একটু ভয় পেয়ে দূরে সরে এলো রুহি।
তারপর সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,” আপনি কি আসলেই আহান নাকি আহানের রুপ ধরে এসেছেন আপনি জ্বীন না তো?” বোলেই আহান থেকে টর্চ টা টেনে নিলো রুহি।
তারপর আহানের দিকে টর্চ মারলো আহানের ছায়া পড়ছে কিনা দেখতে ছায়া দেখতে পেয়ে হেসো হাসো চেহারায় টর্চ আহানের হাতে দিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসে আহানের হাত ধরে দাড়ালো।
আহান বিরক্তি নিয়ে রুহির দিকে তাকালো তারপর বলল,” তুমি কোনোদিন সুধরাবে না তাই না?”
রুহি চুপ করে রইলো বেশি কথা বললে তার কপালে খারাপ আছে সে জানে। এর মেজাজ বিগড়ে গেলে যখন তখন জঙ্গলে রেখে চলেও যেতে পারে।
[ চলবে ]
আজ ছোটো করে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত।?