#ক্যানভাস_
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১০)
শ্রাবণ মেঘকে বলল,
_অবাক হচ্ছো আমাকে দেখে?
_হুম।
_তিনটায় বাসায় যাওয়ার কথা, ভাবলাম আজকে তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরবো, তাই ইচ্ছে করেই বাসায় গেলাম না। তোমার ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম।
_কিন্তু তুমি এই কলেজের কথা জানলে কীভাবে?
_তোমার কলেজে গেছিলাম সেখানে পাইনি, একজন স্যার বললেন তুমি এখানে আছো। তাই এই কলেজে এলাম। কিন্তু তুমি আর্ট কলেজে কী করছো?
_নওরিনের সাথে দেখা করতে এসেছি।
_ওহ তাই বলো। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় মেঘের মতো একজন চিত্রশিল্পী।
_না না, আমি চিত্রশিল্পী হতে যাবো কেন?
_হ্যাঁ সেটাই, সবাই তো আর সব কিছু পারার ক্ষমতা রাখে না।
_হ্যাঁ। মাথামোটা আমি তো তোমার জন্যই নিজের পরিচয় গোপন করলাম। (বিড়বিড় করে)
_কিছু বললে।
_কই না তো।
_তাহলে আমরা কি যেতে পারি?
_হ্যাঁ অবশ্যই।
মেঘ নওরিনকে বিদায় জানিয়ে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে শ্রাবণের গাড়িতে গিয়ে উঠে। মনেমনে নওরিনকে ধন্যবাদ দিলো। নওরিন যদি তখন বুদ্ধিকরে স্যারেকে সবটা না বলতো তাহলে আজ স্যার নিশ্চয়ই মেঘের আসল পরিচয় দিয়ে দিতেন। নওরিনের বুদ্ধির জোরেই এ যাত্রায় মেঘ বেঁচে গেল। মেঘ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে একটুকরো হাসি ফুটায় ঠোঁটের কোণে। যত এই চেহারার দিকে তাকায়, ততই যেন প্রেমে ডুবে মেঘের হৃদয়। হারিয়ে যায় মেঘ এই হাসির মাঝে। মনেমনে বিধাতার দরবারে হাজারো ‘শুকরিয়া’ আদায় করে মেঘ। শ্রাবণকে জীবনসাথী হিসেবে পাওয়া যেন মেঘের সাত জন্মের ভাগ্য।
২৪!!
শ্রাবণ একমনে ড্রাইভ করছে। একটা সময় সবুজ শ্যামল প্রকৃতি ঘেরা একটা রোমাঞ্চকর জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামায় শ্রাবণ। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি, মনভুলানো কিছু কলরব, প্রাণ জুড়ানো শীতল বাতাস আর হৃদয় মাতানো এক অপার সৌন্দর্য, যার কাছে হার মানে হাজারো রূপের খেলা। এ যে প্রকৃতির আসল রূপ। এই বাংলা মায়ের নিজস্ব রূপ যে দেখবে সেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে এই প্রকৃতির মাঝে। ডুবে থাকবে এক অবাক নেশার ঘোরে। উঁচুনিচু একটা জায়গা দেখে পা মেলে দু’জনেই সবুজ ঘাসের উপর বসে। হাল্কা বাতাসে কেঁপে উঠে মেঘের হৃদয়। নেচে উঠে মেঘের মন এই প্রকৃতির নেশায়। মেঘ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত মেলে ধরে প্রকৃতির মায়াতে। হাল্কা বাতাসের মৃদু কম্পনে নেচে উঠে মেঘ। ঘুরে ঘুরে এদিক-সেদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে মেঘ। মেঘের এমন বাচ্চা বাচ্চা মন দেখে শ্রাবণ মেঘের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকায়। মেঘ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণের তাকানোকে পাত্তা না দিয়ে নিজেকে মাতিয়ে রাখলো নিজের কাজে। শ্রাবণ মেঘকে ডাক দিয়ে বলল,
_রাত্রি,
_বলো।
_কিছু খাবে?
_না।
_কেন?
_এই মোমেন্টটা মিস করতে চাই না।
শ্রাবণ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। মেঘ নিজেকে ব্যস্ত করে নেয়। কিছু সময় পর চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি আসতে শুরু করে। বৃষ্টি আসতেই শ্রাবণ উঠে দাঁড়ায়, গাড়িতে উঠে যেতে চাইলে মেঘ শ্রাবণের হাত টেনে ধরে। মেঘ ভিজতে চায় শ্রাবণকে নিয়ে। শ্রাবণকে ভিজার কথা বললে শ্রাবণ মানা করে দেয়। শ্রাবণ নিজেকে বাঁচাতে গাড়িতে গিয়ে বসে। মেঘ শ্রাবণের এমন কান্ড দেখে একটু কষ্ট পায়। তাই ইচ্ছে করেই নিজেকে বৃষ্টির মাঝে বিলিয়ে দেয়। ভিজতে থাকে ঝুম বৃষ্টির পানিতে। কখনও ঘুরছে, কখনও কাদাকে নিয়ে পা দিয়ে নাচানাচি করছে। মেঘের এই অবস্থা দেখে শ্রাবণ পিছনের সিট থেকে ছাতা আর একটা রেইনকোট আনে। ছাতাটা মেলে রেইনকোটটা হাতে নিয়ে মেঘের কাছে যায়। মেঘের দিকে রেইনকোটটা এগিয়ে দেয় শ্রাবণ। মেঘ রেইনকোট হাতে নিয়ে আবারও সেটা গাড়ির ভেতরে রেখে দেয়। শ্রাবণের থেকে দূরে সরে আবারও ভিজতে থাকে মেঘ। শ্রাবণ মেঘের এমন কান্ড দেখে রেগে যায়। আসলেই এই মেয়েটা খুব জেদী। যখন যা মাথায় চাপে তাই করে। কাজের কোনো ঠিক নেই। শ্রাবণ মেঘকে বলল,
_রাত্রি! এইবার থামো, ঠান্ডা লেগে যাবে।
_লাগুক, তাতে তোমার কী?
_আমার অনেক কিছু।
মেঘ হাত গুটিয়ে অবাক হয়ে শ্রাবণের দিকে তাকায়। শ্রাবণের চোখে মেঘের জন্য কোনো অনুভূতি আছে কি না সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু না! মেঘ হতাশ। শ্রাবণের চোখের ভেতর মেঘের প্রতি বিন্দুমাত্র টান নেই। শ্রাবণের থেকে দূরে সরে গিয়ে মেঘ আবারও ভিজতে থাকে। এইবার শ্রাবণ খুব রেগে যায়। হাতের ছাতা ফেলে দিয়ে মেঘকে এক ঝটকায় বুকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা টানে মেঘ খুব অবাক হয়, আরো অবাক হয় নিজেকে এইভাবে শ্রাবণের বুকে মিশে থাকতে দেখে। মেঘ না চাইতেও শক্ত করে খামচে ধরে শ্রাবণের শার্ট। শ্রাবণ নিজেই মেঘকে বকা দিচ্ছে, কিন্তু; রাত্রি ভেবে নয় আনিকা ভেবে। শ্রাবণ বলছে,
_তুমি আমার কথা কেন শুনো না আনু? তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো কীভাবে? তুমি জানো না তুমি আমার কী? তোমায় কত যতনে রেখেছি আমি আমার হৃদয়ের গভীরে! আর তুমি কি না সেই হৃদয় ছিঁড়ে চলে যেতে চাইছো। কেন এমন করছো আনু? কেন কষ্ট দিচ্ছো তোমার ভালোবাসাকে?
মেঘ বোবা হয়ে যায় শ্রাবণের কথা শুনে। শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে মেঘ ডুকরে কেঁদে উঠে। মেঘের কান্নার আওয়াজ পেয়ে শ্রাবণ মেঘের মাথা তুলে মেঘের দিকে তাকায়। আনিকার বদলে মেঘকে দেখে মেঘের থেকে এক-পা দূরে সরে যায় শ্রাবণ। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রাবণ। মেঘ কোনো প্রকার শব্দ না করে গাড়িতে গিয়ে বসে। ঠান্ডায় কাঁপা-কাঁপি অবস্থার শুরু। মেঘ দু’হাত দিয়ে দু’হাতের কনুই চেপে ঠাণ্ডা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু ঠান্ডার মাত্রা না কমে বরং তা বেড়েই যাচ্ছে। তার উপর মেঘের ফুঁপানি তো আছেই। অনেকক্ষণ মেঘের গলার আওয়াজ না পেয়ে শ্রাবণ পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে মেঘ শ্রাবণের সামনে নেই। আশেপাশে ভালো করে তাকালে কোথাও মেঘকে পায়না। গাড়ির দিকে চোখ পড়তেই মেঘকে দেখতে পায় শ্রাবণ। বৃষ্টির ফোঁটা ততক্ষণে কমে গেছে। আকাশটা একটু লাল রঙ ধারণ করেছে। দক্ষিণের এক কোণে সাতরঙা রঙধনু নিজের রঙের ঝুরি নিয়ে আকাশে ভেসে উঠেছে। সন্ধ্যে নেমে আসবে আর কিছুক্ষণ পর। শ্রাবণ গাড়িতে উঠে মেঘকে সরি বলতে গেলে মেঘ বলল,
_সরি বলার প্রয়োজন নেই, তুমি এখনও আমার জায়গায় আনিকাকে ভেবেছো।
_প্লিজ রাত্রি রাগ করো না। আমি বুঝে উঠতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে। যতবারই তোমাকে কাছে টানি, ততবারই আনিকার স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকে।
_আমি এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করছি না শ্রাবণ। যতদিন তুমি আনিকাকে ভুলে স্বাভাবিক না হও ততদিন তুমি আমাকে মানতে পারবেনা। এটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
_বিশ্বাস করো রাত্রি আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু বেহায়া মন কেন যে বারবার আনিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয় কে জানে?
_হয়তো এখনও আনিকাকেই ভালোবাসো।
_জানি না৷ আমি তো চাই না রাত্রি, আমি তো বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
_এ নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, প্লিজ ড্রাইভ করো, বাসায় যেতে হবে।
শ্রাবণ সিটে সোজা হয়ে বসে ড্রাইভ শুরু করে। নিজের বোকামির জন্য নিজেই নিজেকে বকে যাচ্ছে। একবার নয়, বারবার রাত্রির সামনে আনিকার নাম নিচ্ছে শ্রাবণ যা রাত্রিকে আরো কষ্ট দিচ্ছে। মেয়েটা মুখে কিছু না বললেও শ্রাবণ বেশ বুঝতে পারছে রাত্রির ভেতরে ঝড় শুরু হয়েছে। নিজের জেদ আটকিয়ে রাখতে না পেরে ইচ্ছে করেই আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে নিজেকে। এইভাবে হতে থাকলে তো শ্রাবণ কখনও রাত্রিকে ভালোবাসতে পারবেনা। যেভাবে হোক আনিকার সব স্মৃতি নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে চায় শ্রাবণ। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়না, কারণ; যাকে খুব বেশি ভালোবাসে মানুষ তাঁর দেওয়া কষ্ট গুলো যখন খুব বেশি মনে পড়ে তখন শুধু বারবার সেই মানুষটাকেই মনে পড়ে, মনে পড়ে তাঁর সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মোমেন্টের কথা। যা শ্রাবণ চাইলেও ভুলতে পারেনা। কাউকে খুব বেশি ভালোবাসলে না-কি সে সেই ভালোবাসার জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। খাঁচার পাখিকে যখন খাঁচার আটকে রাখা হয় তখন সে পাখিও ডানা মেলে উড়বার জন্য চটপট করে। একসময় যখন সে মুক্তি পায় তখন সে স্বাধীন হয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায়। থাকে না কেউ তাকে বাধা দেওয়ার মতো। তাহলে কি শ্রাবণ এতদিন আনিকাকে খাঁচায় বন্দি করে রেখেছিলো, নাকি সবটাই ছিলো সাজানো আর মিথ্যে অভিনয়! শ্রাবণ জানেনা আনিকার চলে যাওয়ার পিছনের কারণ। যতবার নিজের মনকে প্রশ্ন করে ততবারই উত্তর আসে “শ্রাবণ হয়তো আনিকার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেনা, তাই আনিকা মুক্তির আশায় বন্দি খাঁচার জীবন উপেক্ষা করে চলে গেলো”। যদি সেটা হয় তাহলে এতে তো শ্রাবণ দোষী নয়, কারণ; শ্রাবণ আনিকাকে সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলো। আনিকার সাথে ব্রেক-আপ হোক, আনিকা শ্রাবণকে ছেড়ে চলে যাক, এমন কোনো কাজই শ্রাবণ কখনও করেনি। তাহলে কিসের টানে! কিসের মায়ায়! আনিকা শ্রাবণকে একা ফেলে এক যন্ত্রণাদায়ক জীবন উপহার দিলো! শ্রাবণ কি আনিকার কাছে কোনো ভুল করেছিলো? যার ফলে আনিকা আজ শ্রাবণকে এমন শাস্তি দিয়ে আরেকজনের কাছে আশ্রয় খুঁজে নিলো। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায় শ্রাবণের মাথায়। ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভ করতে থাকে শ্রাবণ। পৌঁছে যায় মেঘদের বাসার মেইন গেইটের কাছে। মেঘ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। বৃষ্টি এখন আর নেই দেখে মেঘ শ্রাবণের গাড়িটা বেশি ভেতরে আনে নি। রাস্তার পাশেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে মেঘ। দু’মিনিট চুপচাপ নিরব থাকে মেঘ। তারপর অস্পষ্ট স্বরে গম্ভীর গলায় বলল,
_আসছি,
২৫!!
মেঘ আর এক মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকে না। দৌঁড়ে চলে আসে বাসার দরজার কাছে। শ্রাবণ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে মেঘের চলে যাওয়া দেখে ড্রাইভ করতে শুরু করে। মেঘ কলিংবেল চাপ দিলে কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। মেঘ চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়। কাজের মেয়ে ভেজার কথা জানতে চাইলে মেঘ কোনো উত্তর দেয়না। রুমে ঢুকার পর ইরা মেঘকে কিছু জিজ্ঞেস করলে ইরার কথায় কোনো জবাব দেয়না মেঘ। চিল্লিয়ে কাজের মেয়েটাকে বলে ‘এক কাপ কফি পাঠাতে’। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ইচ্ছেমতো শাওয়ারের নিচে ভিজতে থাকে। আধাঘন্টা মাথাটা শাওয়ারের নিচে ভিজিয়ে রাখে। কাজের মেয়েটা কফি এনে মেঘকে ডাকলে মেঘ আসছি বলে আবারও ওয়াশরুমেই পড়ে থাকে। ভিজতে ভিজতে নিস্তেজ হতে থাকে মেঘের শরীর। শাওয়ার শেষ করে কোনোমতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বিছানায় ধুম করে পড়ে যায়। বিছানায় পড়তেই ঘুমিয়ে যায় মেঘ। ইরা মেঘের এমন অবস্থা দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।
মেঘকে বেশি বিরক্ত না করে মেঘের মাকে ডেকে আনে। মেঘের মা মেঘের কাছে এসে দেখেন মেঘ কোনাকোনি ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। মেঘের এভাবে ঘুমানো দেখে মেঘের মা তাড়াতাড়ি মেঘের মাথাটা নিজের কোলে তুলেন। মাথায় হাত দিয়েই বুঝে নেন, জ্বরে মেঘের শরীর পিড়ে যাচ্ছে। মেঘকে সোজা করে মাথার নিচে বালিশ রেখে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। ইরার কাছে জানতে চাইলে ইরা বলে মেঘের শাওয়ার নেওয়ার কথা। মেঘের মা এইকথা শুনে বুঝতে পারেন মেঘের জ্বর আসার পিছনের কারণ। ইরা মেঘের এমন অবস্থার কথা জানতে চাইলে মেঘের মা ইরাকে বললেন, “মেঘ যখন খুব কষ্ট পায় তখন এইভাবে শাওয়ার নেয়, আর খুব জ্বর আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যদিনের কারণ জানলেও আজকের কারণটা আমার অজানা ইরা।” মেঘের বিড়বিড়িয়ে কথা বলা দেখে মেঘের মা মেঘের দিকে নজর দেন।
_কেন শ্রাবণ, কেন? কেন এতো কষ্ট দাও আমাকে? কী পাও আমাকে এতো কষ্ট দিয়ে? কেন করো এমন?
মেঘ এসব বিড়বিড় করে ঘুমের মাঝেই কেঁদে উঠে। মেঘের মা মেঘের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। জ্বরটা ধীরেধীরে বাড়ছে। ইরা থার্মোমিটার এনে জ্বর চেক করে। ১০২° জ্বর এখন মেঘের শরীরে। বালতি এনে পানি দিতে শুরু করে ইরা। মেঘের বাবা এসব দেখে ডক্টর এনে মেঘের জন্য কিছু ঔষধ নিয়ে আসেন। ঘুমের মাঝেই জোর করে এক ডোজ ঔষধ খাইয়ে দেন মেঘকে। সবাই খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মেঘের সেবায় ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে মেঘের এমন পাগলামি মেঘের বাবা-মাকে ভীষণ ভোগান্তির মধ্যে ফেলে। ওনারা মেঘকে এতটাই ভালোবাসেন যে মেঘের সমস্ত চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে গিয়ে আজ মেঘকে এমন জেদী বানিয়ে ফেলেছেন। ওনাদের আশকারাতেই আজ মেঘের এই অবস্থা।
সারারাত মেঘের বাবা-মা, ইরা সহ কাজের মেয়েটা মেঘের রুমেই পাড় করে দেন। ভোর হতেই মেঘ দু’হাত মেলে শরীরের অলসতা সরাতে যাবে তখনই হাত লাগে মায়ের মুখে। মেঘ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। মেঘের নড়াচড়া দেখে মেঘের মা উঠে পড়েন। মেঘ ভালোকরে তাকিয়ে দেখে সোফায় মেঘের বাবা, ইরা বিছানায় বসেবসে ঘুমাচ্ছে আর ফ্লোরে কাজের মেয়ে রিতা। মেঘ চোখ কচলিয়ে ভালো করে তাকায়, আর বুঝার চেষ্টা করে এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। মেঘের এমন অবস্থা দেখে মেঘের মা মেঘের কপালে হাত রাখলেন। কপালে হাত রাখতেই মেঘ চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকায়। চোখের পাতা উপর নিচ করে মাকে কিছু বুঝালো। মেঘের মা মেঘকে বললেন,
_আর হা করে তাকাতে হবে না, জ্বর কমে গেছে।
_আবারও!
_এমন বোকামি করিস কেন?
_কী করবো, মাথায় উল্টা পাল্টা চিন্তা আসে কেন?
_তুই নিজে এসব প্রশ্রয় দিস বলেই তোর মাথায় এসব আসে। কী দরকার এসব ফালতু চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার?
_সরি আর হবে না।
_দশমিনিট সময় দিলাম, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়, আমি নাশতা রেডি করছি।
_আচ্ছা।
মেঘের মা মেঘের বাবাকে আর কাজের মেয়েটাকে ডেকে তুললেন, মেঘের বাবা মেঘকে একটু বুকে জড়িয়ে মাথায় বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে চলে যান। মেঘ সবার এতো এতো ভালোবাসা দেখে মনেমনে ভাবতে লাগলো,
_আমি শুধু শুধু একজনের জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিলাম। আমার প্রকৃত সুখ, প্রকৃত ভালোবাসা তো এরা, যাদের ভালোবাসা আমি চাইলেও মুছে ফেলতে পারবোনা। তাঁদের ভালোবাসার তো কোনো তুলনাই হয়না। অথচ আমি কি’না বোকার মতো? কিন্তু শ্রাবণ! আমি তো শ্রাবণকেও ভালোবাসি! কবে বুঝবে আমাকে? আমি যে ওকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি, তাইতো ঘুমে জাগরণে আমি শুধু শ্রাবণকেই দেখি।
মেঘ এসব ভাবতেই থাকে। ইরা মেঘের মাথায় ঠুকা দিয়ে বলল,
_আর এসব না ভেবে নিচে আয় বোন। কাল থেকে না খেয়ে আছি। তোর বিয়ে খাওয়ার স্বাদ হজম হয়ে যাবে যদি এইভাবে না খেয়ে থাকি।
_চুপ থাক ফাজিল মেয়ে। মাথায় শুধু বিয়ের চিন্তা।
_থাকবেই তো, তোর পরে যে আমার সিরিয়াল।
_ওহ, তাহলে নিজের জন্য এতো কিছু।
_আমার রাস্তা ক্লিয়ার কর, নেহাৎ আমি বয়সে ছোট নয়তো আজকেই বিয়ে করে নিতাম।
_তা-ই
_হুম,
_আজকে তোকে,
মেঘ ইরার পিছনে দৌঁড়াতে শুরু করে। ইরা মেঘের আগে আগে ছুটতে ছুটতে নিচে চলে যায়। মেঘ বেশি ইরার পিছনে না ছুটে রুমের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে থেমে যায়। ইরা চলে যাওয়ার পর ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মেঘের ফোন বেজে উঠে। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে শ্রাবণের নাম্বার দেখে চট করেই ‘এয়ার-প্লেন’ মুড অন করে ফোন বিছানায় ফেলে রেখে নিচে নামে।
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন