মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৩

0
3068

#মনের_অন্দরমহলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩

–“একটা তিন আঙ্গুলেপর্বর চোখে দেখতে না পাওয়া মেয়ে সে কিনা আয়াশ রায়হানের নাগাল থেকে পালিয়ে গেল? এতোবার করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি ছাড়া অন্য কারো নাম মাথায় আনা যাবে না। আমার বোঝা উচিত ছিল। কিছু মানুষ ভালো কথা নয় শক্ত কথাতেই বোঝে।”

রাগে কটমট করতে করতে চেয়ারের ওপর লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিল আয়াশ এবং তার হাতে থাকা আনিশার লিখা চিঠি দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিয়ে পায়ের জুতো দিয়ে পিষতে থাকল। চিঠিতে স্পষ্ট লিখা, “আমাকে সকলে ক্ষমা করে দিও। আয়াশ রায়হানের মতো লোককে বিয়ে করা সম্ভব নয়। একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে ঘর করা যায় না। তোমরা হয়ত উনার রুপ দেখোনি। মুখোশ পড়া লোক যে! আসল রুপটা আমি দেখেছি। এরপরেও এই বিয়ে করা আমার কাছে আত্মহত্যার সমান।”

–“আমাকে পাগল বলে কোন সাহসে? বিয়ে করতে চেয়েছি বলে মাথায় উঠে গিয়েছে। মানসিক রোগী আমি? (একটু থেমে) হেই ওয়েট! আমি মানসিক রোগী। এই কথাগুলো কে বলেছে ওকে?”

আশেপাশে সকলে ওর ভয়ানক আর তুখোড় দৃষ্টি দেখে সকলে কুকিয়ে গেল ভয়ে। আয়াশ সবার দিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি স্থির করল তার সৎমা এর দিকে।

–“সাক্ষীর জন্য আপনাকে আমি আসতে বলিনি মিসেস. মালিহা রায়হান। কিন্তু আপনি এসেছেন। আমার ভালো করতে নয়। আমার নামে যত বদনাম করা যায় সেসব করতে। এম আই রাইট?”

মিসেস. মালিহা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। কি বলবেন এর উত্তরে বুঝলেন না। কি বলা উচিত? আয়াশের বাবা সাহাদ রায়হান উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এই দশা দেখে মিসেস. মালিহা সাহাদ সাহেবের কানে ফিসফিস করে বললেন….
–“এসব কি করছে তোমার ছেলে অন্যের বাড়িতে এসে? একে তো গরীবের ঘরের মেয়েকে পছন্দ করেছে। চয়েস বলতে কিচ্ছু নেই। আর এসব অভদ্রতা? থামতে বলো ওকে।”

সাহাদ সাহেব স্ত্রীর কথা শুনে আয়াশের দিকে তাকান। আয়াশ নিজমনে কিছু বিড়বিড় করছে আর এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। ওর চোখে রাগের মাত্রা অনেকটা। কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না সাহাদ সাহেব। কেননা, ছেলের রাগের সামনে তিনিও ফিকে পড়ে যান। সাহসটার লেভেল একেবারে জিরো হয়ে যায়। তবুও গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন…..
–“আয়াশ? কি হচ্ছে টা কি? এসব কি পাগলামি করছো? ভুলে যেও না এটা তোমার হবু শ্বশুড়বাড়ি।”

আয়াশ ঘাড় কাঁত করে সাহাদ সাহেবের দিকে তাকায়। সাহাদ সাহেব অজান্তেই একটা ঢক গিলেন। কেননা আয়াশ অন্তত রেগে থাকলেই এভাবে তাকায়।

–“হবু শ্বশুরবাড়ি মাই ফুট! তোমাকে এখানে জ্ঞান দিতে নয় বিয়েতে সাক্ষী লাগবে সেজন্য আসতে বলেছি। চুপচাপ সাক্ষী দেবে আর চলে যাবে।”

আয়াশের কড়া গলার কথাগুলো আরেক ঢক গিলে হজম করলেন সাহাদ সাহেব। সকলে তার দিকে ভীরু চোখে তাকিয়ে আছে। আনিশার মা-বাবা মাহমুদ আহমেদ এবং হেমা আহমেদ বিশ্বাস করতে পারছেন না এটা সেই ছেলে যে কিনা অতি নম্র ভাবে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। একই মানুষের কত রুপ! তাদের হঠাৎ করে মনে হলো তারা সত্যিই মেয়ের বিয়ে আয়াশের সঙ্গে দিতে চেয়ে ভুল করছেন না তো? উনারা দুজন দুজনের দিকে তাকালেন। আয়াশের কথাতে চমকালেন উনারা।

–“আর আপনারা? আনিশা নাকি অন্ধ? তাহলে পালিয়ে গেল কি করে? আপনারা কেউ সাহায্য করেছেন?”

আয়াশের কথায় থতমত খেয়ে জবাব দেন শিউলি আহমেদ(আনিশার দাদিমা)।
–“ও তো জন্মান্ধ নয়। আনিশা আগে স্বাভাবিক ছিল। সকলের মতো স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করত। কিন্তু ক্লাস এইটে যখন পড়ে তখন ওর এক্সিডেন্ট হয়। সেখান থেকে চোখে দেখার ক্ষমতা হারায়। সেকারণেই তো লিখতে পারে এখনো। এমনকি আরো অনেক কাজই পারে যা স্বাভাবিক মানুষ পারে। আমরা কেউ ওকে সাহায্য করিনি। আমরা কি জেনেশুনে নিজের মুখে চুনকালি লাগাবো তুমিই বলো আয়াশ বাবা?”

আয়াশ নিজের প্রখর বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ভাবল শিউলি আহমেদ কিছু ভুল বলেনি। উনারা যদি কেউ সাহায্য করতেন তাহলে আয়াশের সঙ্গে বিয়েতে কেন মত দিতেন?
এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতে জুহায়ের ঘরে প্রবেশ করে। তাড়াহুড়োর সঙ্গে বলে ওঠে…..

–“আনিশা ম্যামের খোঁজ পাওয়া গেছে। লোকেশন ট্র্যাক করতে পেরেছি।”

আয়াশের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। মুখে ফোটে এক রহস্যময় হাসি। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলে যায়….
–“তোমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারো। কারণ আমি আর এখানে ফিরছি না।”
হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল জুহায়ের এর সঙ্গে আয়াশ।

আয়াশ যাবার পরপরই আয়াশের মা-বাবাও আনিশার পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম কথা না বলেই চলে এলেন। প্রথম থেকেই তাদের বিয়েতে কোনো মত ছিল না। মিসেস. হেমা তাদের থামাতে গিয়েও পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়েন মিসেস. হেমা। উনার মেয়ে নিখোঁজ। এবার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে এসবের জন্য উনারাই দায়ি। কান্নারত অবস্থায় উনি বলেন…..
–“আমার মনে হচ্ছে আমরা সত্যিই কোনো ভুল করে ফেলেছি। আনিশা ঠিক বলছে নাতো? আজ জামাইয়ের আচরণ দেখেছো?”

–“আমিও একই কথা ভাবছি হেমা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মাহমুদ আহমেদ। কিন্তু তাদের ধমক দিয়ে চুপ করালেন শিউলি আহমেদ।

–“কি বলছো তোমরা? নাতজামাইয়ের কি না রাগ করা স্বাভাবিক না? কত আশা নিয়ে বিয়ে করতে এসেছিল। সব ঠিক ছিল কিন্তু তোমাদের আশকারা পাওয়া মেয়ে এই রাতে উধাও হয়ে গেল। বিয়ের আসর থেকে যদি পাত্রী উধাও হয় তাহলে পাত্রপক্ষের খারাপ লাগা স্বাভাবিক না? আর ওরা ওতো বড়লোক মানুষ ওদের তো রাগ হবেই। তোমরা অযথা বেশি বুঝছো। চুপ করো তোমরা। নাতজামাই ঠিক মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে।”

শিউলি আহমেদের কথায় নিজেকে আশ্বস্ত করতে পারলেন না মিসেস. হেমা। হাঁসফাঁস করতে থাকলেন। তুষারকে কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলেন উনি।

অনেকক্ষণ ধরে নীলাদ্রের হাত ধরে কেঁদে চলেছি আমি। কান্না যেন ফুরচ্ছেই না। কোথায় যাব কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। নীলাদ্র আমাকে শান্তনা দিয়ে বলল….
–“কান্নাকাটি করলে তো চলবে না আনিশা। এভাবে করতে থাকলে তো ধরা পড়ে যাব। তুমি কি এখান থেকে যেতে চাও না?”

–“এখান থেকে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু আয়াশের জন্য আমায় যেতে হবে। বুঝতে পারছি না কোথায় লুকাবো?”

–“তুমি এখানেই দাঁড়াও আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। তোমার পায়ে লেগেছে যেতে পারবে না।”

ভয়ে ভয়ে ছেড়ে দিলাম নীলাদ্রের হাত। হয়ত সে চলেও গেল। সমুদ্রের পাড়ে গা ছমছমে পরিবেশে থাকতে ভয়ও করছে। পায়ে করছে যন্ত্রণা। রাতের জোয়ারভাটায় সমুদ্রের পানি আরো কাছে চলে এসেছে। হারহিম করা বাতাসে দুটো বাহু ধরে ঠকঠক করে কাঁপছি আমি। আর কারণ খুঁজছি হঠাৎ কেন আমার মতো অন্ধ মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে আয়াশকে। এর আগে উনি যেমন আমার উপকার করেছেন তেমনই বদনামও করে ছেড়েছেন। আমি নিশ্চিত উনিই আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার কারণে বদনাম হয়েছি আমি। এজন্যই দাদিমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করছেন। সেই সঙ্গে আমার মা-বাবাও!

প্রায় দশ-পনেরো মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে আছি একা। কিন্তু নীলাদ্র আসছে না। একসময় ভয় আমার মনে জমা হতে শুরু করল। এখন সাবুও নেই। আস্তে করে ডাক দিলাম…..
–“নীলাদ্র? নীলাদ্র? কোথায় তুমি?”

কোনে সাড়াশব্দ পেলাম না। ভয়ে আঁতকে উঠলাম। আজ যদি নীলাদ্র না আসে তাহলে জানি না কি হবে আমার! আস্তে করে পায়ের ধাপ ফেলতে লাগলাম। আর জোরে জোরে নীলাদ্রকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু কোনো লাভই হলো না। বিপাকে পড়ে কান্না পেলো আমার। চোখে ভরে এলো অশ্রু। আবারও চিৎকার করে ডাকলাম…..
–“নীলাদ্র?”

কোনো লাভই হলো না। সোজা হাঁটতে হাঁটতে কীসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলাম আমি। পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে যেই বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা খেলাম তাকেই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। অতঃপর আবিস্কার করলাম এটা কোনো বস্তু নয় আস্ত একটা মানুষ। তবে কি এটা নীলাদ্র? হবে হয়ত। এই রাতে ও ছাড়া কে থাকবে? ঝটপট করে ভয়ের চোটে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার শব্দ করে কেঁদে দিলাম।

–“এতোক্ষণ কেন একা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আসবে না আর।”

–“আর ইউ লস্ট মাই বিউটিফুল উডবি ওয়াইফ?”

কন্ঠস্বর শুনে আমার শরীর সহ আত্নাও কেঁপে উঠল। এটা নীলাদ্রের কন্ঠ নয়। লোকটার গরম নিশ্বাস আমার কাঁধে পড়ছে। হয়ত আমার দিকে ঝুঁকে আছেন। এক ঝটকায় ছেড়ে পিছিয়ে এলাম আমি। পিছিয়ে যেতেই থাকলাম। পায়ের নিচে বালিতে আমার বেনারসি গড়াগড়ি খাচ্ছে। নীলাদ্র কোথায়? মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার। কোনোকিছু ভাবনাচিন্তা না করেই পেছন দিকে ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার করলাম পায়ের নিচে পানি। আমি সমুদ্রের দিকে দৌড়াচ্ছি। সেখানেই থেমে গেলাম। ডান দিকে দৌড়াতে নিলে শাড়ির পায়ের নিচে পড়লে পেঁচিয়ে পড়ে যাই আমি সমুদ্রের পাড়ে হালকা পানিতে। ভিজে যাই জোয়ারভাটার বড় ঢেউয়ের কারণে।

–“শুধু শুধু পালানোর চেষ্টা করলে। লাভটা কি হলো? তোমার চিন্তাভাবনার প্রশংসা করতে হয়। বড্ড সাহস আছে তোমার।”

–“আ….আপনি কি করে আমায় খোঁজ পেলেন?”

আয়াশের কথায় পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি। কেননা এই প্রশ্নটাই মাথায় আমার ঘুরছে। নিজেকে ক্লান্ত লাগছে। আয়াশের হাসির শব্দ পেলাম।
–“তুমি ইন্টেলিজেন্ট! তবে কি জানো? আমি তোমার চেয়ে দ্বিগুন ইন্টেলিজেন্ট। টিনএজ মেয়ে তুমি। এমন পদক্ষেপ নিতে যে দুইবারও ভাববে না সেটা আমার জানা ছিল। তোমার ঘরে গিয়েছিলাম মনে আছে? তোমার একটা গয়নার সঙ্গে লোকেশন ট্র্যাকার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও একটা বিশ্বাস ছিল তুমি পালাবে না। কিন্তু তুমি সেটাই করলে। অন্য একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেলে।”

বেশ চিল্লিয়ে কথাগুলো বললেন উনি। এসব উনি করতে পারেন আমার ধারণারও বাইরে ছিল। চোখ বড় বড় করে সমুদ্রের নিচের বালি চেপে ধরে বসে আছি। একসময় প্রশ্ন করলাম…..
–“নী…নীলাদ্র কোথায়?”

সঙ্গে সঙ্গে আবারও আমার মুখ চেপে ধরলেন উনি। অন্যহাতে চেপে ধরেছেন আমার চুলের খোঁপা।
–“হুঁশশ…. নাম নেবে না ওর। মুখ সেলাই করে দেব তোমার। ভুল তুমি অনেক করে ফেলেছো। আমাকে আর রাগিও না ডার্লিং। আর ওই ছেলেটাকে অজ্ঞান করে রাস্তার মাঝখানে ফেলে দিয়ে এসেছি। এখন গাড়ির নিচে চাপা পড়লে সেটা গাড়ির দোষ হবে। তাই না?”

আমি কথায় বলতে পারছি না। নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়লাম আমি। মাথাটা ভার হয়ে আসছে। শক্তি কমে আসছে। একসময় চোখজোড়াও বন্ধ হয়ে এলো আমার। নেতিয়ে পড়লাম একেবারে। শেষবারের মতো অনুভব করলাম উনি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমার কানে আসছে উনার চমৎকার কন্ঠে বলা কিছু অস্পষ্ট কথা।

–“যার হাসিতে আহত হয়েছি
তাকে এতো সহজে ছাড়ি কি করে বলো?
যার চোখে নিজের ভালো থাকা দেখেছি
তাকে এভাবে হারায় কি করে বলো?
তাকে যে রেখেছি #মনের_অন্দরমহলে
সেই অন্দরমহল থেকে তাকে কেউ বের করতে পারবে না।”

চলবে…..

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here