#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
১১.
রুশা আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে। রুশা কিছু বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছে না। রুশার সন্দেহ হচ্ছে, মনে হচ্ছে এখানে সাংঘাতিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সেজানের দিকে তাকাল। সেজান মাথা নিচু করে রেখেছে। শুধু সেজান না বাকি সবাই মাথা নিচু করে আছে।
রুশা আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশের মুখ থমথমে। রুশা ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,
“আমরা কোথায় আছি?”
আদ্রিশ রুশার দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ওয়েলকাম টু মাই জাহান্নাম।”
রুশার বুক কেঁপে উঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“জাহান্নাম!”
রুশার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আদ্রিশ ওর এক বাহু চেপে ধরে বলল,
“তোকে কি বলেছিলাম? যা খুশি করবি, মেনে নেব। কিন্তু ধোঁকা দিস না। ধোঁকা একদম সহ্য করতে পারি না।”
রুশা আমতা আমতা করে বলল, “ধোঁকা?”
আদ্রিশ ওর হাত আরো জোরে চেপে ধরে বলল,
“হ্যা ধোঁকা। সামনে থেকে ছুরি মারলে সহ্য করে নিতাম। কিন্তু তুই তো পেছনে থেকে ছুরি মেরেছিস। জারিফকে কি করে চিনিস? ওর সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?”
“জারিফ কে? আমি তাকে চিনি না।”
আদ্রিশ ওর গলা চেপে ধরে বলল,
“জারিফকে চিনিস না? সকাল বেলায় অফিসের নিচে জারিফের লোকের সাথে কি করছিলি? ও তোকে জড়িয়ে ধরল কেন? ওর সাথে তোর কি কথা হয়েছে? কি বলেছিস ওকে? কিসের ইনফরমেশন দিচ্ছিলি? তোর মতো অনাথ মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই এতদিন ধরে তার প্রচুর দাম দিয়েছিস। এখন আমি তার দাম দেব। আর সেটা হলো মৃত্যু। ভয়ানক মৃত্যু।”
রুশা আদ্রিশের হাত সরানোর চেষ্টা করছে ওর গলা থেকে। শ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে মারা যাবে। আদ্রিশ ওর গলা থেকে হাত সরাচ্ছে না। আদ্রিশ হঠাৎ ওর গলা ছেড়ে দিল। ও ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল।
রুশা হাঁপাতে লাগল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আদ্রিশ ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল,
“এটা কেন করলে? আমি কিসের কমতি রেখেছিলাম? কেন আমাকে এত বড় ধোঁকা দিলি?”
রুশা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
“আরে কি বলছেন? আমি কিছু করিনি। আমি চিনি না ওকে। জারিফ কে তাও জানি না। বিশ্বাস করুন আমাকে।”
“নাটক করছিস? নাটক করবি না। ও নিজে বলেছে।”
রুশা আকুতি মিনতি করছে।
“আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি মিথ্যা বলছি না। ও আপনাকে মিথ্যা বলেছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র।”
আদ্রিশ ওর লোকদের ইশারা করল। ওরা এগিয়ে এলেই রুশা চেঁচিয়ে বলল,
“একদম আমার গায়ে হাত দিবেন না। খবরদার!”
আদ্রিশ রুশার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। রুশা বারবার অনুরোধ করছে ওর কথা শোনার জন্য। কিন্তু আদ্রিশ শুনছে না। একটা খাঁচার সামনে নিয়ে এল। খাঁচার উপর থেকে পর্দা সরাতেই রুশা চিৎকার করে উঠল।
আদ্রিশ খাঁচার বাঘ দেখিয়ে বলল,
“এই হচ্ছে চরিত্রহীন, ধোঁকাবাজির শাস্তি।”
রুশা আদ্রিশের হাত ধরে ভয়ে চিৎকার করছে আর কাঁদছে। কান্নার মাঝে বারবার বলছে,
“ওরা আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমি সত্যিই কিছু করিনি।”
আদ্রিশের চোখের কোনে পানি জমেছে। সেজান ওর দিকে চেয়ে আছে। অনেকগুলো বছর ধরে আদ্রিশকে চিনে। ওর চেয়ে ভালো ওকে আর কেউ চিনে না। ও যখন অন্য কাউকে শাস্তি দেয় তখন ওর চোখে মুখে তৃপ্তি থাকে। ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি থাকে। কিন্তু আজ ওর মুখটা ফ্যাকাসে, চোখে ব্যথা ফুটে উঠেছে। প্রিয়তমা স্ত্রীকে শাস্তি দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
আদ্রিশ রুশাকে ওর মুখের বরাবর করে বলল,
“দেখো, আমার চোখে পানি। আমি কাঁদছি। আদ্রিশ কোনো মেয়ের জন্য কাঁদছে। এর অর্থ বুঝো? বুঝলে আমাকে হার্ট না করে ভালোবাসতে।”
সেজান সাহস জুগিয়ে বলল,
“ভাই, ভাবীকে একটা সুযোগ…..
আদ্রিশ ওকে থামিয়ে বলল,
” আমার আইন সবার জন্য সমান। ওকে শাস্তি পেতেই হবে।”
রুশা আকুতি নিয়ে বলল,
“আমার খুব ভয় করছে। আমাকে ওই খাঁচায় দেবেন না। প্লিজ। আপনি যদি আজ এই ভুলটা করেন তবে খুব শীঘ্রই আপনাকে পস্তাতে হবে। নিজের হাতে নিজের নির্দোষ
স্ত্রীকে হত্যার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো?আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন তো?”
আদ্রিশের মনটা হঠাৎ গলে গেল। সেজানের দিকে তাকাল। রুশাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ওকে নিয়ে এসো।”
সেজান সেই ছেলেটাকে নিয়ে এল। ওকে বেধড়ক মার মারা হয়েছে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। হেলেদুলে হাঁটছে। কোনো রকম প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে এমন।
আদ্রিশ ওকে দুহাতে তুলে বলল,
“তোকে ছেড়ে দেব, যদি সত্যিটা বলিস। তোকে তোর মালিকের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। রুশার সাথে তোর কি সম্পর্ক? সত্যি করে বলবি।”
রুশা ওকে দেখে বলল,
“ওকে আমি চিনি না। আমি অফিসের ভেতরে যাব তখন কোথায় থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি সরিয়ে রাগ দেখিয়ে বললাম আপনি কে,উনি দুহাত উঁচু করে সরি বলে চলে যায়। কোনো সিনক্রিয়েট করিনি, আপনাকেও বলিনি যদি আপনি রেগে যান তাই।”
আদ্রিশ লোকটাকে লাথি মেরে বলল,
“ও যা বলছে ঠিক বলছে? ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই? একটা সত্যি কথার জন্য বেঁচে যেতে পারিস।”
লোকটা অবশেষে বলল,
“মালিক সাজিয়েছে ঘটনাটা। উনার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মালিক আপনাকে ভাঙতে চেয়েছিল।”
আদ্রিশ আর বাকি সবার বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। রুশা কান্নার মাঝেও হেসে ফেলল। আদ্রিশ ওকে একটা লাথি মেরে বলল,
“অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিস। আজ সত্যিই আমি ভেঙেচুরে যেতাম। চল তোর মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেই।”
আদ্রিশ একটা লম্বা রড তুলে ওর মুখে বারি মারল। মুখটা প্রায় থিতলে গেল। রুশা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। আরেকটা বারি মাথায় মারল মাথা দিয়ে টগবগিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। লোকটা হাত পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁপে নিস্তেজ হয়ে গেল। রুশা এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে মেঝেতে ঢলে পড়ল। আদ্রিশ ওকে দেখে হাতের রড ফেলে ওর কপালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিল।
.
রুশা ঘুমের মধ্যে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর ঠোঁট কাঁপছে। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আদ্রিশ ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুশার হঠাৎ জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে আদ্রিশকে দেখে ভয়ে ছিটকে সরে গেল। তারপর চারদিকে চেয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে।
আদ্রিশ ওকে আশ্বস্ত করে বলল,
“তুমি সেফ আছো। বাড়িতে আছো।”
রুশা বিছানা থেকে নেমে গেল। ভয়ে ভয়ে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ বুঝতে পারছে রুশা বেশ ভয় পেয়েছে। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। রুশা কখনো আদ্রিশের বিরুদ্ধে যাবার কথা ভাবতেও পারবে না।
আদ্রিশ উঠে দাঁড়াতেই রুশা ভয়ে ভয়ে বলল,
“আমার কাছে আসবেন না প্লিজ।”
আদ্রিশ ওর কথা না শুনে ওর কাছে গিয়ে জোর করে জড়িয়ে ধরল। রুশার হার্টবিট দ্রুত চলছে। শ্বাস উঠানামা করছে।
“সরি রুশা! আ’ম সরি। একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য তোমাকে সাফার করতে হলো।”
রুশা এখনও ওই দৃশ্য ভুলতে পারছে না। মনে হচ্ছিলো মরেই যাবে। আদ্রিশ ওর প্রতি দয়া করবে না। ওর ভয়ংকর একটা মৃত্যু হতে যাচ্ছে।
.
আদ্রিশের মন-মেজাজ ভালো নেই। জারিফ বিদেশে বসে বসে কল-কাঠি নাড়ছে। ওর স্ত্রীর দিকে নজর দিয়েছে। ওকে টার্গেট করে আদ্রিশের ক্ষতি করতে চেয়েছে। আর ও সে ট্রাপে পড়েও গিয়েছিল। আজ রুশাকে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলছিল। রুশা এতবার করে বলল বিশ্বাস করেনি।
আদ্রিশ ঘরে এসে দেখে রুশা এক কিনারে শুয়ে আছে। যেকোনো সময় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আদ্রিশ ওকে টেনে বিছানার মাঝে নিয়ে এল। রুশার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে আছে। ওর কপালে, গালে, নাকে হাত বুলালো। রুশা একটু নড়ে-চড়ে উঠে। আদ্রিশ ওর নাকের ডগায় ঠোঁট ছুয়ালো। রুশা জেগে উঠল। আদ্রিশকে এত কাছে দেখে ঘাবড়ে গেল। রুশা কপাল কুঁচকে কিছু বলতে গেলে আদ্রিশ ওর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ওর গলায় নাক ঘঁষলো। রুশা জমে ফ্রিজ হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের উপর থেকে আঙুল সরিয়ে ওর কপালে, গালে চুমু খেয়ে বলল,
“বড্ড ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু ধোঁকাটা আমি নিতে পারি না। খুব যন্ত্রণা হয়। মাথা খারাপ হয়ে যায়। মাথায় খুন চেপে যায়। একটা দফারফা না করা পর্যন্ত শান্তি পাই না। তাই ভুল করে ফেলেছি। রুশা আমি তোমাকে মারার কথা ভাবতে পারি না। এখন থেকে আমি তোমাকে আরো আগলে আগলে রাখব। কারো ছায়া পড়তে দেব না।”
রুশা কিছু বলল না চুপচাপ ওর কথা শুনল। আদ্রিশ রুশাকে বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করল।
সকালে রুশার ঘুম ভাঙার পরেও নিজেকে আদ্রিশের বুকে আবিষ্কার করল। আদ্রিশ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। যেন আগলেই রেখেছে। রুশা নিজেকে আদ্রিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল। কোনো এক সময় স্বপ্ন দেখতো স্বামী, সংসার, একজন ভালোবাসার মানুষ হবে, যে সব সময় আগলে আগলে রাখবে। সব সময় তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে, দিনের সূচনা করবে। রুশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে সব বদলে গেল।
।
আদ্রিশ অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। রুশা টেবিল সাজাচ্ছে। আদ্রিশ ডাইনিং টেবিলে খেতে বসবে তখন সেজান এলো। রুশা ওকেও খেতে দিল। আদ্রিশ খেতে খেতে সেজানকে বলল,
“মন্ত্রী সাহেব আগামীকাল আমাদের বাড়িতে আসবে। তার সিকিউরিটির সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করো। আর হ্যা কেউ যেন জানতে না পারে। মিটিংটা কিন্তু গোপন থাকবে নয়তো মন্ত্রী মশাইকে জবাবদিহি করতে হবে।”
সেজান আশ্বস্ত করে বলল যাতে কোনো চিন্তা না করে।
.
কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল অন্যরকম। মন্ত্রী মশাই
বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মিডিয়া এসে হাজির। একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে মন্ত্রী গোপনে কি কাজে এসেছেন? এরকম নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি যাওয়ার সময় আদ্রিশের উপর রাগারাগি করেছেন প্রচুর। আদ্রিশকে আর কোনো কাজে সাহায্য করবেন না বলে গেছে। আদ্রিশ তাই ক্ষেপে আছে, সেজানের উপর সব রাগ ঝেরেছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না কে জানাল। কারণ সেজান ছাড়া আর কেউ জানে না এই ব্যাপারে। তখনই আদ্রিশের হঠাৎ মনে পড়ল রুশা ওদের সাথে খাচ্ছিল। তখন ও বলেছিল কথাটা। না চাইতেও ওর দিকে সন্দেহের আঙুল পড়ল। কিন্তু আদ্রিশ মুখে কিছু বলতে পারছে না। ঘরে গেল রুশার সাথে কথা বলতে। বিছানার উপরে ওর মোবাইল পেয়ে সেটা হাতে তুলে নিল। মোবাইল নিয়ে চুপচাপ নিজের আলাদা রুমে চলে গেল। পুরো মোবাইল ঘেটে তেমন কিছু পেল না। আর এদিকে রুশা মোবাইল খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত। ওর কথাকে কল দেওয়া প্রয়োজন। আদ্রিশকে দরজার সামনে দেখে বলল,
“আমার মোবাইল দেখেছেন?”
আদ্রিশ মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“বসার ঘরে রেখে এসেছিলে। সামলে রাখো।”
আদ্রিশ ঘর থেকে চলে গেল। রুশা মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর স্পষ্ট মনে আছে মোবাইল বিছানার উপরে রেখেই ওয়াশরুমে গিয়েছিল। আদ্রিশ ওকে মিথ্যা বলল কেন? আর ওর মোবাইল নিয়ে কি করছিল? আদ্রিশ কি আবারও ওকে সন্দেহ করছে?
আদ্রিশ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবছে তাহলে কি সেজান? এতদিন ধরে সেজান ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? এত বড় ধোঁকা?
চলবে..
(এখন থেকে রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করব।)