ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 7

0
1503

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

০৭,,

তিলো নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় না দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে কারো সামনে নিজের স্বাভাবিক প্রকাশ ভঙ্গিমায় কোনো বিকার আনবে না। এই চুক্তিটা সে নিজের সাথে করে ফেলেছে। এরপরও মাঝে মাঝেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, তা সে বুঝতে পারছে। তিলো দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। সে থাকবে না এখন বাড়িতে। সে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার আগে আনিস সাহেবের সাথে ওর দেখা হলো। আনিস সাহেব সবটা বুঝতে পেরেও অনাবশ্যক অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় ওকে জিজ্ঞাসা করলেন,

-কোথায় যাচ্ছিস তিল?

তিলো নিজের কন্ঠস্বরকে স্বাভাবিক করে বললো,

-আমার বন্ধুর বাড়িতে।

আনিস সাহেব কন্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,

-আজকে যাসনা।

তিলো কিছু সময় থমকে দাঁড়িয়ে কথাটা গুছিয়ে নিলো নিজের মস্তিষ্কে। এরপরই বললো,

-আজকে যাই আব্বু। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবো।

-একটু সহ্য করে নে মা। ভেবে দেখ, তুই না থাকলে কথা উঠবে এটা নিয়ে।

তিলো নিজেও এবার ভেবে দেখলো। আসলেই, ও না থাকলে কথা উঠবে। অন্তত ওর ফুফু অর্থাৎ ফাহাদের মা, যার কিনা অভ্যাসই যেকোনো তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে উপস্থাপন করা, সে তুলবেই। এবার বোধহয় তিলো তুলির কেচ্ছায় ছাড় পেতেও পারে। তিলো চলে গেলে, এটা ওর দূর্বল মনোবলের পরিচয় দেবে। সে অতীত ভুলে এগিয়ে যেতে পারে না, এমনটাই ভাববে সকলে, যা তিলো একদমই চায়না। খোঁটা দিতে কেউ পিছু হটবে না।
তিলো থেমে গেলো। সে আর গেলোনা। তাকে প্রমাণ করতে হবে, সে ফাহাদের পরোয়া করে না। সেদিনের অপমান ওকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিতে পারেনি।

তিলো আনিস সাহেবের দিকে তাকিয়ে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বললো,

-ঠিক আছে আব্বু, আমি যাচ্ছি না।

আনিস সাহেব তিলোর এই সিদ্ধান্তে যেন খুশিই হলেন। তিলোকে একটা মমতামিশ্রিত এবং তিনি যে ওর সিদ্ধান্তে খুশি এমন প্রকাশক হাসি উপহার দিয়ে আবারও বাজারে বের হলেন মিষ্টি কিনতে। তিলো ফিরে এলো নিজের রুমে। সেই অপমানটা তিলো আজও ভুলতে পারেনি। তিলোর হঠাৎই মনে হলো, ও কি সত্যিই ফাহাদকে এতোটা ভালোবেসেছিল কখনো? ফাহাদের অপমানে ও আসলে লজ্জিত। আর কিই বা হতে পারে সে? সে সত্যিই কখনো মরতে চায়নি ফাহাদকে হারিয়ে। তাহলে তো উপায় ছিলো মরার। কিন্তু ও মরেনি। তিলোর সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন ও আর সহ্য করতে না পেরে ফাহাদকে সরাসরি নিজের মনের কথা বলে ফেলেছিলো–

ফাহাদ, তিলোর ফুফু আর ফুফা এসেছিলো সেদিন তিলোদের বাড়িতে ফাহাদের বিয়ের দাওয়াত দিতে। সাথে চাচাদের বাড়ির সবাই, দাদীসমেত। ফাহাদ ফুফুর একমাত্র ছেলে, তাই আয়োজনটাও বড় করে করছেন তারা। তিলো জানতো ফাহাদের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। যেদিন থেকে জানতো, সেদিন থেকেই ওর ভেতর তীব্র অসন্তোষ আর অস্থিরতা শুরু হয়। তিলো কিশোরী বয়স থেকেই ফাহাদের প্রেমে পড়েছিলো। মধ্যবিত্তরা আসলেই বোধহয় প্রথম প্রেমের স্বাদ পায় কাজিনের থেকে। তিলো নানাভাবে ফাহাদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কোনোকিছুতেই লাভ হয়নি। আসলে এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং ইচ্ছাকৃত ছিলো। ফাহাদ বুঝেও বরাবর না বোঝার ভান করে গিয়েছে। তিলোও বুঝতে পারতো বিষয়টা। সেদিন যখন ওরা তিলোদের বাড়িতে আসলো, তিলো ঝোঁকের বশেই কাজটা করে ফেলেছিলো।
ফাহাদ তখন তিলোদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। ঠিক দাঁড়িয়ে ছিলো না। ও তখন কলির সাথে একান্তে কথা বলতেই ছাদে একা উঠেছিল। তিলো এমনই একটা সুযোগ চাচ্ছিলো মনে মনে। সেও একান্তেই ফাহাদকে বলতে চায়।

ফাহাদ কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে রেখে রেলিঙের উপর হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকালের লাল টুকটুকে সূর্যটার দরুন রঙিন আকাশটা দেখছিলো। কলির সাথে কথা বলে মনটাও ফুরফুরে ছিলো তার। মাঝে মাঝেই কিছু কথা মনে পড়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো। তিলো ওর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। ও ছিলো সিঁড়িঘরের সাথে লাগোয়া চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে। ফাহাদের কথা শেষ হতেই ও ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ফাহাদ আগেই টের পেয়েছিলো ওকে। তিলোর শরীর থেকে হু হু করে বাতাসের সাথে মিলিয়ে যাওয়া আচ্ছন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতাযুক্ত পারফিউমের সুঘ্রাণটা আগেই ফাহাদের নাকে এসে ঠেকেছে। ফাহাদ ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে, তিলো আজকে সেজেছে। সে ফাহাদের পছন্দের লাল খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। হালকা মেকআপ করেছে।

ফাহাদ মৃদু হেসে ওর দিকে না ফিরেই বললো,

-তিলোত্তমা, আজ এভাবে সাজলি যে?

‘তিলোত্তমা’! হ্যাঁ, ফাহাদ ওর ভালো নাম ধরে ডাকে। তিলো জানে যে, ফাহাদ জানে তিলোর সাজের কারণ। এরপরও অমূলক একটা প্রশ্ন করলো। তিলো যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই অসভ্য মস্তিষ্ক! সে যে মাঝে মাঝেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে, তিলো নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফাহাদের একটা হাত নিজের দুইহাতে স্যান্ডউইচের মতো করে আঁকড়ে ধরলো। ও জানে না তখনও ও কি করছে! কেবল ওর মস্তিষ্ক বলছে, তিলো কিছু করো। কিছু করো বড্ড দেরি হয়ে যাওয়ার আগে৷ তিলো এতোদিন ফাহাদের জন্য জমিয়ে রাখা সমস্ত ভালোবাসা তার চোখজোড়ায় ধারণ করে নমনীয় আবেদন এবং একইসাথে প্রেমময় কন্ঠে বললো,

-ফাহাদ ভাই, তুমি কি সত্যিই বোঝো না আমার অনুভূতিগুলোকে? আমি জানি, তুমি বুঝতে পারো। এরপরও কেন তুমি আর কাউকে বিয়ে করছো আমায় রেখে? আমি আমার সবটা উজাড় করে তোমাকে ভালো রাখবো। চেষ্টা করবো আমার সবটুকু দিয়ে৷ আমি যে থাকতে পারবোনা তোমাকে ছাড়া। কেন বোঝো না তুমি? আমি জানি, আমি দেখতে খারাপ। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলোর চেহারা এমন নয়। আমি সত্যিই তোমাকে ভালো…।

কথাটা তিলো শেষ করতে পারলোনা। ফাহাদ একটানে নিজের হাতটা ওর হাতের তৈরি খাঁচা থেকে মুক্ত করে নিলো। তিলোরও হঠাৎই বোধোদয় হলো। সে কি করলো এটা! কথাগুলো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিলো, যেগুলো তিলোর গভীর আবেগের প্রকাশরূপ। তিলোর নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের পঙক্তিমালা। হয়তো বাঁধা না পেলে সেটা আরো বিস্তৃত হতো। ফাহাদের চোখজোড়া! সেটাই তো তিলোকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে ফেলার মাদক।
তিলোর লজ্জায় এখন নিজেকে নিজেরই খুন করতে ইচ্ছা করছে। সে বোকামি করেছে। সে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে, সে যে দুঃখিত সেটা প্রকাশ করতে যাবে, তার আগেই তিলোর গোলগাল মুখটায় একটা থাপ্পড় পড়লো। তিলো নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও পায়নি৷ ফাহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,

-তোর সাহস কি করে হলো রে তিল? লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছিস নাকি?

তিলো আবারও কিছু বলার চেষ্টা করলো। ফাহাদ সে সুযোগ ওকে দিলো না। সে আবারও বললো,

-নিজেকে তো রোজই আয়নায় দেখিস, স্বীকারও করলি। এরপরও কিভাবে তুই আমার পাশে দাঁড়াতে চাস? এই শিক্ষা দিয়েছে মামা মামী তোকে? আমার বিয়ে ভাঙতে চাস? তোর রূপ তো কেউ পছন্দ করে না। এরপরও!

তিলো আবারও কিছু বলবে তখন ফাহাদ সেখান থেকে চলে আসতে আসতে বললো,

-বড্ড বেড়েছিস তুই। আজ এর একটা বিহিত করেই আমি ছাড়বো।

তিলোর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ ভুলটা করে ও যথেষ্ট লজ্জিত। লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। আসলে ও চায় কি ও নিজেও বুঝতে পারছে না। ফাহাদের বিয়ে ভাঙতে ও পারবে না। তবুও এই বৃথা চেষ্টার মানে কি? তিলো তখনও বুঝতে পারেনি, ফাহাদের এই আচরণটুকু ছিলো আসলে কোনোকিছুর শুরু। কিছু একটার শুরু। ফাহাদের এই আচরণটুকু কিছুই নয় আসলে।
তিলো নিজের চোখ মুছে নিচে গেলো। ফাহাদ আগেই নেমে এসেছে। কাজল লেপ্টে ওকে এখনই বরং বাজে দেখাচ্ছে।
তিলো নিচে নামতেই তিলোর গালে দ্বিতীয় থাপ্পড়টা পড়লো যেটা নাসিরা পারভীন দিলেন। সবার সামনে লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে। তিলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো ওনার দিকে। ওনি নিজেও কেঁদে দিয়ে চিৎকার করে বললেন,

-বেহায়া মেয়ে কোথাকার! এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? ভাইকে নিয়ে এমন কথা ভাবলি কিভাবে? ভাইকে এই জঘন্য প্রস্তাব কোনো কলঙ্কিনিও দেয়না। আমার পেটের কলঙ্ক তুই। নষ্টা মেয়ে কোথাকার! হারা**। বে**।

নিজের মায়ের মুখে গালিগুলো তিলোর খুব গায়ে লাগলো। নাসিরা পারভীনকে আনিস সাহেব শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিলোর আরো বেশি কান্না পাচ্ছে। সত্যিই মনে হচ্ছে, ও মরে যাক। তিলো আরো বুঝতে পারলো, ফাহাদ ঘটনাটাকে আরো রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করেছে। না হলে নাসিরা পারভীন এমন কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করার মতো মহিলা নন। তিলোকে ওর ফুফু, দাদী, চাচীও অনেক কিছু বললো, যার একবর্ণও ওর কানে ঢোকেনি। ও তো কেবল ওর মায়ের দেওয়া আঘাতটা সামলাতে মরিয়া তখন মনে মনে। তিলো বেশি সময় সেখানে দাঁড়ালো না। ও নিজের ঘরে চলে এলো। দরজাটা বন্ধ করে সেই দরজাতেই পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। এখন আর ও কাঁদছে না। ফাহাদের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তিলোকে যখন কথা শোনানো হচ্ছিলো, সে তখন ছিলো একদমই নির্বিকার। তিলোর সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফাহাদ কতোটা রঙ চড়িয়েছে, সেটা তিলো তার মায়ের বলা গালিগুলো থেকে আন্দাজ করতে পারছে। জঘন্য প্রস্তাব! সেটা তিলো কখন দিলো। তিলো যেন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে।
ঘটনাটার পর ওরা আর বসলো না। ফিরে গেলো সকলে। এরপর তিলোর দরজায় নক পড়লো। তিলো প্রথমে নিজের ধ্যানে থাকায় শুনতে পেলো না৷ তবে আনিস সাহেব ডাকাডাকি শুরু করতেই ও আর ওনার ডাক উপেক্ষা করতে পারলোনা। তিলো দরজা খুলে দিলে আনিস সাহেব ওর রুমে ঢুকলেন। তিলো কিছু বললো না। আনিস সাহেব স্নেহমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

-ছোটমা! আমি জানি তুমি এমন কোনো কথা ফাহাদকে বলোনি৷ আমি জানি তুমি ওকে ভালোবাসো৷ কিন্তু এমন কথা বলার মেয়ে তুমি নও, সে বিশ্বাস আমার আছে কারণ আমি তোমার বাবা। যে যাই বলুক মা, তুমি কিন্তু ভেঙে পড়ো না৷

তিলো এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা, ওর শরীরের হাড়গুলো যেন উবে গিয়েছে। ও আনিস সাহেবের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো হঠাৎ। ডুকরে কেঁদে উঠলো। আনিস সাহেবের হৃদয় ভেঙে গিয়েছে মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে। তিনি বুঝতে পেরেও তখন কিছু বলতে পারেননি। ফাহাদ অপরাধী হয়ে যেতো না হলে, আর তাদের আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো নষ্ট হতো। কারণ সংখ্যাগুরু সমর্থন ফাহাদ পেতো। প্রথমত উপলক্ষটা ফাহাদ কেন্দ্রীক এবং তার থেকেও বড় কারণ বাড়িতে ছেলেদের পক্ষ নেওয়া হয় বেশি। মূল মুরব্বিরা, তারা ফাহাদের পক্ষে। ফাহাদও হয়তো এতোটা হবে ভাবেনি৷ মানুষ একটা শুনে রঙ চড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু বেশিই করে ফেলে। সেটা হতে পারে অনিচ্ছাকৃত বা হয়তো ইচ্ছাকৃত।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here