ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 6

0
1583

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

০৬,,

তিলো ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখতে পায়, আনিস সাহেব ইশানকে কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তুষার বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে সার্কাসের ক্লাউনের মতো হাত পা নাড়িয়ে ওকে দেখাচ্ছে, যাতে ওর কান্না থেমে যায়। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। বাচ্চাটা গলা ছেড়ে সর্বোচ্চ যতোটা বড় করা যায় গাল ততটা বড় করে চিৎকার করে কাঁদছে। মাঝে মাঝে কাঁশছে। আবারও কাঁদছে। তিলোর অবাক লাগে, ও তো একটা মানবশিশু। কিভাবে এতো চিৎকার করে কাঁদতে পারে! গলা চিড়ে কি মনে হয় না, এখন থামা উচিত?

তিলোর মনে প্রশ্ন জাগছে, নাসিরা পারভীন এবং তুলি কোথায়? আনিস সাহেব ফিডারটার মুখ খুলে ইশানের মুখে দিলো। ইশানের কান্নার দরুন ও বিষম খেলো। আনিস সাহেব ওর পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে মুখ থেকে আহ্লাদ মেশানো কিছু শব্দ উচ্চারণ করছেন। তিলোর দেখে বেশ হাসিও পাচ্ছে। ছেলেরা বাচ্চা সামলাতে কিভাবে নাকের জলে চোখের জলে এক হয়, সেটা আজকে স্ব চোখে দেখে তিলো এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতে পারছে মনে মনে। তিলো ঠোঁট টিপে হেসে ড্রইং রুমে ঢুকতে ঢুকতে ওদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-আম্মা কই?

তুষার ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,

-আম্মা আর তুলি আপু মার্কেটে গিয়েছে।

কথাটা শুনে তিলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ওকে রেখে তারা মার্কেটে গিয়েছে! তিলো উত্তেজিত হয়ে বললো,

-কি! আমাকে বাদ দিয়ে কিভাবে মার্কেটে যেতে পারে তারা! একবার বললোও না যে যাবে।

তিলোর কান্না পাচ্ছে। আনিস সাহেব তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-ছোট মা দেখ না, এই ছেলেকে সামলাবো কি করে আমি? তুই একটু কিছু কর। ওর কি লাগবে, তাতো বুঝতে পারছি না।

তিলো ভগ্ন কন্ঠে বললো,

-আমি জানবো কি করে? বাচ্চাকাচ্চা সামলিয়েছি কোনোদিন। যার বাচ্চা, তাকে ফোন করো গিয়ে।

কথাটা বলেই তিলো নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। ওরা বুঝতে পারছে তিলোর রাগের কারণ। তিলো এইসমস্ত মার্কেটিং, সাজগোজ, অনুষ্ঠানাদির বিষয়ে একটু বেশিই আগ্রহী। একটু না। বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহী। ফাহাদের বিয়েতে তার যাওয়া হয়নি বলে ক্ষেপে যেতো। কিন্তু সেখানে নিজের ভালোর একটা বিষয় ছিলো বলে, সে শান্ত আছে।

তিলো রুমে ঢুকে রাগে গজগজ করছে। ওরা ওকে ফেলে চলে গেলো! ভাবতেই রাগ হচ্ছে। এর ভেতর ইশানের কান্না কানে যেতে বিরক্ত হলেও ওর মায়াও হচ্ছে। বাচ্চাটার কান্না সহ্য করা দ্বায়। তিলো রুম থেকে বেরিয়ে আনিস সাহেবের কোল থেকে ওকে নিজের কোলে নিলো। ওকে ভালো করে পরখ করে ওর ডায়াপার পরিবর্তন করে দিলো, তারপর ফিডার খেতে দিলো। বাচ্চাটা ক্লান্ত ছিলো। ওর কোলে ঘুমিয়েই পড়লো।
ইশান ঘুমিয়ে যেতেই আনিস সাহেব আর তুষার যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে এমন ভঙ্গিমায় বসলো যেন, সারাদিনে কনস্ট্রাকশন লেবারের কাজ করে এসেছে। আনিস সাহেব খুশি হয়ে বললেন,

-বাঁচালি মা আমাদের। বাচ্চা সামলানো আসলেই কঠিন। একটা মেয়ে কি করে এতোটা পারে!

তিলো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-যার বাচ্চা, তার বোধ নেই? এভাবে ফেলে যায় কেউ?

-রাগ করিস না। তোকে আমি মার্কেটে নিয়ে যাবো। তোর যা পছন্দ কিনে নিস।

-লাগবে না আব্বু। আমি আর কখনো মার্কেটে যাবো না।

তিলোর গাল ফুলিয়ে বলা অভিমানের কথা শুনে আনিস সাহেবের হাসি পাচ্ছে। তিনি নিজেকে সামলে নিলেন তারপরও। এখন হাসা ঠিক হবে না তিলোর সামনে।

কিছু সময়ের নিস্তব্ধতার পর আনিস সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনই তিলো আঙুল ঠোঁটে দিয়ে ইশারা করলো থেমে যেতে। তিলো ইশানকে কোলে নিয়ে তুলির ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসে ওদের সামনে বসলো। কর্কশ কন্ঠে তিলো তুষারকে বললো,

-তা তোর মা আর বোনের মহৎ উদ্দেশ্যটা কি শুনি?

-ওই তো কাল…।

তুষার কথাটা শেষ করার আগেই আনিস সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-ইশানের কি কি প্রয়োজন যেন বললো। চলে আসবে তাড়াতাড়ি।

তিলো ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

-আসুক আর না আসুক, তাতে আমার কি? তারা যখন আমার কথা ভাবে না, তখন আমি ভাববো কেন?

তুষার ফোঁড়ন কেটে বললো,

-ঠিকই তো। তুই কেন ভাববি?

তিলো অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোকে জিজ্ঞাসা করিনি আমি। সো, মুখ বন্ধ রাখ।

তুষার আর কোনো কথা বললো না। তিলো ওখান থেকে নিজের রুমে চলে আসলো।

ওরা ফিরে আসলে তিলো দেখতেও বের হয়নি কার জন্য কি আনা হয়েছে। রাতে খেতে বসেও কথা বলেনি ওদের সাথে। ওরাও কেউ সেদিকে পাত্তা দেয়নি। সাধারণত এমন হয়না। এবার হওয়ায় তিলো অবাক হওয়ার পাশাপাশি, ওর অভিমানটাও বাড়লো। ও একবার ভেবেছিলো নিজে বলবে। পরে আর বলেনি।

পরদিন শুক্রবার হওয়ায় তিলো ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। ব্রাশটা গালে নিয়ে সারা বাড়ি চক্কর দিতে গিয়ে তিলোর চক্ষু চড়কগাছ। আজকে বাড়িতে সে বিশাল আয়োজন। ওর মা, কাজের মহিলা আর তুলির মাঝে বিরাট ব্যস্ততা। তিলো দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতেই ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতে একটা বাটি নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘সর, সর সামনে থেকে। পুড়ে মরবি তো।’

তিলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো সরে দাঁড়িয়ে তুলিকে জিজ্ঞাসা করলো,

-এতো আয়োজন কিসের আপু? কেউ আসবে?

তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বললো,

-আসবে তো। তুই একটু ইশানকে দেখ না বোন। আমার হাতে অনেক কাজ।

তিলো গালের থুথু ডাইনিং এর বেসিনে ফেলে মুখ ধুয়ে নিয়ে বললো,

-কারা আসবে?

ওর প্রশ্নটা হয়তো কারো কানে ঢুকলো না। ঢুকলেও কেউ পাত্তা দিলো না। ও এবার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো। নাসিরা পারভীন এবার নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,

-সবাই আসবে। তোমার ফাহাদ ভাইয়া নতুন বিয়ে করেছে। তাদের তো একবার অন্তত দাওয়াত করে খাওয়াতে হয়, নাকি?

ফাহাদের নাম শুনে তিলো থমকে গেলো। আজকে সে আসবে! নতুন বউ নিয়ে আসবে! তিলো কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-নতুন বউ আসবে?

নাসিরা পারভীন এবারও আগের মতো স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-নতুন বউ কি তিল? ভাবি বলো। তোমার থেকে কলি একবছরের বড়।

কথাটা বলে ওনি পোলাওতে ঘি ঢাললেন। তিলোর হঠাৎ করেই খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ফাহাদের বউয়ের নাম তাহলে কলি। তিলো এইমাত্র জানতে পারলো। এই কয়েকদিন ভুলে ছিলো। আজ আবারও ওদের আসা লাগছে! তিলোর মনে হচ্ছে, কেন ওর মা আগে বললো না, তাহলে ও নানাবাড়ি চলে যেতো অন্তত। ফাহাদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস ওর নেই।

তিলো ওখানে আর দাঁড়ালো না। সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ওদের ওর দিকে খেয়াল করার সময় হাতে নেই। বুক ফেটে কান্না আসছে তিলোর আবারও আজ। হঠাৎ মনে পড়ায় কষ্টটা বেশি হচ্ছে। কলি ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, ওর পাশে বসে তিলোর বাড়িতেই ডাইনিং এ বসবে, ভাবতেই ভেতরটা মুচড়ে উঠছে তিলোর।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here