মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:২০

0
1144

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#অন্তিম_পর্ব ❤(বিংশ পর্ব)
সকাল থেকে এই নিয়ে প্রায় পনেরো বারেরও বেশিবার পর্ণাকে ফোন করেছে সৌমিক। আজ ওর জন্মদিন, আজ প্রথমবারের মতো পর্ণা আসবে ওদের বাড়ি। সেই একদম প্রথমদিন, দিদির জন্মদিনে পর্ণার সাথে কয়েকজনের আলাপ করিয়েছিল সৌমিক। তবে সেইবার ভালোভাবে বাড়ির কারো সাথে পরিচয় হয়ে ওঠেনি, আর তখন পরিচয়ের সম্পর্কের সমীকরণ টাও অন্যরকম ছিল। সৌমিকের সবথেকে লজ্জা লাগছে এটা ভেবে, যে মা দাদার থেকে সবটাই জেনে গেছে ইতিমধ্যে। আর মা জানা মানে বাড়ির প্রত্যেকেই যে জেনে যাবে,এ তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। দিদি বাড়ি থাকলে হয়তো আরো কিছু কান্ড করে বসত, ইয়ার্কি মেরে মেরে জীবন অতিষ্ঠ করে দিত। আজকে পর্ণার বাড়ি আসা নিয়ে সৌমিকের ভাবনাচিন্তার শেষ নেই, একবার ওকে ফোন করে বলছে শাড়ি পরে আসতে, একবার বলছে কোনো গিফ্ট না নিয়ে আসতে, আবার বলছে তাড়াতাড়ি চলে আসতে। মায়ের সামনে পর্ণার পাশে কীভাবে যে দাঁড়াবে, সেটা ভাবলেই ভীষণ অস্বস্তিতে ভরে যাচ্ছে মনটা। দাদার না হয় তবু বয়সটা বেশি তার থেকে, কিন্তু সে? মায়ের চোখে বড্ড তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যেতে মাঝে মাঝে একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু তবু জীবন তো আর থেমে থাকবেনা, সে চলবে আপন খেয়ালে। লজ্জাভাবটা সরিয়ে রাখলে, মনের যে আনন্দটা হচ্ছে এই মুহূর্তে, সেটাও তো অস্বীকার করার জায়গা নেই। জীবনে প্রথমবার জন্মদিনে পর্ণার উপস্থিতির কথাটা কল্পনা করলেই একটা মুচকি হাসি চলে আসছে ঠোঁটের কোণে অজান্তেই।

দুপুরের দিকে আরো একবার পর্ণার নম্বর টা ফোনে ডায়াল করল সৌমিক। ওর বিভিন্ন অদ্ভুত স্বভাবের মধ্যে এটাও একটা স্বভাব, সেটা হল- ফোনে নম্বর সেভ থাকা সত্ত্বেও তার নম্বরটা ডায়াল করা….বিশেষ করে প্রিয় কোনো মানুষের। মুখস্থ থাকা প্রতিটা নম্বর ডায়াল করার সময় যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মানুষটার হাসিমুখ….আর এই ব্যাপারটাই ভীষণ পছন্দের সৌমিকের। ও এই মুহূর্তে সেই প্রিয় কাজটা করতে করতেই পর্ণার ফোন ধরার অপেক্ষা করতে লাগল।
খানিকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে পর্ণা ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করল। ঘুম জড়ানো গলাতেই ও মৃদুস্বরে বলল,

-” হুম বলো, আবার ফোন? বাপরে কত কথা তোমার বলার আছে বলোতো?”

-” আরে, শোনো, একটা কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল। তুমি আজকে ফাইনালি তাহলে কী পরে আসছো? কুর্তি তো??”

-” হুমমমম। দুপুরেই তো বললাম, ঐ যে লং কুর্তি গুলো আছে, ওগুলো থেকে যে কোনো একটা পরব।”

-” আচ্ছা শোনো, শোনো, তুমি হলুদ রঙের কোনো কুর্তি পরে আসতে পারবে? আমি আমার ঐ নতুন হলুদ-সাদার চেকশার্টটা পরব তাহলে। বেশ একটা ম্যাচিং ব্যাপার হবে, বুঝতে পারছ তো?”

-” হ্যাঁ বুঝতে পারছি। খুব বুঝতে পারছি।”

-” পর্ণা, রাগ করলে? এতবার ফোন করছি বলে? ওকে সরি।”

গলার আওয়াজটা এক ধাক্কায় অনেকটা নীচে নেমে গেল সৌমিকের। ওর মনে মনে হালকা একটা খারাপলাগা শুরু হয়ে গেল হঠাৎই। অথচ পর্ণা সত্যি একদমই রাগ, অভিমান, দুঃখ কিছুই মনে করেনি।ও বরং বেশ মজাই পাচ্ছিল সৌমিকের এমন ছেলেমানুষি দেখে। আজকের দিনটাই সকাল থেকে বেশ সুন্দর, মনোরম, রোদ ঝলমলে একটা পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। এরকম একটা দিনে মন যেন অকারণেই ভীষণ খুশি খুশি লাগে, আর সেখানে আজ তো পর্ণার খুশির কারণ এমনিতেই রয়েছে। সৌমিকের মনখারাপি গলাটা শুনে পর্ণা তাড়াতাড়ি করে উত্তর দিল,

-” আরে, এত রাগ কীসের? আজকে জন্মদিন বলে রাগটাও কি বেড়ে গেছে আপনার?”

-” না, রাগ করিনি । খারাপ লাগল নিজেরই, তোমার অসুবিধা হচ্ছে এই ভেবে ”

-” হুমম অসুবিধা তো হচ্ছেই, এতবার ফোন করছ বলে, আমার অসুবিধা হচ্ছে, ভীষণরকম হচ্ছে। এত বিরক্ত লাগছে যে মনে হচ্ছে, তোমাকে বিয়ে করে তোমার কাছেই থেকে যাই। তাহলে আর এত দূরত্বও থাকবে না, যা বলার আমাকে ডেকে সামনেই বলে দেবে। সেটাই ভালো হবে না??”

-” হুমমম, আজ তো বাড়ি আসবেই। শ্বাশুড়িমাকে বলো বিয়ের কথা, যদি রাজি হন, দেখো।”

-” সে তো বলবোই, তবে তুমি সকাল থেকে এমন ফোন করছো, আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আজ আমাদের বিয়ে। একটু পরে বরযাত্রী নিয়ে তুমি আমার বাড়িতে আসবে”

-” হ্যাঁ আজ শুধু উল্টোটা হবে। তুমি তোামার একজন কনেযাত্রী নিয়ে আমার বাড়ি আসবে, তাই তো? হাঃ হাঃ”

দুপুর বেলার সমস্ত নিস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে জোরে হেসে উঠল সৌমিক। পর্ণাও যোগ দিল সেই হাসিতে। সৌমিকের ঠিক এই মুহূর্তটাতে মনে হল, তার জন্মের দিনটার পরে এটাই বোধহয় জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন। পর্ণা ওর জীবনে এসে, এতটা পরিবর্তন যে এভাবে এনে দেবে তা তো সে কল্পনাই করতে পারেনি।

**************
ঘড়ির কাঁটা এখন পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। বিকেল হওয়ার সাথে সাথেই আকাশের রঙ তার উজ্জ্বলতা খুইয়ে ম্লান হতে শুরু করেছে। সূর্যাস্তের শেষে হালকা গোলাপী রঙের একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশজুড়ে। দরজার ঠিক সামনেটায় দাঁড়িয়ে পর্ণা তৃণার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” তুই তো তাও একবার এসেছিস। আমি এই প্রথমবার, কীরকম ভয় ভয় লাগছে রে ”

-” আরেহ্ চল না, ভয় আবার কীসের? কাকিমা খুব ভালো, একদম বন্ধুর মতো। আর ওদিকে তো তোর প্রেমিক কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে তোর জন্য। চল, তাকে একবার নিজের মুখটা দেখিয়ে আয়”

-” ধুররর, তুই না। পাগল একটা।”

-” দাঁড়া দাঁড়া, আবার আরেকটা লাটসাহেব আছে, তিনি আবার কোথায় কে জানে।’

-” সৌমাভদার কথা বলছিস?”

-” হ্যাঁ, তাছাড়া আবার কে”

-” কেন রে? সৌমাভদা এখন তো আর রেগে রেগে কথা বলে না, ভালোভাবেই কথা বলে। তাহলে?”

-” আরে, ওসব লোকদেখানো। অনেক কষ্ট করে হেসে কথা বলে, মনে মনে আসলে রেগেই থাকে। বুঝলি?”

-” কথাগুলো কি আমাকে নিয়েই বলা হচ্ছে?”

নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই চেনা একটা গলার আওয়াজে চমকে ওরা পেছনে ফিরে তাকালো। তৃণা ঘাড় ঘুরিয়ে সৌমাভকে দেখেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ওর সামনে উজ্জ্বল নীল রঙের একটা টি-শার্ট পরে ভ্রুঁ কুচকে, জিন্সের পকেটে একটা হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সৌমাভ। যতই ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করুক, তবু অদ্ভুত এক অজানা কারণে এখনো সৌমাভকে হঠাৎ দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে তৃণার। অবশ্য মুখে এখন সেই ভয়ভাবটা বেশিক্ষণ রাখলনা ও। আমতা আমতা করে সৌমাভর মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে তৃণা বলল,

-” হ্যাঁ তো-তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল, শুনে নিলে তো, তাহলে এবার কী করবে?? বকা দেবে আমায়?”

-” কলেজে চলো, অ্যাটেনডেন্সে জিরো বসিয়ে রাখব। তারপর দেখব কেমন লাগে, এমনিতেও তো কলেজ অর্ধেক দিন এখন আর যাওনা।”

-” আরে পরীক্ষা তো, কয়েক সপ্তাহ পরে। এখন কলেজ যাব, না পড়াশোনা করব? আর শোনো আজকে কিন্তু একটা ভালোদিন,অনেক কাজ পড়ে আছে। তাই এখন কোনো ঝগড়া নয়,যা হবে পরে। ওকে?”

-” এটা ঝগড়া করছি আমি? সাধারণ কথা আর ঝগড়ার পার্থক্য বোঝোনা?”

-” দেখো, দেখো। এই সাধারণ কথাটাও তুমি কেমন জোরে জোরে রেগে বলছো! পর্ণা তুই শুনে বল, এটা রেগে কথা বলা নয়?”

ওদের এইসব কথাবার্তার মাঝখানে পড়ে বেচারা পর্ণা বুঝে পেল না যে কী উত্তর দেবে। ওর এই মুহূর্তে মন পড়ে রয়েছে ঘরের ভিতরে সৌমিকের দিকে। ভেতরে ভেতরে মন ছটফট করছে, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে মুখে কিছু বলাও যাচ্ছেনা। তৃণার কথার উত্তরে পর্ণা একটু হেসে বলল,

-” তোদের ঝামেলা তোরা মিটিয়ে নে, আমি আর কী বলব??”

-” দেখলি তো, তার মানে এটা ঝামেলাই ছিল। আমি বললাম না, দেখো তুমিও দেখো”

-” তোমার ব্যবস্থা আমি পরে করব । এখন যাও ভেতরে যাও, পর্ণা এই প্রথমবার তুমি এখানে এলে। যাও ভিতরে গিয়ে বসো। ছোটোমা তোমার সাথে কথা বলার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছে।”

সৌমাভর কথার পিঠে আর কোনো উত্তর দিল তৃণা। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে, চুপচাপ বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেল। অবশ্য যেতে যেতে পিছনে ফিরে একবার আড়চোখে তাকাতেই তৃণার ঠোঁটের কাছে অজান্তেই একটা মুচকি হাসি চলে এল। ও দেখল সৌমাভ ঐখানে দাঁড়িয়েই একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ চোখের তাকানোটায় এমন কিছু কিছু আলাদা, অন্যরকম লুকানো কথা আছে যা কেবল তৃণাই পারে পড়ে নিতে….

**************
সোফায় বসে সর্বাণীদেবী হাসিমুখে পায়েসের বাটি গুলো তৃণা আর পর্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-” সবটা খেয়ে নেবে কিন্তু, পায়েস ফেলে রাখতে নেই”

-” হ্যাঁ কাকিমা, আমরা খাবার একদম নষ্ট করিনা। সব খেয়ে নেব। তাই না বল?”
পর্ণার দিকে তাকিয়েই হাসতে হাসতে কথাটা বলল তৃণা। ওদের ছেলেমানুষি দেখে সর্বাণীদেবীও হেসে ফেললেন। তবে পর্ণা অত বেশি হাসতে পারল না প্রাণখুলে। ওর সংকোচ দেখে সৌমিকের মা এবার বললেন,

-” কী হল, তুমি এমন চুপচাপ কেন? তোমার বান্ধবী দেখো কী সুন্দর বলছে, এত লজ্জা আর পেতে হবেনা।”

-” না না লজ্জা কেন পাব। বলুন না”

-” আপনি কেন আবার, তুমি করে বলো আমাকে। নাহলে কিন্তু বকা দেব”

-” আচ্ছা বেশ, তুমি করেই বলব। ”

-” এই তো লক্ষ্মী মেয়ে। নাও এবার খেয়ে নাও তোমরা, একটু পরেই তো আবার কেক কাটা হবে। অনেকে আসবে, আমি সব দেখে নিই কতদূর কী এগোলো।,”

-” আচ্ছা।”

সর্বাণীদেবী উঠে চলে যাওয়ার পরেই পায়েসের বাটি থেকে অল্প পায়েস মুখে দিয়ে সেটা, টেবিলের উপর রেখে সামনের ঘরের দিকে তাকালো পর্ণা। একটু অস্থির অস্থির ভাব ওর মধ্যে স্পষ্ট। ওর অস্থিরতার কারণ যে মানুষটা, সে অবশ্য এখন বাড়িতে নেই। একটু আগেই বেড়িয়েছে কেকের অর্ডারটা আনতে।
তৃণা নিজেও ওখানে বসে রইলনা। পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়েই ও বারান্দার যেদিকে সৌমাভর ঘর সেদিকে এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। ফুলের গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখল দরজাটা বন্ধ বাইরে থেকে। তারমানে কোথাও গেছে হয়তো। দূর! মনটাই খারাপ হয়ে গেল তৃণার। যতই ভয় পাক, রাগ-অভিমান হোক, সৌমাভর মুখটা একঝলক দেখলে যেন সমস্ত মনখারাপ একনিমেষে দূর হয়ে যায়। অবশ্যই সেটা অপরজনের ক্ষেত্রেও হয়। আর সেই কারণেই হাজার ঝগড়া- ঝামেলার পরেও ওরা একে অপরের ওপরের কাছে ফিরে আসে, সম্পর্কের ভাঙন বাঁচায়…

দরজা দিয়ে বসার ঘরের দিকে ঢুকতেই একটা যেন হোঁচট মত খেল সৌমিক। পর্ণা এসে গেছে! আর তাকে জানাল না একবারও পৌঁছে। কেকের অর্ডারটা আনতে গিয়েছিল সে, আর সেই সময়েই তার মানে পর্ণারা পৌঁছেছে। সোফায় বসে থাকা পর্ণাকে দেখে, একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে রইল সৌমিক। ওর কথামতই মেয়েটা আজ একটা হলুদ রঙের কুর্তি পরে এসেছে। অল্প করে খুলে রাখা চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়েছে অগোছালো ভাবে। সৌমিকের ইচ্ছে করতে লাগল নিজের হাতে করে সেই চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু এটা বাড়ি। এখানে তা সম্ভব নয়, তাই অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল সৌমিক। এই বাড়িতে পর্ণাকে দেখেই ওকে যেন ভীষণ নিজের কেউ মনে হচ্ছে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পর্ণাকে না ডেকেই ওর দিকে তাকিয়ে রইল সৌমিক।

*************

কেকটা সবে কাটা হয়েছে তখন। খুব বেশী লোকজন নিমন্ত্রণ করেননি সর্বাণীদেবী। ঐ বাড়ির কয়েকজন, আর পাশের বাড়ির কয়েকটা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে।
কেকের টুকরো গুলো তৃণা বেশ উৎসাহ ভরে সবাইকে এক এক করে দিচ্ছে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছেনা যে ও এবাড়ির বর্তমান অতিথি। হাসি-মজায় চারিদিক ভরে উঠেছে। এমন সময় তৃণা দেখল, তার একটা খুব পরিচিত, প্রতীক্ষিত মুখ হালকা ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মৌলিদি! সারাদিন আনন্দ, হই-হুল্লোড় করে কাটালেও, এই মুহুর্তটার জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করেছিল তৃণা। সৌমাভও দেখতে পেয়েছে মৌলিকে। মৌলি এসে হাসিমুখে ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই সৌমাভ খুব স্বাভাবিক গলাতেই জিজ্ঞেস করল,

-” ওহ তুই, এলি? আমি তো ভাবলাম আসবিনা ”

-” না আসার মতো তো কিছুই হয়নি। তোর ভাইয়ের জন্মদিন, আমি তোর বন্ধু হিসেবে এখানে আসব, এতে এত ভাবার কী আছে? ”

মৌলির বন্ধু হিসেবে কথাটা বেশ কানে বাজল তৃণার। এই কথাটা এত জোর দিয়ে বলল মৌলি, যে লক্ষ্য করার মতই ছিল সেটা। সৌমাভ কথাটা শুনেও অবশ্য তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে আবারও স্বাভাবিক গলাতেই বলল,

-” হুমম তা তো বটেই, আচ্ছা আয়, বসে কেকটা খা আগে। তৃণা, মৌলিকে কেক দাও”

-” হুমম দিচ্ছি ”

কথাটা বলেই কেকের একটা টুকরো প্লেটের মধ্যে রেখে মৌলির দিকে এগিয়ে দিল তৃণা। মৌলি কেকটা হাতে নিয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাড়ির অন্যরা ততক্ষণ খেতে বসার তোড়জোড় শুরু করেছে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। এদিকে ওদিক তাকিয়ে, সৌমাভ আর তৃণার দিকে তাকিয়ে মৌলি মৃদু স্বরে বলল,

-” তার বল তোরা দুজনে কেমন আছিস?”

-” ভালো আছি। খুবই ভালো আছি।” সংক্ষেপে উত্তর দিল সৌমাভ।

-” হ্যাঁ ভালো আছিস, সেটা দেখানোর জন্যই তো এখানে আজ ডেকেছিস , তাই না? বেশ ভালো।”

-” হ্যাঁ, কাউকে ভালোবাসলে ভালো তো মানুষ থাকেই, সেটা অন্যদেরও দেখায়, যাতে তাদেরও ভালো লাগে। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম মানুষ ও আছে।

-” বাদ দে। আমি আর কোনো তর্ক করতে চাইনা। তৃণা, তোমাকে একটা প্রথমেই বলি, যা কিছু হয়েছে, সরি ফর দ্যাট। আমি তোমাদের মাঝখানে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম। বা আরো যা যা কিছু বলেছি তোমাকে, তার জন্য সরি।”

-” মৌলিদি, তুমি মন থেকে কি এই সরি গুলো বলছ? শুনে তো তা মনে হচ্ছে না?!”

-” না তৃণা। সরি ফিলটা মন থেকেই করে বলছি, তবে আমি এটাও মনে মনে বিশ্বাস করি যে,আমি যা করেছি তা ঠিক উদ্দেশ্যেই করেছি। ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য করেছি। এটুকুতে কোনো ভুল নেই।তবে জোর করে কি আর সব পাওয়া যায়? তাই আমি মেনে নিয়েছি সবটা, এছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই”

-” উপায় নেই মানে?”

-” মানে আমি বাধ্য এটা করতে, কারণটা তুমি নও অবশ্যই, কারণটা হল সৌমাভ। ও নাহলে আমার সাথে ভবিষ্যতে কখনো কথা বলবে না, বন্ধুত্বের সম্পর্ক টুকুও রাখবেনা। তাই আমি মেনে নিয়েছি সবটা। তোমরা ভালো থাকো, খারাপ থাকো, ইট ডাসন’ট ম্যাটার। আমি তোমাদের মাঝে আর কাঁটা হবো না এটুকু জানিয়ে দিলাম জাস্ট । বুঝতে পেরেছ আশাকরি!”

-” হুম পেরেছি। থ্যাংক ইউ মৌলিদি এটা বোঝার জন্য। ”

মৌলি আর ওদের কথার কোনো অপেক্ষা না করে, একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি নিয়ে, গটগট করে ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল যেখানে সৌমিক ও বাকিরা রয়েছে। ওকে দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে মন থেকে কতটা অসন্তুষ্ট হয়ে রয়েছে এই মুহূর্তে। তৃণার মনে আবারও হঠাৎ একটা ভয় চেপে বসতে যেন শুরু করল আবার, এত সহজে সব মিঠে যাবে সে ভাবেনি। মৌলিদি ভবিষ্যতে যদি আবার কিছু করার চেষ্টা করে! কিন্তু ওর ভয়টা ছড়িয়ে পড়ার আগেই তৃণা টের পেল একটা হাত, একটা চেনা স্পর্শ, ওর হাতটা ধীরে ধীরে চেপে ধরছে শক্ত করে। স্পর্শটা পাওয়ার সাথে সাথেই একটু আগের ভয়টা যেন দূরে সরে যেতে লাগল। পাশে তাকিয়ে তৃণা দেখল, সৌমাভ ওর হাতটা চেপে ধরে মুখে একটা মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সরাসরি চোখের দিকে। তৃণা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সৌমাভ ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” ভয় নেই, আমি তো সাথে আছি , পাশে আছি। এটুকু ভরসা করতে পারবেনা?”

কোনো কথা না বলে একটা সম্মতিসূচক হাসি হেসে তৃণার শক্ত করে চেপে ধরল সৌমিভর হাতটা। পাশের ঘরে ততক্ষণে আরো একটা নতুন জুটি নিজেদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে চলেছে অনবরত। সৌমিক আর পর্ণা, দুজনে মিলে বাচ্ছাদের খেতে দিচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর হাসি ওদের সম্পর্কের মতোই মিষ্টি লাগছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, এরকমভাবে হাতে হাত রেখে চলার নামই তো সম্পর্ক- এই সম্পর্ক টাকেই যদি জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে নেওয়া যায়, তবেই সেটা সাফল্য, তৃপ্তি। সম্পর্কে তো ঝড়ঝাপ্টা আসবেই, কখনো অভিমানের মেঘ, কখনো চোখের জলের বৃষ্টি, আবার কখনো বা ভালোবাসার উজ্জ্বল রোদ ওঠে আকাশ জুড়ে। এই মেঘ-বৃষ্টি-রোদে . …এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যারা পারে হারিয়ে যেতে, নিজেকে সঁপে দিতে, তারাই প্রেমিক হতে পারে , হতে পারে প্রেমিকা। তারাই ভালোবাসার সমস্ত পথের দূরত্ব মিটিয়ে একে অপরের কাছে আসতে পারে, সর্বোপরি ভালোবাসতে পারে ……

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here