❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#দ্বাদশ_পর্ব ❤
দুপুরবেলা যথারীতি অন্যবছরের মতই আয়োজন ছিল বাড়িতে। পাঁচরকম ভাজা, মাছ-মাংস, পায়েস, চাটনি…ইত্যাদি সুস্বাদু খাবারের গন্ধ চারিদিক ম’ ম’ করছে। অন্যসময় হলে, এই খাবার গুলো হাতের সামনে পেলে, আর তর সয় না তৃণার। একটু একটু করে অনেক আগের থেকেই মুখ চলতে শুরু হয়ে যায় ওর। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা এবার একটু অন্যরকম। এত আনন্দের মাঝেও মুখটা গম্ভীর করে, চেয়ারে বসে আছে তৃণা। জীবনে এরকম অপমানের মুখোমুখি কখনো হতে হয়নি তাকে। চেনা নেই, জানা নেই, একটা বাইরের মেয়ে এভাবে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল, শুধুমাত্র ঐ মানুষটার জন্য।
মনে মনে সৌমাভর প্রতি প্রচন্ড একটা রাগ জেগে উঠল মনের ভিতর। যেটুকু শ্রদ্ধা-সম্মান ছিল এতদিন, সেগুলোও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল। একটা এতবড়ো মানুষ, তার নিজস্ব কোনো মতামত নেই? নিজস্ব ভাবনা চিন্তা বলেও কিছু নেই? ঐ মৌলি নামের মেয়েটা যতই পুরোনো বন্ধু হোক, তার কাছে নিজের আত্মসম্মান এভাবে বিলিয়ে দেবে? হাতের মুঠোটা শক্ত করে দৃঢ়ভাবে, তৃণা সিদ্ধান্ত নিল, জীবনে মরে গেলেও আর কোনো দিন সৌমাভর কাছে নিজের মাথা নত করবেনা। এভাবে বিনা দোষে যখন শাস্তি পেতেই হল তাকে, সুতরাং এর প্রতিবাদও করা উচিত অবশ্যই, নাহলে নিজের মান-সম্মান বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।
খাওয়ার টেবিলে বসে, তৃণার মা, শ্রীলেখা দেবী, তৃণার এই পরিবর্তনটা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলেন। তাঁর মেয়ের স্বাভাবিক স্বভাব তো এরকমটা মোটেও না, সারাদিন হই হুল্লোড় করে, হাসি-মজা করে দিন কাটায় যেই মেয়ে, সে আজ নিজের জন্মদিনে এভাবে মুখ ভার করে বসে আছে- এই দৃশ্য সত্যি বড়ই বেমানান আর অস্বাভাবিক। মেয়ে দুরন্তপনা করলে তিনি মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যান ঠিকই, তবে এতটাও নিস্তব্ধতা তিনি কখনো চাননি। শ্রীলেখাদেবী তৃণার কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” কী হয়েছে রে? মনখারাপ করে বসে আছিস কেন?”
-” কই কিছু না তো। আমি ঠিকই আছি,”
-” মায়ের কাছে মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করছিস? সত্যি করে বল না মা, কী হয়েছে?”
-” সত্যিই বলছি মা। সেরকম কিছুই হয়নি। ঐ একটু কলেজের পড়াশোনার চাপ, ব্যস এটাই। তুমি চিন্তা করোনা কেমন?”
-” চিন্তা করোনা বললেই তো চিন্তা থামাতে পারবনা। তুই এখন বড়ো হয়েছিস। নিজের ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে। কিন্তু তা বলে আমি মা হয়ে তোর জন্য চিন্তাভাবনা করা তো আর বন্ধ করে দিতে পারিনা।”
-” আরে ধুরর। বলছি তত কিছু হয়নি। কেন বারবার একই কথা বলছ মা? আমি ভালো আছি। ভীষণ ভালো আছি, বিশ্বাস করো।”
এই বলে আর কথা না বাড়িয়ে, খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি করে টেবিল থেকে উঠে পড়ল তৃণা। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। শ্রীলেখাদেবী আর কোনো নতুন কথা বলার সুযোগই পেলেননা।
ঘরে এসে, বিছানার উপর শুয়ে তারপর ফোনটা হাতে নিতেই চমকে উঠল তৃণা। সৌমাভর নম্বর থেকে তেরোটা মিসড কল! এরকম আকস্মিক ঘটনায় সে আবারও হতভম্ব হয়ে পড়ল। ভগবান যেন সমস্ত অবাক হওয়ার মতো ঘটনা আজকের জন্যই তুলে রেখেছিলেন। মনে মনে এতক্ষণ ধরে তৈরী করা অভিমানের বাঁধটা আচমকাই কখন ধসে পড়ে গেল তা টেরও পেলনা তৃণা। এই ছোট্ট ঘটনাতেই পূর্বের যাবতীয় রাগ-কষ্ট ভুলে আবারও একটা আশার মেঘ জমা হল মনে। নিজের ব্যবহারে নিজেই যেন ক্রমশ অবাক হয়ে যাচ্ছে তৃণা । এতটা নির্লজ্জতা কখন গ্রাস করল ওকে? নিজের কাছে নিজেই এভাবে দুর্বল কখন হয়ে পড়ল সে?…
তৃণা নতুন করে আবার ফোন করার আগেই ও দেখল পুনরায় ফোন করছে সৌমাভ। নিশ্চয় কিছু একটা জরুরি কথাই বলার আছে, নাহলে এতবার কেন ফোন করবে…..এই ভেবেই তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করল সে। মনে মনে ভাবল খুব করে রাগ দেখিয়ে কথা বলবে , যতটা বাজেভাবে কথা বলা যায়, বলবে। কিন্তু বাস্তবে হলো তার পুরোটাই বিপরীত। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে সেই পরিচিত গম্ভীর কন্ঠস্বর ধীরকন্ঠে বলে উঠল,
-” তৃণা!!’
-” হ্যাঁ, বলুন। আমি শুনতে পাচ্ছি”
তৃণা বেশ শান্তকন্ঠে এই কথাটা বলার পরেই দু’ জনের কেউই আর খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলনা। যেন ওরা দু’জনেই বুঝতে পারলনা যে কী দিয়ে কথা শুরু করা উচিত এই মুহূর্তে। খানিক নীরবতার পর সৌমাভ এবার নিজেই গলাটা একটু খাঁকরিয়ে বলতে আরম্ভ করল,
-” আজ সন্ধ্যাবেলায় তোমার সময় হবে একটু? মানে বেরোতে পারবে বাইরে?”
-” কেন? কী প্রয়োজন?”
-” প্রয়োজন অপ্রয়োজনের জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই তৃণা। যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। অযথা সময় নষ্ট করো না।”
-” আরে হুমকি দিচ্ছেন নাকি আমাকে? আপনি বেরোতে বলছেন, আর আমি জানতে চাইতে পারিনা? যে কোথায়, কখন, কেন বেরোবো?”
-” তৃণা আমি যথেষ্ট ডিস্টার্বড এই মুহূর্তে। হয়তো বা তুমিও, তাই হেঁয়ালি না করে বলো”
হ্যাঁ বলে সম্মতি দেওয়ার আগে আরো একবার কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো তৃণা। তার ইচ্ছে তো করছে চিৎকার করে, সবাইকে জানিয়ে হ্যাঁ বলতে। সন্ধ্যা বেলা কেন? এখুনি বেরিয়ে সৌমাভর সাথে দেখা করে সমস্ত কথাবার্তা মিটিয়ে নিতে। কিন্তু মুখে তো সেই উচ্ছ্বাসটুকু দেখানো কোনো ভাবেই সম্ভব না। তাই যতটা পারা যায় শান্তস্বরেই সে বলল,
-” হুম। হবে সময়। কোথায় যেতে সেটুকু তো বলবেন?”
-” হ্যাঁ আমি টেক্সট করে দিচ্ছি। তোমার বাড়ির কাছেই জায়গাটা। আসতে পারবে? না আমাকে আসতে হবে?”
-” আমি, যেতে পারব। বাচ্চা ভাববেন না আমাকে”
-” এত বেশি কথা বলোনা। ঠিক সময়মতো চলে আসবে। কথাটা যেন মাথায় থাকে। ফোন রাখছি আমি”
-” আর কিছু বলবেন না?”
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেই জিভ কাটল তৃণা। ও এতক্ষণ ধরে চাইছিল, একবার অন্তত জন্মদিনের শুভেচ্ছা তো অবশ্যই জানাবে সৌমাভ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসেও সেটা না হওয়ায় আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলনা ও। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তৃণার, সেটা হল -আজ সকালে মৌলি ওকে বলল যে সন্ধ্যাবেলায় সে আর সৌমাভ দেখা করতে বেরোবে, এদিকে আবার এখন সৌমাভ বলছে ওকেও বেরোতে। ঘটনা কী ঘটতে চলেছে, আর কোনো মোড় নিতে চলেছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না তৃণার।
ওদিক থেকে সৌমাভ আবারো কিছুক্ষণ কোনো কথা বললনা প্রথমে। তারপর তৃণার শেষ কথাটা শুনে খানিকটা থেমে থেমে বলল,
-” কী কথা শুনতে চাও? আমার কিছুই বলার নেই। ফোন রাখলাম। টাটা”
খুব বেশিক্ষণ আর না অপেক্ষা করে, ফোন কেটে দিল সৌমাভ। আর তার সাথে সাথেই কিছু মূহুর্ত আগের উধাও হয়ে যাওয়া রাগ-অভিমান গুলো আবার যেন ফিরে এল তৃণার মনের ভিতরে। কীরকম অসভ্য একটা মানুষ! এতটুকু ভদ্রতা জানেনা যে, একটা মানুষের জন্মদিনের তাকে শুভেচ্ছা জানানো উচিত। সৌমাভ কি তবে ভুলে গেছে আজকের দিনের কথা? ভুলে যেতেই পারে, সে আর এমন কে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যে তার জন্মদিনের দিনটাকে কেউ একটা গুরুত্ব সহকারে মনে রাখবে ? এটাই স্বাভাবিক! তৃণার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে, পুনরায় ফোন করে সৌমাভকে বলে দিতে যে ও কোত্থাও যাবেনা আজ সন্ধ্যাবেলায়। কেন যাবে? তার কোনো আত্মসম্মান নেই? সৌমাভ যখন চাইবে তাকে অবহেলা করবে, আবার যখন চাইবে দেখা করতে বলবে। মামাবাড়ির আবদার নাকি? মনে আর কোনো আশা না রেখেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে শুয়ে পড়ল তৃণা। একটু ঘুম দরকার, এবার….শরীর আর মন দুইই বেজায় ক্লান্ত। কে জানে আবার কী চমক অপেক্ষা করছে সন্ধ্যাবেলায় ওর জন্য!
**************
বিকেলের দিকে আকাশে হালকা হালকা কালো মেঘের আভাস দেখা গেল। এতদিনের গুমোট গরমের প্রচন্ড অস্বস্তি থেকে অবশেষে হয়তো একটু মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু মেঘের এরকম অবস্থা দেখে তৃণার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করল। এত কিছুর পরে আজ যাও বা দেখা করার একটা সুযোগ হল, তাও না সেটা এই বৃষ্টির জন্য ভেস্তে যায়। সত্যি কথা বলতে কী, ভেতরে ভেতরে চাপা একটা দুশ্চিন্তা অনেকক্ষণ থেকেই কাজ করছে তৃণার মধ্যে। কী হতে চলেছে খানিকক্ষণ পরে, সেটার কথা ভাবলেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে।
ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। সাদা আর নীলের কম্বিনেশনের একটা লং কুর্তি পরেছে আজ সে। সাথে কালো রঙের জিন্স। চুলটা সামান্য আঁচড়ে, একটা ছোট্ট ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল তৃণা। সাজতে ভালোবাসলেও বাইরে কোথাও গেলে বেশি সাজগোজ পছন্দ নয় তার। তাই অল্প একটু চোখে কাজল দিয়ে আর ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক বুলিয়ে সাজগোজ শেষ করল তৃণা। টিপ পরবে কি পরবেনা, সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবল সে। তারপর অনেক ভেবে ছোট্ট কালো টিপটা কপালের মাঝবরাবর আটকে, নিজেকে ভালো করে আয়নায় একবার দেখে নিল তৃণা।
মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল ওর, নিজেকে ভালোবাসলে, নিজেকে সামান্য সাজালে, এক আলাদাই তৃপ্তি, আনন্দ পাওয়া যায়। মনের যাবতীয় কষ্ট, হতাশা দূর করতে মাঝে মাঝে এরকম কিছু চেষ্টা করাই যায়। যেটা করে নিজেকে ভালো রাখা যায়, অন্যকে খুশি করার আগে নিজেকে ভালোবাসা যায়।
ফোনটা হাতে নিয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল তৃণা। সাড়ে ছ’টায় যেতে বলেছে সৌমাভ, এখন ছ’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। এবার বেরোনোর কথা ভাবতে লাগল তৃণা। ব্যাগটা হাতে নিয়ে, মাকে বলে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো সে। মায়ের অনেক বলা সত্ত্বেও ছাতা নিতে রাজি হলনা ও। যতই বৃষ্টি হোক, আর যাই হোক, ছাতা জিনিসটাকে একদম পছন্দ করেনা তৃণা, বোঝা মনে হয় যেন একটা। কিন্তু রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চোখ যেতেই, তৃণার মনে হল মায়ের কথার অবাধ্য হওয়াটা সত্যিই উচিত হয়নি। আকাশ ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেছে, মাঝে মাঝে হালকা বিদ্যুতের চমকও দেখা যাচ্ছে। এমনিতে বাজের শব্দে ভয় না পেলেও, এই আলোর ঝলকানিতে ভীষণ আতঙ্ক তৃণার। সেই কারণে বৃষ্টি আসার আগেই যাতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়, সে চেষ্টাই করতে লাগল সে। চলার গতি অনেকটা বাড়িয়ে দিল তৃণা। হাঁটতে হাঁটতে ও শুনতে পেল, ফোন বাজছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে তৃণা দেখল সৌমাভ ফোন করছে। বিরস মুখে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল সে। সৌমাভই প্রথম কথাটা বলল,
-” কোথায় তুমি? বৃষ্টি পড়ছে না তো? পড়লে দাঁড়িয়ে যাও, আমি তোমাকে গাড়িতে নিয়ে নিচ্ছি”
-” না, আমি একাই যেতে পারব। আর বৃষ্টি পড়ছে না, তাই আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবেনা আপনাকে”
-” তৃণা, সবকিছু না জেনে এভাবে কথা বলবেনা আমার সাথে। ওকে? আগে বোঝো সবটা তারপর এসব বলবে”
-” ঠিক আছে, আপনিই বরং বুঝিয়ে দেবেন আমাকে সবটা। আমি অপেক্ষায় রইলাম। কেমন?”
-” তুমি বদলাবেনা। কিছু বলেও লাভ নেই, তাড়াতাড়ি এসো, সাবধানে। ফোন রাখলাম”
-” দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কি চলে এসেছেন অলরেডি?’
-” হুমম, এসে গেছি।”
-” ওকে, রাখুন। আমি আসছি”
ফোনটা রেখে আরো তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করল তৃণা। সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যেতে লাগল ওর। ততক্ষণে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তবে তাতে খুব বেশি ঝামেলা হল না, কারণ মাথার উপরে ব্যাগটা আড়াল করে, মিনিট খানেক হাঁটার পরেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল তৃণা। একটা বেশ ছোটোখাটো ছিমছাম রেস্টুরেন্ট।
আশেপাশে এলাকাটাও বেশ সুন্দর। বাড়ির কাছাকাছি হলেও, এই জায়গাটা এতদিন, কখনো সেভাবে লক্ষ্য করেনি তৃণা। এখানকার এমন জায়গার খোঁজ সৌমাভ পেল কী করে? অদ্ভুত তো! তৃণা এদিক ওদিক তাকিয়ে, সৌমাভকে খুঁজতে লাগল। কই কেউ তো নেই! সৌমাভ তো এই রেস্টুরেন্টের কথাই বলেছিল, তাহলে? ফোন করার জন্য ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই, পেছন থেকে শুনতে পেল একটা পরিচিত গলার আওয়াজ।
-” আমি এইদিকে আছি, এই যে”
পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তৃণা। এতদিন পর, সৌমাভকে এত কাছ থেকে দেখে আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা ফিরে এল যেন তৃণার মনে। কালচে নীল রঙের একটা শার্ট আর জিন্সে বরাবরের মতোই ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে সৌমাভকে। তাড়াতাড়ি করে চোখের মুগ্ধতা লুকিয়ে, তৃণা বলল,
-” এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবেন? বৃষ্টি পড়ছে তো”
-” না, ভেতরে যাব, তুমি যদি বুঝতে না পারো তাই এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম”
-” ওহ, আচ্ছা ”
-” হুম এসো এবারে”
সৌমাভর পিছু পিছু রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকল তৃণা। বাইরে থেকে যতটা সুন্দর মনে হচ্ছিল, ভিতর থেকে রেস্টুরেন্ট টা তার থেকেও আরো অনেক বেশী সুন্দর। একটা বেশ হালকা হলুদ,আর নীল রঙের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। নীচু শব্দে কোথাও গানও চলছে , সফট মিউজিক। বাইরের মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, আর তার সাথে এইরকম একটা পরিবেশ। সবকিছু ভুলে তৃণার মনটা বেশ আনন্দে ফুরফুরে হয়ে গেল। কিন্তু তৃণা অবাক হয়ে দেখল, এত সুন্দর রেস্টুরেন্টটা পুরো ফাঁকা। কেউই নেই ভিতরে। অদ্ভুত কান্ড! চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, সামনের চেয়ারটায় বসতে যাবে তৃণা, ঠিক এমন সময় নিজের ডানহাতে একটা কঠিন, পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেল সে। চমকে তাকাতেই তৃণা দেখতে পেল, সৌমাভ হঠাৎ কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । অবাক হয়ে তৃণা দেখল, সৌমাভর হাতটাই এই মুহূর্তে ওর ডানহাতটা জড়িয়ে আছে। অদ্ভুত এক শিহরণে যেন মনে মনে কেঁপে উঠল তৃণা। যা দেখছে সে , যা ঘটছে এই মুহূর্তে, তা সবই কি সত্যি? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
-” এদিকে এসে বসো”
নরম কন্ঠে বলল সৌমাভ। ওর গলার আওয়াজটাও যেন বদলে গেছে আচমকা। তৃণা সেইমতোই কাজ করল, এক ধারের একটা চেয়ারে বসে সৌমাভর চোখের দিকে বিস্মিত ভাবে তাকালো সে। ওর এমন তাকানো দেখে, সৌমাভ এতক্ষণের গম্ভীরভাবটা কাটিয়ে অল্প একটু হেসে বলল,
-“শুভ জন্মদিন, মিস তৃণা বোস। আমি জানি এটা শোনার জন্য তুমি সকাল থেকে অপেক্ষা করেছিলে। কিন্তু ইচ্ছে করেই আমি বলিনি। কেন বলিনি, তার উত্তর টা এক্ষুণি পেয়ে যাবে। পিছনে তাকাও, বুঝতে পারবে”
তৃণা ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে দেখল, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার প্লেটের উপরে একটা মাঝারি আকারের কেক নিয়ে আসছে ওদের টেবিলের দিকেই। কেকের পাশে, রাখা আছে কয়েকটা উজ্জ্বল জ্বলন্ত মোমবাতি। জীবনের প্রথম কোনো জন্মদিনে বোধহয় এরকম চমকের পর চমক পাচ্ছে তৃণা। নতুন করে অবাক হওয়ার ক্ষমতাটাই যেন হারিয়ে গেছে তার।
( ক্রমশ )