মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:৮

0
587

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#অষ্টম_পর্ব❤
ক্লাসটা শেষ করে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সৌমাভ। এইরকম অদ্ভুত পরিস্থিতি, অস্বস্তির মধ্যে পড়ানো যে কতটা কষ্টকর….. তা একমাত্র যে পরিস্থিতির শিকার সেই বুঝতে পারে বোধহয়! লাস্ট বেঞ্চের কোণার দিকের সিটটা, যেটা তৃণার একপ্রকার নিজস্ব সম্পত্তি বলা যেতে পারে, ওখানে আজ এতবার তাকিয়েছে সৌমাভ.. যে নিজের ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ল সে। তার মধ্যে সবথেকে বিরক্তির ব্যাপার হল, মেয়েটা পড়াশোনার ক্ষেত্রে একদমই সিরিয়াস নয়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সবসময়, বাকি অন্যান্য বিষয়ে মন পড়ে আছে। সামনে পরীক্ষাও আসছে, একবার সাপ্লি খেলে বুঝবে ঠেলা….। চেয়ার থেকে উঠে সবেমাত্র বাইরে এসে কয়েক পা হেঁটেছে সৌমাভ, ঠিক তখনই ওর নজরে পড়ল….সামনের জানালার কাঁচের প্রতিবিম্বের দিকে। পিছন থেকে কেউ একটা দ্রুতপায়ে হেঁটে আসছে। হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মানুষটা কে! মনে মনে অকারণেই একটু মুচকি হেসে উঠল সৌমাভ, তৃণাকে আসতে দেখে ওর মধ্যেও হঠাৎ একটা মন ভালো করা আবহাওয়া তৈরী হয়ে গেল। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সৌমাভ। পেছনে ঘুরে, তৃণার দিকে একটু গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে সে বলল,

-” কী হয়েছে? এটা কলেজ, খেলার মাঠ নয়,এভাবে ছুটে আসার কী প্রয়োজন?”

-” বলছি, এক মিনিট…”
হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল তৃণা। অনেকদিনের অনভ্যাসে এইটুকু ছুটে আসার ফলেই, ঘেমে গিয়েছিল তৃণা। ওর কপালের সামনের দিকের হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো হাওয়ায় উড়তে লাগল অল্প অল্প। সৌমাভ ভালোভাবে তৃণার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, আজকে হালকা করে চোখে কাজলও দিয়েছে মেয়েটা। তার সাথে উজ্জ্বল লাল রঙের একটা কুর্তিতে বেশ প্রাণবন্ত লাগছে ওকে। ব্যাপারটা তৃণাকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য, ব্যস্ততা দেখাতে পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করল সৌমাভ। ইচ্ছে করেই, একটু তাড়া নিয়ে সে বলল,

-” যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমার কাজ আছে অনেক, বলো”

-” আসলে, সামনে তো সেমিস্টার, মানে সিলেবাস সেভাবে কিছু বুঝতে পারছিনা। আপনার পার্টটা যদি বলে দিতেন , কী কী আছে, আরকি!”

-” মানে? আমি আগের সপ্তাহেই তো বলে দিলাম পুরো সিলেবাস। গ্রুপে পাঠিয়েও দিয়েছি। আর তুমি এখন এসেছ জানতে?”

-” হ্যাঁ মানে, বুঝতে পারিনি ঠিক। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরও পারছিনা, একটু প্লিজ হেল্প করে দিন না, প্লিজ”

-” ক্লাসে ঘুমোলে তো, এরকমটাই হবে মিস তৃণা বোস। তো, এখন আমি তোমাকে আলাদা করে সবকিছু বোঝাতে বসব, তাই তো? কিন্তু কেন?”

-” প্লিজ স্যার।এই বারের মতো, আমি আসলে বাড়িতে কারো কাছে সেভাবে টিউশনও পড়িনা। দাদা আছে, ও মাঝে মাঝে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু দাদার ও পরীক্ষা। তাই বলছিলাম। আমি জানি আপনি না করতে পারবেন না, প্লিজ”
প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল তৃণা। পরীক্ষার রুটিনটা নোটিশ বোর্ডে দেখার পর থেকেই চিন্তায় চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। পর্ণা তবু পড়াশোনা করে মাঝেমধ্যে। কিন্তু সে নিজে তো সেটুকুই করেনা! এই অবস্থায়, একমাত্র সাহায্য করতে পারে সৌমাভ….। এতটা আশা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তৃণা সৌমাভর কাছে এসেছে, কারণ ওর কেন না জানি মনে হচ্ছে যে কিছু তো একটা গন্ডগোল রয়েছে কোথাও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই,একটা মেয়ে বহুদূর থেকেও কোনো ছেলের কেবল কথাবার্তা আর চোখের চাহনি দেখেই বুঝতে পারে….যে সে কী বলতে চাইছে। তাও না বোঝার ভান করে থাকতে হয়, পরিস্থিতির চাপে। সৌমাভ বাইরে থেকে যতই গম্ভীর, ভারিক্কি স্বভাবের হোক না কেন, ওর মনের ভেতরে কী চলছে, তা কিছুটা হলেও, সেদিন রাতে যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল তৃণা। রাগ করে ফোন কাটার পরেই ও হোয়াটস অ্যাপে যখন দেখল, সৌমাভর ডিপি, স্ট্যাটাস শো করছে…. তখনই অল্প অল্প ব্যাপারটা পরিস্কার হয়েছিল তৃণার কাছে। কিন্তু সৌমাভ যে কিছুই প্রকাশ্যে আনতে চায়না, সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। তাই, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা……

তৃণার কথাগুলো শুনে রীতিমত অবাক হয়ে গেল সৌমাভ। বিস্মিত গলায় সে বলল,

-” না করতে পারবনা মানে? এতটা ভরসা কোথা থেকে আসছে তোমার?”

-” না মানে, এমনিই বললাম। ছাড়ুন না, আপনি এটা বলুন যে রাজি কি না??”

-” এখন তুমি সাহায্য চাইতে এসেছ। কথাটা জানাজানি হলে, এরপর বাকিরাও একে একে আসলে, তখন কী করব আমি?”

-” কেন জানাজানি হবে? দরকার হলে,লাইব্রেরির দরকার নেই। আমি আপনার বাড়ি চলে যাব। আপনি শুধু ইমপর্টেন্ট কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে বুঝিয়ে দিন, যেগুলো রেডি করে গেলে পাশ-মার্কস টুকু হয়ে যাবে”

-” বাড়ি?!!” – খানিকটা ইতস্তত করে উঠল সৌমাভ।

-‘হুমম, কোনো অসুবিধা হবে ?”

-” দেখো, তৃণা, আমি ঐ বাড়িতে সপ্তাহে একবার যাই। বাকি দিন নিজের ফ্ল্যাটে থাকি এবং একাই থাকি। এবার তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে তুমি আসতে পারো। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তবে যা করবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েই করবে, আশা করি, কী বলতে চাইছি, বুঝতে পারছ?”

-” হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো জাস্ট, দু-তিন দিন গেলেই হয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা নেই আমার। তাহলে কবে যাব?”

-” আজ গেলে আজই যেতে পারো। তুমি তো চেনো না।ছুটির পরে আমার সাথেই চলে যেও”

-” আপনার সাথে?”

-” হুমম, এনি প্রবলেম?”

-” না না কোনো অসুবিধা নেই। ওকে আপনি তাহলে মেসেজ করে দেবেন একটা।”

-” হুমম। এখন, যাও ক্লাসে যাও”

দু’জন দুইদিকে চলে যাওয়ার পরেই একটা একইরকম ভাবনা দু’জনের মাথাতেই এল। ক্রমশ হাতের বাইরে সবটা চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়েও, কেউই বাধা দিতে পারলনা বিন্দুমাত্র। বিশেষ করে সৌমাভ একটা অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেল। বাড়াবাড়ি হচ্ছে জেনেও, কেন বাধা দিতে পারছেনা সে? কী এর কারণ? তবে কি সেও দুর্বল হয়ে পড়ছে ঐ মেয়েটার প্রতি? তাহলে মৌলি? ওকে কী উত্তর দেবে সৌমাভ? ওকে কী বলবে?….যে সে মৌলিকে নয় বরং অন্য কাউকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? আর মৌলি যা মেয়ে ও এটা খুব সাধারণ ভাবে মেনেও তো নেবেনা। ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা কল্পনা করে, একটা দুশ্চিন্তার মেঘ ছেয়ে গেল, সৌমাভর মাথায়…..

************
দরজা দিয়ে ঢুকে, ঘরে এক পা রেখেই… চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখল তৃণা। বেশ সুন্দর ছিমছাম, সাজানো গোছানো দু’কামরার ফ্ল্যাট। একটা ছেলের ঘরও যে এত গোছানো হতে পারে, সেটা তো কল্পনাও করতে পারেনি সে। মনে মনে ও ভেবেছিল, যে একটা অগোছালো, আসবাবপত্র এলোমেলো করা একটা ঘর হবে। সামনে একটা সোফার দিকে আঙুল দেখিয়ে, সৌমাভ বলল,

-” বসো এখানে। কিছু খাবে?”

-” খাবো? হুমম, খাওয়াই যায়, কী কী আছে?”

-” কী খাবে তুমি বলো? বানানো তাহলে। কফি? চা? কোল্ড-ড্রিংকস?”

-” না না, আপনার তাড়ার জন্য তো আগে আগে বেরিয়ে এলাম। পর্ণার সাথে কথাও হলোনা। ক্যান্টিনে খাওয়াও হলোনা। ধুরর”

-” হ্যাঁ তো কী খাবে? সেটা বলো। তোমার জন্য কি এখন, রান্না করতে বসব?”

-” না থাক। কফিই খেয়ে নেব। আচ্ছা আপনি কী খেয়ে থাকেন বলুন তো, সারাদিন? এই চা-কফি?”

-” তুমি, পড়তে এসেছ না এইসব করতে এসেছ তৃণা?”

ঘরের জিনিসপত্রগুলো গোছাতে গোছাতে এবার একটু রাগত গলাতেই বলে উঠল সৌমাভ। ওর কথায় ধমকের সুর পেয়ে নিজেকে সামলে খানিকটা নড়েচড়ে বসল তৃণা। ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় বইখাতা বের করে সে বাধ্য গলায় উত্তর দিল,

-” হুমম পড়তেই এসেছি। আর এই যে বইখাতাগুলোও বের করলাম সেইজন্য। এবার আপনি পড়ানো শুরু করলেই হবে”

-” আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ততক্ষণে চুপ করে বসে থাকো। একদম এদিক ওদিক যাবেনা। বুঝতে পেরেছ? বইটা পড়ো, আমি আসছি”

-” হুমমম ওকে, বুঝতে পেরেছি।”

-” গুড। সেটা হলেই ভালো”
এই বলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস আর জামা নিয়ে, বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো সৌমাভ। আর তার ঠিক কিছু সেকেন্ড পরেই, টেবিলের উপর রাখা ওর ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে। আওয়াজ শুনেও প্রথমে চুপ করে বসেই রইল তৃণা। কিন্তু তারপরে, মিনিটখানেক ছাড়া ছাড়াই যখন বারবার ফোনটা আসতে লাগল, তখন উচিত নয় জেনেও, তৃণা নিজের কৌতুহলের চেপে রাখতে পারলনা। চুপি চুপি সোফা থেকে নেমে, টেবিলের কাছে উঁকি মেরে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই, এতক্ষণের মনেরর খুশি-আনন্দটা যেন দপ করে নিভে গেল তৃণার। এটা সে কী দেখছে? ফোনের উপরে, ‘মৌলি’ নামের কেউ একজন হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও কল করছে। সৌমাভ আর ঐ মেয়েটারই হবে বোধহয় একটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকা ছবি ফোনের স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করছে। ছবিটা যে এই ঘরেই তোলা তা আ আশপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থান দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই মেয়েটাই কি সেদিন সৌমাভকে ফোন করেছিল?? কে হয় মেয়েটি? তবে কি এতদিন যা ভাবতো তৃণা, সেগুলো সব মিথ্যে? সৌমাভর জীবনে ইতিমধ্যেই কেউ আছে? এই মেয়েটার সাথে সৌমাভর সম্পর্ক রয়েছে? আর এই ব্যাপারটা, তৃণা ঘুণাক্ষরেও টের পেলনা??

-” তৃণা!!”
সৌমাভর গলার আওয়াজ শুনে টেবিলের দিক থেকে তাড়াতাড়ি করে সরে এল তৃণা। ওর মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন একসাথে তোলপাড় হয়ে চলেছে। তাহলে, ইচ্ছে করে, সৌমাভর কাছাকাছি আসা, ওকে পছন্দ করা, এসবকিছুই বেকার ছিল? না বুঝেই এতটা বড়ো একটা ভুল করে ফেলল সে নিজে? আর এতটা কষ্ট কেন হচ্ছে ওর মনের ভিতরে? সৌমাভর সাথে তো ওর কোনো সম্পর্ক নেই, কিছুই নেই….যেটা আছে তা হল, অল্প একটু ভালোলাগা, তাহলে? তবে কি ভালোলাগার ঐ অল্প অনুভূতিটা কখন আরো বেশি কিছু হয়ে গেছে, আর সেটা ও নিজে বুঝতেও পারেনি?

-” তুমি এখানে কী করছ?”

-” না, ঐ একটা ফোন এসেছিল। তাই আমি …..”

-” ফোন বাজল, আর তুমি চলে এলে? কারোর ফোন ভাবে দেখা যে উচিত নয়, সেটুকু জানোনা?”

-” হ্যাঁ জানি। বারবার ফোনটা আসছিল, তাই জন্যই উঠেছিলাম, নাহলে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আপনার ফোনের দিকে তাকানোর। মৌলি বলে একজন ফোন করেছিল, সরি, ফোন না ভিডিও কল”

-‘ ওহ, আচ্ছা ”
মৌলির নামটা তৃণার মুখে শুনে একটু ইতস্তত করে কথাটা বলল সৌমাভ। অনেক বারণ সত্ত্বেও মৌলির রাখা ডিপিটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই ছবিটা! সেই ছবিটা কি কোনো ভাবে তৃণা দেখে নিয়েছে? ওর মুখ দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে। সৌমাভকে হঠাৎই চুপ করে যেতে দেখে, তৃণার এবার একটু জোর গলায় বলল,

-” স্যার, আপনি বরং, যা পড়ানোর বলে দিন, আমাকে একটু তাড়াতাড়ি। বাড়ি ফিরতে হবে।”

-” আজকেই সব পড়ে ফেলবে?” – পরিস্থিতি একটু সহজ করার জন্য বলে উঠল সৌমাভ। কিন্তু তৃণা ঠিক তেমনই গম্ভীর গলায় মাথা নীচু করে বলল,

-” হুম, আর বোধহয় আমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই, এখানে”
( ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here