❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#সপ্তম_পর্ব❤
তৃণার বাড়ির কাছাকাছি যখন ওরা পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ন’টা ছুঁই ছুঁই। তৃণা যদিও বাড়িতে ফোন করে সবটা জানিয়েই রেখেছিল, তাই কোনো সমস্যা হয়নি। বৃষ্টি এখন সামান্য পড়ছে, ভিজে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আর নেই। এর থেকে বেশি অপেক্ষা করলে, আরো দেরী হয়ে যেত। আকাশের যা অবস্থা তাতে মনে হয়, খানিক পরে আরো জোরে আবার বৃষ্টি নামবে। তাই সৌমাভ আর কোনো ঝুঁকি নেয়নি।
বাড়ির ঠিক সামনে এসে যাওয়া মাত্রই তৃণা সৌমাভর কানের কাছে চিৎকার করে উঠল, নাহলে সৌমাভ বাড়িটা চিনতে না পেরে এগিয়ে যাচ্ছিল।
-‘ আরে আরে, এটা আমার বাড়ি, থামুন থামুন।”
এমনভাবে চিৎকারটা করে উঠল তৃণা…যে চমকে ওঠে ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা, সৌমাভর কাছে। তাড়াতাড়ি করে ব্রেকটা কষে সে, বিরক্ত গলায় ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
-‘সেটা আস্তে বললেও তো হয়? আমি কি কানে শুনতে পাইনা?”
-‘ হ্যাঁ তা পান। কিন্তু আপনাকে ভরসা নেই, তাই আরকি জোরে জোরে বলা”
কথাটা বলেই মাথা নীচু করে চাপা গলায় হেসে উঠল তৃণা। আজ যে স্যারের মেজাজ বেশ ভালোই আছে, তা আর তাকে বলে বোঝাতে হবেনা। প্রথমে অল্প ভয় পেলেও, কিছুটা রাস্তা আসার পর থেকেই তৃণা বুঝতে পারছিল যে, তার উপর সৌমাভ একেবারেই বিরক্ত নয়। বরং তার মতোই উনিও এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছেন। আর সেই জন্যই এতটা সাহস দেখাতে দু’বার ভাবল না আর সে…. । ওকে এরকম করে হাসতে দেখে, রাগ করতে গিয়েও রাগ করতে পারল না সৌমাভ। মুচকি হেসে সেও যথেষ্ট নরম সুরেই বলল,
-” ওকে, নামো এবার। কতক্ষণ স্ট্যান্ড করে দাঁড়িয়ে আছি। বেশি দেরী করলে আমার ফিরতে রাত হয়ে যাবে, আকাশের অবস্থা ভালো না।”
-‘সেকি,! আপনি এতটা এলেন, আর আমার বাড়িতে আসবেন না? সামনে থেকে এসে, এভাবে ফিরে যাবেন?”
বাইক থেকে নেমে, কুর্তিটা ঠিক করতে করতে তৃণা অবাক গলায় বলল।
-” তৃণা আমি অন্যদিন ঘুরে যাব। বোঝার চেষ্টা করো, এখন সত্যিই দেরী হয়ে যাবে। আমি আসি কেমন? তুমি যাও, বাড়ি যাও”
সৌমাভ কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই, পকেটে থাকা ওর ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। কথা থামিয়ে সে ফোনটা বের করল,পকেট থেকে। কিন্তু স্ক্রিনের দিকে চোখ যেতেই মুহূর্তের মধ্যে মুখের আদল যেন বদলে গেল… মৌলি ফোন করছে আবার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তৃণার দিকে একবার তাকিয়ে,খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ফোনটা রিসিভ করল সৌমাভ। ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ বেশ মিষ্টি গলায় বলে উঠল,
-” কীরে, রাগ করেছিস? তখনের জন্য?”
-” না না, সেরকম কিছু নয়। বল,কিছু বলবি?”
-” কী আবার বলব? কথা বলার জন্য ফোন করলাম, আজ তো বাড়িতে আছিস, ফ্রি পুরো, তাই তো ফোন করলাম। তুই কিন্তু কথা বলবি, বলেছিলিস, মনে কর”
-” ওহহ, হুমম। কিন্তু আমি তো এখন একটু বাইরে আছি, মানে তোকে পরে ফোন করছি”
-” বাইরে, এখন ? এই বৃষ্টিতে? কার সাথে আছিস?”
-” তোকে পরে বলছি, রাখ এখন”
এই বলে মৌলিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল সৌমাভ। তৃণা বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেছে, সৌমাভকে এরকম অস্বস্তিতে পড়তে আপাতত সে এতদিন পড়তে দেখেনি। কী ব্যাপার? কে ফোন করেছিল? যার জন্য এতটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সৌমাভ? বিশেষ কেউ? হালকা একটা ভয়ে সামান্য কেঁপে উঠল তৃণা….। তবে কী অন্য কেউ জীবনে আছে ওর? যাই হোক, যদি থেকেও থাকে, তবেও তো কিছু করার নেই, তৃণার। কারো ব্যক্তিগত জীবনে, শতচেষ্টা করলেও সে ঢুকতে পারবেনা, যদি সে না অনুমতি দেয়!
************
রাত এগারোটা বাজে। তৃণা বুঝে পারছেনা, ফোন করাটা উচিত হবে কি হবেনা। আজকে এতটা বেশি পরিচিতির পরে, ফোন করাটাও খুব বেশি সংকোচের ব্যাপার না। তবু সেটা বেশি বাড়াবাড়ি হবে কিনা, সেটার সিদ্ধান্তই নিয়ে উঠতে পারছেনা সে। শেষপর্যন্ত ভাবল, যা হবে হবে, মন যখন চেয়েছে, একবার করে দেখাই যাকনা। একটা মানুষ ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে এতটা কষ্ট করল,সেখানে ধন্যবাদ হিসেবে তিনি এটুকু তো পেতেই পারেন। সব দোনোমোনো কাটিয়ে, ফোনটা হাতে নিয়ে তৃণা সৌমাভর নম্বরটা ডায়াল করল। … কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে, ওপাশ থেকে একটা একটা অর্ধ-জাগ্রত, ঘুমজড়ানো কন্ঠস্বর বলে উঠল,
-” হুমমম কে?”
তৃণা প্রচন্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেল, কী বলবে ও ভেবে পেলনা। এ বাবা… সৌমাভ তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছিল? ইশ, এভাবে ঘুমের মাঝখানে বিরক্ত করাটা বোধহয় উচিত হয়নি।
সৌমাভ কোনো উত্তর না পেয়ে, ফোনের দিকে একবার দেখল, অচেনা নম্বর। আসলে তৃণার নম্বরটা পরে আর সেভ করে রাখা হয়নি, তাই সেটা চিনতেও পারলনা সৌমাভ। সে বুঝতে পারল না, এত রাতে কে ফোন করছে! আবার একটু গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে সে বলল,
-” হ্যালো, কে বলছেন?”
-” আ-আমি তৃণা বলছিলাম”
-” তুমি?এত রাতে? দরকারি কিছু বলবে?”
-” না না,আসলে এমনিই ফোন করলাম, মানে আপনি দিতে এলেন আমাকে, তারপর তো আবার বৃষ্টি আসল। তাই সাবধানে পৌঁছেছেন কিনা, সেটা জানার জন্যই…”
-” ওহ, আচ্ছা। হ্যাঁ, আমি ঠিক ভাবেই পৌঁছে গেছি।”
-” হুমম ঠিক আছে”
এরপর মিনিটখানেকের নীরবতা। কিছুক্ষণ দুজনের কেউই কোনো কথা বললনা, আসলে কী বলবে সেটাই ভেবে পেলনা বোধহয়। শুধুমাত্র হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ গুলো শোনা যেতে লাগল। এমনিতে আজ মন-মেজাজ খুব বেশি ভালো নেই সৌমাভর।তৃণাকে পৌঁছে দিয়ে এসেই, একধাপ ঝামেলা হয়ে গেছে মৌলির সাথে। খুব সাধারণভাবেই সৌমাভ সত্যি কথাটা বলেছিল,যে এক ছাত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিল। আর সেটা নিয়েই ঝগড়া-ঝামেলা একেবারে তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন থেকেই এত বেশি মাথা যন্ত্রণা করছিল, যে না ঘুমিয়ে আর থাকতেও পারেনি সৌমাভ। এখন, তৃণার ফোনে সেই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যেতে খানিক বিরক্তই হয়েছে সে।
দু’পক্ষ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে, শেষপর্যন্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে, সৌমাভই কথা বলল,
-” বলছি, আর কিছু কি বলবে তুমি?”
-” না না, আর কী বলব?”
-” ওকে তাহলে ফোনটা রাখি ? আর হ্যাঁ, শোনো তৃণা… এভাবে রাত্রিবেলা হঠাৎ হঠাৎ ফোন করবেনা। আশাকরি বুঝতে পারছ, আমি কী বলতে চাইছি?”
-” শুনুন, আমি কোনো অন্যকিছু ভেবে ফোন করিনি ওকে? আজকে আপনি আমাকে কষ্ট করে দিয়ে গেলেন, তাই আমার একটা কর্তব্য ছিল, এটা। বুঝেছেন?”
তৃণা এবার একটু গলার আওয়াজটা উঁচু করে কথাটা বলল। খুব বেশিক্ষণ একভাবে, ধৈর্য্য ধরে রাখা তৃণা বোসের পক্ষে ভীষণই কষ্টকর একটা ব্যাপার। তাই সে ভুলে গেল, যে উল্টো দিকের মানুষটা তার স্যার। আর এনাকে সে মাঝে মাঝেই ভয় পায়, বা একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে ওনার প্রতি। তৃণা এমনভাবে হঠাৎ চিৎকার করে কথাটা বলে উঠল, যে সৌমাভ নিজেই সামান্য চমকে উঠল। সে আবার বলল,
-” ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজকে করেছো বুঝেছি, আর করবেনা সেটাই বললাম।”
-” আরে অদ্ভুত তো, আমার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? যে আপনাকে ফোন করব? মানুষের ভালো করতে নেই এইজন্য। দূরর! রাখুন তো ফোন, ছাতার মাথা”
গজগজ করতে করতে ফোনটা কেটে দিল তৃণা। এইজন্য এই মানুষটাকে ওর পছন্দ হয়না….। নিজের ইচ্ছেমত ব্যবহার করবে সবার সাথে। ওঁর নিজের মেজাজ অনুযায়ী যেন চলতে হবে সবাইকে। এত অপমান? কাল থেকে যদি নিজে থেকে তৃণা কথা বলেছে ঐ সৌমাভ চক্রবর্তীর সাথে, তাহলে সে তৃণা বোস নামটা পাল্টে অন্যকিছু রেখে দেবে- মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল তৃণা।
আর এদিকে, বিছানার উপর হতভম্ব হয়ে বসে রইল সৌমাভ। ঘুমটা অনেকক্ষণ হল ভেঙে গেছে। যে বিরক্তি ভাবটা ছিল প্রথমে সেটাও এখন আর নেই। অদ্ভুত ব্যাপার! ফোনটা হাতে নিয়ে তৃণার নম্বরটা সেভ করল সে। হোয়াটস অ্যাপে গিয়ে, ওর ডিপিটা ওপেন করল সৌমাভ। নীল রঙের একটা চুড়িদার পরা, বেশ হাসিমুখের একটা ছবি! এই ড্রেসটা পরেই, কলেজের অনুষ্ঠানে এসেছিল তৃণা। চোখ বন্ধ করে, সেই দিনের দৃশ্যটা মনে মনে একবার ভাবল সে। আর তার পরেই হঠাৎ চোখটা খুলে, উঠে দাঁড়ালো সৌমাভ। নাহ্, ব্যাপারটা ক্রমশই হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটাকে যে ভাবেই হোক আটকাতে হবে। মনের অনুভূতি গুলো, এভাবেই চলতে থাকলে… হয়তো একদিন সেই অঘটন টাই ঘটে যাবে যেটার আশঙ্কায় আজ সন্ধ্যে থেকে ভেবে যাচ্ছে সৌমাভ।
ফোনটা চার্জে বসিয়ে, একটা সিগারেট জ্বালালো সে। অন্ধকার ঘরে জ্বলন্ত সিগারেটের লালচে আলোটা যেন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। যত ঘুমোনোর চেষ্টা করছে সৌমাভ, তত বেশি করেই তৃণার কথাগুলো ওর মাথায় ঘুরেফিরে আসছে। মেয়েটাকে বারণ করে, এখন তো নিজেই সব বারণের বাধা পেরিয়ে যাচ্ছে সৌমাভ! মনের ভিতরে একটা অস্থির ভাব যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই অস্থিরতার শেষ কোথায়? মনের গভীরে অনেক হাতড়েও কোনো উত্তর পেল না সে। সিগারেট টা ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। শেষ অংশটুকু বারান্দার কাছে ফেলে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল, সৌমাভ। আর তারপরেই কখন যে, বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ল সে, তা ও বুঝতেই পারলনা…
************
সোমবার। কলেজের লাঞ্চ টাইমে ক্যান্টিনে বসে আছে, তৃণা আর পর্ণা। কোল্ডড্রিংকসের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে, মুখে বেশ একটা তৃপ্তির শব্দ করে তৃণা বলল,
-” আহা, কতদিন পর একটু ঠান্ডা খেলাম। বাড়িতে মা তো খেতেই দেয়না এসব। এমন করে না মা”
-” আরেহ্, তুই তো একদিন ঠান্ডা খাবি, তারপর দু’দিন আর কথা বলতে পারবিনা। পেত্নীর মত খসখসে আওয়াজ বেরোবে খালি”
-” এই চুপ করতো। আমি মরছি আমার টেনশনে, আর ইনি এসেছেন জ্ঞান দিতে।”
-” কেন? কী হয়েছে আবার? সৌমাভ স্যার এর কোনো খবর? তুই ও তো বললি, ক্রাশ খেয়েছিস ছোটোখাটো”
-” দূর দূর, ওনার কথা বাদ দে, বহুত ঘ্যাম ওঁর। বেশি বেশি , পাত্তা পেয়ে মাথায় উঠে গেছে একেবারে। আমি চিন্তায় আছি, সৌমিককে নিয়ে”
চিন্তিত গলায় বলে উঠল তৃণা। পর্ণা নতুন গল্পের স্বাদ পাওয়ার লোভে একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর তৃণার হাতটা ধরে সে হাসিমুখে বলল,
-” প্রপোজ করেছে তোকে? এই দুই ভাইকে একসঙ্গে ঘোরাবি নাকি?”
-” ফালতু বকিস না, সৌমিকের কথাবার্তা আমার সুবিধের লাগছেনা। যদি প্রপোজ করে দেয়, কী উত্তর দেব? না বলে দেব মুখের উপর?”
-” তোর কি ভালোলাগে ওকে? মানে তোর মন যা চায়, সেটাই করবি।”
-” হুমম তা তো করবই। আসলে সামনের বুধবার, সৌমিক বলছিল একটা মুভি দেখার কথা, মানে ওর সাথে আলাদা করে বেরানোর জন্য। সেখানে গিয়ে যদি এরকম কিছু বলে, তাহলে??”
-” তাহলে চল, আমিও যাব সাথে, কেমন আইডিয়া?”
-” যাবি তুই?? সত্যি? তাই কর বরং, তারপর দেখছি ব্যাপার কোনদিকে এগোয়”
গ্লাসের কোল্ড ড্রিঙ্কসটা পুরোটা একেবারে খেয়ে নিয়ে, হাসিমুখে মুখটা মুছে কথাটা বলল। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পড়েনি, কেন যে সেদিন বিনা নিমন্ত্রণে ঐ বিয়েবাড়ি ভেবে ওখানে খেতে গেল !
(ক্রমশ)