মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:১

0
1198

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#প্রথম_পর্ব ❤
শহরের রাস্তায় সবেমাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। বৈশাখ মাসের তপ্ত দুপুরের পর একটুখানি ঠান্ডা স্বস্তির হাওয়া। একটা দুটো করে রাস্তার হলদে-সাদা আলো গুলো জ্বলে উঠছে। মেইন রোডের উপরে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে অসংখ্য গাড়ি। উবার থেকে নেমে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে, তৃণা ফুটপাতের দিকে একটু সরে দাঁড়াল। পর্ণাও ধীরপায়ে, অন্যমনস্ক ভাবে ওর পাশে এসে দাঁড়াল। এভাবে মাঝরাস্তায় হঠাৎ নেমে পড়ার উদ্দেশ্য হল, আপাতত কোনো খাবারের দোকানের সন্ধান করা। সকাল থেকে কলেজের সেমিনার, ফ্রেশারস অনুষ্ঠান সব সামলে খাওয়া দাওয়াটা করাই হয়নি সেভাবে। আর তৃণার পক্ষে এতটুকু খিদে সহ্য করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। সে কারণেই তড়িঘড়ি করে এভাবে মাঝপথে নেমে যাওয়া। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে কাজটা করা হল, সেটাই বোধহয় আর সফল হলনা। আশেপাশে যতদূর চোখ যাচ্ছে, কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট বা খাবারের স্টল তো দেখা যাচ্ছেনা। সারাদিনের ক্লান্তি, ঝামেলার আর খিদের চোটে তৃণার রাগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। গজগজ করতে করতে সে পর্ণার হাতে কনুই দিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে বলল,

-‘ বল, কী করব এখন? দাঁড়িয়ে থাকব এভাবে রাস্তার মাঝখানে?’

-‘ আমি কী বলব বল তো! তোর কাকিমা যখন টিফিনে লুচি আলুচচ্চড়ি দেবে বলেছিল, তখন কে বারণ করেছিল? আমি? ওটা থাকলে তো পেট ভরে খাওয়া যেত এখন, তাই না?’

-‘উফফফ চুপ কর তো। জ্ঞান দিস না। কী করে জানব এত দেরী হবে! ঐ নতুন কে প্রফেসর এসেছে না কে এসেছে, ওর জন্য তো এইসব হল। ক্যান্টিনও বন্ধ হয়ে গেল। সব ঝামেলা যেন একসাথে হওয়ার ছিল।”

-‘ ছাড় বাদ দে, মাথা ঠান্ডা কর। চল বাড়ি যাই তাড়াতাড়ি, ফালতু দাঁড়িয়ে না থেকে। একটা ক্যাব বুক কর আবার’

তবু শেষচেষ্টার মত করে চারিদিকে একবার তাকাতে লাগল তৃণা। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে আসার সাথে সাথে পথচলতি সবার ব্যস্ততাও যেন বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ব্যর্থ মনে সামনে থেকে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে যাবে এমন সময় হঠাৎ তৃণার চোখ পড়ে গেল একটা বাড়ির উপরে। রাস্তার উপরেই বেশ বড়ো একটা বাড়ি, আলো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অনেক লোকজন যাওয়া আসাও করছে সেখানে। দেখে মনে হচ্ছে, কোনো বিয়েবাড়ি টিয়েবাড়িই হবে হয়তো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। একগাল হেসে সে বাঁকা চোখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পর্ণার দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলে উঠল,

-‘ এইই দেখ, ঐদিকে একবার। বিয়েবাড়ি বোধহয়। এখন তো বিয়ের সিজন চলছে, তাই না?’

পর্ণা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘তো কী করব? যার বিয়ে সে বুঝবে, আমার কী?’

-‘আরে ধুর, কিচ্ছু বোঝেনা মেয়েটা। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ, আমার দিকে তাকিয়ে দেখ। কলেজের অনুষ্ঠানের জন্য দুজনেই যা সেজে আছি, তাতে মোটামুটি চালিয়ে দেওয়া যাবে কী বল? হবে না?’

-‘মানে??’

-” মানেটা ভেরি সিম্পল। আমরা অতিথি সেজে ঐ বিয়েবাড়িতে ঢুকে খেয়ে চলে আসব। টাকাও খরচ হবেনা, খাওয়াও কমপ্লিট। আর দেখে তো মনে হচ্ছে বড়োলোক বাড়ির বিয়ে, দুটো একস্ট্রা প্লেট গেলে খুব বেশি অসুবিধা হবে বলে মনে হয়না, কী বল?’

-” তৃণা তুই শিওর? না মানে, এটা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। যদি কেউ কোনোভাবে বুঝে ফেলে, তাহলে ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে।”

তৃণার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় কথাটা বলল পর্ণা। ভর-সন্ধ্যাবেলায় মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তৃণার প্ল্যানটা শুনে রীতিমত ঘাবড়ে গেছে সে। অবশ্য অবাক খুব একটা হয়নি।কারণ পর্ণা জানে, তার ছোটোবেলার এই বান্ধবী- তৃণা ,এ বরাবরই এমন পাগলামি করে। একবার কিছুর জেদ ধরলে আর সেটা না করা অবধি শান্তি নেই। যেমনটা এখন করছে।

-এই শোন, এত ভাবিস না বুঝলি? লাইফটা এমনিতেই শুকনো তেজপাতা হয়ে গেছে, একটু অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে আর বাঁচার কী দরকার তাহলে? কেউ কিচ্ছু বুঝবেনা। ম্যায় হু না!’

-‘ তুই আছিস বলেই তো চিন্তা, সেই সেবার হাইরোডের দিকে, গাড়ি থেকে নেমে কোন গাছের ফল চুরি করতে গিয়ে কেস খেয়িছিলি মনে আছে তো? তোর সাথে সাথে আমাকেও পুরো গাড়ি অবধি ছুটতে হয়েছিল একটানা। উফফ, আর কিন্তু অমন দৌড়াতে পারবনা বলে দিলাম”

-‘ ধুসস, তুই সাহস করে আয়ই না একবার। কেউ চিনতে পারবেনা। কনেপক্ষ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলব আমরা বরপক্ষ। আর নাহলে উল্টোটা। ব্যস, রাস্তা ক্লিয়ার”

-‘কিন্তু ….’

-” আর কোনো কিন্তু নয়, আয় তো তুই।”

এই বলে পর্ণাকে আর কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে ওর হাতটা টেনে ধরল তৃণা। সাবধানে কোনোরকমে রাস্তাটুকু পার হয়েই ওরা বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছে পর্ণার। কেউ বুঝতে পারলে যে কতটা লজ্জাজনক ব্যাপার হবে, সেই দুশ্চিন্তা তেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। কোথাও কিছু যেন একটা গন্ডগোল লাগছে ওর। কিছু একটা মনে হচ্ছে নেই, অথচ যেটা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা যে কী জিনিস, তা-ই এই মুহূর্তে মাথায় এলনা তার।

*************
কফি কাপটা হাতে নিয়ে, ধীরপায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো সৌমাভ। দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিয়ে, ঘরের শেষ আলোটুকুও নিভিয়ে দিল সে। আনমনা হয়ে সন্ধ্যা-প্রকৃতির উদ্দেশে নিজের দৃষ্টিটুকু বিলিয়ে দিল সৌমাভ। বহুতল অন্ধকার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে অসংখ্য সুন্দর, স্নিগ্ধ কিছু কিছু দৃশ্য চোখে পড়ছে। দূরের ঘরবাড়ি, নীচের রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করা ব্যস্ত গাড়ি-ঘোড়া গুলোকে ছোটো ছোটো আলোর ফুটকি মনে হচ্ছে। সারাদিন কাজ করে এসে, ক্লান্তি কাটাতে এইটুকু সুন্দর দৃশ্যই যেন যথেষ্ট তার জন্য । নতুন চাকরি, নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা…. সব মিলিয়ে এমনিতেই বেশ টেনশনে আছে সৌমাভ। শহরের এই বেসরকারি বিখ্যাত কলেজটায়, সবাই একটা চাকরির জন্য হা পিত্যেশ করে। সেখানে একপ্রকার ভাগ্যের জেরেই বলা যায় সে চাকরিটা পেয়ে গেছে। আপাতত পার্ট টাইম প্রফেসর হিসেবে চান্স পেয়েছে, ধীরে ধীরে চেষ্টা করলে পদোন্নতি ঘটবেই, এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। ভাগ্যে বিশ্বাসী হলেও, নিজের হাতে প্রতি এটুকু আত্মবিশ্বাস তার আছে। আজ অনেক ছাত্রছাত্রীই তার কমবয়স দেখে প্রথমে খানিকটা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, কয়েকটা ছেলে একটু হাসিঠাট্টা করারও চেষ্টা করছিল। কিন্তু সৌমাভ সেসবকে পাত্তা দেয়নি। কারণ সে যে আসলেই কীরকম তা এরা কয়েকদিন পরেই টের পাবে নিজেরা। তখন হাসি ঠাট্টা, মজা, ইয়ার্কি সব একনিমেষে থেমে যাবে।

সবকিছু ভালোর মাঝখানে, আজকে সারাদিনের ঘটনাগুলোর কথা পরপর মনে পড়লেই মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে সৌমাভর। কী যেন নাম ঐ মেয়েটার, যে আজকে প্রোগ্রামটা হোস্ট করছিল, কী তৃষা না তৃণা নাম, এত বিরক্তিকর, পাকা একটা মেয়ে যে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়। কথায় কথায় এমন আচরণ করছিল যেন ও নিজে টিচার, এবং সৌমাভ ওর স্টুডেন্ট। শুধুমাত্র আজ প্রথম দিন, তারমধ্যে অনুষ্ঠান ছিল বলে মুখ বন্ধ করে সবকিছু সহ্য করে নিয়েছে সে, সোমবারটা আসুক একবার, সব শুধে আসলে উসুল করে নেওয়া হবে, এত সহজে কোনোকিছু ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, মি.সৌমাভ চক্রবর্তী।

***********

বাইরে থেকে যতটা সুন্দর লাগছিল বাড়িটাকে, ভেতকে যেন সেটাকে আরো বেশি সুন্দর মনে হল তৃণার। কিন্ত আশেপাশের খাবারের স্টলগুলো কোথায়! মানে একটু ফুচকা, পকোড়া, আইসক্রিম…এসব আর কী!. তৃণা ভাবছিল স্টার্টার টুকু খেয়েই বেরিয়ে যাবে, মেইন কোর্স খাওয়ার দরকার নেই। বেশি রিস্ক না নেওয়াই ভালো। কিন্তু এখানে তো কিছু স্টার্টারই চোখে পড়ছে না। উপরের তলায় উঠতে হবে নাকি! বেশি নার্ভাস মুখ বানালে চলবেনা। হালকা ফুরফুরে মেজাজে পর্ণার সাথে কথা বলতে বলতে এগোতে লাগল তৃণা। আশেপাশের মানুষগুলোও বেশ আনন্দের সাথে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত। হঠাৎ করে তৃণার নিজেরও কীরকম যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে পর্ণার সাথে হাঁটতে হাঁটতে সে ফিসফিস করে বলল,

-‘ শোন না, কেউ বুঝবে না তো রে? আমরা এরকম ভাবে না বলে ঢুকে পড়েছি”

-‘এখন আমাকে বলছিস? তোকে তো কতক্ষণ থেকে বলে যাচ্ছি, এই কথাটাই। বলছি তৃণা, এটা বিয়েবাড়িই তো? কার সাথে কার বিয়ে সেটাও তো কোথাও লেখা নেই ‘

-‘ উফফ, তুই আবার আর এক পাগল! বিয়েবাড়ির সিজন এটা , এই তো আমাদের পাড়াতেই আছে একটা বিয়ে আজকে। বিয়ে হবে নাতো কী হবে? শ্রাদ্ধবাড়ি?”

-‘হতেই পারে, আজকাল সবই সম্ভব!’
ভাবলেশহীন মুখে কথাটা বলল পর্ণা। ওর কথা শুনে তৃণার বিরক্তিটা আরো একধাপ বেড়ে গেল। সে দাঁতে দাঁত চেপে, নীচু গলায় বলল,

-‘তোর শ্রাদ্ধ এরকম বাড়ি ভাড়া নিয়ে, ডিজে চালিয়ে , আলো দিয়ে সাজিয়ে পালন করব। বুঝেছিস?’

-‘এক্সকিউজ মি’
তৃণা আর পর্ণা দুজনেই হঠাৎ অচেনা গলার আওয়াজ শুনে, কথা থামিয়ে, চমকে পিছনে ফিরে তাকাল। একটা কমবয়সী ছেলে, হয়তো তাদের সমবয়সীই হবে। নীলসাদা চেকশার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স পরা, চুলটা খানিক এলোমেলো, কিছুটা ঘামে লেপ্টে আছে কপালে। মুখে একটা কৌতুকের হাসি লেগে আছে। ছেলেটা তৃণার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তৃণা ভেবে পেলনা যে কী কথা দিয়ে কথোপকথন শুরু করবে। ভেতরে ভেতরে ইতিমধ্যে তার হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। পর্ণা তো আর তাকিয়েই নেই এদিকে। সে ফোন নিয়ে কাকে একটা ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে! আসল না নকল কে জানে! একবার সুযোগ আসুক,মেরে ওর নিজের নাম ভুলিয়ে দেবে তৃণা।
ছেলেটা মুচকি একটু হেসে, এগিয়ে এল তৃণার দিকে। তারপর বেশ সহজ গলাতেই বলল,

-‘ আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না। মানে, মনে পড়ছেনা আসলে। আপনারা পারমিতার বান্ধবী?’

-‘হ্যাঁ?? ওহ হুমম। পারমিতার বান্ধবী, আমরা পারমিতার বান্ধবী। আপনিও? ?’

-‘সেকি পারমিতা কে চেনেন, আমাকে চেনেন না? আমার দিদি তো! ওর জন্যই আজকের অনুষ্ঠান। আশ্চর্য!! ‘

-‘হ্যাঁ?? আসলে মানে, ঠিক বুঝতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু কিছু কি হয়েছে নাকি?’

-‘ না না, জাস্ট আলাপ করতে এলাম। দাঁড়িয়ে আছেন কেন, যান না গিয়ে বসুন।”

-‘হুমমম, বলছি বিয়ে কি শুরু হয়ে গেছে? মানে লগ্নের সময় তো হয়ে গেছে মনে হয়’

প্রথমে ভয় পেলেও, কিছুটা কথা বলার পর বেশ অনেকটা আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে তৃণার মধ্যে। তারমানে পারমিতা নামের কারোর বিয়ে। ব্যাপারটা আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য একটু বেশিই বলে ফেলল তৃণা। অবশ্য ছেলেটি তাতে অবাক হলনা। সে আগের মতোই মুচকি হেসে বলল,

-‘উপরে আসুন আমার সাথে। সমস্ত অতিথি ওখানেই আছে। একটু গল্প গুজব করুন। এখন তো কেক কাটা হবে। তারপর না হয় দেখা যাবে, বিয়ের লগ্ন ক’ টায় আছে। কেমন??”

-‘মানে??”
বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ল তৃণা। তারমানে এটা বিয়েবাড়ি নয়? বার্থডে সেলিব্রশন হচ্ছে? মাই গড ! এই ছেলেটা আবার বার্থডে গার্ল এর ভাই! সবটা জেনেও গেছে। কী হবে এবারে? ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে তৃণা দেখল, একটু দূরে পর্ণাও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মনে হচ্ছে পা দু’টো কেউ আঠা দিয়ে মেঝের সাথে আটকে দিয়েছে।
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here