মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:২

0
684

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#দ্বিতীয়_পর্ব❤
-‘ কী হল চলুন? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”

ছেলেটি আরেকবার খুব স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বলল। ওর মুখের সেই কৌতুকের হাসিটা এখনও একইরকম রয়েছে। কিন্তু তৃণা এত তাড়াতাড়ি সহজ হতে পারে পারলনা। এই পরিস্থিতিতে যে পড়তে হবে, এই ধারণা টুকুই তো আসেনি এতক্ষণ মাথায়। পর্ণার কথা মেনে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেই দেখা যাচ্ছে ভালো হত। এখন তো ছেলেটা এমন ভাবে সামনে পুরোটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে যে, ছুটে পালানোও একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। তাহলে কি সব সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো?? সেই বরং ভালো! তৃণা মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল । একটু হালকা হেসে সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে এই প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠল,

-‘ আ-আপনি যা ভাবছেন, ব্যাপারটা তা কিন্তু নয়। একটু সমস্যা হয়ে গেছে আসলে আমাদের। মানে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। তাই… বুঝতে পারিনি আপনার দিদির জন্মদিন আজকে। আমরা এখনি বেরিয়ে যাচ্ছি, কোনো অসুবিধা হবেনা আপনাদের’

-” এই দাঁড়ান দাঁড়ান, কোনো ভুল নেই। আমি অনেকক্ষণ আগে থেকেই, লক্ষ্য করছি আপনাদের, আর সম্ভবত বুঝতেও পেরেছি ব্যাপারটা কিছুটা হলেও। বাট আমি সত্যিই কিছু মাইন্ড করিনি। আপনারা চাইলেই উপরে আসতে পারেন, পার্টি অ্যাটেন্ড করতে পারেন।’

-‘মানে এতক্ষণ আপনি সব জেনেও নাটক করছিলেন তাই তো? আর এখন দয়া দেখাচ্ছেন? আপনার দেখে মনে হচ্ছে যে আমরা ঐ ধরনের? যারা বিনা নিমন্ত্রণে খেয়ে চলে যাবে? বলুন?”

এভাবে ধরা পরে গিয়ে আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে রেগে গেল তৃণা। ছেলেটার এই সবজান্তা মুচকি মুচকি হাসি দেখলে গা জ্বলে যাচ্ছে। অপমানে লজ্জায় ওর মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে রীতিমত।

-‘আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে অপমান করার জন্য বলিনি কথাটা। আপনাদের দেখে অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে যে আপনারা অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ। এভাবে এসেছেন যখন নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, বা মজা করে করেছেন। এই নিয়ে আমি রাগ বা মজা কোনোটাই করছিনা।”

-‘ঠিক আছে, এখন আমরা চলে যেতে চাই। প্লিজ রাস্তা ছাড়ুন।’

তৃণা চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই ছেলেটি ব্যস্ত ভাবে আরো একবার বলার চেষ্টা করতে লাগল,

-‘হাই, আমি সৌমিক। সৌমিক চক্রবর্তী । আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি, প্রথমে মজা করার জন্য। আজকে আপনারা এসেছেনই যখন, প্লিজ কিছু অন্তত খেয়ে যান। নাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে। প্লিজ’

তৃণা মাথাটা তুলে এবার একটু ভালো করে তাকাল সৌমিকের দিকে। ছেলেটা দেখতে বেশ। একটু বাচ্চা বাচ্চা ভাব এখনো যেন রয়ে গেছে মুখে। আর এখন এমন করে সে ওদের থেকে যেতে বলছে যে রাগ ভুলে একটু হাসিই পেয়ে গেল তৃণার। ও দেখল গুটি গুটি পায়ে পর্ণাও কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে ওরও একটু সময় লাগছে। ছেলেটা এত করে কেন বলছে তৃণাকে এই ব্যাপারটাও খটমট লাগছে। প্রেমে পড়ে গেল নাকি! তৃণা এবার গলাটা সামান্য গম্ভীর করে বলল,

-‘ বাকিরা কেউ কিছু বললে? মানে আমরা কে বা এরকম কিছু? তখন?”

-‘বলব আমার বন্ধু হন। কেউ কিছুই বলবে না। কিন্তু আপনারা নিজেদের পরিচয়টা এখনো দিলেন না”

-‘বাব্বা! এত তাড়াতাড়ি বন্ধুও হয়ে গেলাম? যাই হোক আমি তৃণা বোস, আর এ হল আমার বন্ধু পর্ণা ‘

-‘ওহহ , বেশ নমস্কার । আর বন্ধুত্ব হতে নিশ্চয় খুব বেশী সময় লাগেনা। বরং বন্ধুত্বটা বজায় রাখাটাই মুশকিলের। আর প্লিজ এবার চলুন, উপরে সবাই আমাকে খুঁজতে আরম্ভ করে দিয়েছে। আসুন আমার সাথে”

তৃণা আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালো সৌমিকের সাথে। ও লক্ষ্য করল না, যে একজোড়া মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি ওকে আড়াল থেকে ক্রমাগত দেখে যেতে লাগল। প্রথম দেখাতেই একটা ভালোলাগার আবেশে মনটা ছেয়ে গেল সৌমিকের। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আড়চোখে তৃণার দিকে একবার তাকালো সে। নীল রঙের একটা লং স্কার্ট আর টপে অসাধারণ লাগছে মেয়েটাকে। মুখচোখ দেখে, আর আজকের ঘটনা দেখেও বোঝা যাচ্ছে, যে যথেষ্ট দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় ঘোরাফেরা করছে সারাক্ষণ। তবে একদিকে ভালোই হয়েছে। ভাগ্যিস এরকম দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চেপেছিল, তবেই না দেখা হল! ভগবান কখন কার সাথে দেখা করিয়ে দেয়, কী উদ্দেশ্যে, তা বোঝাই দায়!

************
কলেজে এসে, ক্লাসে ঢুকেই মাথাটা গরম হয়ে তৃণার। আজকেও লাস্টবেঞ্চে জায়গা হলনা। গত তিনদিন ধরে এরকম হচ্ছে। না পারছে ভালোমত ক্লাসের মাঝে ঘুমোতে, আর না পারছে ক্লাসগুলো এড়িয়ে যেতে। তার মধ্যে , আজ নতুন টিচারের ক্লাস আছে। তিনি আবার কেমন পাবলিক কে জানে! বিরস মুখে ব্যাগটা একটু ছুঁড়েই টেবিলে রাখল তৃণা। তারপর জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করে, পর্ণার নম্বরটা ডায়াল করল।

-‘এই কোথায় তুই? তাড়াতাড়ি আসতে পারিস না কলেজে???’

-‘হুমম, কেন কী হয়েছেটা কী? অটোয় আছি, ফার্স্ট ক্লাসটা আর হবেনা, বাদ দে। ফোন রাখ। গিয়ে কথা বলছি।’

পর্ণা ফোনটা কাটতেই, রাগটা আরো একটু বেড়ে গেল তৃণার। আজ থেকে ক্লাস রিপ্রেজেন্টার হিসেবে আবার ওর দায়িত্ব। সব চিন্তা মাথায় একেবারে এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লাসে টিচার চলে এসেছে, তৃণা বুঝতেই পারেনি। সেই নতুন প্রফেসর, যার আসার কথা ছিল আজকে। তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে সামনের দিকে একবার তাকাল সে। দেখল, কালচে নীল রঙের একটা ফুলহাতা শার্টের সাথে, কালো ফর্মাল প্যান্ট। শার্টটা ইন করে পরা। মুখে হালকা দাড়ির সাথে একটা কালো ফ্রেমের চশমা মুখটায় দারুণ মানিয়েছে। চেহারাটাও বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান। বয়সও যে খুব বেশি নয়, সেটাও মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মোটকথা ক্লাসের প্রতিটা মেয়ে যে এবার এনাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করবে, এটা স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে। অবশ্য তৃণার এসব নিয়ে মাতামাতি করার খুব বেশী ইচ্ছে নেই। এই লোকটাকে কাল একবার দেখেই, ঠিক সুবিধার মনে হয়নি ওর। সারাক্ষণ কীরকম গম্ভীর মুখ করে বসে আছে, কঠিন স্বরে কথা বলছে। এই বয়সে এত পড়াশোনা করে ফেললে, যা হয় আর কী….। জীবনে কোনো সুখশান্তি থাকেনা এদের, শুধু ছাত্রছাত্রীদের জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করে বেড়ায়।

ক্লাসের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর চোখ এখন সামনের টেবিলের দিকে আটকে রয়েছে। সৌমাভ নিজেও মাইকটা হাতে নিয়ে, একবার চোখ বুলিয়ে নিল ক্লাসের প্রত্যেকের দিকে। একটু নার্ভাস লাগছে তার নিজেরও, তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগলনা। গলাটা কেশে সামান্য পরিষ্কার করে, মাইকটা মুখের সামনে এনে সে একটা ভারী পুরুষালি গলায় বলে উঠল,

-‘গুড মর্নিং এভরিবডি। হোপ, ইউ অল আর ফাইন। সো ডু ইউ নো মি? এনিওয়ান ?’

এতক্ষণ প্রত্যেকে বিশেষ করে মেয়েরা, শুধু তাদের ক্লাসে আসা নতুন প্রফেসরের চেহারা দেখেই অর্ধেক গলে গিয়েছিল। এখন এই গমগমে, ভারী গলার আওয়াজটা শুনে আরো যেন গুঞ্জন বেড়ে গেল। সৌমাভর কথার উত্তরে ক্লাসে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হলেও, কেউই সেভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বললনা। অগত্যা সৌমাভ নিজেই আবার বলল,

-‘ওকে, কিপ সাইলেন্স। আমিই বলছি। মাইসেল্ফ সৌমাভ চক্রবর্তী , বি.এস. সি অ্যান্ড এম. এস.সি অন ফিজিওলজি। আমি এই কলেজের এখন ফিজিওলজির পার্টটাইম প্রফেসর। তোমাদের ক্লাসও এখন থেকে আমিই নেব। সো আজকের ক্লাসে তোমরা নিজেদের ইন্ট্রোডাকশন গুলো দাও একে একে। নেক্সট ক্লাস থেকে আমি পড়ানো স্টার্ট করব। ইজ ইট ওকে?”

প্রত্যেকেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল এই কথাটায়। এক এক জন করে উঠে নিজের নাম, বলতে শুরু করল। কিন্তু মিনিটদুয়েক পর সৌমাভ হাতের ইশারা করে সবাইকে একটু চুপ করতে বলল। ওর চোখ এখন সিটের থার্ড রো এর কর্ণারের দিকে। ক্লাসে এতক্ষণ এত কথা হয়ে গেল, অথচ একটা মেয়ে সেই থেকে পুরো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল এতটা সময়? বিরক্তিতে সৌমাভর ভ্রু কুঁচকে উঠল। এই জিনিসটা তার ভীষণ অপছন্দের। পড়াশোনা জিনিসটা তার কাছে ভীষণ সিরিয়াস একটা ব্যাপার। আর তাছাড়া ক্লাসে টিচার থাকাকালীন এভাবে ঘুমোনো মানে তো সেই টিচার কেই অপমান করা!
কিছু কথা না বলে সৌমাভ নিজেই হেঁটে হেঁটে তৃণার সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ক্লাসের সবাই ততক্ষণে বুঝে গেছে ব্যাপারটা। চাপা একটা হাসিও শুরু হয়ে গেছে। যদিও সবার কাছে এটা ভীষণ পরিচিত একটা দৃশ্য! তৃণা বোস ক্লাসে জেগে থাকাটাই পৃথিবীর নবম আশ্চর্য। অনেক টিচার ও ব্যাপারটা দেখেন, জানেন তবে পাত্তা দেননা। কিন্তু এই নতুন প্রফেসর কী করে, সেটা জানার একটা প্রবল আগ্রহ প্রত্যেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। সৌমাভ কাছাকাছি যাওয়ার আগেই, তৃণার পাশের জন ওকে ধাক্কা মারতে লাগল জাগাবার জন্য। কিন্তু এমন গভীর ঘুম যে কুম্ভকর্ণ কেও হার মানায়। অনেকবার ডাকার পর ঢুলুঢুলু চোখেই, এলোমেলো মাথার চুল নিয়ে তৃণা সামনের দিকে তাকাল। আর প্রায় সাথে সাথেই সে চমকে উঠল। দেখল, স্যার ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে, আর ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়েও ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফর্সা কানের পাশগুলো লাল হয়ে গেল সাথে সাথে! কান দিয়ে এমন গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে , যে তৃণার মনে হতে লাগল এক ছুটে ক্লাস থেকে পালিয়ে যায়।

-‘প্লিজ স্ট্যান্ড আপ” স্পিকার ছাড়াও সৌমাভর গলার আওয়াজটা যথেষ্ট জোরে শোনা গেল। তৃণা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে এই লোকটার উপর যে পরিমাণ রাগ ধরছে তার, সেটা যদি বাড়িতে হত, তাহলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত।

-‘ ক্লাসে ঘুমোচ্ছিলে কেন? এনি প্রবলেম? আর ইউ সিক?”

-‘ না আসলে মাথা যন্ত্রণা করছিল, তো তাই জন্য ….”
কোনোরকমে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগল তৃণা। কিন্তু সৌমাভ যে এসব উপরচালাকি দেখে অভ্যস্ত সেটা বোধহয় সে বুঝতে পারেনি। তৃণার উত্তরটা শুনে, সৌমাভ একইরকম কঠিন গলায় বলল,

-‘ওকে দেন লিভ মাই ক্লাস। বাড়ি যাও, রেস্ট নাও, ফিট হলে দেন ক্লাস জয়েন করো। নাউ প্লিজ গেট আউট ফ্রম দ্য ক্লাস।’

-‘বাট আমি …..”

-‘ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম। জাস্ট আউট”

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here