চন্দ্রাবতী,পর্ব:২১

0
926

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#অন্তিম পর্ব

সেদিনের সেই বিভীষিকাময় কালরাত্রির পর কেটে গেছে পঁচিশ বছর। সময় তার আপন খেয়ালে চলে। সে কখনো কারো জন্য থামে না। এই পঁচিশশ বছরে পরিবর্তন হয়ে গেছে সবকিছু। বদল ঘটেছে চন্দ্রা ,চারুর দুইজনের জীবনেই।

গ্রামের আঁকা বাঁকা মেঠো পথে আজ পঁচিশ বছর পর আবারো রূপগঞ্জে যাচ্ছে চন্দ্রা। সাথে চন্দ্রার স্বামী পূর্ন আর বছর সতেরোর কিশোরী মেয়ে নূর। তুহিনের বিয়ের পরেরদিন সেই যে চারুর হাত ধরে চন্দ্রা শহরের পথে পাড়ি জমিয়েছিল তারপর আর ফিরে নি এই রূপগঞ্জে। চারুর খবর না পেলে এবারো হয়তো আসতো না চন্দ্রা।

রূপগঞ্জের “মাষ্টার বাড়ির” আঙিনায় এসে থামল চন্দ্রা। মলিন দৃষ্টিতে চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে তাকাল টিনের বেড়া দেওয়া বাড়িটির দিকে। আজকাল “মাষ্টার বাড়ির” কাঠের দরজার ওপাশে কারো গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। চন্দ্রার চলে যাওয়ার বছর দুয়েকের মাথায় হঠাৎ মারা যান “মাষ্টার বাড়ির” কর্তী আনোয়ারা বেগম। আনোয়ারা বেগম মারা যাবার পর চারু আর আমজাদ হোসেন তখন ভেঙ্গে পড়েন । স্ত্রীর এভাবে চলে যাওয়াটা হয়তো সহজে মেনে নিতে পারেন নি “মাষ্টার বাড়ির” গৃহকর্তা তাই তো বছর চারেকের মাথায় এই ধরনীর মায়া ত্যাগ করে তিনিও চলে যান পরপারে। এরপর মাষ্টার বাড়ির এই বড় ঘরগুলো খালিই পড়ে থাকে সব সময় । চারুরা বছরান্তে এক আধবার আসে এক-দু দিনের জন্য । এর বেশি দিন এই রূপগঞ্জে থাকে না তারা। হয়তো আগের মতো আর এই গ্রাম টানে না ওদের‌।

চন্দ্রা নিজের স্বামী সন্তানকে নিয়ে নিজের নিজেদের টিনের বেড়া দেওয়া ঘরের সামনে এসে দাড়ালো। আগের থেকে এখন‌ বেশ স্বচ্ছল হয়েছে ওদের পরিবার। তাইতো ছনের চাল পরিবর্তিত হয়েছে টিনের চালে। সেই সাথে একটা ঘরের পরিবর্তে দাঁড়িয়েছে তিনটি ঘর। এর সবটাই চন্দ্রার বৌদলতে হয়েছে। মেয়ে আর জামাইকে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলেন বিলকিস বেগম। এখনকার বিলকিস বেগম আর পঁচিশ বছর আগের বিলকিস বেগমের মাঝে বিস্তর ফারাক। এই পঁচিশ বছরে বিলকিস বেগমের মাথার চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে,সেই সাথে কুঁচকে ঝুলে গেছে গায়ের চামড়া। পিট বেঁকিয়ে কুঁজো হয়ে গিয়েছেন এখন।

মাকে এগিয়ে আসতে দেখে চন্দ্রা বলে ওঠল,

–” কেমন আছো মা? শুনলাম তোমার নাকি শরীর খারাপ? ভাইয়া কোথায়? ”

–” আমি আর কই দিনই বা বাচুম। আমারে নিয়া ভাবিস না। তুই বরং তোর মাইয়া আর জামাইরে নিয়া ভেতরে তা।”

–” সে তো যাচ্ছি কিন্তু ভাবি কই? আর তুমিই বা এতো শুকিয়ে গেছো কেন?”

–” সে অনেক কথা পরে কমু নে।”

–” আচ্ছা ভেতরে চলো।”

একটা বড় ঘরে চন্দ্রাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন বিলকিস বেগম। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। তাই আজ আর বাড়তি কিছু করতে হয় নি ওনাকে। গত বছর পাঁচেক আগে ওনার স্বামী রমজান মিয়া ওনাকে একা রেখে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই থেকে এই বিশাল বাড়িতে একাই থাকতেন বিলকিস বেগম কিন্তু গত বছর ওনার ছেলে নাহিদ এসে ভাগ বসালো ওনার সংসারে। চাকরিতে নাকি চুরি করার অপরাধে ওকে বের করে দিয়েছিল সেখান থেকে। জমানো কিছু টাকা দিয়ে মাসখানেক চলেছিল দুজনে কিন্তু চাকরি যোগাড় করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ মায়ের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় ওরা। সেই থেকে মায়ের সাথেই সাথে এই স্বার্থপর দম্পতি।

বিকেলের গোধূলি লগ্নে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো চন্দ্রা। পূর্ন আর নূর তখনো ঘুমে। চন্দ্রা আজ কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চন্দ্রা ওদের ঘরের দরজা ভিরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো পুকুর পাড়ের দিকে। সময় তখন শীতের প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকে শীতের আমেজ। এবারের শীতটা বেশ জেঁকে বসেছে প্রকৃতিতে। বিকেলের এই গোধূলি লগ্নেই আবছা কুয়াশার আস্তরন পড়েছে দূরের ধান ক্ষেতের গায়ে। সূর্য মামা পশ্চিম আকাশকে লাল আভায় রাঙিয়ে দিয়ে অস্ত যাওয়ার পাইতাড়াই ব্যস্ত। রক্তিম আকাশের এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে হাজারো নাম না জানা পাখির দল। দিনশেষে তারাও চটে চলছে ওদের নীড়ের পানে। কাস্তে হাতে নিয়ে দলে দলে মাঠ থেকে ফিরছে কৃষানের পাল। গৃহস্থ বাড়িতে চলে ওঠেছে সন্ধ্যা প্রদীপ। চন্দ্রার দৃষ্টি তখনো দূরের সীমান্তে। ফেলা আসা অতিতের পাতাগুলো বারংবার ওর চোখে এসে ভাসছিলো। ক্ষনিকের মাঝেই চন্দ্রা হারিয়ে গেলো অতিতের সেই দিনগুলোতে।

সময় তখন শীতের প্রথম সপ্তাহ। তুহিনের বিয়ের পরেরদিন চন্দ্রা নিজে যেচে গিয়েছিল তুহিনের বউকে দেখতে। মিয়া বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক পানে তাকিয়ে চন্দ্রা ঘোমটা মাথায় বউয়ের ঘরে গিয়েছিলো সেদিন। আশা সেদিন চন্দ্রাকে চিনতে ভুল করে নি। ওকে দেখে ছলছল দৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আশা জিঙ্গেস করেছিল,

–” তুমিই বুঝি ওনার সেই আপনজন। জানো তো কাইল রাইতে যহন ওনি তোমার কথা কইল তহন মোর খুব রাগ হইছিল তোমার ওপর। কিন্তু আইজ তোমারে দেইখা মোর প্ররানডা জুইরা গ্যাছে। তয় এহন মুই কি করুম তুমিই কও? বোধ হওনের পর থেইকা তারেই স্বামী বইল্যা মানছি আমি। তারে ছাড়া অপর কোন পর পুরুষের মুখও দেহি নাই।”

আশার অশ্রুসজল দু চোখ মুছে দিয়ে চন্দ্রা কন্ঠে বলে উঠলো,

–” কাইন্দো না নতুন বউ ,কাইন্দো না। সুখ সব্বার কপালে আহে না। সুখ কইরা নিতে হয়। একডা মাইয়া খুব সহজেই একডা পোলার মনে জায়গা কইরা নিতে পারে। আমি জানি তুমি তুহিন ভাইয়ের মনে একদিন না একদিন ঠিক জায়গা কইরা নিবা তয় তার লাইগা আমারে এ গাও ছাড়ন লাগবো। ভালা থাইকো নতুন বউ, স্বামী সন্তান লইয়্যা সুখে থাকো। ”

–” কিন্তু……

–” আর কোন পিছুটান রাইখো না নতুন বউ। আমি আমার নতুন জীবনে পাড়ি জমাইতেছি। যদি সেই জীবনের কোন মোড়ে কহনো আমাগোর দেখা হয় তাইলে আমার পানে মুচকি হাইসা তাকাইয়ো তাইলেই খুশি হমু আমি। থাকো , যাই এহন । ”

কথাগুলো বলেই সেদিন চারুর হাত ধরে চলে এসেছিল শহরে। চারুদের বাসা থেকেই বাদবাকি পড়াশোনা শেষ করে চন্দ্রা। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুল শিক্ষকের শিক্ষাবৃত্তি শুরু করে সে। সেই সময়েই পরিচয় হয় নূরের সাথে। নূরের বয়স তখন সবে সাত। নূরের মা ওকে জন্ম দেওয়ার সময়েই মারা গিয়েছিল। এরপর নূরের বাবা মোঃ পূ্র্ন আহসান আর বিয়ে করেন নি। নূরের সাথে পরিচয় হবার কয়েকমাসের মধ্যেই নূরের জেদের কাছে হার মেনে চন্দ্রা আর নূরের বাবার বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও পড়াশোনা করে চন্দ্রা। অতঃপর আজ সে শুধু এক কন্যা সন্তানের জননী নয় বরং হাজারো অনাথ শিশুদের মা চন্দ্রা। স্বামীর বিষয় আশয় থাকায় অনায়াসেই একটা অনাথ আশ্রম চালাচ্ছে চন্দ্রা। এ নিয়ে অবশ্য পূর্নর কখনো আপত্তি ছিল না আর না এখন আছে। বিয়ের কিছু দিন পরে তুহিনের খবর নিয়েছিল চন্দ্রা। তুহিন তখন একছেলের বাবা। মানে তুহিন ততদিনে আশাকে নিয়ে সংসার সামলানো শুরু করে দিয়েছে। এ নিয়ে কখনো চন্দ্রার মনে ক্ষোভ হয় নি বরং প্রশান্তি এসেছে। পঁচিশ বছরে আর কখনো তুহিনের মুখোমুখি হতে হয় নি চন্দ্রাকে,আজও হয়তো হতে হবে না। রাশেদের খবরও পেয়েছিল ও। অনাথ আশ্রমের পাশেই একদিন ভিক্ষা করতে দেখেছিল চন্দ্রা কিন্তু সামনে গিয়ে কথা বলে নি ও। মোটকথা কথা বলার ইচ্ছে জাগে নি ওর।

–” কি রে কখন এলি তোরা?”

রিনরিনে কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভেঙ্গে গেল চন্দ্রার । এতক্ষণ ও ডুবে গিয়েছিল অতিতের বিষন্ন দিনগুলোতে । সন্ধ্যা গড়িয়ে ধরনীতে নেমে এসেছে নিকষ কালো অন্ধকার। আকাশে আজ চাঁদের ছিটেফোঁটাও নেই। চারিদিক অন্ধকার। সুবিশাল আকাশের বুক থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিশিরের কনা। চন্দ্রা পিছনে তাকানোর আগেই ওর পাশে এসে বসল সেই নারী কন্ঠস্বরের মালিক। তারপর মৃদু হেসে বলল,

–” কি রে এখনো রাগ করে থাকবি? কথা বলবি না আমার সাথে?”

এতোক্ষণে পাশ ফিরে তাকালো চন্দ্রা। পাশে বসে থাকা নারীটি আর কেউ নয় স্বয়ং চারু। যার সাথে গত বছর আঠারো দেখা নেই ওর। বলতে গেলে চারু নিজেই ইচ্ছে করে যোগাযোগ রাখেনি ওর সাথে। প্রান-প্রিয় নানা- নানীর মৃত্যুতে বেশ ভেঙ্গে পড়েছিল সে। তাইতো পরিবারের সকলকে ফেলে পড়াশোনার অযুহাতে পাড়ি জমিয়েছিল বাহিরের দেশে। তারপর আর দেশে ফিরে আসে নি। সেখানেই বিয়ে করে সেটেল হয়ে গেছে। আজ আঠারো বছর পর প্রান প্রিয় বান্ধুবিকে দেখে এত দিনের চাপা অভিমানটা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো চন্দ্রার। চারু চন্দ্রার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

–” জানিস যখন আপা মারা গেল তখন আমি একটু ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কিন্তু নানুকে নিয়ে আবারো উঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিন্তু সেও নানুও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আমার পুরো পৃথিবী ধমকে গিয়েছিল এক নিমিষেই। সেই সময় খুব ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আমি। এইভাবে আর কয়েকদিন থাকলে বোধহয় পাগল হয়ে যেতাম তাইতো সবাইকে না বলে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাই কানাডায়। সেখানে গিয়ে আবারো নতুন করে গড়ে তুলি আমার জীবন। বাবা -মা, পরিবারের সবাইকে একে একে নিয়ে যায় সেখানে। গড়ে তুলি নতুন ক্রং- ক্রিটের ইটবাধানো আভিজাত্য বাড়ি। সেই জীবনের গদ বাধা নিয়মের বাইরে আর বেরোতে পারিনি বলেই হয়তো সেদেশ ছেড়ে আসতে পারি নি আর কোন দিন। আজ এইখানে এসেছি তোর টানে, আবারো ফিরে এসেছি এই ভেজা মাটির গন্ধে।”

–” তোর নতুন জীবন নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না আমার ,আর না আছে এখন। আমার অভিমান তুই আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস নি কেন ? জানিস কতটা মনে পড়তো তোকে? প্রতি বছর তোর জন্য তোর পছন্দের আমের আচার করে রাখতাম। আপার কাছে পাঠাতামও কিন্তু তোর কোন খবর পেতাম না। আপনাকে বললে বলতো তাদের সাথেও যোগাযোগ নেই তোর। কেন এমন হাওয়াই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলি তুই?”

–” প্রয়োজন ছিল। আমি হাওয়ার নিরুদ্দেশ না হলে আজ যদি এই অবস্থানে আসতি না। আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতিস তুই। তা কি করে হতে দেই বল?”

–” এজন্য তুই এতো দিন দূরে থাকবি?”

–” আমি দূরে ছিলাম ঠিকই কিন্তু তোর সব খবরাখবর কিন্তু ঠিকই নিতাম। একটা কথা সব সময় মনে রাখিস, ” চারু ,চন্দ্রা একে অপরের প্রান। একজনকে ছাড়া অপরজন অচল।”

–“হুম।”

চারু হেসে বলল,

–” এবার কান্নাকাটি বন্ধ করে পিঠে বানাবি চল। তোর হাতের পিঠে খাওয়ার লোভেই সেই সুদূর কানাডা থেকে এখানে এসেছি। চল্ চল্।”

–” হুম চল।”

রাতের কালো অন্ধকারকে ভেদ করে দুই নারী অবয়ব এগিয়ে চলছে সামনের পানে। এখনো কিছুটা পথ চলা বাকি তাদের। মাঝে মাঝে এমন একজনকে খুব প্রয়োজন যার হাত ধরে নির্ভয়ে পাড়ি দেওয়া যায় অজানা পথে। হয়তো চন্দ্রার মতো সবার কপালে এমন বান্ধুবি জোটে না। আজীবন অটুট থাক না এমন কিছু বন্ধুত্বের বন্ধন।

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here