চন্দ্রাবতী,পর্ব:১৮

0
334

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৮

সেদিনের পর কেটে গেছে চারদিন। আজ বুধবার। হেমন্তের শেষ সপ্তাহ। ইতি মধ্যেই শীত বেশ জেঁকে বসেছে প্রকৃতিতে। রাতভর নীল আকাশের বুক থেকে টুপটুপ করে সবুজ ঘাসের ওপরে ঝড়ে পড়ে শিশিরের কনাগুলো । সকালে সূর্য মামাকে আজকাল বেশ সময় গড়ালেই আকাশের বুকে দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামীন কৃষক এই হিম ঠান্ডায় কাস্তে হাতে ছুটে চলে মাঠের পানে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই গৃহবধু চলে যায় তার সবজির মাচা পরিচর্যা করতে। এখন সন্ধ্যা গড়ালেই চারিদিক দেখতে পাওয়া যায় ঘন কুয়াশার আস্তরন। যেন প্রকৃতি এক পরম মমতার চাদরে ঢেকে রেখেছে সমগ্র পৃথিবীকে।

মধুগন্জের টিনের বেড়া দেওয়া বাড়ির অন্দরমহলে
বসে আছে রোকেয়া বেগম আর পারুল। ওদের সাথে অবশ্য পারুলের স্বামী আব্দুর রহমানও এসেছেন। বড় ঘরের কোনে কাঠের চেয়ার পেতে বসতে দেওয়া হয়েছে তাদের। সামনেই রাখা আছে মাঝারি আকারের কাঠের টেবিল। সেই টেবিলের ওপর সজ্জিত আছে নানান রকমের মিষ্টি। এই মিষ্টির উৎস ঘর যে মিষ্টান্ন ভান্ডারের ভাড়ার ঘর এইটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তাদের। দু – দশ গ্রামেও এমন মোদক বাড়ি আছে কি না সন্দেহ।

রোকেয়া বেগমদের সামনেই বসে আছেন শ্যামল সাহেব। বয়স পঞ্চান্ন। বয়সের ভারে মাথার চুল পেকেছে কিছুটা। সেই সাথে দৃষ্টি শক্তিও বোধহয় কিছুটা কমেছে । এজন্যই তো চোখে চশমা লাগিয়েছেন তিনি। লম্বাটে মুখ, শ্যামবর্ন চেহারা তবে নাকটা একটু লম্বা আর তীক্ষ্ণ। ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ওনার স্ত্রী সরলা বেগম । শ্যামল সাহেব রোকেয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–” একি আপনারা কিছু খাচ্ছেন না কেন?”

শ্যামল সাহেবের কথার প্রসঙ্গে রোকেয়া বেগম বলে উঠলেন,

–” খাওন-দাওন পরে করা যাইবো আগে যে কামে আইছি সেই কামডা করি? কি কন ভাই?”

রোকিয়া বেগম এর কথা শেষ হতেই পারুল বলে উঠলো ,

–“হ ভাইজান আগে আমাগোর মাইয়্যারে নিয়া আসেন। ভাবি মাইয়্যা দেখুক, তারপরে না হয় খাওন-দাওন করা যাইবো।”

–” ঠিক আছে । আমি মাইয়্যারে আনবার কইতাছি ।”

কথাটা বলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,

–” আশার মা মাইয়ারে ডাইকা নিয়া আসো। ওনারা দেখবার চাইতাছে।”

–” আইচ্চা আমি আনতাছি। ”

সরলা বেগম কথাটা বলেই চলে গেলেন অন্দরমহলে বাম দিকের বড় ঘরটাতে যেখানে লাল রঙের শাড়ি পড়ে কেউ অপেক্ষা করছে ওনার জন্য।

বড় ঘরটার কাঠের বিছানার একপাশে বসে আছে এক কিশোরী। বয়স বড়জোড় পনেরো কি ষোলো হবে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। পরনে সিঁদুর রাঙা লাল শাড়ি, লম্বাটে মুখ, কমোড় অব্দি রেশমী সুতোর মতো লম্বা চুল। মুখটাতে যেন একরাশ মায়া মাখানো আছে মেয়েটির। কিশোরী মেয়েটি উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সরলা বেগম। মেয়েকে শাড়ি পড়ে বসে থাকতে দেখে সরলা বেগম বলে উঠলেন,

–” আর বসে থাকিস না ,ওঠ এবার।”

মেয়েটি রিনরিনে কণ্ঠস্বরে বলল,

–” ক্যান মা?”

–” ক্যান মানে? ওনাদের সামনে রাইতে হইবো না নাকি?”

–” আমার খুব ডর করতাছে মা।”

–” ওমা ডরের কি আছে। এতোদিন তো তুইই ঐ বাড়ির বউ হবি বলে জেদ ধরেছিলি তো আজ ডর করতাছে কিল্লাই?”

–” আহা মা তুমি বুঝবার পারতাছো না। থাক তোমারে বুঝাইয়া লাভ নাই। চলো এইবার দেহি কি কন ওনারা।”

–” হু চল। মাথায় ঘোমটা টানা দিয়া যা ছেমড়ি।”

–” মনে আছিলো না ।”

–” হইছে চল এবার।”

কথাগুলো বলেই আশাকে নিয়ে চলে গেল ওপাশের বৈঠক ঘরের দিকে।

এদিকে চন্দ্রাদের বাড়ির সামনের দিকের ফাঁকা জায়গাটিতে একাকি বসে আছে চারু। গোধূলি বিকেল তখন। চন্দ্রাকে এই চারদিন পড়াশোনার মাঝে ডুবিয়ে রেখেছে ও। পড়ার মাঝে থাকলে হয়তো বা কিছুটা স্বস্তি পাবে চন্দ্রা। আজ এই পুকুর পাড়ের শিড়িতে বসে কারো জন্য অপেক্ষা করছে চারু। আকাশটা আজো নানা রঙের আভায় রাঙিয়ে আছে। একেক দিন একেক ভাবে সাজে সে। দিনকে দিন যেন তার রূপের বাহার বেড়েই যাচ্ছে। চারু সেই রঙিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” আচ্ছা তুমি এতো রঙ পাও কোথায় বলো তো? আমাকে কি একটু রং দিবে? তোমার ঐ সুন্দর রঙ দিয়ে আমিও অন্য একজনকে রাঙিয়ে দিতাম। জানো তো তার না খুব কষ্ট। ”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামলো চারু। তারপর আবারো বলে উঠলো,

–” জানো তো সে চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল। তার আলোয় সবাইকে আলোকিত করে নিজেকে অন্ধকারে রাখে। জানো তো তার কাছে আমি অনেক ঋনী। তার জীবনটা যতক্ষন সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে পারছি ততক্ষন আমার স্বস্তি নেই।”

আবারো থামল চারু। দুচোখ নোনা পানিতে সিক্ত হয়ে উঠেছে। গোধুলি লগ্ন পেরিয়ে এখন ধরনীতে নেমে এসেছে নিশ্চুপ সন্ধ্যা। পাখিরা ইতিমধ্যে তাদের নীড়ে ফিরে গেছে। গৃহস্থ কৃষকেরাও বাড়ি ফিরে এসেছে এতোক্ষণে। হঠাৎ এই অন্ধকারকে ছাপিয়ে শোনা গেল এক পুরুষালী ভরাট কণ্ঠস্বর। কন্ঠস্বরটি শুনতে পেয়ে পিছন পানে তাকালো চারু। তারপর ক্ষীনস্বরে বলে উঠলো,

–” এসে গেছেন আপনি? আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

আবারো ভরাট গালায় শোনতে পাওয়া গেল পুরুষালি কন্ঠস্বরটি।

–” আমাকে এখানে কেন ডেকেছো চারু?”

–” এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? সব কথায় বলবো আপনাকে, সেই জন্যই তো ডেকেছি আমি।”

–” কি কথা বলবে তাড়াতাড়ি বলো।”

–” আরে বাবা আবারো অস্থির হচ্ছেন কেন? আর আপনি এত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাছে এসে বসুন।”

–” কি বলছো কি চারু? তোমার কি মাথা ঠিক আছে নাকি পুরোপুরিই পাগল হয়ে গেছো হ্যাঁ। কেউ যদি এখন আমাকে তোমার পাশে বসে থাকতে দেখে তখন কি হবে বুঝতে পারছো ?”

–” আপনি কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ভুলে যাচ্ছেন। আমি সম্পর্কে আপনার ভাগ্নি আর আপনি সম্পর্কে আমার মামা হোন।”

–” সে তো আর লোকজন বুঝবে না তাই না।”

–” উহু বুঝবে। যাই হোক আমি বেশি সময় নেব না আপনার কাছ থেকে। এবার তো এগিয়ে আসুন।”

চারুর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। আজ দুপুরে রাসেল নামের এক ছোট ছেলের মারফত ওর কাছে খবর পাঠায়েছিল চারু। বলেছিল সন্ধ্যার সময় পুকুর ঘাটে আসতে , কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা নাকি আছে ওর সাথে। তাই এই সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুর ঘাটের দিকে ছুটে এসেছে সে। তুহিন এগিয়ে এসে চারুর থেকে কিছুটা দুরত্বে বসে চারুকে বলল,

–” এখন বলো কি বলবে?”

তুহিনের কথা শেষ হওয়ার পরেও কিছুক্ষণ চুপ ছিল চারু। তারপর বলে ওঠলো,

–” আচ্ছা এই যে আমি আর চন্দ্রা গুনে গুনে পাঁচ বছরের ছোট। যদিও দুজন একই ক্লাসে পড়ি । তবুও আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে আপনাদের মনে কোন প্রশ্ন জাগে না? মনে হয় না চন্দ্রার কোন‌ বিপদে কেন চারুকেই সবার প্রথমে দেখতে পাওয়া যায় আর কেনইবা দুজনের মধ্যে এতো ভাব?”

চারুর বলা কথাগুলো পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো তুহিন। তারপর বলে উঠলো,

–” প্রশ্নগুলো যে মনের কোনে উঁকি দেয় নি এমনটা নয় কিন্তু প্রশ্ন করবার সাহস পাই নি কোনদিন।”

–” কেন?”

–” যদি কারন শুনতে চাও তাহলে বলব কারণটা তুমি নিজেও জানো। এই রূপগঞ্জ গ্রামের কোন ছেলের সাহস নেই “মাষ্টার বাড়ির” কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর আর তাদের সাথে কথা বলা বা তাদের বিষয়ে কথা বলা তো দূরের কথা।”

–” আচ্ছা বেশ আমি নিজেই বলছি আজ। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই নানী বাড়িতে থেকেই বড় হই। আমার বয়স তখন বড়জোড় পাঁচ বছর । সেই সময় চন্দ্রার দশ বছর চলছে। পিঠেপিঠি হওয়ার দরুন আমরা দুজন এক সাথেই থাকতাম সবসময়। সেদিনও আমরা একসাথেই খেলছিলাম দুজনে । হঠাৎ আমার হাতের ধাক্কা লেগে উঁচু বিছানা থেকে নিচে পড়ে যায় চন্দ্রা। সেদিন পড়ে গিয়ে চন্দ্রা কপালে আঘাত পায় যার দরুন পাঁচটা বছর পর্যন্ত ভুগতে হয়েছে ওকে। পিছিয়ে গেছে সকলের থেকে শুধু তাই নয় সেই সাথে হারিয়েছে নিজের মাতৃত্বের অধিকার।”

কথাগুলো বলে থামলো চারু। ততক্ষণে অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে ধরনীকে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে মুখরিত চারিদিক। তালগাছের ওপরে দেখা যাচ্ছে পূর্নিমার গোল চাঁদ। নিস্তব্ধ এই রাত অপেক্ষায় আছে আরো কিছু কথা শোনার ।

সন্ধ্যার কিছু পরে বাড়িতে এলেন রোকেয়া বেগম। মেয়েকে বেশ পছন্দ হয়েছে ওনার। তাই তো বিয়ের কথা পাকাপাকি করে এসেছেন তিনি। আগামী শুক্রবার বাদ আসর বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন তিনি। তুহিন এলেই বাকি কথা বলবেন বলে মনস্থির করেছেন তিনি‌।

নির্ঘুম, নিস্তব্ধ এই রাতে সবাই অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয়জনদের জন্যে, আর কেউ বা অপেক্ষা করে আছে কোন অজানা সত্য কথা জানবার। তবু যেন অপেক্ষার শেষ নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here