#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৬
আজ শুক্রবার। স্কুল প্রাঙ্গনে আবারো আজ বিচার সভা বসছে। সেবারের মতো আজও দেখা যাচ্ছে লোকসমাগম। তবে আজ নারীদের সংখ্যা সেদিনের থেকে কিছুটা বেশি। গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রতিপক্ষ। চন্দ্রাদের পক্ষ থেকে সবাই উপস্থিত থাকলেও রাশেদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন না আকলিমা বেগম ও গফুর মিয়া । গতকাল রাতেই তারা তাদের অনুপস্থিতির কথা জানিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধানকে। গতকাল সকালেই তারা আবারো গিয়েছেন অলিন্দপুরে । আকলিমা বেগমের বড় বোনের অবস্থা নাকি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। গতকাল থেকে আকলিমা বেগমকে দেখতে চাচ্ছেন ওনি। এ যাত্রার বুঝি আর বাঁচানো যাবে না তাকে। তাই মৃতপ্রায় বোনকে দেখতে আকলিমা বেগম গতকালই স্বামীর সাথে রওনা হয়েছেন অলিন্দপুর এর দিকে।
সময় নষ্ট না করে আমজাদ হোসেন প্রথমে বলে উঠলেন,
–” যেহেতু গত বিচার সভাতেই আলাপ আলোচনা করা হয়েছে তাই আজ আর সময় বেশি নিতে চাচ্ছি না আমরা। ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামলেন তিনি । তারপর রাশেদের উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠলেন,
–” রাশেদ মিয়া তোমাকে সেদিন টাকার বন্দোবস্ত করতে বলা হয়েছিল। টাকার বন্দোবস্ত হয়েছে তো? আজ কিন্তু আমরা আর বাড়তি সময় দিবো না তোমাকে।”
এতক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল রাশেদ। আমজাদ হোসেনের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো সেদিকে। তারপর ক্ষনকাল আড়চোখে তাকালো চারু ও চন্দ্রার দিকে। তারপর আবারো মাথা নিচু করে বলল,
–” হ আনছি।”
–” বেশ তাহলে তালাকের কাজ শুরু করা যাক।”
–” আমি চন্দ্রারে তালাক দিমু না?”
রাশেদের এমন হেঁয়ালি কথায় গর্জে উঠলেন মোঃ মোবারক হোসেন। বললেন,
–” হেঁয়ালি করো মিয়া। পরকিয়া করনের আগে বউয়ের কথা মনে আছিলো না তোমার? এহন বউয়ের জন্যে দরদ ওতলাইয়া ওঠতাছে তোমার। যখন বউরে কারনে- অকারণে মারধর করতা তহন কই আছিল এতো দরদ। এতো হেঁয়ালি বাদ দিয়া যা করতে বলা হইছে তাই করো মিয়া তা নাহলে আমাগোর অন্য পথ বাহির করতে হইবো । এতো মাত্তবরি না কইরা মৌলভি সাহেবরে ওর কাজ করবার দাও। আমাগোরে চটাইয়ো না কইলাম। আমরা চইট্যা গেলে তোমার কপালে বহুত দুংখ আছে । তাই ভালই ভালই কাজ শেষ করবার দাও। এতে তোমার জন্যেও মঙ্গল আর হামাগোর জন্যোও। বুঝছো নি কি কইলাম ?”
মোঃ মোবারক হোসেন এর কথা শুনে আর কোন কথা বাড়ায়নি রাশেদ নিরবে মৌলভির কথা মতো আপাতত মুখে তালাক দিয়ে দিয়েছে চন্দ্রাকে। আইনগতভাবেও তালাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে যা কিছুদিন পর কার্যকর হবে। তালাকের কাজ শেষ করে চন্দ্রকে ওর দেনমোহর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু দেনমোহর নয় তার সাথে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ বিশ হাজার টাকাও। সকল কাজ শেষ করতে করতে জুম্মার আযানের সময় হয়ে এলো। তাই কাজ শেষে যে যার গন্তব্যের পথে চলে গেল। মুহূর্তের মাঝে জনবহুল স্কুল প্রাঙ্গনটি জনশূন্য হয়ে গেল। শুধু এই নিরব স্কুল প্রাঙ্গনে নিস্তব্ধ কিছু আর্তচিৎকার আর দীর্ঘশ্বাস।
চন্দ্রা আর রাশেদের বিচ্ছেদের গোধূলি সন্ধ্যায় চন্দ্রার সামনে এসে দাঁড়াল তুহিন। পরনে তার নীল রঙের পাঞ্জাবি। মাথার অগোছালো ঝাঁকড়া চুল আর নিদ্রাহীন দুচোখ দেখে বড্ড মায়া হলো চন্দ্রার। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ধরনীতে। সূর্য্যি মামাও বিদায়ের পথে। আলো আঁধারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুই মানব-মানবি। দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন এই প্রতিক্ষার প্রহর যেন শেষ না হয়।
এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। ততক্ষণে অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে ধরণীকে। হঠাৎ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ভেঙে গেল চন্দ্রার। নিজেকে কোনরকমে সামলিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” তুহিন ভাই ক্যান আইছো এইহানে? কেউ দেখলে সর্বনাশ হইয়া যাইবো।”
–“ক্যান আইছি তুমি বুঝো না চন্দ্রাবতী।”
–“না বুঝি না আর না বুঝবার চাই।”
–” এহন তো কোন বাঁধা নাই আমাগোর মাঝে, নাই কোন অশুভ দেয়াল । তাইলে এমন করতাছো ক্যান?”
–“কেডা কইছে কোন দেয়াল নাই। আমাগোর মাঝে সব থাইকা বড় দেয়াল তোমার পরিবার। তারা কোহনো আমার মতো গরিবের মাইয়্যারে মাইনা নিবো না। এই কথা কি ভুইলা গেছো তুমি?”
–” না ভুলি নাই। তহনকার কথা আর এহনকার কথা আলাদা । তহন আমি বেকার আছিলাম । তাই আমার কথার কোন মূল্য আছিলো না কিন্তু এহন আমি চাকরি করি । মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা দেই আম্মার হাতে। এহন আর কেউ না করবো না আর কেউ না করলেও শুনমু না কারো কথা।”
–” পাগলামি কইরো না তুহিন ভাই। এইটা হয় না। তোমার মা কোন কালেই মাইনা নিবো না আমায় । মাঝখান থাইকা শুধু শুধু আমি বদনাম হমু।”
–“ক্যান হয় না ? নাকি তুমিই চাও না?”
–” আমার চাওনে যদি সব হইতো তাইলে সব থেইকা খুশি আমিই হতাম । কিন্তু যা হওনের না তা নিয়া মিছা আশা কইরা কি হইবো?”
তুহিন চন্দ্রার দিকে আরো একটু এগিয়ে চন্দ্রার দুই গালে হাত রেখে বলল,
–” তুমি এমন কথা কইয়ো না চদ্রাবতী। তুমিহীনা নিঃসঙ্গ আমি। আমার এই মনের গহিনে তোমার লাইগা এক শহর গড়ছি যেহানে শুধু তোমার বসবাস।সেখানে এক শহর ভালবাসা শুধু তোমার জন্য। হের পরেও না কইয়ো না চন্দ্রাবতী।”
তুহিনের কথা শেষ হতেই চন্দ্রা তুহিনের হাতটি ওর গাল থেকে নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
–” আমি নিঃস তুহিন ভাই। আমার কাছে প্রেম চাইয়ো না । তুমি বরং আমার কাছে অন্য কিছু চাও আমি তোমার দুই হাত ভরে তা দিয়া দিমু।”
–” এইডা তুমি কইতে পারলা চন্দ্রাবতী?”
–“তোমায় আজ মুক্তি দিলাম তুহিন ভাই আর রইল না কোনো পিছুটান তোমার।”
চন্দ্র কথা শেষ হতেই তুহিন বিদ্রুপ হেসে বলল,
–“ছাইড়া যাইতে চাইলে অজুহাতের অভাব হয়না চন্দ্রাবতী। তুমি আমার সব চন্দ্রাবতী ,তোমারে এত তাড়াতাড়ি ভুইলা যাই কেমনে? তোমারে এইবার আমি আমার ঘরের চন্দ্র কইরাই ছাড়ুম। অপেক্ষায় থাইকো।”
কথাগুলো বলেই রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তুহিন। খটখট শব্দ তুলে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। গন্তব্যে নিজ বাড়ি । এদিকে চন্দ্রা তখনি সিক্ত দুই চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। সুখ নামক কথাটা কি আদৌও তার কপালে আছে নাকি সবটা নিছক স্বপ্ন।
ঠিক তখনি আগমন ঘটে চারুর। এতক্ষণ দূর থেকে সবটাই অবলোকন করেছে ও। তুহিনের ব্যাপারে আগে থেকেই সব কিছু জানতে চারু তবে চন্দ্রা বা তুহিনের সামনে তা প্রকাশ করেনি এতদিন। কিন্তু আজ আর কথা না বলে থাকতে পারলোনা সে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছে হাত রাখল চন্দ্রার কাধে অতঃপর মোলায়েম গলায় বলল,
–” অসম্ভব জিনিস মনের গহীনে পুষে রাখা ভালো নয় চন্দ্রা। রোকেয়া নানিকে তো তুই চিনিস, দিনরাত এক হলেও তিনি তোর আর তুহিন মামার সম্পর্ক মেনে নেবেন না। যদি মেনে নিতেন তাহলে বহু আগেই মেনে নিতেন, এতটা সময় লাগত না ওনার। শুধু শুধু আকাঙ্ক্ষা মনে রাখিস রাখিস না।”
–” আমি কি করবো চারু? আমি যে পারতাছি না? ”
–“শান্ত হ । কান্না কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সকল সমস্যার সমাধান তুই নিজে।”
–” আমি ? কিন্তু কেমনে?”
–“আগে নিজেকে শক্ত কর। এভাবে অল্পতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। আমি তোকে আগেও বলেছি, এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে তোকে। তুই যত দুর্বল হয়ে পড়বি ততই তোর লক্ষ্য থেকে তুই দূরে সরে যাবি। তুহিন মামাকে যা বলার আমি বলে দেবো। আপাতত ঘরে চল।”
–“ঠিক আছে চল।”
রাত তখন আটটা বাজে। গ্রামে রাত আটটা মানে অনেক রাত। পুরোনো আমলের কাঠের বিছানার এক পাশে বসে আছে তুহিন। বিছানার ওপাশে গম্ভির মুখে বসে আছেন রোকেয়া বেগম । ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি বলতে চাই সে। প্রায় আধঘন্টা হলো ঠাঁই বসে আছে তুহিন না নিজে কোন কথা বলছে আর না রোকেয়া বেগমের কোন কথার উত্তর দিচ্ছে। নিরবতার সমাপ্তি ঘটিয়ে রোকেয়া বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
–” কি বলবি বলে ফেল দেকি। রাত অনেক হইয়ে। আর দেরী করবার পারুম না আমি।”
এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল তুহিন। মায়ের কথা কানে পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,
–” আম্মা আমি চন্দ্রারে বিয়া করবার চাই।”
রোকেয়া বেগম অবাক হয়ে বললেন ,
–” কারে বিয়া করবি কইলি ?”
–” চন্দ্রারে।”
–” বলি মাথার বুদ্ধি কি সব চইল্যা গ্যাছে তোর? যেই মাইয়্যারে আমি আগে মাইন্যা নেই নাই তালাক হওনের পর সেই মাইয়্যারে মাইন্যা নিমু তুই ভাবলি ক্যামনে?”
–” আম্মা….
–” আম্মা আম্মা কইরা কাজ হইবো না। শোন মাষ্টারবাড়ি পরে যদি এই গেরামে কোন ধনী লোক থাহে তা হইলাম আমরা। আর তুই কিনা ওমন ফকিন্নি মাইয়্যারে বৌ করবার কস আমারে। এইডা হইবো না মানে হইবো না। তুই যদি চারুরে বিয়া করবার চাস তাইলে আমি রাজি আছি।”
–“আম্মা তোমার কি মাথা খারাপ হইয়া গ্যাছে? চারু আমার ভাগ্নি হয়। তুমি কি ভুইলা গ্যাছো? আর শোন মা ধনী-গরীব আমি বুঝি না। আমি চন্দ্রারেই বিয়া করুম। এতে যদি তুমি রাজি হও তো ভালা আর তা নাহলে আমি চন্দ্রারে বিয়া কইরা ওরে নিয়া শহরে চইল্যা যামু।”
কথাগুলো বলে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তুহিন । পুরো ঘরে একাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন রকেয়া বেগম। ছেলের এমন উদ্ধত স্বভাব মোটেও পছন্দ না ওনার। এর আগেও চন্দ্রাকে নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে ওদের মাঝে। তবে আজ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তুহিন। এখন যদি তুহিনকে আটকালো না যায় তাহলে আর কিছু করার থাকবে না ওনার। তাই চন্দ্রাকে সরানোর একটা বুদ্ধি আটতে লাগলেন রোকিয়া বেগম।
পরেরদিন সকাল বেলা। সোনা রঙা আলোর ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙল চন্দ্রার। পাশে চারুকে না পেয়ে ওঠে বসল ও। এমন সময় ঘরের বাহির থেকে উচ্চ কন্ঠে কারো গলার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলো সে। দেখল ওঠানের মাঝখানে ……..
চলবে