চন্দ্রাবতী,পর্ব:১৫

0
283

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৫

দিন চারেক পরের কথা। সময় গোধুলি লগ্ন । পুরো আকাশটাকে লাল আভায় রাঙিয়ে দিয়ে পশ্চিমাকাশের কোলে ঢলে পড়ে সূর্য্যিমামা বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে তখন। আর কিছুক্ষণ পরেই অস্ত যাবে টকটকে লাল সূর্য। অতিতের খাতায় যুক্ত হতে চলেছে আরো একটি দিনের।

শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে একা একা গোধুলি লগ্ন অপার সুন্দর্য উপভোগ করছে চন্দ্রা। পুকুরের ঘোলা পানিতে তখনো সাঁতরে বেড়াচ্ছে একপাল রাজহাঁসের দল। তাদের প্যাক প্যাক শব্দে মুখরিত হয়ে আছে চারিদিক। সুবিশাল আকাশে হাজারো পাখি ছুটে চলেছে তাদের নীড়ে। সন্ধ্যা হতে খুব একটা দেরি নেই। মিনিট পাঁচেকের মাথাতেই হয়তো গ্রামের মসজিদ থেকে শোনা যাবে আজানের ধ্বনি। তারপর গৃহস্থরা পুকুরের পানিতে ওযু করে দলে দলে চলে যাবে মসজিদে।

সত্যিই চন্দ্রার অনুমান সঠিক প্রমানিত করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গ্রামের মসজিদ থেকে শোনা গেল আজানের ধ্বনি। ধরনীতে ততক্ষনে নেমে এসেছে আবছা অন্ধকার। গৃহস্থ কৃষকেরা ওযু শেষ সবাই মিলে নামাজ পড়তে যাচ্ছে। চন্দ্রা তখনো পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে ঠাঁই বসে রয়েছে। দক্ষিনা মৃদু হাওয়া খুব একটা খারাপ লাগছে না ওর। বরং এই ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ ভালো লাগছে ওর। চন্দ্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল পুকুরের শেষ সিঁড়ির দিকে। যেখানে টলমল করছে পুকুরের ঘোলাটে পানি। চন্দ্রা একটু ঝুকতেই পিছন থেকে এক বলিষ্ঠ হাত জড়িয়ে নিল ওকে। হঠাৎ এইভাবে কাউকে জড়িয়ে ধরতে দেখে ভয় পেয়ে গেল চন্দ্রা। মাষ্টার বাড়ির এই পুকুরে কিনারায় গ্রামের অপরিচিত য়কেউ ওকে জড়িয়ে ধরার সাহস পাবে না সেকথা চন্দ্রা হলফ করে বলতে পারে। তাই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

–” তুহিন।”

চন্দ্রার মুখে তুহিনের নামটি শুনে আগন্তুক চন্দ্রাকে ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল।সেই সুযোগে চন্দ্রা পিছনে ফিরে সেই অপরিচিত মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

–” আপনি?”

চন্দ্রার কথা শুনে আগন্তুক লোকটি এবার হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

–“তো কারে ভাবছিলে? তোর ঐ নাগোররে? নষ্টামি করোনের লাইগাই আমারে ছাইড়া দিতে চাইতাছোস তাই না ?”

আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি আর কেউ নয় স্বয়ং রাশেদ । সন্ধ্যার অন্ধকারে এসেছিল চন্দ্রার কাছে, ভেবেছিল চন্দ্রাকে মানিয়ে নিয়ে তালাকের ব্যবস্থা বাতিল করবে। তালাক বাতিল করার মূল কারন অবশ্য টাকা। দেনমোহর এর বিশ হাজার সহ জরিমানার বিশ হাজার মিলে মোটে চল্লিশ হাজার টাকা যোগাড় করা ওর জন্য কষ্টকরই না বরং অসম্ভব। এর মাঝে বিচারের পর ওকে আর সাইমাকে আলাদা করে দিয়ে আকলিমা বেগম আর গফুর মিয়া করেছেন ত্যাজ্য করে দিয়েছে সেদিনই। কিন্তু এখানে এসে চন্দ্রার মুখে তুহিনের নাম শুনেই রেগে গেল রাশেদ।

এদিকে রাশেদের মুখে এমন কথা শুনে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল চন্দ্রা। অতঃপর নিজেকে সংযত করে ক্ষীন স্বরে বলল,

–” আফনে এইহানে আইসেন ক্যান?”

–“কেন আমি আইয়া বুঝি আপনার নষ্টামিতে বাধা হইয়া দাড়াইলাম?”

–” ছি আপনার নিজের চরিত্রের দোষ আছে বইলা সবার চরিত্রের দোষ থাকবো এমন কোন কথা নাই আর আপনার মত চরিত্রহীন মানষেই এমন কতা ভাববার পারে।”

–“আমি চরিত্রের হইলে তুই কি একটা বেশ্যা। সকলের সামনে সতী সাবিত্রী সাইজা বইয়া থাহস আর আন্দার ঘোনাইলেই গতোর খুইলা পর পুরুষের সামনে আছোস।”

রাশেদের এমন কথা শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলো না চন্দ্রা। রেগে বলে উঠলো,

–” আপনার কি কথা কওনের আছে তাড়াতাড়ি কন? আপনার মত লোকের কাছ থাইকা ভালো কোন কথা আশা করনিই বৃথা। আপনি এইহানে কেন আইছেন হ্যা?”

–“চোরের মায়ের দেখতাছি বড় গলা। তা গলা এত বড় হইল কেমনে ? তুহিনের কারনে নাহি? তুহিনের মতো চাকরি করা পোলা দেইখা লোভ সামলাইতে পারোস নাই তাই না । তাই হামলে পড়ছিস ওর উপরে। তোদের মত ফকিন্নি মাইয়ার কাছ থেইকা এর থেইকা আর কিবা বেশি আশা করুন যাই। তোদের তো আর একডা দিয়া হয় না।”

রাশেদের কথা শেষ না হতেই চন্দ্রা চড়ে বসিয়ে দিল ওর গালে। তারপর রাগত স্বরে বলল,

–” আপনার মতো জানোয়ারের সাথে যে এতগুলো দিন সংসার করছি এইটা ভাবলেই আমার এহন নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়। আপনি একটা মানুষ রুপি জানোয়ার। এহনি এইহান থেইকা চইলা যাইবেন। আপনার মতো মানষের ছায়াও কারো গায়ে পড়লে তার জীবন তছনছ হইয়া যাইবো। ”

কথাগুলো বলে রাশেদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাস্টার বাড়ির দিকে চলে গেল চন্দ্রা কিন্তু পথিমধ্যে দেখা মিলল চারুর সাথে। চন্দ্রাকে খুঁজতে এদিক পানেই আসছিল সে কিন্তু পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল দুজনের। চন্দ্রার চোখে পানি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চারু। তারপর পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রাকে বলল,

–‘ সন্ধ্যা হয়েছে তুই ঘরে যা। আপা অপেক্ষা করছে তোর জন্য ।”

–” তুই যাবি না?”

–” আমি আসছি, কিছু কাজ বাকি আছে আমার । তুই যা ।”

–” কিন্তু……..

চন্দ্রাকে ওর কথা শেষ করতে না দিয়ে চারু নিজেই বলে উঠলো,

–“বললাম তো খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব আমি।চিন্তা করিস না।”

–“ঠিক আছে।”

চন্দ্রা চলে যাবার পর চারু দ্রুত পুকুর পাড়ের কাছে চলে এলো । চারুর অনুমানই সত্যি হলো । পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো সেই সিঁড়িতে এখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাশেদ । চন্দ্রার মত ভিতু মেয়ে কি করে এতগুলো কথা ওকে বলে গেল সে কথাই ভেবে চলেছে রাশেদ।

–“আপনি এখানে কেন এসেছেন আর পঞ্চায়েত প্রধান তো আপনাকে সাত দিনের আগে চন্দ্র সাথে দেখা করতে মানা করে দিয়েছিল তারপরও এখানে এলেন যে।”

এক ধ্যানে কথাগুলো ভাবছিল রাশেদ । পিছন থেকে হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে। নিজের থেকে হাত দুয়েক দূরে চারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

–“আরে চারু ম্যাডাম যে। কি খবর আপনার ? চার দিন পর দেখা পেলাম আপনার। বাড়ির বাইর হন না নাকি?”

–“আমাকে নিয়ে এত না ভাবলেও চলবে আপনার। আগে বলুন আপনি এখানে এসেছেন কেন?”

–“কি যে বলেন । আপনাগোর লাইগা বউয়ের লগে কি দুইটা কথা কইতে পারুম না নাকি?”

–“না পারবেন না কারণ পঞ্চায়েত প্রধান আপনাকে সেই অধিকার দেয়নি। এখন আপনি যদি পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে সে ব্যাপারটা অন্যরকম । সে ক্ষেত্রে আমাকে নিজে গিয়ে পঞ্চায়েতকে জানাতে হবে আপনি তাদের কথা অমান্য করছেন।”

–“আরে আরে আমি কখন কইলাম যে আমি পঞ্চায়েতের কথার অমান্য করুম?”

–“এইতো এইমাত্র আপনি আমাকে বললেন। সে যাই হোক, এবার আপনি যতই ধান্দা করেন না কেন চন্দ্রা আপনার ঘরে ফিরে যাবে না । আমি নিজে যেতে দেবো না ওকে। আর তাছাড়া আপনার পেয়ারের সায়মা তো আছে আপনার সাথে। চন্দ্রকে তো আপনার কোন প্রয়োজন নেই ।”

–“আপনি ভুল করতাছেন চারু ম্যাডাম।”

–” ভুল হোক আর সঠিক হোক চন্দ্রা এবার আপনার বাড়িতে ফিরে যাবে না ।”

–“আপনি কইলাম কামডা ভালা করতাছেন না। এর মাশুল কিন্তু আপনারে ঘুনতে হইবো ।”

রাশেদের কোথায় চারু হেসে বলে উঠলো,

–” আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?”

–“যা মনে করেন আপনে। আপনি যদি এইটারে হুমকি মনে করেন, তাইলে আমি আপনাকে হুমকিই দিতাছি।”

–“বেশ। দেখা যাক কি হয়? এই খেলায় আপনি যেতেন না আমি জিতি তা আর তিনদিন পরে প্রমাণ হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ আর একটা কথা, আপনি আমাকে চন্দ্রা পাননি যে আমাকে আপনি উটকো হুমকি দিয়ে যাবেন আর আমি ভয় পেয়ে যাব। আপনি যদি এখন এখান থেকে চলে না যান তবে আমি চিৎকার করে পুরো গ্রামবাসীকে এখানে ডেকে নিয়ে আসবো ।”

–“ঠিক আছে দেখাই যাইবো কে জেতে আর কে হারে। তয় একটা কথা আমি আপনাকে কইয়া দিতাছি আপনারে আমি ছাড়ুম না।”

কথাগুলো বলে রাশেদ হনহনিয়ে চলে গেল ফিরতি পথের দিকে। চারু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে চলে গেল মাষ্টার বাড়ির দিকে।

এদিকে মাস্টার বাড়ির দোরগড়ার সামনে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রা । সদর দরজার দিকে একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। মিনিট দশেকের মতো এইভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রা। অবশেষে চারুকে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে ছুটে গেল সেদিকে। চারুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল,

–” তুই ঠিক আছিস তো? ওই জাদুকাটা তোকে কিছু করেনি তো ? কি প্রয়োজন ছিল ওর সাথে কথা বলার? যদি কিছু করে ফেলত তখন কি হতো ?একটা কথা শুনিস না আমার।”

একনাগাড়ে চন্দ্রার এতগুলো প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে আছে। চন্দ্রাকে কোনো রকমে শান্ত করে বলল,

–“আমি ঠিক আছি । ভালো করে তাকিয়ে দেখ কিছুই হয় নি আমার । এত অল্পতে ভেঙ্গে পড়লে চলবে?”

–“কি প্রয়োজন ছিল ঐ জানোয়ারটার সঙ্গে কথা বলার?”

–“দেখ চন্দ্র তোকে আজ কিছু কথা বলবো । দেখ আর তিন দিন পর মুক্ত হয়ে যাবি সেই বদলোকটার কাছ থেকে। তারপর কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত তোর জীবন কাটবে না । সমাজের হাজারটা কথা শুনে তোকে এগিয়ে চলে যেতে হবে সাফল্যের পথে। তুই যদি এখনই এতটা দুর্বল হয়ে পরিস তাহলে সে সময়টা পাড়ি দিবি কিভাবে? ধর আমি কোনদিন যদি তোর পাশে থাকতে না পারি তাহলে তুই কি করবি তখন? তোকে আমার ছায়ায় বাঁচতে হবে না বরং নিজেকে নিজে গড়ে তোল। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখ । নিজকে এমন ভাবে গড়ে তোল যে কেউ তোর দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলতে ভয় পাই। ”

–” আমি কি পারবো?”

–” অব্শ্যই পারবি । মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই পৃথিবীতে। তবে হ্যাঁ তুই যে কোন কাজই করিস না কেন সেই কাজেই যে প্রথমবারেই তুই সফল হবি এমনটা নয় । তুই যদি কখনো কোন কাজে হোঁচট খেয়ে পড়িস তবে তোকে দাঁড় করাতে এগিয়ে আসবো আমি কিন্তু তোর অভ্যাস হবো না আমি। তোর সফলতার শীর্ষে তোকে তোর নিজ প্রচেষ্টায় পৌঁছাতে হবে। আমি শুধু তোকে পথ দেখাবো মাত্র। বাকি পথটুকু তোকে একাই চলতে হবে। বুঝেছিস তো। ”

–“হুম বুঝেছি। ”

–“তাহলে আগামী তিন দিন পর থেকে শুরু হবে তোর নতুন করে পথচলা। ”

–” আমিও অপেক্ষায় আছি সেই দিনের। আবারো নতুন করে নিজের জন্য বাঁচব আমি।”

–” খুব বেশি দেরি নেই আর।”

–“হুম।”

–“চল অনেক রাত হয়ে গেল । এখন ভেতরে যাই। তা না হলে আপা মারবে দুজনকেই।”

–“হুম চল।”

সময়ের ঘড়ি চলছে তার আপন খেয়ালে। সময়ের সাথে সাথে চলে এলো নিঝুম রাত্রি। আকাশে অর্ধ চন্দ্র ওঠেছে আজ। ক্ষীন সেই অর্ধচন্দ্র চাঁদের আলো। কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিদিক। সবুজ ঘাসের ওপর জমছে শিশির কনা। গাছপালার ডাল-পালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো। ধীরে ধীরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চাঁদটি হেলে পড়ছে পুব আকাশের কোনে। আর কিছুক্ষণ পর শুরু হবে আরও একটি নতুন দিনের। যেখানে থাকবে না কোন অশুভ ছায়া।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here