#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-০২
নিঝুম নিশুতি রাত । চারদিক নিস্তব্ধ । পুরো গ্রাম যেন নীরবতা চাদরে মুড়ে আছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে কেবল পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । গাছের ডাল-পালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার গোল রূপোলী চাঁদ।
সন্ধ্যায় রান্না শেষ করে সেই থেকে মেয়ের শিউরের কাছে বসে আছেন বিলকিস বেগম । চন্দ্রার গায়ে ধুম জ্বর ওঠেছে। ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বকে চলেছে সেই কখন থেকে । মাঝে মাঝে ব্যথার চোটে ছোট্ট শিশুর মতো কেঁদে ওঠছে চন্দ্রা। বিলকিস বেগম ঠান্ডা পানি দিয়ে চন্দ্রার গা মুছে দিয়েছেন কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমছে না ওর । শাড়ি বদলে দেওয়ার সময় মেয়ের শরীরের আঘাতগুলো পূর্ণ দৃষ্টিগোচর হলো ওনার। আঘাতের চিহ্ন দেখে মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল বিলকিস বেগমের।
মেয়ের এমন অবস্থা থেকে দিশাহারা হয়ে কেঁদে দিলেন তিনি। এদিকে বিলকিস বেগমের কান্না শুনে এগিয়ে এলেন রমজান মিয়া। কবিরাজের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি কিন্তু কবিরাজকে না পেয়ে রিক্ত হস্তেই ফিরে এসেছেন। ফিরে এসে মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাহিরে দাওয়ায় গিয়ে বসেছিলেন কিছু সময়ের জন্য কিন্তু বিলকিস বেগমের কান্না শুনে আবারো ঘরে ফিরে এলেন তিনি। স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
–“জ্বর এহনো কমে নাই?”
বিলকিস বেগম স্বামীর প্রশ্নে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
–” না কমে নাই, জ্বর তো আরো বাড়তাছে মাইয়াডার। কবিরাজ পাইছো?”
–“না পাই নাই। কবিরাজ নাকি কোন কামে শ্মশানে গ্যাছে।আজ রাতে আইবো না, তয় কাল ভর দুপুরে যাইতে কইছে।তহন নাহি পাওয়া যাইবো তারে ।”
রমজান মিয়া স্ত্রী কি আশ্বাস দিয়ে বললেন ,
–“তুমি আর কাইন্দো না। তুমি যদি এহন এমন করো তাইলে মাইয়াডারে সামলাবো কেডা ? তুমি বরং গামছা ঠান্ডা পানিতে ভিজাইয়া সেই গামছা দিয়া ওর শরীরটা ভালো কইরা মুইছা দাও । আমি ততক্ষনে বাহিরে গিয়া খারাইতাছি।”
কথাগুলো বলে রমজান নিয়ে আবারো ঘরের বাহিরে চলে গেলেন। রান্নাঘরের সাথে ফাঁকা জায়গাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে এই অন্ধকারে সিগারেট জ্বালালেন তিনি।
এদিকে বিলকিস বেগম স্বামীর কথা মতো ভেজা গামছা দিয়ে চন্দ্রার পুরো শরীর মুছে দিলেন কিন্তু পানি দিয়ে মুছে দেওয়াতে আরেক বিপত্তি দেখা গেল। চন্দ্রা শরীরে আঘাতের স্থানগুলো পানির স্পর্শে জ্বালা করতে লাগলো । চন্দ্রার আর্তনাদ শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন বিলকিস বেগম। তাই শুকনো কাপড় দিয়ে জায়গা গুলো মুছে দিলেন। এতে একটু স্বস্তি বোধ করলো চন্দ্রা তারপর আবারো ঢলে পড়ল ঘুমের ঘোরে।
রাতের শেষ প্রহরে জ্বর নামতে শুরু করলো চন্দ্রার। সেইসাথে ঘাম ছুটতে লাগলো ওর । মেয়ের অবস্থার উন্নতি দেখে বিলকিস বেগম আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালেন। তারপর হেঁটে চলে গেলেন কলপাড়ের দিকে । মেয়ের সুস্থতা কামনায় তাহাজ্জুতের নামাজ পড়বেন তিনি। পুরো রাত মেয়েটার চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন নি বিলকিস বেগম।
নামাজ শেষে মেয়েকে আরেকবার দেখে বাহিরে চলে গেলেন বিলকিস বেগম । “মাষ্টার বাড়িতে” যেতে হবে তাকে এখন। গৃহস্থের বাড়িতে কাজ না করলে অনাহারে থাকতে হবে যে তাদের । তবে বিলকিস বেগম যাওয়ার আগে চন্দ্রার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতে ভুললেন না । অজানা বিপদের কথা তো বলা যায় না । ঘরেতে তার যুবতি মেয়ে আছে এখন । মেয়েকে নিয়ে সব সময় অজানা আতঙ্কে থাকেন তিনি।
টিনের বেড়া দেওয়া বড় বাড়িটির নাম “মাস্টার বাড়ি”। বাড়ির কর্তা আমজাদ হোসেন প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক আর বাড়ির কর্তি আনোয়ারা বেগম একজন গৃহিণী। তবে আনোয়ারা বেগম যেমন সহজ সরল তিনি দয়ালু। ওনার ঘরের দুয়ার থেকে কোন লোক খালি হাতে ফিরে গেছেন বলে কেউ বলতে পারবে না। পাড়ার ছোট থেকে বড় সকলের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা মানুষ এই মাস্টার বাড়ির সকলে।
আনোয়ারা বেগম তিন সন্তানের জননী। দু-ছেলে আর এক মেয়েকে ঘিরে ওনাদের সুখের সংসার ।মেয়েকে অবশ্য বিয়ে দিয়েছেন বহু আগেই। দুই ছেলেরও বিয়ে হয়েছে । বয়স তো আর কম হলো না ওনাদের। দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো বছর। এখন চুলে পাক ধরেছে ওনাদের।গায়ে শক্তিও কমে এসেছে সেই সাথে। তাই ধানের সময় আসলেই লোক রাখতে হয় এখন। কাজের লোক রাখলেও আনোয়ারা বেগম সর্বত্র তাদের সাথে থেকে কাজ বুঝিয়ে দেন। এমনকি নিজেও হাতে হাতে কিছু কাজে সাহায্য করেন ।
আজও রাতের শেষ প্রহরে উঠে নামাজ পড়ে টুকটাক কাজ করছিলেন আনোয়ারা বেগম। বিলকিস বেগমের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু বিলকিস বেগম না আসাই তিনি নিজেই নেমে পড়লেন কাজে। হয়তো বিলকিস বেগমের কোন সমস্যা হয়েছে ভেবে তিনি নিজে কাজ শেষে বিলকিস বেগমের বাড়ি যাবেন বলে মনস্থির করলেন। ঠিক এমন সময় বিলকিস বেগমের আগমন ঘটল “মাস্টার বাড়িতে”। আনোয়ারা বেগম মুখ তুলে তাকালেন ওনার দিকে । বিলকিস বেগমের চোখেমুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” আজ তোকে কাজ করতে হবে না বিলকিস। এদিকটা আমি আর জিন্নাতের মা দুজনে মিলে সামলে নেব।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে চমকে উঠলেন বিলকিস বেগম। তবে কি কাজটা তার হাত ছাড়া হয়ে গেল? কিন্তু এই কাজটা চলে গেলে যে তাদের অনাহারে মরতে হবে। তাই কান্নাভেজা কণ্ঠে বিলকিস বেগম বলে উঠলেন,
–“হামাক কাম থাইকা বাদ দিচ্ছেন ক্যান ভাবি? হামার কোন ভুল হয়ে থাকলে হামাক কন,আমি ভুলগুলো শুধরে নেবার চেষ্টা করুম।”
বিলকিস বেগমের কান্না শুনে এগিয়ে এলেন আনোয়ারা বেগম । দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলেন,
–“তোকে কাছ থেকে বাদ দিচ্ছে এমনটা কখন বললাম? শুধু আজ কাজ করতে বারণ করেছি। চোখ মুখের অবস্থা দেখেছিস তোর? সারারাত বোধহয় ঘুমাস নি । এখন গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে। দুপুরের পর থেকে না হয় আবার কাজে আসিস।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বিলকিস বেগম। কিভাবে যেন মানুষটা সকলের না বলা কথা গুলো অনায়াসেই বুঝতে পারে । তাইতো পাড়ার সকলে তাকে এত ভালোবাসে তাকে। হয়তো আনোয়ারা বেগমের মতো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীতে মনুষত্ব বলে কথাটি টিকে আছে এখনো নাহলে সেই কবেই উঠে যেত । বিলকিস বেগম আপন মনে কথাগুলো ভেবে চোখের পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললেন।
–“কিরে কান্না শেষ হলো তোর? এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে না-কেঁদে ঘরে গিয়ে ঘুমা যা। এবেলায় কাজে বারন করেছি বলে ওবেলাই কিন্তু ছাড় দিব না।”
বিলকিস বেগম মুচকি হেসে বললেন,
–” সে তুমি না কইলেও ও বেলায় আর কোন কাজ করতে দিচ্ছি না তোমাকে। আর ভাবি শরীর খারাপ করলে আমায় ডাক দিবে। জিন্নাতের মা তুমি কিন্তু ভাবির দিকে খেয়াল রাখবা। ভাবিকে বেশিক্ষণ নীচু কইরা কাজ করতে দিবা না বুঝলা। ভাবির কিন্তু কোমর ব্যথা করে।”
জিন্নাতের মাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলেন বিলকিস বেগম। সম্পর্কে উনি আনোয়ারা বেগমের ছোট জা হোন। আমজাদ হোসেন আর রমজান মিয়া চাচাতো দুই ভাই ।
মাষ্টারবাড়ি গোড়াপত্তন হয় মিজানুর সরকারের হাতে। সে ১৯৩৫ সালের কথা। মিজানুর সরকার তখন সবে মেট্রিক দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি এসে পিতা নিজামুদ্দিন সরকারের কথামতো প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। সেইসময় মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়া মানে বিশাল কিছু, কিছুটা অর্ধেক রাজ্য জয় করার মতো অবস্থা। স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে জড়ানোর পরেই লোক মুখে এই বাড়ির নাম হয়ে যায় “মাস্টার বাড়ি “। সেই থেকে আজ অব্দি এই বাড়িটিকে সময় “মাস্টার বাড়ি” বলেই চিনে।
নিজামুদ্দিন সরকাররা ছিলেন দুই ভাই। অপর ভাইয়ের নাম ছিল সালাউদ্দিন সরকার। নিজামুদ্দিন সরকারের দুই ছেলের নাম মিজানুর সরকার ও রশিদ সরকার।অন্যদিকে সালেহউদ্দিনের ছিল এক ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলের নাম ছিল আশাদূল।
পরবর্তীতে মিজানুর সরকার তিন ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের পিতা হন এবং রশিদ সরকারো তিন কন্যা সন্তানের পিতা হন। এদিকে আসাদুল সরকার ও পাঁচ পুত্র সন্তানের জনক হোন। অতঃপর এভাবেই পৌঁছানো ক্রোমের সরকার বাড়ির বংশধর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মিজানুর রহমান ওনার ছেলেদের শিক্ষায় সুশিক্ষিত করলেও আসাদুল সরকারের ছেলেরা পড়াশোনা করে নি । সেই জন্য আজ তারা পাঁচ ভাইই অনেক কষ্টে দিনযাপন করছে। অন্যদিকে মিজান সরকারের উত্তরসূরীরা শিক্ষায় স্বশিক্ষিত হয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করছে।
পুরনো ইতিহাস মনে পড়তেই চোখে পানি এলো বিলকিস বেগমের। এতক্ষণ ধুলো পড়া অতীতে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। যে স্মৃতিতে শুধুই ওনাদের দারিদ্র্যের কথা লিখে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে নিজের জীবনের প্রতি বড্ড ঘৃনা হয় ওনার। পরবর্তীতে সে ঘৃনা পরিবর্তিত হয়ে অদৃষ্টের প্রতি চলে যায়। মাঝে মাঝে নিজের অদৃষ্টকে নিজেই কথা শুনান তিনি। ওনার মতো পোড়াকপালি আর কেই বা আছে।
নিজের দুঃখের কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে বিলকিস বেগম চলে গেলেন নিজ অর্ধভগ্ন বাড়িটির দিকে।
চলবে