চন্দ্রাবতী,পর্ব:১

0
797

গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে হেঁটে চলেছে সপ্তাদশী বয়সের একটি মেয়ে। পরনে তার কুচকানো শাড়ি, মাথার কালো লম্বা চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পিঠ বরাবর, মুখে তার হাজারো আঘাতের চিহ্ন। তবুও জনাজীর্ণ শরীরে এলোমেলো ভাবে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। গন্তব্য তার পাশের গ্রাম রূপগঞ্জ।

গ্রামের মেঠো পথের দু’পাশে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। সেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে কেবল হলুদ রঙের ধান আর ধান। দলে দলে মানুষজন সেসব ধান কাঁটে, আঁটি বাঁধে, আর সে সব ধানের আঁটি বাগের দু’ পাশে দাড়িপাল্লার মতো ঝুলিয়ে বাঁক কাঁধে বাড়ি ফেরে কৃষকেরা। কোথাও বা সেসব ধানের আঁটিবোঝায় গরুর গাড়ি মেঠো পথে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে গৃহস্থের বাড়ি বা ধান-খোলার পথে চলে।

রূপসা (কাল্পনিক নাম) নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। ওপারে সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত গ্রামটি চোখে পড়ে ওর। ওপারের গ্রামটির নামই রূপগঞ্জ। নামের মতোই অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা গ্রামটি। এ যেন কোন শিল্পীর বহু যত্নে রঙ তুলি দিয়ে আঁকা কোন এক ছবি। দু্’গ্রামের মাঝখানে রয়েছে ছোট্ট একটি রূপসা নদী। তবে রূপসা নদী এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। বছরের পর বছর নদীর তলদেশে পলি জমে হ্রাস পেয়েছে এর গভীরতা। তবে বর্ষাকালে এই মৃতপ্রায় রূপসা নদীটি যেন আবারো ফিরে পায় তার নব-যৌবন। তখন তার দু-কূল কানায় কানায় ভরে ওঠে পানিতে। পানির কলকল শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিদিক। তখন অবশ্য খেয়াতরীর সাহায্যেই সম্পন্ন হয় দুই গ্রামের যাতায়াত। তবে এই ছোট্ট নদী পারাপারের প্রধান মাধ্যম এখন সাঁকো। বাঁশের তৈরি সাঁকো পেরিয়েই চোখে পড়ে ছোট্ট গ্রামটির। ছায়া-শীতল পথ, জলরাশি, পাখির কলতানে মুখরিত গ্রামটিতে পা দিলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। নিরিবিলি পরিবেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যায় ক্ষনিকের মাঝে। এ গ্রামের সকলের ঘুম ভাঙ্গে হরেক প্রজাতির পাখির ডাকে। গভীর মমতা আর ভালোবাসায় ভরা গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের জীবন-ধারা।

মৃতপ্রায় রূপসা নদীটির তীঁরে এসে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। ছলছল দৃষ্টিতে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে ফেলে আসা গ্রামটিকে। অতঃপর আবারো চলতে শুরু করে সামনের দিকে। সাঁকো পেরিয়ে পৌঁছে যায় সবুজ গাছপালা ঘেরা অপরূপ গ্রামটিতে। ততক্ষণে দিনের আলো ফুরিয়ে আঁধার নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। আঁধার নামতেই আজকের মত বিদায় নিল পশ্চিম আকাশের কোলে থাকা টকটকে লাল সূর্য্যি মামা। পাখিরা রক্তিম আকাশের এদিক – সেদিক উড়াউড়ি করে করে ক্লান্ত শরীরে তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথে তখন বাড়ি ফিরছে এক ঝাঁক রাজহাঁসের দল। হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দে তখন মুখরিত চারিদিক। মেঠো পথের দু’ধারে থাকা গাছের গোল পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের তালে তালে দোল খাচ্ছে জবাফুল। গ্রামের মাঠ জুড়ে সবুজ ফসলের মাঠ । দখিনা বাতাস দোল দিচ্ছে সে ফসলকে। আঁকাবাঁকা নদীর দু’তীরে অবারিত সবুজ মাঠ। মাঝে মাঝে গ্রাম অতঃপর আবারো মাঠ। গ্রামগুলো মাঠের সঙ্গে মিশে অনেক জায়গায় এক হয়ে গিয়েছে।

টিনের বেড়া দেওয়া একটি অর্ধ ভগ্ন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সপ্তদশী মেয়েটি । অন্ধকার ততক্ষণে গ্রাস করে নিয়েছে পুরো পৃথিবীকে। টিমটিম করে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলছে গ্রামের প্রতিটি ঘরে। গৃহবধূ তখনো মাটির চুলায় রান্না করতে ব্যস্ত। গৃহস্থ কৃষকেরাও মাঠ ফিরে দাওয়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন। অনেকে আবার মনের সুখে হুকোও টানছে।

কাঠের দরজায় বার দুয়েক ধাক্কা দিয়ে দুর্বল কন্ঠে ডেকে উঠলো মেয়েটি,

–“মা দরজাটা খুলো।”

গ্রামের আটপৌর এক বয়স্ক মহিলা তখন ঘরের ভিতরে রান্নার সরঞ্জামগুলো ঠিক করছিলেন রান্না করবেন বলে। বয়স তাঁর চল্লিশের কোঠায়। মাথায় পাকা চুল , শ্যামবর্ন চেহারা । নাম বিলকিস বেগম। কারো গলার আওয়াজ শুনে দরজার পানে তাকালেন তিনি ‌। ভাবলেন হয়তো ওনি ভুল শুনেছেন কিন্তু আবারো কন্ঠস্বরের আভাস পেতেই ভ্রু – কুঁচকে দরজার দিকে চলে গেলেন । মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন,

–“সারাদিনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাইটা কোথায় ভাবলাম দুটো ডাল ভাত খাইয়া ঘুমাইয়া পড়মু তা আর হলো কই ? দেখি এই ভর সাঁঝের বেলা কে এলো হামার দোয়ারে? নিশ্চয়ই পাশের বাড়ির ছোট বউ ফুলিই হইবো।”

কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে-আওড়াতে দরজা খুলে দিলেন তিনি। দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলেন বিলকিস বেগম। এ যে ওনার মেয়ে চন্দ্রাবতী । এদিকে মা কে দেখে শ্যাম বর্ণের মেয়েটি ততক্ষণে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কান্নায় ভিজিয়ে দিচ্ছে মায়ের আঁচল।

চন্দ্রাবতী গ্রামের গরিব কৃষক রমজান মিয়ার একমাত্র মেয়ে । রমজান মিয়া ওনার মেয়েকে খুব ভালবাসেন তবে ছেলের আল্লাদ পূরণ করতে গিয়ে ছোটবেলা থেকেই মেয়ের ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে পারেতেন না তিনি। কিন্তু মেয়ের আবদার পূরন করতে না পারার ক্ষতি পূরন পুষিয়ে দিতেন মেয়েকে আদর করে।

চন্দ্রাবতী নামের মেয়েটি দেখতে শ্যাম বর্ণের, চোখগুলো টানা টানা। লম্বায় পাঁচ ফুট হবে। চন্দ্রাবতী নামটি রেখেছিল ওর দাদা আনোয়ার মিয়া। চন্দ্রাকে আঁতুরঘরে কোলে নিয়ে বলেছিলেন,

–“আমার সংসার আলো কইরা যে আইছে আজ থাইকা তার নাম দিলাম চন্দ্রাবতী।”

ছোটবেলা থেকেই চন্দ্রার গায়ের রং শ্যামলা হওয়ার জন্য অনেকে হাসাহাসি করতো ওকে নিয়ে। অনেকে আবার ওর নাম নিয়ে টিপ্পনী কেটে বলতো,

–“কালো মাইয়ার নাম নাকি আবার চন্দ্রাবতী। তো চন্দ্রাবতী তুই আলো দিবি ক্যামনে? তুই তো কালো মাইয়া তোর থাইকা কেবল আন্দারই পাইবো মানুষ। তার থাইকা আজ থেকে তোরে কালাবতী কইয়া ডাকুম হামরা।”

কথাগুলো বলেই ছেলেমেয়েগুলো খিলখিল করে হেসে উঠতো। ছোট্ট চন্দ্রা ওদের হাসি দেখে কান্না করতে করতে বাড়িতে এসে ওর দাদাকে বলতো,

–“দাদু আমি কালা বইলা সবাই আমারে কালাবতী কইয়া ডাহে। তুমি হামার নাম বদলাইয়া দাও দাদু।”

আনোয়ার মিয়া তখন নাতনিকে কোলে নিয়ে পরম আদরের সাথে হেসে বলতেন,

–“চাঁন্দের আবার কালা আর সাদা রঙ আছে নি। চান্দের শুধু একটাই কাজ তা হইলো সারারাত ওই নীল আকাশের বুকে একলা জাইগা থাইকা উজ্জ্বল আলো ছড়ানো। দেখবি তুইও একদিন ঐ চান্দের লাহান তোর গুনের আলো ছড়াবি। তহন দেখবি সব্বাই তোরে মাথাই কইরা রাখবো।”

ছোট চন্দ্রাবতী সেদিন ওর দাদার কথাগুলো না বুঝলেও মাথায় ঢুকিয়ে নেয়। এরপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়, সেদিনের সেই ছোট্ট চন্দ্রাবতীও ততদিনে কিশোরীতে পরিণত হয় । তবে দাদার কথা গুলো ভোলে না । মনের মনিকোঠায় খুব যত্ন করে রেখে দেয় সেই কথাগুলোকে।

বিলকিস বেগম মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে রইলেন। মেয়ে ওনার এমন সাঁঝের বেলায় বা এলো কেন আর এভাবেই বা কেঁদে চলেছে কেন? কোন খারাপ খবর নয় তো? তবে কি জামাইয়ের কোন বিপদ হয়েছে? প্রশ্নগুলো মনের কোন উঁকি দিতেই মেয়েকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–” কিরে এভাবে কাঁদতেছিস ক্যান? কি হইছে? আর জামাই বাবাজি কই ? তোর লগে আহে নাই ক্যান ?”

চন্দ্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে লাগলো। এই যে ওর গায়ের কালচে বর্নের আঘাতগুলো দেখা যাচ্ছে সেইগুলো ওর মা কি দেখছে না? না কি দেখেও না দেখার অভিনয় করছে? চন্দ্রাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিলকিস বেগম আবারো মেয়েকে তাড়া দিয়ে বললেন,

–” কি রে এমন বোবার মতোন খাড়াইয়া রইসোস ক্যান? কি জিগাইলাম তার উত্তর দে।”

চন্দ্রা আলতো করে ওর চোখের কোনে লেগে থাকা পানি মুছে নিল । কারন ওর চোখের পানি দেখার মত কেউ নেই এখানে। সবাই পড়ে আছে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে। চোখ মুছে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,

–” তোমার জামাই আহে নাই মা । আর আইবো কিনা তাও সন্দেহ।”

বিয়ের কথা শুনে বিলকিস বেগমের উদ্বিগ্নতা যেন আরো বেড়ে গেল। সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল গৃহস্থ বাড়ির সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। জামাইয়ের সাথে মেয়ের দ্বন্দের কথা সবাই জেনে গেলে নানা কটু কথা ছড়াবে। তাই মেয়েকে হাত ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলেন তিনি। বাকি কথা না হয় ঘর বসেই শুনবেন।

ঘরে নিভু নিভু করে জ্বলছে কুপবাতিটা। হয়তো খুব বেশি সময় আর জ্বলবে না। জ্বলবে কি করে তেল ফুরিয়ে এলো যে। অভাবের সংসারে কোন রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে মানুষগুলো।

পুরো ঘর ঈষৎ আলো – অন্ধকার হয়ে আছে। টিনের বেড়া দেয়া ছোট ঘরটির এককোণে পেতে রাখা হয়েছে একটি চৌকি। চৌকি বরাবর টিনের বেড়া খানিকটা কেটে বানানো হয়েছে জানালা। চৌকির ঠিক বাম পাশে একটি কাঠের আলমারি রয়েছে। আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছে গুটি কতেক জামা- কাপড় আর ব্যাবহার্য কিছু থালাবাটি। যেগুলো মেয়ের বিয়ের উপলক্ষে মাস ছয়েক আগে কেনা হয়েছিল। দুজনের সংসারে এর থেকে আর কি বা প্রয়োজন। ছেলে তো বউকে নিয়ে ঢাকা শহরে থাকে। বছরে এক আধবার এদিকে আসে কি না সন্দেহ। হায় কি নিয়তি যে ছেলেকে নিজেদের ঘাম ঝরিয়ে পড়ালেখা করালেন সেই ছেলেটি কি না তাদের খবর রাখে না।

চন্দ্রাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে কুপি হাতে বিলকিস বেগম চুলার কাছে চলে গেলেন রান্না করতে। ঘর থেকে বের হয়ে গান দিকে হাত দুয়েক দূরে খড়ের ছাউনি দিয়ে রান্নাঘর করা হয়েছে। কুপি নিভে যাবার আগেই ঝটপট রান্না সেড়ে নিলেন বিলকিস বেগম। তবে মেয়ের কথা এখনো মাথাতেই রয়ে গেছে ওনার। মেয়ের গায়ে আঘাতের চিহ্নগুলো যে ওনার নজরে পড়ে নি এমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু ঐ যে গরীব বাবা – মার যে এসব দিকে নজর দিতে নেই। তাই অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হলেও তা মুখে আনতে নেই, নেই অসহায় মেয়েকে শান্তনা দেবার সাহস। তাই তো সবকিছু না দেখার মতো অভিনয় করে যেতে হয়। হায় এই বুঝি হতভাগা দরিদ্র মা – বাবার নিয়তি

# সুচনা পর্ব
#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here