পুনরারম্ভ, পর্ব-৮

0
569

#পুনরারম্ভ। পর্ব-৮
লেখক- ইতি চৌধুরী

যা ভাবা তাই করা। একবার ঘড়ি দেখে নেয় সেহের। সবে ৮ টা বাজে। আহামরি রাত হয়ে যায়নি। মাহির ঝিগাতলা থাকে। ঝিগতলা বাস স্ট্যান্ড রেখে অনেকটা ভেতরে মাহিরের বাসা। বাসাটা সেহেরের চেনা আছে। আরও দুইজনসহ একটা বাসা নিয়ে থাকে তারা। বেশ কয়বারই মাহিরের সাথে যাওয়া হয়েছে তবে বাড়ির গেইট পর্যন্তই। ভেতরে যাওয়া হয়নি। বাসাটা চেনা আছে এই বেশি। অনেক সাবধানে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে সেহের। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত বিয়ের আয়োজন নিয়ে। একদলের শপিং তো এখনো শেষ হয়নি। তারা শপিং ও আয়োজনে ব্যস্ত। বাবা ছাদে আছেন আগামীকাল গায়ে হলুদ সেখানে স্টেইজ বানানোর কাজ চলছে। সেই তদারকিতে ব্যস্ত। সবার ব্যস্ততার সুযোগেই বেরিয়ে আসে সেহের। রাস্তায় নেমেই একটা রিকশায় উঠে উড টেনে দেয়। এখানটায় কেউ তাকে দেখে ফেললে সমস্যা আছে। পরে এমনিও সবাই জানতে পারবে কিন্তু পরের টা পরে। আপাতত সে ধরা পরতে চায় না। এই গন্ডির বাইরে চলে গেলেই তার শান্তি। রাস্তায় জ্যাম আছে মোটামোটি। কাউকে জানানো হয়নি সে চলে এসেছে। কেউ খুঁজলে বুঝতেও পারবে না যে সে পালিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোনো চিরকুট বা চিঠি কিছুই রেখে আসতে পারেনি। তৎক্ষনাৎই মনে পরে ডাক্তার সাহেবের কথা। সে অনুরোধ করেছিল যাই সিদ্ধান্ত নেয় তা যেন অন্তত তাকে জানায়। বেচারার অনুরোধটা রাখতে ইচ্ছা করছে সেহেরের। ফোনের কল লগে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের নম্বরে কল দিতে নিয়েও থেমে যায়। কল না দিয়ে ম্যাসেজ পাঠায়। ম্যাসেজে লিখে, “চলে যাচ্ছি আমি। আপনি আমার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলেন তাই আপনাকেই জানালাম। বাসায় কেউ জানে না ভালোবাসার টানে আমি ঘর ছেড়েছি। এখন সবাইকে জানানোর দায়িত্বটা আপনার। সেহের।”
ছোট্ট একটা ম্যাসেজ। পাঠিয়ে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে ব্যাগপ্যাকে রেখে দেয়। আপাতত ফোনে আর হাত দিবে না সে। যার ইচ্ছা ফোন দিক। ফোন দিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলুক সে কারো কল রিসিভ করবে না।

সবেই ওটি থেকে বেরিয়েছে অতুল। আজ সারাদিনে পরপর তিনটা ওটি এটেন্ড করেছে সে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। শরীর আর চলছেই না যেন। এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি ও একটু বিশ্রাম খুব প্রয়োজন। শেষ রাতে আরেকটা ওটি আছে। এরপরেই তার ছুটি। বাসায় গিয়ে সকালে একেবারেই ঘুম দিবে। তারপর সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ। হলুদের কথা মনে পরতেই খেয়াল হয় আজ সারাদিনে সেহেরকে তার কল দেয়া হয়নি। কেবিনে ফিরে এসেই ফোনটা হাতে নেয় সেহেরকে একটা কল করবে বলে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে তার আর সেহরকে কল দেয়া হয় না। সেহেরের পাঠানো ম্যাসেজটা পড়ে কিঞ্চিৎ হাসে সে।
সেহেরের ম্যাসেজটা দেখেই সেদিনের মাহিরের সাথের কনভারসেশনটা মনে পরে যায় অতুলের। যেদিন সেহের নিজ উদ্যোগে এসে তার সাথে দেখা করলো বিয়ে করতে পারবে না জানাতে। তার ভালোবাসার মানুষের কথা জানাতে। সেই মুহূর্তে মুখে না করে দিলেও পরবর্তীতে সে ঠিকই ভেবেছিল সেহেরের এতটুকু উপকার সে করবে। তবে তার মনে হয়েছিল যার জন্য সে উপকারটা করতে চায় তার সাথে একবার কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। সোর্স লাগিয়ে ঠিক মাহিরকে খুঁজে বের করে ফেলে অতুল একদিনেই। পরেরদিনই সে গিয়ে মাহিরের সামনে দাঁড়ায়। তাদের কথপোকথন ছিল এরূপ।
অতুল নিজের পরিচয় দিতেই মাহির জিজ্ঞেস করেছিল,
‘আমার কাছে আপনার কী প্রয়োজন?’
‘প্রয়োজন নেই আবার বলা যায় প্রয়োজন আছে।’
‘একটু পরিষ্কার করে বলবেন কি?’
‘বলছি, সেহেরের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু সে আপনাকে ভালোবাসে। যদি আপনারা বিয়ে করতে চান সেক্ষেত্রে আমি আপনাদের হেল্প করতে পারি।’
‘আমরা কখন বিয়ে করব না করব সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। যদি কিছু করতে চান তাহলে বিয়েটা ভেঙে দিন।’
‘আমি বিয়েটা ভেঙে দেয়ার পর যে সেহেরের বাবা তার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? আমি বিয়ে ভেঙে দিলে হয়তো অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে। তাই এর সহজ সমাধান হচ্ছে আপনারা বিয়েটা করে নিন।’
মাহিরকে কিছুটা চিন্তিত দেখায়। তা দেখে অতুল জিজ্ঞেস করেন,
‘এনিথিং রঙ?’
‘নো, নাথিং রঙ। আমাদের বিয়ে নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে।’
মাহিরের কথা শুনে স্মিত হাসে অতুল। তা দেখে মাহির বলে,
‘আমার মনে হয় না আমি হাসার মতো কিছু বলেছি।’
‘আপনার পক্ষে বিয়ে করাটা সম্ভব নয় তা বললেই পারেন।’
‘যেহেতু বুঝতেই পারছেন তাহলে নিশ্চয়ই এটাও বুঝতে পারছেন কেনো সম্ভব নয়।’
‘সবটা বুঝতে পারছি না ভেঙে বললে ভালো হয়।’
‘আপনি প্রতিষ্ঠিত বলেই খুব সহজে অন্যের প্রেমিকাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব করতে পারছেন। কিন্তু তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যের তো দূরের কথা এই মুহূর্তে আমি নিজের প্রেমিকাকেও বিয়ে করার কথা ভাবতে পারি না। সামনে আমার বিশাল ফিউচার, সেদিকে ফোকাসড না হয়ে এখন বিয়ে করার সময় আমার জন্য নয়। আই হোপ আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন। আপনার যদি আমাদের জন্য এতই দরদ হয় তাহলে বিয়েটা ভেঙে দিন। আমার আর কিছু বলার নেই আপনাকে। আপনার আর কিছু বলার থাকলে আমি দুঃখিত আপাতত আপনার কথা শুনার মতো সময় আমার হাতে নেই।’
বলেই মাহির উঠে হনহন করে চলে যায়। পেছনে বসে অতুল তখনই সিদ্ধান্ত নেয়। সে বিয়েটা ভাঙবে না। মাহিরের সাথে সেহেরের ভবিষ্যৎ নেই তা তার তখনই বুঝা হয়ে গেছে। যে ছেলে ভালোবাসতে পারে কিন্তু দায়িত্ব নিতে পারবে না নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেই ছেলের সাথে সেহের কেনো কোনো মেয়েই কখনো ভালো থাকবে না। কখনো কখনো জীবনে ভালো থাকাটাও খুব জরুরী। ভালোবাসা ব্যতীতও ভালো থাকা যায়। সেহেরটার জন্য খুব আফসোস হয় অতুলের। মেয়েগুলো এত বোকা কেন? এরা সবসময় অপাত্রেই কেন প্রেম দান করে। ভালোবাসা কেনো ভুল মানুষের জন্য আসে?

অতিরিক্ত নার্ভাসনেসে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে সেহেরের। মাথার ভেতর খালি লাগছে। মাহিরকে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছে। সে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে কে জানে? এরপর কি করবে তারা? কোথায় যাবে? অনেক অনেক চিন্তা-ভাবনা, প্রশ্ন কিন্তু এর কোনো জবাব সেহেরের কাছে নেই৷ মনে মনে নিজেকে একটা শক্ত করে ঝাড়ি লাগায় সেহের। যখন যেটা হবে তখন দেখা যাবে। এখন এসব ভাবার কোনো মানেই হয় না। মাহিরের কাছেই সবসময় শুনেছে এই বাসার দ্বিতীয় তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটটায় সে থাকে। সেই মোতাবেক দোতলায় উঠে ডান পাশের ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপে সে। মিনিট দুয়ের মাথায় কেউ একজন এসে দরজা খুলে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কাকে চাই?’
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে বেচারীর। একবার ঢোক গিলে নিয়ে বলে,
‘ম মাহির আছে বাসায়?’
‘আপনি কে?’
‘আমি সেহের। ওকে একটু ডেকে দিন না প্লিজ।’
ছেলেটা আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, সম্ভবত সে সেহেরের কথা জানে। মাহিরের রুমমেটদের সাথে আগে তার পরিচয় না হলেও নাম তো শুনেছে বলেই মনে হয়। এক মিনিট বলে ছেলেটা ভেতরে চলে গেল তাকে দরজায় রেখেই। ছেলেটা ভেতরে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দৌড়ে আসে মাহির। সেহেরকে এই মুহুর্তে এখানে দেখে যে সে বিষম খেয়েছে তা তার চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
‘তুমি এখানে!’ অবাক হয়ে জানতে চায় মাহির। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেহের বলে,
‘একটু পানি খাওয়াবা?’
যেহেতু এটা ব্যাচেলর বাসা তাই সেহেরকে ভেতরে আসার কথা বলে না মাহির। দাঁড়াও বলে ভিতরে গিয়ে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসে। গলা ভিজিয়ে পানি খায় সেহের। বোতলটা মাহিরকে ফেরত দিতেই সে আবার জিজ্ঞেস করে,
‘এই সময় তুমি এখানে কেন?’
সেহের জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সোজাসাপ্টা বলে,
‘আমি চলে আসছি।’
‘চলে আসছ মানে?’ অবাক হওয়াটা মাহিরের চোখেমুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়।
‘তোমার কাছে চলে আসছি।’
‘এক মিনিট।’ হাতের পানির বোতলটা দরজার পাশেই নামিয়ে রেখে সেহেরের একটা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে নিচে নেমে যায় মাহির। ব্যাচেলার বাসায় মেয়ে ঢুকালে সমস্যা আছে। কেউ দেখে ফেললে বিশাল কাহিনি হয়ে যাবে। তাই বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তার অন্যপাশের আইলেনের উপর এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা। মাহির জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি চলে আসছ কেন?’
‘কেন আসছি মানে? তুমি বুঝতেছ না কেন আসছি?’
‘না, বুঝতে পারতেছি না বলেই জিজ্ঞেস করতেছি।’
‘মাহির কাল বাদে পরশু আমার বিয়ে। আমি আজ চলে না আসলে কি হবে তুমি বুঝতে পারতেছ?’
‘সেটা আমি জানি পরশু তোমার বিয়ে। কিন্তু সেজন্য তুমি বিয়ের একদিন আগে আমার কাছে কেন আসবা?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মাহির। তোমার কাছে আসব না তো কই যাব?’
‘কই যাবা সেটা আমি জানি না। আমার জানার কথাও না। তুমি কি ভাইবা বাসা থেকে চলে আসলা? আমার এখনো লেখাপড়া শেষ হয় নাই। আমি বেকার একটা ছেলে। বাপ ভাইয়ের টাকায় লেখাপড়া করতেছি। সামনে আমার বিশাল ভবিষ্যৎ পরে রইছে। কিছু করতে হবে আমাকে। নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হবে। সারাজীবন তো আর বাপ ভাই আমাকে টানবে না। নিজের একটা পরিচয় গড়তে হবে। প্রতিষ্ঠিত হইতে হবে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই ভাইয়া আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার জন্য হাজারটা অপশন আছে কিছু করার। এই মুহূর্তে ভবিষ্যতের কথা ভুলে গিয়ে আবেগে গা ভাসানোর সময় আমার না। এই মুহূর্তে আমি আবেগ দিয়ে ভাবতেও পারতেছি না। তুমি যাই চিন্তা করে আসছ ভুল করছ।’
সেহের তার এই চব্বিশ বছর বয়সের জীবনে এত অবাক কখনো হয়নি। এই মুহূর্তে মাহিরের বলা কথাগুলো একদম বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে মাহির তার সাথে কোনো প্রাঙ্ক করছে। এখনই বলবে কেসা লাগা মেরা মাজাক।
কাঁপা কন্ঠে টেনে টুনে সেহের বললল,
‘প্রাঙ্ক করতেছ?’
‘এইটা প্রাঙ্ক করার সময় না সেহের। আমি ফ্যাক্ট বলতেছি। তোমার বিয়ের কথা শুনার পরে কি আমি একদিনও বলছিলাম চলে আসো, আমরা পালায় যাই? এসব আবেগ এই মুহূর্তে আমার জন্য না। তোমার বিয়ের বয়স হইছে কিন্তু আমার হয় নাই। যেদিন আমি প্রতিষ্ঠিত হবো সেদিন আমার বিয়ের সময় হবে, এখন না।’
‘আমি তোমাকে ভালোনাসি মাহির।’
‘ভালো আমিও তোমাকে বাসি। ভালোবাসি বলেই প্রবলেম সল্ভ করার জন্য অসময়ে বিয়ে করাটা কোনো সমাধান না। তাই বলে আমার ভালোবাসা মিথ্যা না কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে এক্সেপ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি নিজে বাপ ভাইয়েরটা খাই তোমাকে পালব কেমনে আমি তুমিই বলো। সেজন্যই বারবার বলছি বিয়েটা ভাঙো, বিয়েটা ভাঙো। কিন্তু তুমিও আমার কথা তোমার বাবাকে বলতে পারো নাই। কেন পারো নাই সত্যি করে বলবা?’
সেহের চুপ করে থাকে। তার চুপ থাকা দেখে মাহির নিজেই বলে,
‘আমি জানি তুমি তোমার বাবাকে আমার কথা কেন বলতে পারো নাই। বেকার প্রেমিকের কথা বাবাকে চাইলেই বলা যায় না, এটা আমিও বুঝি। তবু চাইছিলাম তুমি কোনোভাবে তোমার বাসায় ম্যানেজ করো। বিয়েটা ঠেকাও। কয়টা বছর জাস্ট। সেটা করতে পারলা না উল্টা আমাকে কিছু না জানায়ই চলে আসছ।’
‘চলে আসবো না?’
‘না, চলে আসবা না।’
মাহির হাত বাড়িয়ে সেহেরের একটা হাত ধরে বলে,
‘এখনো সময় আছে সব শেষ হয়ে যায় নাই। পারলে বিয়েটা ঠেকাও, আমি আছি। আর যদি না পারো…’ ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘তাহলে ভালো থেকো। আমাদের জার্নিটা এতটুকুই ছিল।’
সেহেরকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না মাহির। তাকে সেখানে রেখেই হনহন করে হেটে বাড়ির ভেতর চলে যায়।
কিছুক্ষণ এখানেই থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সেহের। বুঝে উঠতে পারছে না সে এই মুহূর্তে যা ঘটলো তা বাস্তব না কল্পনা। সে কি ঘুমিয়ে আছে? ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে কোনো? বুঝতে সময় লাগে না স্বপ্ন নয় সব সত্যি। সামনের দিকে হাটতে লাগে সেহের। থম ধরে রয়েছে সে। হাটতে হাটতে ভেতর গলি পেরিয়ে মেইন রোডের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর এগিয়ে যেতে পারছে না সেহের। শরীর, মন ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। গলির একদম মাথায় এসে হুট করেই বসে পরে সে। এদিকটা ভেতরে হওয়ায় একদমই নিরিবিলি। সম্ভবত প্রায় রাত দশটা বাজতে চলল। এই সময়টায় মানুষজন না থাকাটাও স্বাভাবিক। বসে পরেই দুই হাটুর ভাজে মুখ গুজে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সেহের। এভাবে মাহির তাকে ফিরিয়ে দিবে জীবনেও ভাবতে পারেনি। অনেক আশা নিয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিল। এখন কি করবে সে! কোথায় যাবে? মাহিরের তাকে ফিরিয়ে দেয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারছে না সে। এমনও একটা দিন তাকে দেখতে হবে কখনো চিন্তাও করেনি। জীবন এত কঠিন কেনো? বেঁচে থাকা এত কঠিন কেনো? কেনো সে মাহিরকে ভালোবাসতে গেল? কেনোই বা এই ভালোবাসার টানে ঘর ছাড়তে গেল? অনবরত কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। আচমকা মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে মুখ তুলে তাকায় সেহের। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায় সে। চোখের পানিতে মুখ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। নিজেকে, নিজের কান্না ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই অতুলের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে সেহের। এই মুহূর্তটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না অতুল। সেহের তাকে ঝাপটে ধরতেই সেও আর বাঁধা দেয় না, হাত বাড়িয়ে মাথায় আলতো হাত রাখে। সেহেরের মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে বাঁধা দেয় না। কাঁদতে দেয়। কাঁদলে মন হালকা হবে। বাস্তবতাকে সহজে মেনে নিতে পারবে। এই মুহূর্তে অতুল মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানায়। ভাগ্যিস সে তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা ভেঙে দেয়নি। নেগেটিভ কিছু একটা ঘটার আভাস পেয়েছিল বলেই রক্ষা হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করার পর সেহেরের কান্নার গতি কিছুটা মন্থন হয়ে এসেছে। আলতো হাত বুলিয়ে সেহরকে নিজের বুকে জড়িয়ে রেখেই অতুল বলে,
‘ইটস ওকে, আমরা আবার শুরু থেকে শুরু করব। শুরু থেকে নতুন করে একে অপরকে ভালোবাসবো।’
অতুলের বুক থেকে মুখ তুলে তার চোখে দৃষ্টি রাখে সেহের। অজানা একটা ভরসা এসে ভর করেছে যেন মানুষটার দৃষ্টিতে, চোখেমুখে। মন তাকে বলছে এই মানুষটাকে ভরসা করা যায়। আর ভরসা করতে দোষই বা কোথায়? যাকে ভালোবেসে, ভরসা করে ঘর ছেড়ে ছিল সেই তো মাঝপথে হাত ছেড়ে দিয়েছে। এর চাইতে মন্দ আর কি হতে পারে জীবনে?
সেহেরের দৃষ্টির কৌতুহল আন্দাজ করতে পেরে অতুল বলে,
‘মন্দ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এরপর যা হবে সব ভালো হবে। তুমি দেখেনিও।’
সেহেরের একটা হাত শক্ত করে ধরে আরও বলে,
‘জীবন যুদ্ধের শত প্রতিকূলতায়ও এই হাত আমি ছাড়বো না কথা দিচ্ছি।’
নিঃশব্দে সেহেরে চোখ গলে পানি ঝড়েই যাচ্ছে। একদিকে সদ্য ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া বিচ্ছদে যন্ত্রণা আর অন্যদিকে নতুন জীবনের হাতছানি। পরপর দুটো ঘটনা এত জলদি ঘটেছে যে বিশ্বাস করতে, হজম করতে সময় লাগছে তার।
অতুল কিঞ্চিৎ পিছিয়ে গিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে ধরে বলে,
‘পাওয়া যাবে একটা সুযোগ?’
কয়েক মুহূর্ত অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তার বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখে সেহের নিজের অজান্তেই। সেহেরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পেয়েই তা শক্ত করে আগলে ধরে অতুল। ঠোঁট জুড়ে প্রশস্ত হেসে বলে,
‘চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি। চিন্তার কারণ নেই কেউ কিছু জানে না। এখন জানবে আমার সাথে বেরিয়ে ছিলে।’
নিশ্চিন্ত হয় সেহের। অতুল আর অপেক্ষা করে না। ড্রাইভিং সিটের পাশেই প্রিয়তমাকে নিয়ে যাত্রা করে নতুন দিনের প্রত্যাশায়। এখান থেকে শুরু হবে নতুন আরেকটা গল্পের। যে গল্পে ভরসা স্থান পাবে সবার আগে। ভরসার পাশাপাশি ভালোলাগা, প্রেম, ভালোবাসা সব থাকবে কেবল থাকবে নিজ স্বার্থে কোনো প্রতারণা।

ভালোবাসা জিনিসটাই এমন। সুপাত্র বা ভুলপাত্র দেখে ভালোবাসা আসে না। ভালোবাসা কেবল হয়ে যায়। জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট বড়ো দুর্ঘটনা থেকেই কেবল মানুষ চেনা যায়। প্রকৃত ভালোবাসার মানুষ কোনো প্রতিকূলতায় মাঝ দরিয়ায় হাত ছেড়ে দেয় না। আবার বিপরীত মানুষটাও যে ভুল তাও কিন্তু নয়। ভালোবাসতে প্রতিষ্ঠিত হতে হয় না। তবে সেই ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চাইলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অতি আবশ্যক। ভালোবাসা তবু থেকে যায় কারো জীবনে পুরান রূপে কারো বা হয় পুনরারম্ভ।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here