#মায়া_মহল (১২) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
মায়ার মা রূপী নারীটিকে দেখে পরশ স্তব্দ হয়ে গেলো। এতো তার চেনা শিশু মায়ার মা নয়। এই মায়া যদি আঠারো বছর আগের সেই মায়া হয়,তাহলে এর কাছে কিভাবে এলো? আর যদি এই মায়া সেই মায়া না হয়,তাহলে কে এই মায়া? নাকি এই মেয়ে মায়ার অশরীরী আত্মা?
তফুরাকে পরশ নিজের পরিচয় দিয়ে, একটি রিকশা ডেকে নিলো। তার কাপড়চোপড়ের বড় সাইডব্যাগটি নিজের দুই হাঁটুর ভাঁজের উপর রাখলো।
যেতে যেতে পরশ কৌশল করে তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
আপা আপনার মেয়ে মাশাল্লাহ! লাখে একখান। আদব কায়দায়,জ্ঞানে,মেধায় চালু আছে। মায়ার চেহারার আদল মনে হয় তার বাবার মতো হয়েছে? নাহ?
তফুরা না শোনার ভান করে পথঘাট দেখছে। পরশ তাকে শুনিয়ে আবারও বলল,
আপনার সাথে মায়ার কোন মিল খুঁজে পাইলাম না আমি।
এই ব্যাটা গোয়েন্দার মত এত কথা কয় ক্যান? বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলল তফুরা।
পরশ আর বিশেষ ঘাটালো না তফুরাকে।বাড়ি পৌঁছে গেলো। তফুরার পরিচয় মায়া মহলে একজন আশ্রিতার মা। তাই বিশেষ করে কারো সাথে পরিচয় করার আবশ্যক নেই। নেই তারজন্য বাড়তি খাতির। পরশ কুমকুমকে ডেকে বলল,
কুমকুম উনি মায়ার আম্মা। ঢাকা থেকে এসেছে। জানইতো। উনাকে খাবার দিও হাতমুখ ধুয়ে এলে। পরশ তফুরার ব্যাগ ঘরের সিঁড়িতে রেখে অন্যকাজে চলে গেলো। মর্জিনা তফুরাকে পুকুর ঘাট দেখিয়ে দিলো।
তফুরা জিজ্ঞেস করলো, আমার মেয়ে কই?
আছে। শুনলেন না উনি অসুস্থ?
হ্যাঁ, ফোনে শুনছি।
আপনে খাইয়া লন। নিয়া যামু মায়া আপার কাছে।
তফুরা হাতমুখ ধুয়ে উঠে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালো। তাজ্জব চোখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাড়ির চারপাশ দেখলো। তার মায়া এত রাজকীয় সাজের বাড়িতে থাকে? কি রাজ কপাল নিয়ে এই মেয়ে দুনিয়াতে এসেছে?
ভাত খাইবেন না? আসেন এদিকে।
মর্জিনার ডাকে হুঁশ ফিরে তফুরার। তাকে হেঁশেলের বড় চৌকিতে সুস্বাদু পঞ্চপদ দিয়ে ভাত খেতে দিলো মর্জিনা। খাওয়ার পরে তফুরা নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আস্ত একটা রেডি করা পানের খিলি মুখে পুরে দিলো। অস্থির হয়ে উঠলো মেয়ের মুখ দর্শনের জন্য। মর্জিনা গিয়ে পরশকে বলল। পরশ ছোট বাবুর থেকে চাবি নিয়ে নিলো। সে তফুরাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল মায়ার বন্ধী থাকা কক্ষের সামনে।
কপাট খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো দুজন। পরশ ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মায়া মেঝেতে পাতা আধপুরোনো বিছানার উপরে কাত হয়ে পড়ে আছে। পরশ কোঁচা থেকে মায়ার মোবাইলটা তাকে দিয়ে দিলো।এবং জিজ্ঞেস করলো,
দুপুরে ভাত খাইছ?
মায়া মাথা ঝুঁকিয়ে বলল খাবার দিয়েছে ও খেয়েছে সে।
তফুরা এক বিধ্বস্ত,বিপর্যস্ত, বিপন্ন মায়াকে আবিষ্কার করলো। মায়া অবিকল বহুদিনের পুরোনো কোন ভগ্নস্তূপের মতো হয়ে আছে। সে আল্লাগো! ওমাগো! বলে মায়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার মেয়ের এই হাল ক্যান? মা কি হইছে তোর? তোরে এরা আটকায়া রাখছে ক্যান? কি বড় অপরাধ করছত তুই মা? তোর না অসুখ হইছে? কি অসুখ?
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইলো তফুরা।
মায়া কিছুই বলছে না। কেবল ফ্যালফ্যাল চাহনিতে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।
তফুরা মায়ার সারাগালে হাত বুলাতে বুলাতে আরো বলল,
তোর সুরত এমন হইছে ক্যান? এরা তোরে মারছে ক্যান? কথা কসনা ক্যান? ল এখনই চইলা যামু এই জানোয়ারগো বাড়ি থেইকা। তার আগে এগো নামে থানায় মামলা দিমু।মানুষরে আশ্রয় দেওয়ার নাম কইরা জুলুম করে।অত্যাচার করে এরা।
পরশ তফুরাকে থামালো এবার। বলল,
চলে যাবেন ভালো কথা। তার আগে কারণগুলা শুনা দরকার না আপনার? কেন মায়ার এই বন্ধীদশা হলো?
জ্বি ভাই। কন না। হুনতে চাই হগল কিছু।
কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল তফুরা।
আগে বলেন মায়া কি আপনার গর্ভজাত কন্যা?
তফুরা অবাক হলো শুনে। বলল,
হ আমার পেটের সন্তান মায়া। কি হইছে?
মায়াও নির্বাক চাহনি ফেলল পরশের উপরে।
পরশ বলল,
মনে হয় আপনি মিথ্যা বলছেন। শুনেন তাহলে বলে,পরশ মায়া আসার পর কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করলো। এবং তিনদিন আগে এই বাড়ির বড় ছেলে জুবায়ের মারা গেলো,তাও বলল তফুরাকে।
তফুরা কেঁপে উঠলো। বলল,
তো তাদের মরণের লগে আমার মাইয়ার দোষ কি?
জুবায়ের মারা যাওয়ার আগে বলে গেলো তার মরণের জন্য মায়াই দায়ী। এটা শুনেই বেগম সাহেবা তাকে এখানে বন্ধী করলো। নয়তো যদি তার সান্নিধ্যে আবার কেউ মইরা যায়। উনি নিজের হাতে এরে প্রচন্ড মারলো। রুস্তমকে দিয়েও প্রহার করলো। এবার বুঝছেন কাহিনী। খাওয়া দেয় সারাদিনে দুইবেলা। নয়তো সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো।
তফুরা মায়াকে জিজ্ঞেস করলো,
উনার বলা সত্য মা?
হ্যাঁ আম্মা সত্যি। কিন্তু আম্মা তারা কিভাবে মারা গেলো আমি কিছুই জানি না। বেগম সাহেবা বলে, আমি নাকি সবাইকে মারছি।
তফুরা কিছুক্ষন চুপ হয়ে রইলো। প্রগাঢ় নিরবতা তাকে ঘিরে। তার দুচোখের কোন বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মের মাঠের মতন।
পরশ বলল,
আমার মনে হয় মায়াকে আপনি কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছেন? আপনি সত্য স্বীকার না করলে মায়ার আরো বড় বিপদ হবে।এমনকি মায়াকে জীবন্ত মেরে ফেলার প্ল্যান করতেছে বেগম সাহেবা।
তফুরা ও মায়া একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো। অশীতিপর বৃদ্ধার মত তারা মা মেয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে শরৎকালেও।
মায়া কাঁপা স্বরে বলল,
চাচা আপনি কিভাবে জানেন এটা? আর আপনি আমাদেরকে বলেই বা দিলেন কেন? আপনি না এই মহলের সবচেয়ে পুরাতন ও বিস্বস্ত একজন?
পরশের মুখে অফুরন্ত বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো। শীতল গলায় বলল তফুরার দিকে চেয়ে,
দেখলেন আপা, কইলাম না আপনার মেয়ে বুদ্ধীমতি। তার প্রশ্নগুলা শুনছেন? এইজন্য আমারও অনেক দরদ এই মেয়েটার জন্য। আর আমার ইতিহাস? তা পরেই বলি তোমারে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গভীর পরিতাপের সুরে বলল পরশ।
দরজার বাইরে কারো পদধ্বনি শোনা গেলো। পরশ ফিসফিসিয়ে মায়া ও তফুরাকে সাবধান বাণী শোনাল,
এতক্ষণ আলাপের কিছুই বুঝতে দিবেন না ছোটবাবুকে। কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। নয়তো মা মেয়ের একলগে গর্দান যাবে। মনে রাইখেন এখানে আমি ছাড়া সবাই আপনাদের পর।
মায়া ও তফুরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুখে কুলুপ এঁটে রইলো মা মেয়ে। পরশ কপাট খুলে মেলে দিলো। শাহের ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো তফুরাকে। মায়া ও তফুরা বোবা চাহনিতে চেয়ে রইলো শাহেরের দিকে। শাহের পরশকে আদেশ দিলো চলে যেতে। পরশ চলে গেলো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
শাহের তফুরাকে বলল,
আপনি এখানেই মায়ার সঙ্গে ঘুমাবেন। অসুবিধা হবে কোন?
না বাবাজি অসুবিধা হবে না। মায়ার মুখেতো সব শুনলাম। মায়া নির্দোষ বাবা। আমরা আর থাকুম না। মায়াকে নিয়া আমি কাইল ভোরের চইলা যামু।
নাহ এখন যাবেন না। কোন সমস্যা হবে না আর। যা হওয়ার তা হয়েই গেলো। আপনাদের কাজ আছে। সময় হলে আমিই বলব আপনাদের চলে যেতে।
আইচ্ছা বাবা।
মায়ার কোমরে একটা তাবিজ আছে এটা কিসের? জিজ্ঞেস করলো শাহের তফুরাকে।
তফুরা ও মায়া চমকে উঠলো। তফুরা বলল,
তুমি কিভাবে জানলে বাবা?
আমি কিভাবে জানি সেটা বড় কথা নয়। ইম্পরট্যান্ট হলো কিসের তাবিজ সেটা?
বাবা এই তাবিজ হইলো মায়াকে সকল বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করার তাবিজ।
শাহের গোপনে আশ্চর্য হলো শুনে। রুম থেকে যেতে যেতে বিস্ময়ের সাথে ভাবল,
একটা তাবিজের এত ক্ষমতা? কেউ মায়াকে ছুঁতে চাইলেই মরে যাবে? তাহলে কি মরে যাওয়া সবাই মায়াকে স্পর্শ করতে চেয়েছে? যদি তাই হয় আমি স্পর্শ করার পরেও আমার কোন সমস্যা হয়নি কেন? নাকি মায়া বিশেষ কোন ক্ষমতার অধিকারী? কে এই মায়া? মায়া কি সত্যি এই সহজ সাধারণ নারীর মেয়ে?
শত প্রশ্ন শাহেরকে জীর্ণশীর্ণ করে ফেলছে। সে নিজের রুমে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে দুলতে লাগলো। কল্পনার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে মাকড়সার মতন।
কিছুক্ষণ পরে পরশ চুপিচুপি আবারো মায়ার রুমে গেলো। তফুরাকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি এখন শুধু এটা স্বীকার করেন,
মায়া আপনার ঔরসজাত সন্তান কিনা?
তফুরা হতবিহ্বল চোখে একবার পরশের দিকে একবার মায়ার দিকে চাইলো। তারপর ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল,
আপনার ধারণা সত্যি ভাইজান।
মায়ার কলিজা মোচড় খেয়ে উঠলো কলার মোচার মতন। উদভ্রান্তের ন্যায় আম্মা বলে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করলো তফুরার মুখপানে।
পরশ মায়ার পিঠে মমতার ছোঁয়া দিয়ে বলল,
তোমার আম্মার বলা ও আমার ধারণাগুলো যদি সত্যি সত্যি মিলে যায়,
তাহলে এই মায়া মহলের একচ্ছত্র মালিক তুমি। দ্বিতীয় কেউই নয়। আর আমি কোন ভৃত্য নই।
চলবে…