মায়া মহল পর্ব ১০

0
135

#মায়া_মহল (১০) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
সেই সন্ধ্যায় কায়রুস গ্রামে এলো। অর্থাৎ আঞ্জুমানের স্বামী এবং শাহের ও জুবায়েরের বাবা। অসুস্থ শরীরে গাড়ি থেকে নেমে নিজের কক্ষে চলে গেলো কায়রুস। এতটা মাস পরে বাড়িতে তার আগমন ঘটলো। তবে কেউই খুশী হল না তার আসাতে।

কিন্তু মায়া ভীষণ খুশী হলো। এত সুন্দর বাড়ির কারিগরকে আজ দেখতে পাবে বলে।

পরশ বিড়বিড়িয়ে বলল,
মিয়াভাই, বড় অসময়ে আপনি পা রাখলেন মায়া মহলে। বড় অসময়ে।

______

মায়া আড়চোখে বাসার সবাইকে লক্ষ্য করছে। এতদিন পরে পরিবারের কর্তা গ্রামে এলো। অথচ তাকে নিয়ে কারো মাঝে কোন বিশেষ হেলদোল নেই। নেই কোন উচ্ছ্বাস। নজরে পড়ছে না তার বিশেষ খাতির। সবাই সবার মতো করে আছে। কেউ তার কাছে যাচ্ছেও না। সেও রুম থেকে বের হচ্ছে না। তার রুমে কুমকুম গিয়ে খাবার দিয়ে আসলো।

মায়ার কাছে ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত লাগছে। কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। এতটা মাস হয়ে গেলো তবুও কারো কাছ থেকে কিছুই জানতে পারলো না। কাজের মেয়েগুলোও খুবই অনুগত এদের। কখনো তাদের বিরুদ্ধে বা মহল সম্পর্কে কিছুই বলল না। নাকি তাদের কাছে সবই নরমাল।

মায়া আঞ্জুমান আরার কক্ষে প্রবেশ করলো বাহানা ধরে। কারণ পড়াশোনার জন্য সে নিজের রুমেই থাকে বেশি এখন। তার পড়া ও এসাইনমেন্টের কাজ না কথাকলে রাতে আঞ্জুমান আরার সঙ্গেই ঘুমায়।
মায়া বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,

আন্টি কোন প্রয়োজন হলে জানাবেন।

তোমার পড়া আছে রাতে? জানতে চাইলো আঞ্জুমান।

নাহ আন্টি। আংকেল আসলো না বাসায়?

হুম আসছে। কিন্তু উনি উনার কক্ষেই ঘুমাবে। তুমি আমার সাথেই ঘুমাবে।

ওহ আচ্ছা। তাহলে ঘুমাবো। আংকেল কি আমার কথা জানে আন্টি? না মানে আংকেলকে দেখতে ইচ্ছে করছে?

জানে না। তবে দেখা হয়ে যাবে। তুমি এমন কিছু নয় যে ঘটা করে দেখা করিয়ে দিতে হবে।

কিঞ্চিৎ রাগ ঝেড়ে বলল আঞ্জুমান।

মায়া শংকিত অনুভব করলো। হোঁচট খেলো আঞ্জুমানের আচরণের রুক্ষ রূপ দেখে। অথচ কয়দিন আগেও তার সঙ্গে আঞ্জুমানের গলার স্বরে দরদ ছিলো। কোমলতা ছিলো,সহানুভূতি ছিলো। মায়া নিরব থেকে বেরিয়ে গেলো।

তার পরেরদিন মায়া কলেজে যাওয়ার সময় মূল গেইটে গিয়ে চরণ গতি মন্থর করলো। অচেনা একজন বয়স্কা সুঠামদেহী পুরুষকে দেখতে পেলো। লোকটি পরশের সঙ্গে কথা বলছে। মায়া পাশ কেটে যাওয়ার সময় তাকে সালাম দিলো।

সে সালামের জবাব নিয়েই অবাক চাহনি ফেলল মায়ার উপর। মায়াও একটু থামলো। পরশ নিজ থেকেই বলল,

মিয়াভাই, ওর নাম মায়া। বিপদে পইড়ে আমাদের বাড়িতে আছে। ভাবিজান ওরে আশ্রয় দিলো। কলেজে পড়ে। ছোটবাবু কলেজে ভর্তি করায়া দিলো।

মায়া কায়রুসের মুখপানে চাইলো।
আদুরে হাসি দিয়ে বলল,

আংকেল আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো আপনাকে দেখার। আজ দেখলাম। ভালো লাগছে।কলেজ থেকে এসে আপনার সাথে গল্প করবো আংকেল। বলেই মায়া ছুটন্ত প্রজাপতির মতন কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

চঞ্চল মায়ার কথার নম্রতা ও মাধুর্যতায় বিমোহিত হয়ে গেলো কায়রুস। কিন্তু তার বিস্ময়ের রেশ বিলীন হলো না অস্তমিত সূর্যের ন্যায়। সে পরশকে জিজ্ঞেস করলো,

এ কোন মায়া পরশ? মায়া মহলে মায়া? কিন্তু কিভাবে?

পরশ চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে সহমত প্রকাশ করলো। এবং বলল,

মিয়াভাই একটু অপেক্ষা করুন। দুইদিন বাদে ওর মা পার্মানেন্ট থাকতে চইলে আসবে। তখন খোলাসা হইতে পারবো। সত্য জানা যাবে।

ওর মা আসবে? এক আশ্চর্য সুরে বলল কায়রুস।

হুম ওর মা। সহজ করে বলল পরশ।

ওর মা কেন আসবে ?

ছোটবাবু বলল চইলে আসতে। যেন মেয়ের সান্নিধ্যে থাকতে পারে তাই।

শুনে কায়রুস থম মেরে রইলো। বিষয়টা তারকাছে সুবিধাজনক ঠেকল না। ভীষণ ঘোলাটে লাগছে ভোরের কুয়াশার ন্যায়।

মায়া কলেজ থেকে এলো বিকেলে। সন্ধ্যার পর কুমকুমকে দিয়ে মায়াকে ডেকে পাঠালো কায়রুস। মায়া খুশী খুশী মনে কায়রুসের কক্ষে প্রবেশ করলো। কায়রুস একথা ওকথা বলে মায়ার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। এক পর্যায়ে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলো। মায়া আঞ্জুমান আরাকে বলা তার জীবনের গল্পটা হুবহু শুনালো কায়রুসকে। কায়রুস একটু স্বস্তিবোধ করলো কিছু একটা গভীরভাবে ভেবে।

জুবায়ের শাহেরকে ফোন দিলো। মায়ের প্রসঙ্গ টেনে পরপর চারজন ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে মায়ার আগমনের সাদৃশ্য থাকতে পারে বলে অভিহিত করলো।

জুবায়ের মোবাইল রাখার পর শাহের ভেবে দেখলো জুবায়েরের বলাটা অমূলক নয়। সত্যিইতো তাই। মায়াকে নিয়ে এমন বিরূপ ধারণা তার মাথায়ই আসেনি কখনো। উল্টো মায়ার প্রতি অসীম দূর্বলতা কাজ করেছে। একটা টান অনুভব করেছে সবসময়।

তার কিছুক্ষণ বাদে শাহের মায়াকে ফোন দিলো। মায়ার পড়াশোনা থেকে শুরু করে শারীরিক অবস্থারও খবর জানলো। এবং জিজ্ঞেস করলো,

তোমার কোনরকম প্রবলেম হচ্ছে চলাফেরায়?

নাতো ছোটবাবু। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। তবে…

তবে কি বল হেজিটেশন ফিল না করে?

তবে কিছুদিন আগে পরপর তিনটা চিরকুট পেয়েছি আমার বালিশের নিচে। কিন্তু এখন আর পাই না। আরেকটা বিষয় হলো আপনাদের বাড়িতে আমি আসার পর চারজন মানুষ মারা গেলো। তাই ভাবলেই কেমন যেন লাগে।

দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল মায়া।

নাকি তুমি এদের সবাইকে মেরে ফেলছ?

ফোনের অপরপ্রান্তে হোঃহোঃহোঃ করে হেসে বলল শাহের।

মায়া থতমত খেয়ে গেলো এমন অপ্রত্যাশিত বাক্য শ্রবণ হতেই।

শাহের ফের বলল,
কি তব্দা খেয়ে উঠলে মনে হয়?তোমার কথার রেশ ধরেই মুখ ফসকে একথা চলে এলো।

মায়া পট করেই বলে ফেলল,

তাহলে কি আপনিও আমাকে চিরকুট দিতেন? নয়তো আপনি ঢাকা চলে যাওয়ার পর হতেই আর চিরকুট পাইনা কেন?

ধরো আমিই দিতাম। তাহলে কি তুমিই মারলে তাদের? স্বীকার করো ফেলো। আমি গোপন রাখবো। তোমার সুরক্ষা দিব।

কি বলছেন এসব অবান্তর কথাবার্তা? আর তা হলেও স্বীকার করে কেউ?

তাও রাইট। আচ্ছা ফান করলাম। তো পেতে চাও অমন চিরকুট?

নাতো।

কেন চাও না ?

আজব তো ছোটবাবু। কি ভুলভাল বকছেন? রাখি। আল্লাহ হাফেজ।

ওকে। বাই।ভালোথেকো।

মায়া আশ্চর্য হয়ে গেলো তার প্রতি শাহেরের আবেগপ্রবণতা দেখে। যা সে এর আগে ক্ষুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। ভেবেছিলো আর বুঝেছিলো মানবিকতা ও ঔদার্যতার জায়গা থেকেই শাহের তারজন্য এসব করছে। এখন টের পেলো প্রেক্ষাপট ব্যতিক্রম। তবে শাহেরের এই ভুল অনুভব ও অনুভূতিকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দূরে দূরেই রবে সে৷ একান্ত আবশ্যক না হলে শাহেরের সাথে কথা বলবে না। বাড়ি আসলে সামনে যাবে না।

সময়টা শেষসন্ধ্যা। গ্রীষ্ম ঋতু। মাস চৈত্র। কাঠফাটা গরম পড়েছে প্রকৃতিজুড়ে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছে৷ জেনারেটর ও আসছে না। সবাই মহলের বাইরে চলে গিয়েছে হাওয়ায় গা জুড়াতে। আঞ্জুমান আরা মায়াকে ডেকে বলল,

জুবায়েরের রুমে লন্ঠন জ্বেলে দিয়ে আসো তো মায়া। দাসীরা সবাই বাইরে মনে হয়। কত যে ডাকলাম। তবুও শুনল না। তোমার মা কবে আসবে?

আচ্ছা আন্টি এখনি যাচ্ছি। আম্মা দুই তিনদিনের মাঝেই চলে আসবে। আমি বাসস্টপেজ থেকে গিয়ে নিয়ে আসব।

ওহ আচ্ছা ঠিকাছে।

মায়া জুবায়েরের রুমে প্রবেশ করলো আলো নিয়ে। জুবায়ের বিছানায় শোয়া ছিলো। মায়ার উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

থ্যাংক ইউ মায়া। বসো। একটু কথা আছে।

মায়া বসল। জুবায়ের দুপা এগিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

মায়া চোখ কপালে তুলে ফেলল। ঘাবড়ে গেলো। ভয়ার্ত চোখে প্রতিবাদের কন্ঠে বলল,

ভাইয়া দরজা বন্ধ করলেন কেন?

জুবায়ের মায়ার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো। একহাতকে তার মুঠোবন্ধী করে নিলো। এবং মায়ার নরম অধর যুগলের ভাঁজে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল,

তোমাকে ভালোলাগে মায়া। তুমি যেন গন্ধ ছড়ানো সুবাসিত বেলী।একটু ঘ্রাণ বিলাও আমার মাঝে। তোমার আমার এই গোপন অভিসার না কেউ জানবে। না কেউ শুনবে। এই চারদেয়াল ভেদ করে শব্দগুলোও বাইরে যাবে না।

মায়া চিৎকার দিতে গেলে যুবায়ের তাকে চিৎ করে বিছানার উপরে শুইয়ে দিলো। তার বলিষ্ঠ হাতের নিচে চাপায় পড়ে গেলো মায়ার কোমল মুখখানি। সে মায়ার শরীরে নিবিড় আলিঙ্গন দিতে গিয়েও কেন জানি পারছে না। বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ঝড়ের কবলে পড়া দিক হারানো নাবিকের ন্যায়।

মায়া জুবায়েরের হাতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো। পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

সেই রাতে জুবায়ের অসুস্থ হলো। ভোর না হতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। জ্বর, গা জ্বালাপোড়া, অসহ্য রকমের শরীর ব্যথা তিনদিন ধরে। কিছুতেই সারছে না। এভাবেই হাসপাতালের বিছানায় থেকে জুবায়ের মারা গেলো। তার আগে পরিবারের সবাইকে সে জানালো তার মৃত্যু হলে একমাত্র মায়াই দায়ী হবে। দ্বিতীয় কেউই নয়।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here