শাড়িটার রঙ এত সুন্দর, খুব মানিয়েছে প্রকৃতিকে। আয়নার সামনে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখল। আজ ওর মন আর মেজাজ দুটোই ভয়ানক খারাপ। যখন ওর মন খারাপ হয়, সে ঘরের দরজা বন্ধ করে শাড়ি পরে নিজেকে সাজায়। আস্তে আস্তে মন শান্ত হয়ে আসে৷ কিন্তু আজ কিছুতেই মনটা শান্ত হচ্ছে না৷ সে একদফা কান্নাকাটিও করেছে। তার অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
ছাদ ভর্তি ওর অসংখ্য গাছগাছড়া। সব সে হাতে ধরে ভীষণ যত্নে বড় করছে। এগুলো ওর এত প্রিয়। কিন্তু আজ সকালে ছাদে উঠে দেখে দুটো গাছ ভেঙে টব উল্টে পড়ে আছে। গতকাল রাতে ঝড়ো বৃষ্টি হয়েছে। পরম ভালোবাসার জিনিসের এমন ভঙ্গুর অবস্থা দেখলে কারই বা মন মেজাজ ঠিক থাকে! গাছগুলো ওর সন্তানের মতো, খুব প্রিয় বন্ধুর মতো। সেগুলোকে ছুঁয়ে সে কেঁদে ফেলল। সেগুলো আর ঠিক হবে কিনা জানে না, তারপরও পরম মমতায় আরেকবার লাগিয়ে এসেছে, শুশ্রূষা হিসেবে।
দরজায় কয়েকবার ধাক্কা পড়ল, মা ডাকছেন। মা’য়ের এই এক সমস্যা। ওর যখন একা থাকতে ইচ্ছে করে, তখনই তার যাবতীয় কথাবার্তা মনে পড়ে যায়। দরজা খুললে হয়তো শুনতে হবে,
“শুঁটকি ভর্তায় লবণ ঠিক আছে কিনা চেখে দেখ তো!”
কিংবা “সুঁইতে সুতো লাগিয়ে দে তো।”
প্রকৃতি আগে ধীরে সুস্থে শাড়ি বদলে নিল। এটা মায়ের প্রিয় শাড়ি। তাই আগে ভাঁজ করে জায়গা মতো রাখল। যদিও ভাঁজ ঠিকঠাক হলো না। তাই লুকিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল। পরে ঠিক করা যাবে। নইলে বাড়ি মাথায় উঠবে। ওদিকে মা ক্লান্তিহীন ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন৷
“কী রে দরজা খুলতে এত দেরি। এদিকে সব আমার ঘাড়ে। যত জ্বালা আমার।”
“কী হয়েছে মা?”
“আমাদের রুমের ফ্যানটা নষ্ট মাঝরাত থেকে। আজ মানুষটা ফিরবে। তুই একটু ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে নিয়ে আয় তো।”
“আমি যাব?”
“আর কে আছে বাসায়? আমাকে যেতে বলিস? আমার কত রান্নাবান্না বাকি, সব ফেলে আমি যাব? ময়নার মা-ও আজ আসেনি।”
“আচ্ছা, যেতে হবে না, আমার কাছে ফোন নম্বর আছে। আমি কল করে দেখছি।”
কল করা হলেও দেখা গেল নম্বর বন্ধ। কী এক যন্ত্রণা। সে ওড়না বদলে তৈরি হয়ে বেরুচ্ছিল৷ মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
“শোন, ফেরার সময় দোতলায় গিয়ে রুবিনা ভাবিকে বলবি, উনি যেন প্রিয়মকে নিয়ে দুপুরে চলে আসেন। কাল বলেছিলাম, আজ এখানে খেতে। তুই মনে করিয়ে দিয়ে আসবি।”
“আচ্ছা।”
রুবিনা চাচিকে প্রকৃতি ভীষণ পছন্দ করে। চমৎকার এক মহিলা। ভীষণ মজা করে কথা বলেন। উনি নিজে ওকে কিছু রেয়ার স্পেসিসের গাছ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। তবে সমস্যা তার নাক উঁচু ফটোগ্রাফার ছেলেটা, প্রিয়ম। এত ‘ভাবওয়ালা’ ছেলে সে জগতে দুইটা দেখেনি। কীসের এত ভাব কে জানে! যেন সে রাজা, নিজের রাজত্বে রাজপাট সাজিয়ে বসেছে, বাকিরা বানের জলে ভেসে তার আশেপাশে ভিড়েছে।
***
ফ্যান সারানোর লোক পাওয়া গেছে। তাকে পাঠিয়ে সে দোতলায় এসেছে।
কলিং বেল বাজানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুললেন রুবিনা৷ মিষ্টি হেসে বললেন,
“আরে প্রকৃতি কন্যা যে। কী খবর? আয়, আয়।”
হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। নিজেও পাশে বসলেন।
“শোনো, কাকি আজ দুপুরে তোমরা আমাদের বাসায় যাবে। মা পাঠালো।”
“সে তো যাব। আগে বল, আজ ইউনিভার্সিটিতে যাসনি?”
“নাহ্। মন খারাপ তাই যাইনি।”
“সে কী! মন খারাপ কেন? তোর বৃক্ষকূল কেমন আছে?”
এই কথায় প্রকৃতির আবার কষ্ট জেগে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ভালো নেই৷ দুটো গাছ ভেঙে গেছে।”
ওর বৃক্ষ প্রীতির কথা সম্পর্কে তিনি অবগত।
“মন খারাপ করিস না মা। দুটো ভেঙেছে, তুই চারটা লাগাবি আবারও।”
প্রকৃতির চোখ টপটপ করে পানি পড়ল। রুবিনা চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। তখনই প্রিয়ম এলো নিজের ঘর থেকে। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে।
“তুই কই যাচ্ছিস?”
“কাজে।”
“কী এমন কাজ তোর? সারাদিন ওই কটকটি সাথে নিয়ে ঘুরিস।”
“মা, আমার ক্যামেরাকে তুমি কটকটি বলছ কেন?”
“নেই কাজ তো খই ভাঁজ। ওটা খই ভাজার যন্ত্র ছাড়া আর কী!”
মায়ের এমন বাছবিচারহীন মন্তব্যে প্রিয়ম যারপরনাই বিস্মিত হলো।
প্রকৃতির চোখে এখনো জল। প্রিয়ম সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা কী।
“শোন প্রিয়ম৷ আজ এখন যাস না। দুপুরে ওদের বাসায় দাওয়াত। খেয়ে তারপর বেরুবি। যা এখন ঘরে যা।”
প্রিয়ম অপ্রসন্ন মনে ফিরছিল, শুনল মা বলছেন, “শোন মা, তুই কাঁদিস না৷ গাছ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, আমি এনে দেব। একবার হাস তো?”
প্রিয়ম আবারও বিস্মিত হয়ে অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল, “সামান্য গাছের জন্য কেউ এভাবে ফ্যাঁচফ্যাচ করে কাঁদে?”
প্রকৃতির কানে গেল কথাটা। ওর গাছের অপমান সে হজম করতে পারে না। যুদ্ধংদেহী গলায় বলল,
“সামান্য গাছ মানে? পড়াশোনা জানা গণ্ডমূর্খ নাকি আপনি? গাছের যে প্রাণ আছে সেটা জানেন না? একটা জীবন কী করে তুচ্ছ হয়? আপনি তো মানুষ খু ন করতে পারবেন!”
“গণ্ডমূর্খ কেন বলছ? এভাবে অভদ্রের মতো কে কথা বলে? গাছ আর মানুষ এক হলো?”
“আমি অভদ্র? আপনি অজ্ঞ। এই যে নাক টেনে অক্সিজেন নেন, সেটা কোত্থেকে আসে? আপনার কাঁধের ঝোলার মধ্যে থাকা ওই আর্টিফিশিয়াল জিনিস থেকে?”
“খবরদার, আমার ক্যামেরাকে অপমান করবে না। গাছ কেটে যে ঘরবাড়ি হচ্ছে, ফার্নিচার হচ্ছে, তাদেরকে কী বলবে? ক”সা”ই?”
“ও, আপনার জিনিসকে কিচ্ছু বললে খুব মানে লাগে, আর অন্য কারোরটা কিচ্ছু না? টিট ফর ট্যাট। কথাটা জানেন না? যুক্তিতে না পেরে কুযুক্তি খাড়া করানোই যায়।”
“তোমার মতো অতি ঝগড়াটে মেয়ের সাথে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।”
“নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন বলে ধন্যবাদ। এমন সুবুদ্ধি চুয়ে চুয়ে পড়ুক আরও।”
প্রিয়ম জানে এই চূড়ান্ত অভব্য মেয়ের সাথে কথা বলা বৃথা। কথায় কথা বাড়বে। সে তা এই মুহূর্তে চাইছে না৷ তাই চুপচাপ ভেতরে চলে গেল।
এই বাড়িতে ওরা বহুদিন ধরে একসাথে থাকে। প্রথমে ভাড়ায় ছিল। তখন প্রিয়মের তিন বছর বয়স, সদ্য প্রকৃতির জন্ম হয়েছে। বাড়িওয়ালা এই বাড়ি বিক্রি করবেন। তার আরও বাসা আছে। হঠাৎ টাকার দরকার হয়েছিল। তখন আনোয়ার আর রুবিনার স্বামী জোবায়ের সাহেব দুজন মিলে বাড়িটা কিনে নেন। এই দুই পরিবারের সম্পর্কও মজবুত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে।
***
প্রিয়ম ঘরে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল বলে নিজের তোলা ছবিগুলো দেখছিল। হঠাৎ পুরনো একটা স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। যেই স্মৃতি প্রায়ই ওকে জ্বালাতন করে।
তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করেছে। বাবা প্রমিস করেছিলেন ভালো রেজাল্ট হলে একটা ক্যামেরা কিনে দেবেন। প্রতিশ্রুতি মতো সে ক্যামেরা পেয়ে খুশি মনে সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াত।
একদিন হঠাৎ ওর দৃষ্টি আটকে গেল একটা মেয়েকে দেখে। বলা ভালো একজোড়া কাজল চোখ দেখে। কী যেন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল সেই চোখে।
মেয়েটার চেহারা ওর মনে নেই, তবে সেই সুগভীর চোখ দুটো সে আজও ভুলতে পারে না। কবি গুরুর কাছ থেকে ধার করে সেই চোখের নাম প্রিয়ম রেখেছে ‘কালো হরিণ চোখ’।
এই প্রজন্ম এটার নাম দিয়েছে ‘ক্রাশ’ বলে। কিন্তু প্রিয়ম জানে, এটা তেমন পলকা ব্যাপার নয়। কারণ সেই চোখে সে নিজের সর্বনাশ দেখেছিল।
আজও আনমনে অবচেতনে সে ওই দুই চোখের সন্ধানে ঘুরে। স্বপ্নেও এসে জ্বালাতন করে যায় কখনো সখনো। কিন্তু ভাগ্য এখন অব্দি সুপ্রসন্ন হয়নি। ওর প্রতীক্ষা শেষ হয়নি।
এক জোড়া কালো হরিণ চোখের প্রতীক্ষা, যে চোখে ডুবে যাওয়া যায় অনায়াসে।
…….
ক্রমশ
#কালো_হরিণ_চোখ (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা
নতুন বছরের স্বাগত উপহার আপনাদের জন্য। কেমন লাগল শুরুটা?