#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১১
জ্বরে গা পুঁড়ে যাচ্ছে মুনতাহার। চামড়ার পরতে পরতে আগুন লেগেছে যেনো। ভয়াবহ উত্তাপে ক্রমাগত ঝলসাচ্ছে তুলতুলে নরম শরীর। তড়িঘড়ি করে গাল- কপাল হাতরালো আরশাদ। ঠোঁট অবধি টানা কাঁথার ভিতরে হাত গলিয়ে গলায় ছোঁয়ালো। আল্লাহ! এমন জ্বর? এত জ্বর?
নাম ধরে ডাকলো। মুনতাহা? মুনতাহা? একবার নয়, বারবার, বেশ ক’বার। তবে সাড়া পাওয়া গেলো না। নাহ্, অচেতন নয় মেয়েটা। জ্ঞান আছে। উওর দিতে পারছেনা শুধু। চোখের পাতা কাঁপছে। তাকাতে চাইছে তো, পারছেনা শুধু। গায়ের কাঁথা সরিয়ে দিলো আরশাদ। দু’টো কাঁথা? এতক্ষণে খেয়াল হলো ঘরের ফ্যান চলছেনা। তারমানে জ্বরটা অনেকক্ষণ আগেই এসেছে। মেয়েটা জ্বর নিয়েই শুয়েছে। মাহতাব সাহেব ছুটে এলেন। মুনতাহা ঝাপসা ঝাপসা তাকালো। আরশাদের দিকে চেয়ে কি যেনো বিরবির করলো। আরশাদ ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। বোধগম্য হলোনা, খুব অষ্পষ্ট। মুনতাহা বিড়বিড় করেই চলেছে। আরশাদ কপালের উপর হাত রাখলো। মাহতাব সাহেবের দিকে চেয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,”ওর তো অনেক জ্বর আংকেল।
মাহতাব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। থমথমে হয়ে বললেন,”জ্বর? জ্বর মানে? দুপুরেই তো ভালো দেখে গেলাম। মুন?” বলতে বলতেই এগিয়ে গেলেন তিনি। মুনতাহা আবার চোখ বুজেছে ততক্ষণে। মাহতাব সাহেব মুখে হাত ছোঁয়াতেই আৎকে উঠলেন,”হায় আল্লাহ! আম্মা? এত জ্বর কখন উঠলো?”
বাবার আদুরে সংস্পর্শ পেতেই কুঁকড়ে গেলো মুনতাহা। কোনরকমে জড়িয়ে জড়িয়ে ডাকলো,”আ.. আব্বু..আব্বু তুমি..।”কথা সম্পূর্ণ হলোনা।
আরশাদ হাঁফ ছেড়ে বললো,”আংকেল, জ্বরটা মাপা দরকার।”
মাহতাব সাহেব মাথা নাড়ালেন। দ্রুত পাশের ড্রয়ার থেকে জিনিসপত্র এলোমেলো করে থার্মোমিটার বের করলেন।
জ্বর মাপলেন। মুনতাহা কেঁশে উঠলো হঠাৎই। থার্মোমিটারটা পড়ে গেলো জিহ্বার নিচ থেকে। মাহতাব সাহেব ধরে ফেললেন। মুনতাহা কাঁশতে কাশতেই শুধালো,”পা.. পানি খাবো আব্বু।”
আরশাদ একটু এগিয়ে গেলো। মাহতাব সাহেব নিজ থেকেই একটু সরে দাড়ালেন। মুনতাহার কাশি থামেনা। আরশাদ দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো,
—“দেখি, উঠতে হবে মুনতাহা।”
শরীরে বল নেই। আরশাদ তুলে বসালো। পিঠের পিছে বালিশ দিয়েও বাহু জড়িয়ে ধরে রাখলো। মাহতাব সাহেব পানি ঠেকিয়ে ধরলেন ঠোঁটের কাছে। মুনতাহা অল্পএকটু খেলো। ঠিকঠাক খেতেও পারলোনা। থুতনি বেয়েই গড়িয়ে গেলো অনেকটা। আরশাদ স্বযত্নে মুছে দিলো হাত দিয়ে। মুনতাহা বুকের পাশটায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। কি গরম কপালটা। মাহতাব সাহেব অবিলম্বে জলপট্টি নিয়ে আসলেন। আরশাদ তখনো ধরে রেখেছে তাকে। মুনতাহা নিষ্প্রভ, নিশ্চল, গুঁটিয়ে আছে। মাহতাব সাহেব কিছু বললেন না। আরশাদ উঠতে চাইলো। মাহতাব সাহেব থামিয়ে বললেন,” থাক, ধরে রাখো। একা বসতে পারবে না। পড়ে যাবে।”
আরশাদ দিরুক্তি করলোনা। মাহতাব সাহেব রুমাল ভিজিয়ে কপালে দিলেন। পানি গড়িয়ে গড়িয়ে বুকের শার্ট ভিজলো।
ফোন বের করলো আরশাদ। মাকে জানানো দরকার।
–
ঘন্টা পেরোলো। মুনতাহার জ্বর কমেনা। উল্টো বাড়ছে। বাটির পানি পর্যন্ত গরম হয়ে যাচ্ছে বারবার। কপাল থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়ার একটুপরই যেই না সেই। মাহতাব সাহেব ভেবে পেলেননা এত জ্বর উঠলো কি করে? দুপুরেই তো ভালো রেখে গেলেন।
এখনো আরশাদের বুকের পাশেই লেপ্টে আছে মুনতাহা। আনতারা পাতলা সুতির ওড়না ভিজিয়ে ঘাড়ে দিয়ে রেখেছে। যদি জ্বর কমে। আরশাদের শার্ট ভিজে একাকার।
বাটির পানি আবার গরম হয়ে গেছে। মাহতাব সাহেব বদলে আনতে গেলেন।
মুনতাহা মুখ উঁচিয়ে আরশাদকে বললো,”কাজি আসবে না? মেহমানরা চলে এসেছে?”আরশাদ তাকালো। ধীরগলায় বললো,”রাখেন আপনার বিয়ে। এত জ্বর, একটাবার ফোন করতে পারলেন না?”
মুনতাহা চোখ নামিয়ে নিলো,
—“ফোন তো নিতে পারিনি। ওইযে ফোন। উঠতেই পারলামনা। এত জ্বর এসে গেলো হঠাৎ করে। আমি ভেবেছি কমে যাবে।”
আরশাদ দেখলো ফোনটা টেবিলের উপর রাখা। বিছানা থেকে দুরত্ব অনেকটা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কপালের কাপড়টা উল্টে দিয়ে বললো,”থাক, উঠেছে উঠেছে। আপনি এখন চুপ করে চোখটা বন্ধ করে রাখেন। একটু পর কমে যাবে।”
মাহতাব সাহেব পানির বাটি নিয়ে এলেন। কপালের কাপড় পাল্টে দিলেন। আরশাদ ঘড়ি দেখলো। সাতটা দশ। সাড়ে সাতটার দিকে কাজি চলে আসবে। হাঁফ ছেড়ে পরিষ্কার গলায় বললো,”সবাইকে মানা করে দিন আংকেল। কাজিকে আসতে মানা করুন। ও সুস্থ হোক। পরে ওসব হবে।”
মুনতাহা বাঁধা দিলো,”নাহ, আমি পারবো।”
আরশাদ মৃদু স্বরে ধমকে উঠলো,
—“কি পারবেন? বসতে পারছেন না ঠিকমতো। আবার বলছেন পারবেন। আংকেল, আপনি মানা করে দিনতো।”
মুনতাহা হাঁসফাঁস করে বললো,
—“আব্বু না, শুধু শুধু খারাপ ভাববে সবাই। আমি ঠিক আছি। তুমি কাউকে মানা করবেনা।”
আরশাদ ধমকালো আবার। মুনতাহা নিভলোনা। গোঙাতে গোঙাতে অসহায় কন্ঠে বললো,”আপনি-ই না বললেন সেদিন, আমি শুধু কবুল বললেই হবে। আমি কবুল বলতে পারবোতো।”
আরশাদ জবাব দিতে গেলো। মাহতাব সাহেব থামিয়ে দিলেন,
—“আরশাদ থাক, ও কথা শুনবেনা। জেদ করবে। বিয়েটা হোক শুধু। কবুল বললেই তো হলো।”
আধঘন্টার মধ্য কাজি এলো। মুনতাহার জ্বর তখন তুঙ্গে। তবু দমেনা সে। বাবার অসম্মান হোক কোনোক্রমেই চায়না। আজ বিয়ে না হলে মানুষ উল্টোপাল্টা বলবেই সে জানে।
মাথায় পানি ঢালা হয়েছে একটু আগে। চুল ভেজা। মাথার পিছে আরশাদের বুক। মুনতাহা কাঁপতে কাঁপতেই ‘কবুল’ বললো। আরশাদ হাত ধরে ধরে সাইন করালো। নিজেও করলো। মেয়েটার এতো জেদ। বিয়েটা হয়ে গেলো।
কাজি সাহেব বেরিয়ে যেতেই ডুঁকরে উঠলো মুনতাহা। কেমন যেনো করলো। এতক্ষনের জোর করে চেপে রাখা যন্ত্রনাটা যেনো বেরিয়ে এলো হঠাৎই। আরশাদ অস্থির কন্ঠে বললো,”কি হয়েছে?”
মুনতাহা কেঁদে ফেললো। করুণ অনুনয়ের বললো,
—“আমাকে একটু শক্ত করে ধরবেন? খুব খারাপ লাগছে।”
–
ভোরের প্রথম আলো ঘরে আসলে, তবেই চোখের পাতা এক করলো মুনতাহা। সারাটারাত জ্বরের ঘোরে গোঙাতে থাকা কন্ঠটা একটুখানি আরাম কুঁড়োলো। আনতারা ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায় হেলান দিয়ে। মুনতাহা আরশাদের বুকে। আরশাদ সজাগ নাকি না বোঝা গেলো না তবে চোখ বন্ধ। দু’হাত ব্যস্ত মুনতাহাকে ধরে রাখতে। আগলে রাখতে। মাহতাব সাহেব নম্র চোখে তাকালেন। তার অনুপস্থিতিতেও মেয়ে অযত্নে থাকবে না। এবার নিশ্চিন্ত। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন তিনি। একবার কপালে হাত রেখে জ্বর মাপলেন। একটু কম। ঘরের পর্দা টেনে নিলেন। বাতি নিভিয়ে দিলেন। চোখে আলো পড়লে মুনতাহা ঘুমোতে পারে না। সেই ছোটবেলার অভ্যাস।
ঘরের বাতি নিভে যেতেই চোখ মেললো আরশাদ। মাহতাব সাহেবকে দরজা আটকে বেরিয়ে যেতে দেখলো খুব নিশব্দে। ভোরের আবছা নীল আলো পাতলা পর্দা ফুড়ে ঘরভর্তি করছে। মুনতাহা তার বাহুডোরে। আরশাদ অন্ধকারেই গালে হাত রাখলো। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,”সুস্থ হন চাঁদ, আমার যে এখনো জ্যোৎস্না দেখা বাকি।”
~চলবে~
[রিচেক হয়নি। বানান ভুল থাকতে পারে।]