অমানিশা,পর্ব:১২

0
330

#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১২

সেদিনের পর মাস পেরিয়েছে। জৈষ্ঠ্যর দাপট তখনো লুটপাট চালিয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে শহরজুড়ে। এই তপতপে গ্রীষ্ম বড্ড একরোখা। এত সহসা বিদায় নেবার স্বভাব নেই। বছর ধরে জমানো উত্তাপের ঘটা উপুর করে ঢেলে দিয়ে তবে-ই প্রস্হান করবে সে। তার আগে নয়!
বাড়ি ফিরে মুনতাহাকে ঘরেই পেলো আরশাদ। অন্ধকার ঘরের আবছায়া মায়াকিরণে একটা মেয়েলি গড়নের দেহ এঁকেবেকে লুটিয়ে পড়েছে নরম বিছানার বা’পাশজুড়ে। কোমড়ের নারীসুলভ বাঁকে যেনো উপচে পড়ছে আবেদন। আঁধার ঢাকা ঘরটাও তখন জোছনাভর্তি ঠেকলো আরশাদের।
পিঠ ঝলসানো রোদে গা পুঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়েছিলো সেই সকালবেলা। ভ্যাপসা গরমে কাজ সেড়ে ঘর ফেরা ভেজা দেহ, ক্লান্তিতে থিঁতিয়ে ওঠা লম্বা লম্বা শ্বাস। এই মেয়েলি জোছনা যেনো চোখের পলকে সব গ্রাস করে নিলো। দেহের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা রুগ্নতা, অলসতায় আদর মাখিয়ে দিলো জোরজবরদস্তি। মলিন হাসলো আরশাদ। তবে, ঘর্মাক্ত মুখের দূর্বল মলিনতা ছাঁপিয়ে চোখের অবোধ মুগ্ধতা টাই স্পষ্ট হলো অধিক। এ দৃশ্য যে খুব দূর্লভ তা নয়, তবু আকাঙ্ক্ষিত নারীকে চোখভরে দেখতে কোন পুরুষ পি’ছপা হয়?
আরশাদও হলোনা। নিশব্দে দরজা আটকে দেয়ালের সুইচ চেপে নীল রঙা ঘুমবাতি জ্বালিয়ে দিলো। শান্তমেজাজে গায়ের নেতিয়ে যাওয়া শার্ট ছাড়িয়ে বিছানায় বসলো। মুনতাহার পায়ের পাশে। মাথার উপর ফ্যান, ভেজা দগদগে পিঠে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যেতেই যেনো শান্তি মিললো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মুনতাহা পায়ের সাথে পা ঘঁষছে। উষখুষ করছে। মশা কামড়াচ্ছে। আরশাদের হাতের সাথে একবার পা ছুঁয়ে যেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে সে। আরশাদ হাত সরিয়ে নেয় দ্রুত। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় ঘুমন্ত মুখের দিকে। আধঘুম আধ জাগরণের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় হয় দুজনের। ঘরের অদৃশ্য প্রণয়পূর্ণিমা যেনো স্বসম্মানে নিজ পূর্ণতা স্বীকার করে নেয় সেই ঐশ্বরিক চোখাচোখিতে।
সেই অন্য চাহনীতে খুব ঘাবড়ে গেলো কি জানি। মুনতাহা চোখ নামালো। পা দু’টো ভাঁজ করে গুটিয়ে নিলো অতি সন্তর্পণে। আরশাদ চোখ ফেরাচ্ছে না। মুনতাহা দু’একবার চাইলো। শেষমেষ টিকতে না পেরে উঠে বসতে চাইলো। চোখভর্তি করা ঘুম তখন তল্পিতল্পা নিয়ে পলাতক।
কোলের কাছের কোলবালিশটা সরাতে নিতেই চোখ ফেরালো আরশাদ। থামিয়ে দিয়ে বললো,

—“ওঠা লাগবেনা, ঘুমান। আমি গোসল করে আসি।”

মুনতাহা আধওঠানো মাথাটা আবারো পেতে দেয় বালিশে। হাতের পিঠ দিয়ে কিন্চিৎ বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখজুড়ে ছেঁয়ে থাকা কপালের গোছা চুল সরায়।
আরশাদ উঠে দাড়ায়। বিছানার একপাশে গুছিয়ে বের করে রাখা কাপড় হাতে তুলে নেয়। মুনতাহা চোখ বুজেনি। কোলবালিশে নাক- ঠোঁট গুঁজে চাদরের দিকে চেয়ে আছে অবিচ্ছিন্ন দৃষ্টিতে। যেনো চোখ তুললেই বিনা নোটিশে রাঙা ছাঁপ ফুঁটবে তুলতুলে গালভরে।
আরশাদ হাসে। নীল ঘুমবাতি নিভিয়ে দেয়। মেয়েটা আলো থাকলে ঘুমোতেই চায় না। আলো নিভে যেতেই সহজ হয় মুনতাহা। গুটিয়ে রাখা পা’টা সোজা করে। দু’হাত দু’পাশে মেলে আড়মোড়া ভাঙে। ঘুরে ডানপাশে কাত হয়ে শোয়।
কাপড়গুলো কাঁধে ঝুলিয়ে হাতের ঘড়ি খুলে নেয় আরশাদ। দু’কদম হেঁটে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়েরে ঢুকিয়ে রাখে। পাশ থেকে মুনতাহা যে গালের নিচে হাত দিয়ে গোল গোল করে তাকেই দেখে যাচ্ছে বুঝতে অসুবিধা হয়না। আচ্ছা? ল্যাম্পশেডটা জ্বেলে দিলে কেমন হয়? হলদাভ আলোয় লাজুক চাঁদের সাধু সেজে থাকার বাহাদুরি খতম হোক! মাথায় চিন্তা আসলেও আলো জ্বালায়না আরশাদ। বাঁকা শরীর সোজা করে দাড়ায়। কিছুক্ষণ সেভাবেই, অত:পর আচমকাই ঝুঁকে মুনতাহার কানের কাছে হাত ঠেস দেয় সে। বলে,

—“চাঁদের নিজস্ব আলো থাকেনা। এজন্য-ই বুঝি আপনার অন্ধকার এতো প্রিয়?”

মুনতাহা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলোনা তার আগেই আরো একটু ঝুঁকলো দুষ্টু পুরুষ। চোখ রাঙিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বলল, “এত অন্ধকারে থাকতে নেই মুনতাহা। ঘুটঘুটে আঁধারে কখনো কখনো অঘটনও ঘটে কিন্তু…”
মুনতাহা ভড়কে যায় সেই ঠোঁটকাটা কন্ঠে, বাসনা উপচানো চোখে। ভয় লেগে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে শিরশির করে। বুক হাপরের মতো উঠানামা করে।
চোখ অন্যদিকে ফিরায় মুনতাহা। ঘনঘন শ্বাসকার্যে কাটানোর চেষ্টা করে সেই ধার চাহনীর অর্থ।
আরশাদ তার নিশ্বাস টা আটকে দিতেই যেনো ফিসফিসালো আবার,

—“এভাবে শ্বাস ফেলতে নেই মুনতাহা। আমি মহাপুরুষ নই।”

মুনতাহা জমে যায়। বাক্যের তপ্ততায় শীতল শিহরণ যেনো গলে গলে পড়ে গা বেয়ে।

গোসল থেকে বেরিয়ে ঘর খালি পেলো আরশাদ। পর্দা সরানো। লাইট জ্বেলে দেয়া। মুনতাহা নেই। বিছানার কুঁচকানো চাদর টানটান করে ঝাড়া। আরশাদ ঘাটলোনা। ঘড়ি দেখলো একবার। মেয়েটা হয় চলে গিয়েছে নতুবা আম্মার কাছে আছে। ভার্সিটি না থাকলে বা না গেলে একা বাসায়ই থাকতে হয় ওকে। একা একা কি করবে ভেবে আম্মা এখানে নিয়ে আসে। আম্মার সাথেই থাকে। ঘুম পেলে তার ঘরে শোয়। নয়তো বারান্দায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করে। বাবা এসে পড়লে আবার চলে যায়। আরশাদ থাকার জন্য জোর করেনা কখনো। আবার মানাও করেনা। মুনতাহা ঘুমিয়ে থাকলে সে পাশে বসে চুপচাপ নিজের কাজ করে। হোক তা ল্যাপটপের স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকা আর হোক তা একাধারে সেই ঘুমন্ত মুখে চেয়ে থাকা।
আলমারি থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে যাচ্ছিলো তার আগেই দরজা খোলার শব্দের সাথে ছোট্ট একটা ডাক ভেসে এলো,”খেতে আসেন, মা ডাকছে।”

সিগারেটের প্যাকেটটা মুঠোয় তুলেও পুনরায় জায়গা মতো রেখে দিলো আরশাদ। মেয়েটা যায়নি তারমানে। আলমারির পাল্লা আটকে দিয়ে ভরাট শান্ত গলায় বলল,
—“আপনি এদিক আসেন।”

মুনতাহা আসলোনা। বরং পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,”কেনো?”

—“আমি ডাকছি তাই।” আরশাদের ভারিক্কি গোছের কাটকাট উওর।

মুনতাহা আমতা আমতা করলো। শেষমেষ উপায়ন্তর না পেয়ে ছোট্ট পদচারণে ঢুকলো ভেতরে।
সাবিনা বেগম খাবার টেবিলে বসে আছেন। আরশাদ গাঢ় চোখে একবার দাদির দিকে তাকালো। তার সন্দেহেভরা আড়চাহনী দেখে দু’কদম এগিয়ে তুলনামূলক নিচু স্বরে বলল,”দরজা আটকান।”

ছিটকিনি তুলে দেয়ার খুটখুট শব্দ কানে আসতেই স্বত্বিদায়ক শ্বাস ছাড়লো সাবিনা বেগম। মুখে ফুঁটলো অতিপ্রসন্ন সুন্দরতম হাসি। আনতারা নির্বিকার। প্লেট সাজাচ্ছেন। সাবিনা বেগম হাসি হাসি মুখ নিয়ে ছেলের বউয়ের দিকে চাইলেন। আনতারা দেখলো, পরমূহুর্তেই না দেখার ভান করে পুনরায় মনোযোগ দিলো ভাত বাড়তে। তার এড়িয়ে যাওয়াটায়-ই যেনো দ্বিগুন উৎসাহিত হলেন সাবিনা বেগম। গমগম করে বললেন,
—“হায় আল্লাহ! এত্তদিন বাদে এদের একটু একলা হইতে দেখলাম।”

আনতারা খেঁকিয়ে উঠলেন,”আহ! আম্মা আস্তে।”

—“আরে চুপ থাক তুই। এত্তবড় শাশুড়ি হয়েও বৌ’টাকে কিছু শিখাইতে পারস না। আর..”

আনতারা বিশ্রিভাবে চোখমুখ কুঁচকালেন,”আমি কি শিখাবো আম্মা? আপনি একটু চুপ করেন তো।”

সাবিনা বেগম চুপ করলেন না। বরং শাঁসিয়ে উঠলেন,”আর তোর ছেলে? তোর ছেলেও জানি কেমন। মাইয়াটা পাশে শুইয়া থাকে। ঘুমায় থাকে। তোর ছেলে তো একবার ফিরাও চায় না। গেটটা হা কইরা খোলা রাইখা কোলের উপর ওই এক পোকাবাক্সে মুখ ডুবায় রাখে। আরে মাইয়াটা ছোট মানুষ। আব্বারে ছাড়া থাকতে পারেনা। ঠিকাছে। তোর কাছেওতো আসে। ওর আব্বাতো আসে সেই দশটার পর। ততক্ষণ তো তোর ছেলের কাছেই থাকে। তাইনা?”

আনতারা চুপ করে রইলেন। একটা অনুভূতিশূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের কাজে মন বসালেন। কিন্তু পারলেন না, সাবিনা বেগম কথা চালিয়ে গেলেন। শেষমেষ রেগেমেগে বললেন,
—“এমন করলে তোর আর দাদি হওয়া লাগবো না।”

—“হায় আল্লাহ, আম্মা! আপনি দাদি হয়েছেন না? এবার শান্তি করেন। আমার পিছে পড়েছেন কেনো?”

মাহতাব সাহেব কাগজপত্র ঘাটছিলেন। ড্রইংরুমের বড় কাঁচের টেবিলের উপর ছড়ানো ছিঁটানো রং বেরঙে ফাইলের স্তর। ঘরে জ্বলছে হাই ওয়াটের সাদা আলো। জ্বলজ্বল করছে গ্লাসের স্হির পানি পর্যন্ত।
ঘড়িতে রাত এগারোটা চল্লিশ। মুনতাহা ঘুমাতে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘরের দরজা খোলা, তিনি দেখতে পাচ্ছেন কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়েছে মেয়ে। মাহতাব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরণের মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে গেন্জির কোণা দিয়ে মুছে আবার পড়লেন। কাগজে মন দিলেন। খানিকবাদেই একটা লম্বাটে ছাঁয়ায় মনোযোগ বিগড়ে গেলো তার। মুনতাহা এসে দাড়িয়েছে। দু’পাশে লম্বা দুই বেণি। চোখে ঘুমের ছিঁটেফোটা নেই। সে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলোনা?
মাহতাব সাহেব ঘাড় বাঁকিয়ে কি যেনো দেখলেন। একটা আলোক রশ্নি তেরছাভাবে পড়ছে বিছানার উপর। নম্র কন্ঠে বললেন,

—“ঘুমাসনি আম্মা? আলোতে সমস্যা হচ্ছে? এইটা নিভিয়ে ওই হলুদ লাইটটা জ্বালিয়ে দে। নয়তো দরজাটা একটু ভিড়িয়ে ঘুমা। আমি তো আছি এখানেই।”

মুনতাহা ধীরগতিতে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো। চেহারায় মলিনতা, নির্জীবতা। চুপটি করে বাবার পাশে এসে বসলো সে। বাহুর নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে মাথা রাখলো বুকের মাঝখানটায়। মাহতাব সাহেব ভ্রুকুটি করলেন। হাতের কলমটা নামিয়ে রাখলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,”কি হয়েছে মা? ঘুম আসছেনা? মন খারাপ?”

—“ঘুম আসছেনা আব্বু।”

—“কেনো?”

—“জানিনা।”

–ওখানে কিছু হয়েছে?”

—“না তো।”

মাহতাব সাহেব দিরুক্তি করলেন না। মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
সিদ্রা যখন আটমাসের গর্ভবতী তখন প্রায় প্রায়ই রাতে ঘুমাতে পারতোনা। মুনতাহা সময় অসময়ে পেটে লাথি লাগাতো। পেট ব্যাথায় ঘুমই আসতোনা সিদ্রার। সেসময় তিনি একহাতে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতেন আর আরেকহাতে পেটে হাত বুলাতেন। সিদ্রা বিস্ময় নিয়ে বলতো,”তুমি পেটে হাত বুলাচ্ছো কেনো?”
তিনি সহজসরল উওর দিতেন,”ওকে ঘুম পাড়াচ্ছি সিদ্রা, ও শান্ত হলেই তো তুমি ঘুমাতে পারবে।”
আশ্চর্যজনক হলেও ব্যাথা একটু পড়েই কমে যেতো।

মুনতাহা ঘুমিয়ে গেছে। মাহতাব সাহেব হাসলেন। মেয়ের এই বাবার হাত বুলানোয় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস বোধহয় তখন থেকেই হয়েছে।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here