#রং_তুলির_ক্যানভাস
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_৮ [অন্তিম পাতা]
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“আমি যাদের আগলে রাখতে চাই তারা কেন এভাবে আমার থেকে দূরে সরে যায়? তবে কি আমি মানুষ ধরে রাখতে জানি না? নাকি মানুষগুলোই আমার হয়ে থাকতে চায় না?”
আকাশ পানে তাকিয়ে এমন অহরহ কথা ভেবে চলেছে রাফান। আজ তার নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষ চিনতে না পারার রাগ!
আচ্ছা কেউ কি এতটা বোকা হয়? সামনে ভালোবাসার মানুষ থাকতেও কেন সে চিনতে পারল না তাকে? একজন নয়, দুইজন নারী তাকে মন থেকে ভালোবেসেছিল। অথচ আজ তাদের দু’জনের চোখেই সে অপরাধী। হয়তো ঘৃণার পাত্র!
“দিন শেষে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমি তোমাকেই ভালোবাসি জোহা। হয়তো আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না। নতুন জীবনে তুমি সুখেই আছ। ভালো থেকো তুমি। আমি নাহয় নিজেকে গুছিয়ে নেব নিজের মতো করে। আর কখনো তোমাকে চাইব না। আমার জন্য নিষিদ্ধ হওয়া তোমার দিকে ফিরেও তাকাব না আর।”
দীর্ঘশ্বাস, নিকোটিনের ধোঁয়া, চোখের কোণে অশ্রুকণা আর পুরোনো কিছু স্মৃতি নিয়ে ছাদের এক কোণে বসে পড়ে রাফান। জোহার সাথে কথা না হওয়ার প্রায় চারটা মাস পেরিয়ে গেল। সে ভেবেছিল, জোহাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু সে আজও দিব্যি বেঁচে আছে। কেউ কাউকে না পেলে বাঁচবে না এটা পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বাজে রকমের একটা মিথ্যা কথা। আসলে আমরা যখন কারোর সাথে কথা বলি তখন তার মায়ায় জড়িয়ে যাই। সময়ের সাথে সাথে তার সাথে কথা বলাটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আবার কথা না বলতে বলতে সেটাও অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। জীবন তো এমনই। এভাবেই কত-শত মানুষ বেঁচে থাকে এই ধরণীর বুকে।
জানালার ফাঁক গলে আসা সকালের কড়া রোদ জোহার চোখেমুখে পড়ায় সে বিরক্ত হয়ে আরো নিবিড়ভাবে মিশে যায় আফসানের বুকের মাঝে। তার এমন কান্ড দেখে মুচকি হাসে আফসান।
“কি ম্যাডাম, উঠতে হবে না?”
“কয়টা বাজে?”
“আটটা বাজতে চলল।”
“আজ তো ছুটির দিন। এত তাড়াতাড়ি উঠতে হবে না।”
“তুমি কি ভুলে গেলে আজ আমাদের বের হওয়ার কথা?”
“না, ভুলিনি তো। নয়টার দিকে উঠলেই হবে।”
আর কিছু বলে না আফসান। জোহাকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় পুনরায়। ছয় মাস হতে চলল তাদের বিয়ের। বেশ সুখেই আছে তারা।
দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে আফসান বলে ওঠে,
“কেউ এসেছে। এখন তো উঠে পড়।”
“তুমি যাও গিয়ে দরজা খুলে দাও। আমার ঘুম এখনো কাটেনি।”
“কি ঘুম কাতুরে মেয়েরে বাবাহ!”
কথাটা বলে জোহার দিকে একবার তাকিয়ে দরজা খুলে দেয় আফসান। নিধি ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করে,
“তোরা বের হবি না আজ? এই মেয়ে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে কেন?”
“তার নাকি নয়টার দিকে উঠলেই হবে।”
“এই মেয়ের তৈরি হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। আবার বলে নয়টায় উঠলেই হবে। এই জোহা তাড়াতাড়ি ওঠ বলছি।”
ননদিনীর টানাটানিতে উঠে বসে জোহা। ঘুম ঘুম চোখে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“প্রতিদিন এমন করিস তুই আর তোর ভাই। আমার মামনি আর বাবা ভালো। তোরা পঁচা।”
“আব্বু আম্মু তোমাকে আদর দিয়ে দিয়ে অলস বানাচ্ছে বুঝলে?”
“তো? তোমার কী কষ্ট হয় নাকি? তোমার আদরগুলো এখন সব আমি পাই। তাই কষ্ট হয়?”
“না গো বউ, তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।”
“এই তোদের আদুরে কথাবার্তা বন্ধ কর। ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। আর শোন, আম্মু অনেকগুলো খাবার রেখেছে তোদের জন্য। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবি।”
“এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল?”
“কষ্ট কীসের? আমার ছেলে আর ছেলের বউ ঘুরতে যাবে। তার জন্য এটুকু করব না?”
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে জোহা হেসে এগিয়ে যায় তার দিকে।
“তোমাদের ছেড়ে একা একা বান্দরবান যেতেই ইচ্ছা করছে না আমার।”
“মধুচন্দ্রিমায় কি মানুষ শশুর, শাশুড়ি, ননদকে নিয়ে যায়? এমন কথা আগে কখনো শুনিনি তো!”
নিধির কথায় জোহা হতাশ কণ্ঠে জবাব দেয়,
“বিয়ের ছয় মাস পর মধুচন্দ্রিমায় কজনই বা যায় বল?”
“এমন আনরোমান্টিক বউ হলে তো ছয় মাস সময় লাগবেই স্বাভাবিক।”
“মায়ের সামনে কী বলতে হয় সেটাও জানো না তুমি? মুখে লাগাম দাও।”
ছেলেমেয়েদের এমন কান্ড দেখে মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জোহার শাশুড়ি মা। নিধিও বের হয়ে গেলে আফসান পেছন থেকে জোহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমাকে বুঝতে আমার বউটার ছয় মাস সময় লেগে গেল?”
“নতুন করে সব ভাবা যে আমার জন্য সহজ ছিল না সেটা তোমার অজানা নয় আফসান।”
“সব জানি বলেই সময় দিয়েছি তোমাকে। তারপর বলো আমাদের বাড়িতে নতুন সদস্য আসবে কবে?”
“নতুন সদস্যের জন্য এত তাড়া?”
“আমার বুঝি বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছা করে না?”
“উপরওয়ালা চাইলে তোমার এই ইচ্ছা শীঘ্রই পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ।”
“তাই যেন হয়। এখন চলো ফ্রেশ হয়ে আসি। দশটার মধ্যে বের হতে হবে আমাদের।”
সকালে সবাই মিলে একসাথে খাওয়াদাওয়া করে দু’জন তৈরি হয়ে নেয়। এরমাঝে বাবার বাড়িতে কল দিয়ে সবার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলে নেয় জোহা। অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বান্দরবান যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে জোহা আফসানের কাঁধে মা থা রেখে নিশ্চিন্তমনে দিবানিদ্রায় যায়। আফসান পরম যত্নে আগলে নেয় তাকে।
ভালো সময়গুলো যেন তাড়াতাড়ি কেটে যায়। বান্দরবানে আসার দুই দিন পেরিয়ে গিয়েছে। দু’জন ঘুরাঘুরি করতে ব্যস্ত। একটা নৌকায় চড়ে জোহা আফসানকে বলে,
“আমাদের জীবনের ভালো সময়গুলো এত দ্রুত কেন চলে যায় বলো তো?”
“সময় নিজ গতিতে চলে। আমরা যখন কষ্টে থাকি তখন মনে হয় সময় যেতেই চায় না। আর যখন আনন্দে থাকি তখন মনে হয় সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এই সবকিছু আমাদের মনের উপর নির্ভর করে।”
“আমরা যেন সব সময় এমনভাবে একসাথে থাকতে পারি। তোমার মতো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি কখনো এত সুখে থাকব সেটা ভাবিইনি। ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য।”
“আরে পাগলি মেয়ে, আপন মানুষকে কেউ ধন্যবাদ দেয় না বুঝলে? আর কী বলো তো? সান আর মুন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারে না। সূর্য আর চাঁদ একে-অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি সূর্য হলে তুমি চাঁদ। তাই আমাদের এক তো হতেই হতো।”
“সব সময় আমার হয়ে থেকো তুমি। আমি কখনো তোমাকে হারাতে চাই না আফসান। ভালোবাসি যে!”
“আমিও আমার চাঁদকে অনেক ভালোবাসি। হয়তো নিজের থেকেও বেশি!”
জোহা আর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ আফসানের পাশে বসে প্রকৃতির দিকে তাকায়। আফসান নিজের হাতের মুঠোয় জোহার হাত নিয়ে বলে,
“রং তুলির ক্যানভাসে আমাদের জীবনের গল্প পালটেছে বহুবার। শেষমেশ আমি পেয়েছি আমার ভালোবাসাকে। পেয়েছি আমার চাঁদকে। চাঁদ, আমার চাঁদ!”
জোহা মুগ্ধ চোখে তাকায় তার পাশে থাকা মানুষটার দিকে। এই মুগ্ধতা যেন কখনো শেষ হওয়ার নয়। রং তুলির ক্যানভাসে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে এভাবেই ভালো থাকুক চাঁদ তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে।
★সমাপ্ত★
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। #রং_তুলির_ক্যানভাস গল্পের প্রথম খন্ড যতটা সুন্দরভাবে লিখেছি দ্বিতীয় খন্ড ততটা সুন্দরভাবে লিখতে পারিনি। তবুও চেষ্টা করেছি সুন্দরভাবে শেষ করার। সমাপ্তি পর্ব আপনাদের ভালো না লাগলে তার জন্য আমি দুঃখিত।