হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ পর্ব ঃ- ০১

0
963

ইরা,

সেদিন যদি সুজয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে না আসতাম তাহলে হয়তো আজকের দিনটা দেখতে হতো না। জীবনে ভালবাসাটাই কী সব? নাকি প্রয়োজন নামেরও কোনো কিছু আছে? আমার ঘরে ভালবাসার অভাব নেই কিন্তু সুখ, তা কী আছে! কতোদিন আয়নায় নিজেকে সুখী দেখি না, মনে তৃপ্তি অনুভব করি না!

সুজয়,

লকডাউনের জন্য অফিস বন্ধ। প্রথম প্রথম অর্ধেক মাইনে দিলেও কিছুদিন হলো তাও বন্ধ। যা মাইনে পেতাম তাতেই সংসার চালানো কষ্ট হতে যেত। এখনতো না খেয়ে থাকতে হবে যা অবস্থা। ইরার সাধ-আহ্লাদ পুরণের শক্তি কোনোদিনই আমার ছিল না। কিন্তু এখন কী করবো? ইরা না হয় সব বুঝে চুপ করে থাকে কিন্তু আমার ২ বছরের বাচ্চা ইতু, ও তো ক্ষিদে পেলে কান্না করে, সবকিছু খেতেও চায় না। অনেক বড় ঘরের মেয়ে ছিল ইরা। জীবনে অভাব কী জিনিস কোনোদিন বুঝে নি। কিন্তু আমি ওকে অভাববোধ ছাড়া কিছুই দিতে পারি নি। আজকালতো মন মেজাজও ভালো থাকে না ঘরে থাকতে থাকতে। অকারণেই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করি। জানিনা সামনের দিনগুলি কেমন হতে চলেছে।

তিয়া,

সেদিন যদি পরিবারের চাপে নেহালকে বিয়ে না করে রক্তিমের সাথে পালিয়ে যেতাম তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো। কোনো কিছুর অভাব নেই আমার ঘরে শুধু ভালবাসা ছাড়া। মাসের শেষে নেহাল আমার হাতে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বলে “এই নাও তোমার হাত-খরচ “। এই টাকা দিয়ে যদি ওর সময় কেনা যেত তাহলে হয়তো টাকাটা আমার প্রয়োজনে আসতো। আমার ৪ বছরের ছেলে তুর্য সারাক্ষণ বাবা বাবা করে কিন্তু বাবার আর সময় কই ছেলেকে নিয়ে একটু খেলা করার। দামী দামী খেলনা কী বাবার অভাব পূরণ করতে পারে! রক্তিমের এতো টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু ওর কাছে ভালবাসার কোনো অভাব হতো না আমার।

নেহাল,

লকডাউনের জন্য অনেক টাকার লোকসান হয়ে যাচ্ছে। জীবনে টাকাটাই সব। টাকা দিয়ে সবকিছু কিনা যায়, ভালো থাকা যায়। কিন্তু তিয়া! ওই বোকা মেয়েটাকে কে বুঝাবে? সারাক্ষণ শুরু সময় দাও না, সময় দাও না বলে ঘেনঘেন করে৷ আমার প্রতিটি মিনিটের মূল্য যে হাজার টাকার সমান সে জ্ঞান ওর নেই। এতো কিছু দিয়েও মেয়েটাকে যেন সুখী করতে পারছি না! আমার ছেলে নাকি আমাকে মিস করে, আরে ওর আগামীর জন্যইতো আমার এতোকিছু করা।

ইরা,

আজ একমাস হলো মেয়েকে মাছ-ভাত খাওয়াতে পারি না। জন্মের পর কতো ভালো দেখতে ছিল মেয়েটা। যেন আকাশের পরি নেমে এসেছে আমার কোলে।কিন্তু এখন ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না, শুকিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে ওর। মা ফোনে বহুবার বলেছে ” চলে আয় ওখান থেকে যা হওয়ার হয়েছে তোকে সামনে দেখলে তোর বাবা আর রাগ করে থাকতে পারবেন না।” কিন্তু আমি জানি বাবা খুব কঠিন মানুষ। আর একবার যে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছি সেখানে আবার ভিক্ষারীর মতো থাকতে যাব কোন মুখে এর চেয়ে এখানেই মরে যাওয়া ভালো। সুজয় খুব চিন্তা করছে সংসার নিয়ে। আগে কতো স্বপ্ন দেখাতো আমায়, খুব ভালো চাকরি করবে, আমায় খুব সুখে রাখবে।কিন্তু বিয়ের পর চাকরির জন্য তেমন কোনো চেষ্টা করতেই দেখলাম না। উপরন্তু আমার কাছে মিথ্যা কথা বলতো। মাইনে পেত ১০ হাজার বলতো ১৫ হাজার। সবকিছু জানার পর ওর প্রতি আস্তে আস্তে ভালবাসাটা কেমন উঠে গেছে। এখন যা আছে তা মনে হয় শুধুই দায়িত্ববোধ। আজকাল আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেও শুরু করেছে। সামনে যে আরো কতো কী দেখতে হবে কে জানে!

সুজয়,

লকডাউনে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ব্যাংকে কিছু টাকা জমানো ছিল। ওগুলোই এখন শেষ সম্বল। অনেকদিন ঘরে মাছ নিয়ে যাই না। মাংসের স্বাদতো ভুলেই গেছি বোধহয়। বাজারে দাম জিজ্ঞেস করতেও ভয় হয়। নিজের ভুলের জন্যই আজ এ অবস্থা আমার। কলেজের ভালো ছাত্র ছিলাম। শেষ সময়ে লেখাপড়ার প্রতি কেমন অহিনা চলে আসে নয়তো আজ একটা ভালো সরকারি চাকরি থাকতো। আজকাল রাতে ভালো ঘুম হয় না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আয়নার সামনে যেতেও ভয় হয়। নিজের প্রতিচ্ছবিও যেন নিজেরই উপহাস করে। রাতের খাবারের জন্য ইরা ডাকছে। যাই দেখি আজ কী রান্না করলো।

তিয়া,

সবকিছু সাজিয়ে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছি নেহালের এখনো আসার খবর নেই। মাছ, মাংস, সবজি মিলিয়ে প্রতিদিন ৪/৫ পদ রান্না করি। তারপর মৌসুমি ফল, ডেসার্ট এগুলো ও থাকে। ছেলেটা তবুও ভালো করে খেতে চায় না। নেহালতো খুব অল্প খায়। আমিই দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছি। নেহাল বলছে আমায় একটা ব্যায়াম মেশিন কিনে দিবে। আমার ওসব ভালো লাগে না। রাত ১২ টা বাজে কী এতো কাজ ওর! সারাক্ষণ বাসায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে নয়তো বাইরে চলে যায়। আজ বললো কার সাথে খুব জরুরি দরকার, দেখা করতে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল এখনো ফিরছে না। আমার ঘুম পাচ্ছে। টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলাম।

হঠাৎ দরজার শব্দ শুনে তন্দ্রা ভেঙে গেল। দেখি নেহাল মদ খেয়ে ফিরেছে। ঢ্লতে ঢলতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

“তুমি এখনো ঘুমাও নি?”- নেহাল।

” না, তোমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছি।”

“কতোদিন বলেছি আমার দেরি হলে খেয়ে ঘুমিয়ে যেও।”

“ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।”

“আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।”- বলে নেহাল চলে গেল। আমি বসে রইলাম খাবার সাজানো টেবিলের এক প্রান্তে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। ভালবাসা কী জিনিস তা কী নেহাল কোনদিনও বুঝবে না! আজ আর খাওয়া হবে না। কাজের মেয়েকে সবকিছু রেখে দিতে বলে উঠে এলাম আমি।

নেহাল,

তিয়ার ন্যাকামি দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। কতোবার বললাম লাইফে প্রেক্টিক্যাল হতে শিখো কিন্তু না ও ওর ওইসব আগেকার যুগের ন্যাকামি নিয়ে বসে আছে। ওর জন্য ছেলেটাও ন্যাকামি শিখে যাচ্ছে। না এমন ভাবে চলতে দিলে হবে না। কিছু একটা করতে হবে আমাকে।(চলবে),,,,,,

#হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ
পর্ব ঃ- ০১
~আঁখি দেব তৃপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here