‘
#কান্নাভেজা_রাত
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
মেহেরুন বললো,’ আমি ততোটুকুই বলতে পারবো যতোটুকু বলার সাহস আমার আছে। কিন্তু তুমি এইটুকু জেনে রাখো যে, আমি এখানে একটা দাসীর চেয়েও খা*রাপ অবস্থায় আছি। তাছাড়া কোন একটা কারণে আমি নিজ থেকেই চুপ থাকবো। তুমি কিংবা অন্য কেউ কোনদিন আমার গোপন কথাগুলো জানতে পারবে না। কোনদিন না।’
এই যে কথাগুলো বললো মেহেরুন, বলতে গিয়ে তার নাকের পাটা কাঁপলো।চোখের পাতা তিরতির করে উঠলো।আমি তো জানি, সে সব কিছুই আমায় বলতে চাইছে কিন্তু কোন এক কারণে বলতে পারছে না। এই যে বলতে পারছে না এই জন্য ওর এরকম কষ্ট হচ্ছে।
উপরের কথাগুলো বলে সে তার পিঠ দেখালো। শাড়ি সরিয়ে তলপেট দেখালো। বুকের উপরিভাগ যতোটুকু সম্ভব দেখালো।
ওর শরীরের এই অংশ গুলো দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েকে কি করে এরকম করে ক্ষত -বিক্ষত করে মানুষ? ইশ্!
ওর বুকের উপরটা পোড়ানো। ছোট ছোট ক্ষত।কালচে হয়ে আছে।পেটেও ওরকম।পিঠেও।
অসংখ্য দাগ।গোল গোল দাগ।
আমি ওর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম,’ এসব কি করে হলো মেহু?’
সে কিছু বলতে যাবে এরিমধ্যে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,’ তুমি এখান থেকে চলে যাও। এক্ষুনি যাও বলছি।’
আমি বললাম,’ কেন? কি সমস্যা?’
মেহু আমার পা ধরে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ যাও না প্লিজ! দোহাই লাগে!’
রাগে আমার শরীর কাঁপছে।কার প্রতি এই রাগ? কেন এই রাগ? মেহেরুনের কষ্ট দেখে? ওর কষ্ট দেখে আমার এরকম হবে কেন? ও তো আমার বোন না।রক্তের কেউ না। তবুও ওর এসব দেখে আমার ভেতর জ্বলবে কেন?
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলাম আমি।
আমি বেরিয়ে আসার খানিক পরেই টের পাই মেহেরুন কেন আমায় বের হয়ে আসতে বললো এভাবে! রাতুলের মা এসে গেছে। আমি টের না পেলেও সে টের পেয়েছে আগে ভাগেই। কতোটুকু ভয় ভেতরে থাকলে মানুষ এভাবে কান পেতে রাখে।চোখ খুলে রাখে সব সময়।
কিচেনে এসে দেখি ভাতের অবস্থা খারাপ। দীর্ঘ সময় ধরে চুলোর উপর থাকায় জল শুকিয়ে হাঁড়ির তলানির কিছু ভাত পোড়েও গেছে।পোড়া গন্ধ বেরিয়েছে।
‘
আমার শাশুড়ি কিচেনে এলেন গন্ধ শুঁকে শুঁকে। এসে বললেন,’ জেসি, ভাত পোড়ে গেছে নাকি?’
আমি আস্তে করে বললাম,’ জ্বি।’
কিছুটা ভয় আমার কাজ করছে।এ বাড়িতে নতুন আমি। এখানে আমার আপন কেউ নেই। ইচ্ছে করলেই তো এখন আমি গলা বড় করতে পারবো না। তাছাড়া ভাত যে পোড়েছে তাও আমার দোষেই।খেয়াল রাখিনি ভাত বসিয়ে।
আমি ভাবলাম, শাশুড়ি খুব বকাঝকা করবে।কথা শোনাবে।
কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে তিনি কিচ্ছু বললেন না। শুধু এটুকুই বললেন,’ ডেকচির ভালো ভাত গুলো অন্য একটা ডেকচিতে তুলে রাখো।আর বাকিগুলোতে পানি দিয়ে রেখে দেও।নরম হলে আমি ঘষেমেজে ধুয়ে নিবো।’
আমি বললাম,’ ঠিক আছে মা।’
রাতুলের মা এবার বললেন,’ তোমাকে একটা ভালো উপদেশ দেই মা? আমি তো তোমার মায়ের মতোই।মা ছেড়ে এখানে এসেছো যখন।সারা জীবন তো এখানেই তো থাকবে। এখন তোমার ভালো মন্দ তো আমিই দেখবো তাই না! ‘
আমি ভালো থাকা ভাত গুলো অন্য ডেকচিতে রাখতে রাখতে বললাম,’ জ্বি মা। এখন আপনিই তো আমার মা।মা তো মেয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উপদেশ দেয় না।নিজ থেকেই দেয়।’
আমার শাশুড়ি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ তুমি এই বাড়ির বউ তাই না মা?’
আমি বললাম,’ জ্বি মা।’
তিনি মৃদু হাসলেন। হেসে বললেন,’ তোমার কাজ নিজের সংসার ঠিক ভাবে করা। স্বামীর সেবা করা। সন্তানের দেখভাল করা ,শাশুড়ির উপদেশ মানা ।বুঝছো?’
আমি বললাম,’ জ্বি মা।’
তিনি চকির উপর বসতে বসতে আবার বললেন,’ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দাও তো মা। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে!’
আমি তাড়াহুড়ো করে গ্লাস ধুয়ে ঠান্ডা পানি এনে দিলাম। তিনি ঢকঢক করে পানি গিলছেন। এই সময় তার দিকে লক্ষ্য করলাম। দেখলাম, তার কপাল ঘামছে।কেউ যদি কখনো দুশ্চিন্তা করে তখন এরকম হয়। এবং এরচেয়ে বড় কথা, তিনি যখন আমার সঙ্গে এই কথাগুলো বলছিলেন তখন তার শ্বাস প্রশ্বাস খুব দ্রুতগামী হয়ে উঠছিলো ।
পানি খেয়ে শেষ করে গ্লাসটা আমার হাতে দিলেন তিনি। তারপর ঠোঁটে লেগে থাকা পানি হাতের পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে আমায় বললেন,’ একটা কাজ ভুলেও করবা না মা। কখনোই না।’
কথাটায় কিছুটা ধার ছিল।
আমি বললাম,’ কি মা।’
তিনি বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,’ সবকিছু জানার চেষ্টা করবা না। অতি কৌতুহল দেখাইবা না । সাংবাদিকগিরি বিপদ ডেকে আনে।ঘরের বউদের কাজ সাংবাদিকগিরি করা না। সংসার করা।বুঝলা?’
আমি কোন কথা বললাম না।চুপ হয়ে রইলাম।
তিনি এখান থেকে চলে গেলেন।চলে যাবার পর আমি বুঝতে পারলাম, তিনি সব বুঝে ফেলেছেন। অর্থাৎ আমি যে মেহেরুনের ঘরে গিয়েছিলাম তা তিনি বুঝেছেন।ভুলটা আমারই।ওর ঘরে যখন গেলাম তখন বাইরে থেকে ওর ঘরের দরজার শেকল আটকানো ছিল।আমি তা খুলে ঢুকেছিলাম। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসার সময় দরজা ভেজিয়ে আসলেও শেকল আটকাবার কথা মনে ছিল না!
আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।এ কোন বাড়িতে এসে পড়লাম আমি? এ কেমন ভাগ্য আমার?
‘
রাতুল ফিরলো মাঝ দুপুরে। তার মুখ হাসি হাসি। মিষ্টি লাগছে দেখতে।কি কোমল চেহারা তার।যে একবার দেখবে আপ্লুত হবে। ভাববে দেবদূত।সাক্ষাত ফেরেশতাহ। আসলেই কি সে ফেরেশতা? নাকি মুখোশের আড়ালে আজাজিল শয়তান? কে জানে!
রাতুলের একটা হাত পেছনে ছিল। আমার কাছ অব্দি একটা হাত পেছনে রেখেই এসেছে। তারপর কাছে এসে পেছনের হাতটা সামনে এনে মিষ্টি মিষ্টি হাসির রেণু ছড়িয়ে দিয়ে বললো,’ আই লাভ ইউ জেসি।’
আমার দিকে তার বাড়ানো ডান হাতটায় লাল টকটকে একটা গোলাপ।আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।রাতে আমার সঙ্গে ভীষণ বাজে ব্যবহার করেছে সে। এখন এসে বলছে ‘আই লাভ ইউ’। ভালোবাসার প্রতীক গোলাপও উপহার দিচ্ছে।আমি কি তা নিবো? নেয়া উচিৎ আমার?
যা হবার পরে হবে। অনেক কিছুই দেখার বা করার বাকি এখনও। আমি অতোটা নরম মেয়ে না যে সে আমায় কাঁদামাটি করে তার যখন যা ইচ্ছে করে সেভাবে আমায় গড়বে। অসম্ভব।আমি আমার মতোই।সব ঝড় সামলে নিবো। তারপর নতুন শক্তি হয়ে আঁচড়ে পড়বো তার উপর। তাদের উপর।যদি ভুল হয় ওরা, তবেই কেবল।
আমি হাত বাড়িয়ে গোলাপ গ্রহণ করলাম। মিষ্টি করে হাসলাম।ওর বাহু আঁকড়ে ধরে বললাম,’ কোথায় চলে গিয়েছিলে? আমার খুব ভয় করছিলো!’
রাতুল আমায় জাপটে ধরলো।আদর করে চু*মু খেয়ে বললো,’ আর যাবো না। হঠাৎ রাগ পেয়েছিলো খুব। তুমি রাতে অমন করেছিলে কেন? ছুঁতেই দাওনি।বউয়েরা তাদের বরদের সঙ্গে এরকম করে কখনো? আমার সহ্য হয়নি। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।মন খারাপও হয়েছিল।তাই চলে গিয়েছিলাম।’
রাতুল আমায় শক্ত করে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ধরলো।ওর এই আদর, চু*মু, ছোঁয়া, বুকের উত্তাপ এসবের কোনো কিছুই আমি ভালো ভাবে নিচ্ছি না। খারাপ ভাবেও নিচ্ছি না।আমি শুধু দেখতে চাই।যা আমার মনের ভেতর বাজছে।যা আমার সন্দেহ হচ্ছে।
রাতুলকেও আমি আঁকড়ে ধরলাম। রাতুল আমায় জাপটে ধরে দরজার উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভেতরের দেয়ালের দিকে ওর মুখ।আর আমি দরজার সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। তখনই আমার নজরে এলো দৃশ্যটা। মেহেরুন তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আঁচল চেপে ধরা। সে কাঁদছে। কাঁপছে থরথর করে। কিন্তু তার এই কান্নার কোন আওয়াজ হচ্ছে না। আচ্ছা সে কি দেখতে পেয়েছে রাতুল যে আমায় গোলাপ দিয়েছে? ভালোবাসি বলেছে? এই যে আদর করছে, এসব কিছু?
যদি দেখতে পায় তবে তার দুঃখ পাওয়ার কি আছে এতে? সে না রাতুলের বোন? ওর সমস্যা কি তাহলে? হঠাৎই আমার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিলো। আচ্ছা, এরকম কি হতে পারে যে, রাতুল কোন কারণে মেহেরুনের স্বামীকে মে*রে ফেলেছে? মা*রার কারণও তো থাকতে পারে।
এরকম একটা ঘটনা আমাদের এলাকায় ঘটেছিল।মেয়েটি অন্য ধর্মের একটি ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। দীর্ঘদিন ওরা লুকিয়ে ছিল। তারপর কিভাবে কিভাবে যেন এদের খোঁজ মিলে।মেয়ের বাবা ততোদিনে মারা গিয়েছে।ভাইয়েরা বোনকে মৃত্যুর সংবাদ দিলো।বললো, স্বামী নিয়ে এসে বাবাকে শেষ দেখা দেখে যেতে। জীবিত থাকতে তো পারেনি। এবার এসে বাবার লাশের পা ধরে হলেও যেন ক্ষমা নিয়ে যায়। বাবা মরেছে বলে কথা। নিজের জন্মদাতা পিতা।যে আদর করে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতো। মেলায় নিয়ে ঘুরতো। সুন্দর জামা জুতো কিনে দিতো।নিজে ভালো না খেয়ে তাকে খাওয়াতো। সেই বাবার মৃত্যুতে কি সে না এসে পারে? সে পাগল হয়ে গেল বাবাকে শেষ দেখা দেখে যেতে এসে। তার অন্য ধর্মের স্বামী বুঝালো তাকে।বললো, ওরা প্রতিশোধ নিতে পারে। মেয়ে শুনলো না।বললো, তুমি না গেলেও আমি যাবো। ছেলে নিরূপায়। মেয়েকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।শেষে, সেও সঙ্গে গেল। কিন্তু কপালে তার মৃত্যু লিখা ছিল। মেয়ের ভাইয়েরা বাবার লাশ দাফনের আগে আরেকটা লা*শ ফে*লে দিলো।খু*ন করলো মেয়েটির অন্য ধর্মের স্বামীকে।
আচ্ছা এরকম কিছুও তো হতে পারে মেহেরুনের সাথে? হতে পারে না?
নাকি আমি যা ভাবছি বিষয়টি ঠিক এর বিপরীত? হতে পারে না এরকম যে, মেহেরুন আসলে রাতুলের বোনই না?
‘
#চলবে