কান্নাভেজা রাত পর্ব ১

0
860

বিয়ের পাঁচদিন পর বিকেল বেলা আমি আমার শাশুড়ির সঙ্গে কিচেনে বসে তরকারি কোটছি।তার সঙ্গে এখনও অতোটা সম্পর্ক হয়ে উঠেনি।একটু আধটু কথা হয়।এটা ওটা জিজ্ঞেস করেন তিনি,আমি নরম গলায় উত্তর দেই। এইটুকুই।আজ হঠাৎ করেই তিনি আমায় বললেন,’ জেসি, তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিবা।এই বছরের ভেতরেই। আজকালকার মেয়েরা বাচ্চা কাচ্চা নিতে চায় না তাড়াতাড়ি। তুমি এই রকম করবা না।মনে থাকবে কথাটা?’
কি লজ্জার কথা! এরকম কথার কি উত্তর দিবো আমি? উত্তর দিলাম না।আমি চুপ করে রইলাম। তরকারি কোটছি তাই করতে লাগলাম আপন মনে। এই কথার উত্তর দেয়ার মতো অতোটা সম্পর্ক তো তার সঙ্গে এখনও আমার হয়ে উঠেনি। তাছাড়া ইনি এরকম কেন? এরকম উদ্ভট কথা হুট করে বলবেন কেন আমায়? বিয়ের সপ্তাহও তো হয়নি এখনও। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন আমায় বাচ্চা জন্ম দিতেই তার ছেলের জন্য বিয়ে করিয়েছে!
তরকারি কোটা শেষ হলে আমার শাশুড়ি বললেন পেঁয়াজ কুচি করতে। তিনি তখন চকির উপর বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছেন।তখন হঠাৎ করেই একটা মোটা মতো মেয়ে এসে উপস্থিত হলো এখানে ‌। তার গায়ে বাহারি সাজ।গলায় সোনার চেইন ঝিকমিক করছে।হাতে কাঁচের আধ ডজন করে রঙিন চুড়ি। কি মিষ্টি চেহারা! মোটা মেয়েরাও যে অসম্ভব রকমের রূপবতী হতে পারে একে দেখে প্রথমবার বুঝলাম। কিন্তু ওর মুখটা খুব মলিন। চোখের নিচে কালি জমে আছে।
এসে মায়ের পায়ে কদমবুসি করলো সে।মা তখন আমায় বললেন,’ তোমার ননদ।ওর নাম মেহেরুন। বিয়ের সময় এখানে থাকতে পারেনি। তার শ্বশুরের বেশি অসুখ ছিল। মৃত্যুশয্যায় ছিল শশুর। কিন্তু কি ভাগ্য দেখো, তোমাদের বিয়ে শেষ, তার শশুর দিব্যি সুস্থ এখন। আমার মেয়ের ভাগ্যই খারাপ। নিজের ভাইয়ের বিয়েটা খেতে পারলো না!’
আমি একবার মেহেরুনের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে চমকে উঠলাম। তার নাকের ডগা লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। চোখের পাপড়ি কাঁপছে তিরতির করে যেভাবে বাতাসে শিরিষ গাছের পাতা কাঁপে।টপ টপ করে পাপড়ি ভিজে চোখ থেকে ফোটা ফোটা জল গালে গড়াচ্ছে। চিকচিক করছে ফর্সা গালের উপর সেই জল।
আমি তাকে কিভাবে সান্তনা দিবো কিংবা কিছু বলবো কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বলার আগেই দেখলাম নাকে মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ও কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল।আমি শাশুড়িকে ভয়ে কিংবা কি এক সংকোচে জিজ্ঞেস করতে পারিনি যে, মেহেরুন এভাবে কাঁদছে কেন?

রাতে আমরা সবাই খেতে বসলেও মেহেরুনকে দেখা গেল না টেবিলে।আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,ও কোথায়? ও খাবে না মা?
আমার শাশুড়ি বললেন,’ কার কথা বলছো তুমি?’
আমি বললাম,’ মেহেরুন। আমার ননদ মেহেরুনের কথা।’
তিনি বললেন, ‘ এখন খাবে না।পরে খাবে।’
এরপর সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,’ মা,ওর হাসব্যান্ড আসেনি ওর সঙ্গে?’
আমার শাশুড়ি থমথমে মুখে বললেন,’ ওর স্বামী প্রবাসে থাকে। সিঙ্গাপুরে। আসবে কি করে? আর তাড়াতাড়ি খাও তো। খাবার সময়ে কথা বলা ঠিক না। গোনাহ হয়।’
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। শাশুড়ি এমনিতেই মুখ ভার করে রেখেছে। শুধু হাসলাম মনে মনে। ভাবলাম, মানুষ এরকমই। নিজের মতামতকে জাহির করার জন্য হলেও তা ধর্মের বাণী বলে চালিয়ে দেয়।
খাবার পর্ব শেষ করে যখন শুতে যাবো তখন আমার স্বামী রাতুলকে বললাম, ‘রাতুল, মেহেরুনের কি হয়েছে বলো তো? মা যখন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওকে, তখন তার চোখে জল দেখলাম। মুখে আঁচল চেপে সে ওখান থেকে চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। এরপর আর আমার সামনে আসেনি। কেন? কোন সমস্যা?’
রাতুল অনেক্ষণ ধরে চুপ করে রইলো। তারপর ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’ ওর বিষয়ে তুমি কখনোই মাথা ঘামাবা না। অতো আগ্রহ ভালো না।বুঝেছো?’
আমি অবাক হলাম। রাতুল মেহেরুনের নাম শুনে এরকম ক্ষীপ্ত হলো কেন? ওর বোনের সঙ্গে কি ওর সম্পর্ক ভালো না নাকি?
সাত পাঁচ না ভেবেই আমি আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম,’ তোমার বোনের কথাই তো জিজ্ঞেস করেছি এতে অতো রাগার কি আছে ?’
রাতুল কথা বললো না। সে বরং আমায় কাছে টেনে আদর করতে চায়লো।
আমার এসব ভালো লাগছে না। বললাম, ‘আমার মন ভালো নেই।’
রাতুল কথা শুনলো না।
আমাদের দেশের পুরুষ গুলো এরকমই। পুরুষতন্ত্র তো। তাদের ইচ্ছের দাস হতে হয় ঘরের নারীদের । তাদের কথাই শেষ কথা। এরপর কোন কথায় কাজ হবে না।ওরা যা চায়বে ঠিক তাই হবে।তাই করতে হবে নারীদের। না করলে শক্তি খাটিয়ে হলেও আদায় করে নিবে।

রাতুলকে সরাতে চেষ্টা করেও সরানো গেলো না।ও তার বাসনা পূর্ণ করছে।আমি নিজেকে হঠাৎ জড় ভাবলাম। শুধু টের পেলাম চোখের কোল বেয়ে নালার মতো জল নামছে। এরিমধ্যে আমার কানে একটা রিনরিনে কান্নার গলা ভেসে এলো।এই গলাটা আর করোর না। মেহেরুনের। মেহেরুন এই এতো রাতে কাঁদছে কেন? ওর কি এমন দুঃখ যে ও কাঁদছে?
আমার ভালো লাগছে না কিছুই। খুব মন খারাপ লাগছে। নিজেকে হঠাৎ অপয়া মনে হচ্ছে।আমি রাতুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।
রাতুল রেগেমেগে আগুন হয়ে গেলো। গলায় তেজ নিয়ে বললো,’ তোমার সমস্যা কি? ‘
আমি বললাম,’ কিসের সমস্যা? কোন সমস্যা নাই।’
সে রাগে কাঁপতে থাকা গলায় বললো,’ তাহলে এরকম করছো কেন? ‘
আমি বসে যাওয়া গলায় বললাম,’ আমার ভালো লাগছে না তাই! তুমি জোর করছো কেন? তোমার কি সমস্যা?’
আমি ভাবলাম রাতুল আমার প্রতিবাদী গলায় চুপসে যাবে। কিন্তু সে চুপসে না গিয়ে রাগে কিড়মিড় করতে করতে আমার গলায় শক্ত করে চেপে ধরে বললো,’ তোমার নাগর আছে তাই না? প্রেম ছিল? মা বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছে? এই জন্য এইরকম করতেছো?নাগররে ছাড়া আর কারোর টাচ্ সহ্য হয় না? সত্যটা বলো।’
আমার এতো রাগ পেলো! আমি ওর দু হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে অনেকটা ধমকের গলায় বললাম,’ তুমি এরকম মা*স্তানি দেখাচ্ছো কেন? আর এসব কি বলছো ? মুখে যা আসে তাই বলবা আর আমি সহ্য করবো? আমি তোমার কেনা পুতুল‌ নাকি যে তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে, আমার ভালো লাগা খারাপ লাগা না জেনেই যা ইচ্ছে তাই করতে চাইবে আমার সঙ্গে?’
মেজাজ ভীষণ খারাপ হলো আমার। আস্তে করে আবার বললাম,’ অবলা পেয়েছে।হুহ্।’
রাতুল বিছানা থেকে নেমে গেলো প্রচন্ড রাগ নিয়ে। অদ্ভুত বিষয় হলো সে এই ঘর থেকে গিয়ে ও ঘরে মেহেরুনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলো।মেরেছেও হয়তো। মেহেরুন এখন শব্দ করে কাঁদছে। অনেক বেশিই কাঁদছে।
ও ঘর থেকে রাতুলের মায়ের গলা শোনা গেল। তার মা বলছে,’ কি করতাছস হা*রামজাদা, মাইয়াটারে মা*ইরা ফেলতেছস! ম*রলে তখন বুঝবি!’
রাতুল মাকে এভাবে জবাব দিলো।বললো,’ এরে না মা*রলে আমার শান্তি নাই।তার শরীর জ্বলতেছে।কান্দে।গলা ছাইড়া কান্দে।এরে আমি এখন জনমের কান্দন কান্দাইবো! জ্বালা যন্ত্রণা দূর করবো!’
রাতুলের মা ছি ছি করে বললো,’ এইখান থাইকা বের হয়ে যা বলতেছি। নয়তো থা*প্পর দিয়ে সব গুলো দাঁত ফেলাই দিবো তোর।’
রাতুল মার শাসন মানলো না। সে পাল্টা ধমক দিয়ে বললো,’ তুমি তোমার ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমাও গিয়ে। এখানে এসে তোমার নাক গলাতে হবে না।যাও বলছি!’
রাতুল তার মায়ের সঙ্গে এরকম নোংরা ব্যবহার করছে? ও এরকম দুশ্চরিত্রের লোক? তাছাড়া বোনটিকে এভাবে অকত্য ভাষায় গালাগাল করছে। ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে উঠলো।আর তখনই নিজের ভাগ্যকে আমি অভিশাপ দিলাম।আর বুঝতে পারলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে!

সে রাতে ঘরে এসে আলনা থেকে শার্ট নামিয়ে কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছিল রাতুল।আমি পেছন থেকে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’ কোথায় যাচ্ছেন অতো রাতে?’
রাতুল বললো,’ আরেকটা বিয়ে করতে যাই। তোমার ধারে কাছেও তো ঘেঁষা যায় না। এরকম বউ দিয়ে আমি কি করবো? ঘরে সাজাই রাখবো নাকি? যার ধারে কাছে ঘেঁষা যাইবো ওরকম একটা মেয়ে বিয়ে করে আনবো গিয়ে।তারে এনে তোমার সামনে —–‘
অশ্রাব্য কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সারা রাত আমার ঘুম হলো না। কেঁদে কেঁদেই কাটলো রাতটা। পরদিন সকাল বেলায়ও রাতুল ফিরেনি। আমার শাশুড়ি আমায় রান্নাবান্না কি করতে হবে বুঝিয়ে বলে প্রতিবেশীর বাড়িতে গেলেন আড্ডা দিতে। এই সুযোগে আমি রান্না চড়িয়ে মেহেরুনের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি সে চুপচাপ খাটের উপর পা গুটিয়ে বসে আছে। তার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। নাকমুখ ফুলা ফুলা।সারা রাত কেঁদেছে হয়তো।
আমাকে দেখে ও কিছু বললো না। আগে যেমন বসে ছিল এখনও ঠিক ওরকম ভাবেই বসে আছে।
আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। তারপর বললাম,’ মেহেরুন, তোমার সঙ্গে রাতুলের আসলে কি ধরনের সমস্যা বল তো? ও তোমাকে রাতে এভাবে অকত্য ভাষায় গালাগাল করলো কেন? তোমার গায়ে হাত তুললো কেন? ‘
মেহেরুন প্রথমে কিছুই বলতে চায়লো না। সে ভয়ে আড়ষ্ট হওয়া গলায় বললো,’ আমি কিছু বলতে পারবো না বোন। আমাকে দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবে না তুমি।আল্লার দোহাই লাগে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমায় গলা টি*পে মে*রে ফেলো তুমি বরং। তবুও কিছু বলতে বলো না। ‘
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা।যে করেই হোক এর রহস্য আমাকে জানতেই হবে। অনেক চেষ্টা ফিকির করে, ওকে অভয় দিলে তখন সে যা যা বললো তা শুনে আমার গা শিউরে উঠলো।চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। তখন শুধু মনে হলো, মানুষ এরকম নিকৃষ্টও কি হয় কখনো?

মেহেরুন বললো,’ —-

#চলবে

#কান্নাভেজা_রাত
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here