রাতে ঘুমের ঘোরে মনে হল কেউ জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুটঘুটে একটা ছায়া নড়চড় করছে। রুমটা ভীষণ অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ঘুম ঘুম চোখের কল্পনা ভেবে অগ্রাহ্য করল ফিহা। রাত তখন তিনটা বাজে। এমন সময় কি যেন ভেবে আবারও জানালার পানে চাইল। এবার যা দেখতে পেল তাতে চক্ষু ছানাবড়া! থাই গ্লাসের উপর সত্যি-সত্যিই দুটো হাত রাখা, জানালার বাইরে সত্যিই একটা কালো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তন্দ্রার ঘোর কাটতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো! ওটা কী? ওটা কী দাঁড়িয়ে আছে? বিস্ফোরিত নেত্রে ফিহা শোয়া থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। মূহুর্ত্তের ভেতর সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভয়ের চোটে পশমস্তর কাটা দিয়ে উঠেছে। শিরায়-উপশিরায় দ্রুত রক্তস্রোত বাড়তেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। গলা দিয়ে কোনো প্রকার আওয়াজ বের হচ্ছে না। একী! গলাটা এমনভাবে শুকিয়ে গেছে কেন? সামান্য ঢোকটা পযর্ন্ত গেলা যাচ্ছে না এখন! যদি চিৎকার দিতেই বীভৎস কিছুর দেখা মিলে? যদি ভয়াবহ কিছু ওর উপর হামলা করে? তখন কি করবে ও? কি করা যায় এখন? কিচ্ছু মাথায় আসছে না। এই তো ঘন্টাখানেক আগে লাইট নিভিয়ে শুলো। সবকিছু ঠিকঠাক-ই ছিল। এরই মধ্যে জানালার বাইরে ওটা কি দাঁড়িয়ে আছে? আচ্ছা, ওটা কি আদৌ মানুষ, না বিদেহী কোনো আত্মা? ফিহা দুরুদুরু বুকে সাহস জুগিয়ে ভীত কন্ঠে শুধাল,
– ‘ কে?.. কে বাইরে? ‘
কোনো জবাব এলো না ওপাশ থেকে। বাইরে অসংখ্য কুকুর ‘ ঘেউ ঘেউ ‘ করে ডাকছে। একনাগাড়ে কুকুরগুলো এমন স্বরে ডাকছে যেটা উত্তরোত্তর স্বাভাবিক ডাক না। একেকটি ডাক বুকের ভেতর তীব্র দামামা তুলে দিচ্ছে। হঠাৎ দেখল জানালায় রাখা সেই থাবার মতো হাতদুটো ঘষতে-ঘষতে নিচে নামাচ্ছে ঘুটঘুটে কালো ছায়াটা। ঘর্ষণের ফলে থাইগ্লাসে ‘ ক্যাচচ্ ক্যাচচ্ ‘ করে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে রুমে। ওইটুকু দৃশ্য দেখে দু’হাত কানে চেপে এক চিৎকার দিয়ে উঠল। গলা ফাটিয়ে ‘ মা, মা ‘ বলে চিৎকার করে যাচ্ছে ও। চিৎকারের প্রতিটি আর্তস্বর দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পরতেই সবার ঘুম ভেঙে গেল। ‘ কী হয়েছে, কী হলো ‘ এমন দুশ্চিন্তায় ঘায়েল হতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে নিচতলার দিকে ছুটল। ফিহার ডাক তখনও থামেনি। কান্নায় আছড়ে পরা কণ্ঠটা বেসামাল ভয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। ধরাম করে দরজা খুলে ঢুকলেন বাবা নিয়াজ উদ্দিন। মেয়ের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি যারপরনাই অবাক! চোখে-মুখে বিস্মিত অবস্থা চড়াও করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
– মা? ও মা? চিৎকার দিলি কেন? ফিহা রে কী হয়েছে?
বলতে বলতেই মেয়ের কাছে দৌঁড়ে গেলেন তিনি। উনার চোখদুটো জানালার দিকে স্থির। কেন জানি জানালার প্রতি অদ্ভুত কিছু অনুভব হচ্ছে তাঁর। যদিও জানালার ওপাশটা খালি, সেখানে এখন কিছুই নেই, তবুও মনের কাছে খটখটে কিছু বিঁধছে, যার কোনো উত্তর পাচ্ছে না। পেছন থেকে হুড়মুড় করে আরো দুজন ব্যক্তি চলে এলো। মা নাজনীন মিলা ও বড় বোন সাবিলা হক ফিমা। ফিহার ভয়কাতুরে মুখায়ব দেখে নাজনীন যথেষ্ট বিমূঢ়! তিনি একটুও দেরি না করে ছোট মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে বার বার কান্নারত মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– হলোটা কী? এভাবে চিৎকার দিলি কেন? খারাপ কিছু দেখেছিস? ফিহা, এ্যাই ফিহা? কান্নাটা বন্ধ কর মা। খুলে বল কী হয়েছে? কী জন্যে চ্যাঁচাচ্ছিস?
ফিহা হিঁচকির সুরে কিছুই বলতে পারছে না। তার মানসপটে গেঁথে আছে ভয়াবহ চিত্রটা। ওই ভয়াবহ দৃশ্যটা যে কতো নিষ্ঠুর তা যদি মাকে বলতে পারতো! ভয়ে-কান্নায় শোচনীয় অবস্থা হয়ে পুরো শরীর ঘেমে উঠেছে। বড় বোন ফিমা স্বচ্ছ গ্লাসে পানি এনে ফিহার কাছে বসল। গ্লাসভর্তি পানিটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্নসূচকে বলল,
– কী হয়েছে তোর? নে, ঝটপট পানিটা খা। একটু ঠান্ডা হ। তাড়াতাড়ি বল কী হয়েছে। খারাপ কিছু দেখেছিস? কোনো দুঃস্বপ্ন?
ফিহা কাঁপা-কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা নিলো। ঠান্ডা বরফকুচি দেওয়া পানিটা অস্থিরভাবে সাবাড় করে ভারী দম ছাড়ল। অনেকক্ষণ পর যেন ভয়ের পাথরটা বুক থেকে নেমেছে। গলাটা একটু শান্ত হতেই কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
– বাইরে কেউ ছিলো। আমি শিওর বাইরে কেউ ছিলো। ওই যে…ওই থাইগ্লাসটা দেখতে পাচ্ছ? ওখানে দুই হাত… দুই হাত ফেলে দাঁড়িয়েছিলো। বিশ্বাস করো স্বাভাবিক মানুষের মতো ছিল না। ছায়াটাই বিরাট লম্বা! ঠিক… ঠিক দানোর মতো শরীর। আমি স্পষ্ট দেখেছি। আমি…আমি একবিন্দু ভুল দেখিনি। আমার কথা বিশ্বাস করো।
চোখে কৌতুহল ফুটিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল ফিমা। বিবরণ শুনে চরম আশ্চর্য হচ্ছে সে। ঠোঁটটা কিন্ঞ্চিত ফাঁক করে সেই জানালার দিকে তাকাতেই সেখানে পর্যবেক্ষণরত নিয়াজ উদ্দিনকে বললো,
– বাবা? এদিকে তাকাও তো।
ছোটো মেয়ের ঘটনা আদৌ সত্য কি না সেটা খতিয়ে দেখছিলেন নিয়াজ। ডাক শুনে বড়ো মেয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে উদ্বেগের সাথে শুধালেন,
– কিছু বলবি?
ফিমা কিছু বলতে গিয়েও কী যেন ভেবে দুম করে চুপ হলো। অদ্ভুতভাবে কিছুই বলল না সে। হালকা একটা ঢোক গিলে কথা ঘুরিয়ে বলে,
– বাবা তোমার মেয়েটা যথেষ্ট ভীতু। দিন দিন ওর ঢঙ বেড়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে এগুলো কী সহ্য করা যায়? রাত এখন কয়টা বাজে? ও ঘুম বাদ দিয়ে কী করছিল সেটা আগে জিজ্ঞেস করো তো। রাত তিনটের সময় ভ্যাঁ ভ্যা করে পাড়া-প্রতিবেশি ডাকার মানে আছে? আজ যেই কাণ্ডটা করলো, আরেকটু হলে তো পুরো এলাকা জেগে উঠত। তখন কী জবাবটা দিতে?
কথাটা মোটেও ঠিক বলেনি ফিমা, কিন্তু তাতে বাঁধা দিলেন না তিনি। তাঁর ছোটো মেয়েটা অতো ভীতু নয় যে মামুলি কোনো ঘটনা দেখে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করবে। নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে বিধায় তার আদরের মেয়েটা শান্ত থাকেনি। নিয়াজ উদ্দিন থাইগ্লাসটা বামে ধাক্কা দিয়ে বাইরে একবার উঁকি দিলেন। রাতের ধূ ধূ করা শূন্য রাস্তায় কেউ নেই। সবকিছুই ভূতুড়ে ভেলকির মতো স্বাভাবিক দেখাচ্ছে এখন। তার মনে যে অস্বস্তির কাঁটা ক্ষণেক্ষণে বিঁধছে সেটা কাউকে না বললেও আপাতত সবাইকে ঘুমের তাগাদা দিয়ে রুম থেকে চলে যেতে বললেন। সন্দেহের জন্য ছোটো মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন বড়ো মেয়ের কাছে। নিরিবিলি ছিমছাম নিস্তব্ধ রুম থেকে বেরুতে গিয়ে হঠাৎ পা জোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন নিয়াজ। মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে আবারও জানালার দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে তাকালেন। ফিহা কী আসলেই কিছু দেখেছে? নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণই ভ্রম? কী হচ্ছে এখানে?
.
একফোঁটা ঘুম নেই চোখে। একটা সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা লাগছে না। বারবার ওই অদ্ভুত দৃশ্যটা মনে পড়ছে। ওটা কী হতে পারে? মানুষের মতো লাগেনি। তখন কুকুরগুলো খুব ঘেউ ঘেউ করছিলো। সেটা স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অনেক বেশি-ই বলা চলে। তা ছাড়া বড়দের মুখে শোনা কথা, রাতবিরাতে অশরীরী কিছু থাকলে কুকুররা সেটা আগে দেখতে পায়। তার মানে কী — বাকিটুকু ভাবতেই বুকটা কামড় দিয়ে উঠল। আর ব্যাপারটা ভাবতে চাইছে না। হঠাৎ ‘ আল্লাহু আকবর ‘ বলে চারপাশ মধুর স্বরে একাকার হয়ে উঠতেই ফিহার অশান্ত মন যেন আযানের সুর শুনে একটু একটু করে পরাস্ত হয়ে গেল। ফজরের আযান শেষ হতেই নিচে ঘটলো আরেক বিপত্তি। ঝট থেকে বিছানা থেকে উঠে দরজা ফাঁক করে দেখল, বাবা একনাগাড়ে মেইন দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। মা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কালেমা তায়্যেবা, আয়াতুল কুরসী, দুয়া ইউনুস জোরে জোরে জপ করে যাচ্ছে। কেউ মেইন দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে গেছে। আজ পযর্ন্ত এরকম আজগুবি ঘটনা কখনো হয়নি ওদের সাথে। ফিহা ওইটুকু দৃশ্য দেখার পর স্তম্ভিত মুখে এক পা এক পা করে বিছানায় এসে বসলো। একটার-পর-একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, অথচ কারণ জানে না ও। উপায় না পেয়ে সকাল অবধি অপেক্ষা করে শেষে নিয়াজ উদ্দিন পাশের বাসার দারোয়ানকে কল দিয়ে তালা খুলিয়ে নিলেন। সকালের দিকে অফিসে যাওয়ার সময় বার বার সতর্ক করে দিলেন,
– খবরদার কেউ বাইরে যাবে না। ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। আমি চাই তোমরা সতর্ক থাকো। বাসায় কেউ আসলে চট করে দরজা খুলবে না। আগে ভালো করে জিজ্ঞেস করবে কে এসেছে তারপর চিন্তা-ভাবনা করে দরজা খুলবে। যদি দেখো অপরিচিত কেউ এসেছে, খুলার দরকার নেই। আমি পাশের বাড়ির দারোয়ানকে সব বলে দিয়েছি। ও চোখ-কান খোলা রেখে পাহারা দিবে। খুব বেশি সমস্যা দেখা দিলে আমাকে সাথে সাথে ফোন করবে। একদম দেরি করবে না। আমি সন্ধ্যায় আসব। যাই তাহলে।
অফিসের জন্য চলে গেলেন বাবা। এরপর সারাদিন কিছু হলো না। গোটা দিন নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে কেটে গেল। এতে সবাই ধরে নিলো, কাজটা খুব সম্ভবত চোর-বাটপারদের কাজ। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো। ভয় দেখানোর জন্যে এরকম কিছু করাটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। তাছাড়া চুরিচামারির মতলব যদি থেকেই থাকে, তবে সেটা সুপরিকল্পিত ভাবেই করেছে। যদিও এ তল্লাটে চুরির ঘটনা আজ অবধি শোনা যায়নি, কিন্তু ঘটতে কতক্ষণ? ফিহার অস্থির মনটা ভোরের পর থেকে অদ্ভুত কিছুর আভাস পাচ্ছিল। কেন জানি ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার জানান দিচ্ছিল, এ যেন অন্যকিছুর পূর্বাভাস। ঠিক যেন অস্বাভাবিক, অকল্পনীয়, অদ্ভুত কিছুর আগমন। যা তছনছ করতে বেশ দাপটের সাথেই মুখিয়ে আছে। কিন্তু সেটা ধরার-বুঝার-দেখার মতো অবস্থা হয়নি। কেন ওর মনটা বেচইন অনুভব হচ্ছে? কেন অস্থির মনটা স্বাভাবিক হতে পারছে না? কেন?
.
পরদিন রাতের ঘটনা। গোটা একদিন পেরোনোর ফলে আকস্মিক ভয়টুকু সবার মধ্য থেকে কেটে গেছে। নাজনীন এখনো দুয়া-দরূদ পড়ে মেয়েদের শরীরে, বুকে, ঘরের চতুর্দিকে ঝাড়ফুঁক করেছে। ফিহা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছে ওটা চোরেরই কাজ। নতুবা অত রাতে দানোর মত কর্মকাণ্ড, গায়েবি ঘটনা, এমনকি আগে-পিছে কোনো গুজব পযর্ন্ত যেহেতু রটেনি, তাহলে ধরে নেওয়া যায় ওটা আসলে মানুষ-ই। তাছাড়া মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীবের কর্মকাণ্ড হবে না ওটা। এরকম কিছু শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফিহা সমস্ত চিন্তার ঝুলিটা বন্ধ করে রাতে আবারও ফিমার কাছে ঘুমিয়ে পরে আবারও রাতে ঠিক আগের মতো অবস্থা! কিন্তু এবারের ঘটনা আরো অদ্ভুত, আরো বিভীষিকা রূপে ঘটল! জানালার ওপাশে জ্বলজ্বল করে কিছু একটা জ্বলছে। ফিহা প্রথম দফায় কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রুঁ কুঁচকে ছোটো চোখ করে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। পরে সেটা আঁচ করতে পেরে দৃষ্টি জোড়া অস্বাভাবিক হারে বড়ো বড়ো করে চমকে উঠল। বুঝতে পারল ওটা আসলে ফ্ল্যাশ লাইট! ফিহা সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে এক ঝটকায় সমস্ত ঘুম আস্ফালন করে ফিমাকে উৎকণ্ঠার সাথে ডাকতে লাগল। জানালার দিকে ভীতু চোখদুটো রেখে অস্থিরভাবে ফিমাকে ধাক্কিয়ে যাচ্ছে ও,
– আপু, উঠো! তাড়াতাড়ি উঠো। আপু দ্যাখো ওটা কী! জলদি উঠো, জলদি উঠো! ওটা চলে যাবে আপু। উঠো প্লিজ!
ফিহার তুমুল শোরগোলে ফিমার ঘুমটা মিনিটের ভেতর ভেঙে গেল। চোখের কপাট খুলে ফিহার দিকে তাকাতেই তড়াক করে উঠে পরল সে। কানে ‘ধুপ’ করে জোরালো একটা শব্দ হতেই দু’বোনই সরাসরি জানালার দিকে তাকায়। ছায়াটা আর নেই, জানালার ওপাশটা খালি। ফিমা দ্রুততার সাথে জানালার কাছে যেতেই আফসোসের সুরে বলল,
– ইশ রে! চলে গেছে। ধ্যাত্তরি!
ফিমা তৎক্ষণাৎ জানালার কপাট খুলে নিচের দিকে তাকাল। ভ্রুঁ দুটো উপরে তুলে আশ্চর্য হয়ে বলল,
– মাই গড! ওটা কী? জলদি আয় ফিহা! জলদি আয় এদিকে!
বোনের ডাক শুনে হুড়মুড় করে চলে গেলো ফিহা। বোনের ডানপাশটা দখল করে সেও জানালার বাইরে নিচের দিকে তাকায়। কপালের মধ্যখানে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে অস্ফুট স্বরে বলে,
– ইয়া আল্লাহ্…
একটা মই দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে আর বাকি রইল না অজ্ঞাত কেউ মই বেয়ে উঠেছে। আশেপাশে কেউ নেই। পথটা শূন্য ও খালি। সেদিকে দৃষ্টি রেখে ফিহা নিরুদ্যম সুরে বলল,
– বাবাকে ডাকব?
প্রশ্ন শুনে ফিমা চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকাল।দূরের এক চিলতে ফ্যাকাশে আলো সরাসরি ওর ছোট্ট মুখটার উপর পরায় সুন্দর চোখের চাহনিটা দেখতে পাচ্ছে ফিমা। বুকভর্তি দম ছেড়ে ডানে-বামে অনিশ্চিত ভাবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালা থেকে সরে এসে বসল, কিছুটা গম্ভীর সুরে ঘোষণা দিয়ে বলল,
– দরকার নেই। নিচে একটা মই ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দোতলায় উঠার জন্য মই ব্যবহার করেছে। আমি মতলবটা বুঝতে পারছি না ফিহা। এটা কোনো অ্যাঙ্গেলেই চুরির ঘটনা মনে হচ্ছে না। রাত দুটোর দিকে কোনো চোর চুরি না করে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে এটা অসম্ভব।
ফিহা ভাবনায় ডুবে গিয়ে উপর-নিচ মাথাটা নাড়াতে থাকল। সেও জানালা থেকে সরে এসে আপুর মুখোমুখি বসে চিন্তিত মুখে বলল,
– আমাদের তল্লাটে চোর নেই আপু। আগে যাও একটা চুরির ঘটনা ঘটত, সেটাও আহামরি কিছু ছিল না। এবারের ঘটনা পুরোই ভিন্ন কিছু হচ্ছে।
কথাটা ভুল বলেনি ফিহা। ওর একেকটি বাক্য শতভাগ ঠিক। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? লোকটা কী তাহলে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছে? কোনো গুরুতর ও ভয়াল গ্রাসের কোপ, নাকি মান সম্মানের ক্ষতি সাধনের এক পৈশাচিক প্রচেষ্টা? ফিমা আপনমনে কিছুক্ষণ মশগুল থেকে গমগম সুরে বলে,
– তোর কি মনে হচ্ছে? আমার গাট ফিলিংস বলছে —
কথার মাঝখানে দাড়ি বসালো ফিহা। ফট করে বলে উঠল,
– চুরি করতে আসেনি আপু। এই নাম-না-জানা ব্যক্তি চুরি করতে আসেনি। চুরি করলে এতোক্ষণে বহু জিনিস খোয়া যেত। তুমি নিজেই দেখো ঘরের কোনো জিনিস কী এদিক সেদিক বা চুরি হয়েছে? না, হয়নি। আমাদের ফোন পযর্ন্ত বালিশের পাশে ছিল। তোমার আইফোন, আমার স্যামস্যাং, দু’জনের পাওয়ার ব্যাংক, তোমার আইপড। সেখানে চুরি করা কী সোজা ব্যাপার ছিল না? উলটো ওই উল্লুকটা ফ্ল্যাশ মেরে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? চুরি করে তো ধুম ধারাক্কা পালাতে পারতো। এখানে স্বাভাবিক কিছু হচ্ছে না। আমি নিশ্চিন্ত কিছু তো একটা গড়মিল হচ্ছে।
ফিমা অবাক হয়। ভয়ে কেমন যেন গুটিয়ে যায়। ঢোক গিলে আশ্চর্যের সাথে শুধায়,
– মানে? তুই কী বলতে চাচ্ছিস এখন?
ফিহা নিচের ঠোঁটটা হালকা একটু কামড়ায়। বোনের দিকে ভীতু দৃষ্টি ছুঁড়ে ক্ষীণ গলায় বলে,
– কিছু তো একটা আছে আপু। রহস্য তো ঠিকই আছে। আমি স্পষ্ট দেখেছি এবারের লোকটা ভিন্ন কেউ ছিল। কালকের লোকটার মতো একদমই ছিল না। কাল যেটা ছিল ওটার বডি স্ট্রাকচার আর হাইট আরো লম্বা, আরো মাশল্ ফিট বডি ছিল।
আর কথা বাড়ায় না ফিমা। রাত খুব হয়েছে। কথাগুলো সকালের জন্য উহ্য রেখে দু’বোনই ঘুমিয়ে পরে। তবে সেই রুমে আর দু’বোন ঘুমায়নি। আবারও তারা রুম বদল করে নিরাপত্তার কথা ভেবে অন্য রুমে চলে যায়। সেই রুমের দরজা-জানালা ভালো করে আঁটকে জানালার পর্দা টেনে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমায়। রাতটা আজও ফিহার তন্দ্রাহীন ভাবে কাটে। কাটে চিন্তায়-ভাবনায় আর অদ্ভুত ভীতিতে।
সকালে সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে পেরে নিয়াজ উদ্দিন নাস্তা রেখে ভীষণভাবে চিন্তিত। এমন অবস্থায় মেয়ে দুটোকে একা রাখা ঠিক হচ্ছে না। দিনকালের যা অবস্থা তাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অফিস করবেন, এ ধারণা ভুল। আজকাল তো মেয়েরা বাসা-বাড়িতে একদম নিরাপদ না। কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। পরপর দু’দিন ব্যাপারটা একনাগাড়ে ঘটল। কেনো মেয়েদুটোর পিছনে হাত ধুয়ে পরল এখনো কিছু আন্দাজ করতে পারছেন না। আজ অফিসে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা ছুটিতে রূপান্তর করে বাড়িতেই রয়ে গেলেন। মেয়েদের কথা চিন্তা করে সকাল থেকে মাথায় একটাই বুদ্ধি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও সেটা অন্যদের চোখে কেমন দেখাবে জানা নেই, তবু মেয়েদের কথা চিন্তা করে এটাই সই। নিয়াজ উদ্দিন আরো কিছুক্ষণ ঘরময় পায়চারি করে শেষমেশ মেয়েদের ডেকে বললেন,
– তোরা দু’জন আজ বিকেলের দিকেই বড়ো খালামনির বাসায় চলে যাবি। কিছুদিন ওখানে থাকতে হবে। এখানকার মামলা ঠান্ডা না হওয়া পযর্ন্ত ওখানে থাকা চাই। তোদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা আমি বড়ো আপার বাসায় করে দিচ্ছি। তোরা আমার কথায় রাজী আছিস? কারো কোনো আপত্তি আছে?
দু’বোনই বাধ্য মেয়ের মতো সমস্বরে জানায়,
– না, বাবা। সমস্যা নেই। তুমি যা বলবে তাই ঠিক।
বাবার বাধ্য মেয়ের মতো দু’বোন রাজী হয়। বাবাকে ‘ না ‘ বলার হিম্মত ওদের বুকে নেই। মায়ের চেয়ে বাবার কথাকে বেশি মান্য করে দেখে ওরা। কাজেই দু’বোন ঝটপট রেডি হয়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল এক ঘন্টার মধ্যেই। একটা সিএনজি ভাড়া করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ধানমন্ডির দিকে রওনা দেয় তারা। বিকেলের গোলাকার সূর্যটা পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। স্বল্প তেজের বিকরণ ঘটিয়ে মিঠে আলো ছড়াচ্ছে এখন। রাস্তার জ্যাম, ধূলা ও বিদঘুটে জার্নির মধ্য দিয়ে ফিহা প্রচণ্ড বিষিয়ে উঠল। ভেতরটা বমি-বমি অবস্থার মত ঝিমিয়ে আছে ওর। না জানি কখন পেটের সকল নাড়িভুঁড়ি উলটে ভকভক করে তিঁকুটে পানি বেরিয়ে আসে। খুব কষ্টে বিদঘুটে জ্বালাটা সহন করে শেষপর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দুই ঘন্টার মাঝেই। কিন্তু সিএনজি থেকে নামতেই অদ্ভুতকাণ্ডের মতো ওর চোখদুটো চুম্বকের মত আঁটকে গেছে। এই যে বাবা ভাড়া চুকাচ্ছে, ফিমা যে ব্যাগগুলো নামাচ্ছে, সিএনজি ড্রাইভার যে ভাড়ার জন্য সমানে ফ্যাচ ফ্যাচ করে যাচ্ছে সেদিকে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই ওর। সহসা সবকিছু কেমন ‘স্লো-মোশন’ কথাটার মতো থমকে গেল। মনে হল আশেপাশে কেউ নেই। ফিহার সম্পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি তখন স্থির নেত্রে তিনতলা বাড়িটার দিকে আঁটকে আছে। আলিসান গেটের কাছে আয়তাকার বাদামি রঙের নেমপ্লেটটার দিকে একপলক তাকাল, সেখানে ইটালিক বোল্ড হরফে সোনা রঙে চকচক করতে থাকা ‘ Major S.A Jakir ‘ লেখাটা পড়ল। মেজর সোয়াদ আহমেদ জাকির, বাংলাদেশ সেনাবাহিনি। সামনের সুউচ্চ তিনতলা ভবনের দিকে নাজুক দৃষ্টি ফেলে ঢোক গিলল ফিহা। রোমন্থন স্মৃতিতে চলে গেল সে। স্মৃতির মানসপটে যেন দ্রুতগতিতে শৈশবের দিনগুলো ভাসতে থাকে। নানুবাড়িতে ঈদের উপলক্ষ্যে সবার একত্র হওয়া, বড় খালামনির আগমন, ছোট খালামনির স্বপরিবারে হাজির হওয়া। সবগুলো ভাই-বোন, পরিবারের বড়রা, গুরুজন হিসেবে নানা-নানুর খোশগল্প একেকটি মূহুর্ত যেন চোখের সামনে ভাসল ওর। সবগুলো খালাতো-মামাতো ভাইবোনরা একত্র হয়ে সারাদিন খেলাধূলা করতো তখন।
– ফিহা? বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি? চল মা, ভেতরে চল। তোদের এগিয়ে দিয়ে আসি।
বন্ধ দরজার কাছে আসতেই দেয়ালে সুইচ টিপে দিলেন নিয়াজ। ওমনেই ভেতর থেকে পাখির কিচিরমিচির সুরের মতো কৃত্রিম বাজনার তালে অতিথি আগমনের জানান দিল। নকশাকার কাঠের আভিজাতপূর্ণ দরজা খুলে হাসি দিলেন বড়ো খালা আফসানা কাদির। সহজাত হাস্যমুখে সবাইকে ভেতরে নিয়ে নিয়াজ উদ্দিনকে বিদায় দিলেন তিনি। ফিহা ড্যাবড্যাবে চক্ষু মেলে চারিদিকে শৌখিনতার চিত্র দেখে যাচ্ছে। এই নতুন বাড়িটায় আজই প্রথম আসলো ফিহা। চারিদিকে যেন পারিপাট্যের চেয়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া। একটা পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের রুচিশীল ছোঁয়া প্রতিটি জিনিসে-জিনিসে আকর্ষণীয় ভাবে ফুটে আছে। যেন কত আদর, কত সোহাগ, কত যত্নের সাথে প্রতিটি জিনিস একটার-সাথে-একটা সাজানো হয়েছে। ফিহা বিস্মিত নয়নে বিভোর হলে আফসানা ঝলমলে হাসিতে প্রশ্ন করেন,
– কী বুড়ি? কেমন আছিস? তোর খালামনির বাড়িটা কেমন হল? কতদিন পর এলি রে সোনা। তোর মাকে কত করে বললাম এদিকটা একটু ঘুরে যা। তোর মা-টা আমার কথা পাত্তাই দিল না। সবসময় খালি ব্যস্ততা দেখিয়ে ছুঁতোই দিয়ে গেল। বস তো তুই। এ্যাই ফিমা বসে পড়। তোদের জন্য লেবুর শরবত আনি গে। আমার বাড়িতে এসেছিস যখন, এখানে একদম ভয় নেই। তোর খালুটা এখনো জানে না তোরা আসবি। মেজর সাহেবকে একটা ছোটখাটো সারপ্রাইজ দেব। তোদের ভিডিয়ো কলে দেখে মেজর সাহেব যে কত খুশি হবে আমি ভাবতেই পারছি না! শোন তোরা, মায়ের কথা বাদ দিয়ে মাসির কথা চিন্তা করবি। এখানে যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবি। একদম পর-পর ভাব দেখাবি না। আমি শরবতটা নিয়ে আসি।
খালার কথা শুনে ফিমা বেজায় হাসি দিলো। খালাটা আজও রসিক রয়েছে বটে। আগের মতো আপন ভাবটা এখনো মনের মধ্য থেকে উবে যায়নি। ফিমা অশোভন কায়দায় পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসে আছে। ছেলেদের মতো বসার ভঙ্গিটা খারাপ দেখাচ্ছে বলে ফিহা নিচু স্বরে বলল,
– আপু পা নামাও, বিশ্রী দেখাচ্ছে। তোমার জন্য ওই ব:দখlত মানুষটার কাছে ঝারি খেতে চাই না। মা কি বলেছে শোনোনি? যদি একটা অবজেকশানও মার কাছে যায় তাহলে তোমার রlক্ষে নেই। প্লিজ পা-টা নামাও। অতিরিক্ত কোরো না।
ফিহার অতিরিক্ত মা-ভক্তি দেখলে শরীরটা দাউদাউ করে জ্বলে। তোকে কে বলেছে রে মায়ের গোলামি করতে? এখানে আমি কীভাবে বসব না-বসব সেটাও তোকে বলে বেড়াতে হবে? বlদমাlশ পোলাপান! ছোটো হয়ে বড়োদের মত ভঙ্গিমা দেখলে ঠাস করে চlড় লাগাতে ইচ্ছে করে। ফিমা গরম চোখ করে পা-টা নামালো ঠিকই, কিন্তু ক্রোধের আগুনটুকু নেভালো না। আফসানা কিছুক্ষণ পর দু’গ্লাস শরবত এনে দু’বোনকে ধরিয়ে দিলেন। ফিহা ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিলে ফিমা তখন দ্বিগ্বিদিক দৃষ্টি মেলে কাউকে যেন খুঁজতে থাকে। আফসানা এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত হলে ফিমা ওই সুযোগে প্রশ্ন করে,
– সাঈদ ভাই নেই?
যতটা সাচ্ছন্দে ফিমা প্রশ্নটা করল, ততটা অপ্রত্যাশিত ভাবে সদ্য চুমুকের তরলটুকু কারোর গলায় তখন আঁটকে গেল। গলায় প্রচণ্ড বিষম খেয়ে খিঁচিয়ে আছে ফিহা। কেউ লক্ষ করেনি সেটা। তার আগেই উশখুশ কাশিটা অতি কষ্টে দমন করে ফিহা স্বাভাবিক চিত্তে ফিরে আসলো। এই নাম শুনলে এখনো অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে! এখন এক বাড়িতে কী করে থাকবে?
#নির্মোচন .
#পর্বসংখ্যা_০১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
#নোটবার্তা : ফেসবুকে ২০২০ সালে লেখা ‘ যদি তুমি জানতে ‘ গল্পটা এবার পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আকারে আসছে। নতুন এবং পরিবর্তিত নাম ‘ নির্মোচন ‘। পাঠকের সুবিধার্থে আমি পেজেই পোস্ট করলাম। অবশ্যই আপনাদের প্রাণ প্রফুল্লকর মন্তব্য এবং ভালোবাসার জন্য আমি প্রচণ্ড অপেক্ষায় আছি। ❤