গল্প:-চমক
৪র্থ এবং শেষ পর্ব
লেখা–ছদ্মনাম মায়া ইসলাম
ঘুমে চোখ দুটো প্রায় লেগে আসছিল অমনি ফোনের রিংটোনের আওয়াজে মেহজাবিন সচকিত হয়ে উঠল। অলস গলায় মিনমিনিয়ে বলছে,
‘এতো রাতে আবার কে?
ঘুম ঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালে আননোন নাম্বার দেখা যাচ্ছে। ধরবে না ভেবেও আবার কি মনে করে রিসিভ করে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম!
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম
‘হ্যাঁ কে বলছেন?
‘তোমার ফিউচার
মেহজাবিন এবার ভালো করে কন্ঠস্বর খেয়াল করলে বুঝলো এটা নিশ্চিত ঐ তাজ ছেলেটি। সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম এখন পালিয়েছে। তাই ভাবতে বসে গেল। লোকটা ওর মোবাইল নাম্বার জানলো কেমনে? কার কাছ থেকে নিলো? নিশ্চয়ই ঐ তিতলী নামের মেয়েটার কাছ থেকে। আচ্ছা তিতলী ঐ লোকটার কি হয়? ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে ফোনটা আবারো বেজে উঠায়। হ্যাঁ, লোকটা আবারো কল করেছে; আজব! চাচ্ছে কি এনি? বিকেলে তো কত সুন্দর করে মিথ্যা বলল মেহজাবিনের নামে, আর এখন ফোনকল দিয়ে ডিস্টার্ব করা হচ্ছে? বাধ্য হয়েই কল কেটে দিয়ে মোবাইল অফ করে রাখে মেহজাবিন।
তাজ এদিকে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফটাচ্ছে। কোন কিছুতেই তার মন টিকছে না। ইচ্ছে হচ্ছে উড়াল দিয়ে মেহজাবিনের কাছে ছুটে যেতে। ও কি জানে, যে ওকে তাজ খুব করে মিস করছে?
একটুখানি কন্ঠ শুনতে পেল, তাও আবার বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই লাইন কেটে দিল। বরাবর এমন কারো বিহেভিয়ারে তাজের আত্মসম্মান বোধে লেগে যায়। কিন্তু মেহজাবিনের বেলায় তাজ নির্লজ্জের মত আবারও কল করেছে। কিন্তু মেহজাবিন রিসিভ করেনি। আর এখন মোবাইল বন্ধ রেখেছে। কিন্তু তাজ নাছোড়বান্দা, মেহজাবিনের ভয়েস শুনার জন্য বারবার কল দিতে লাগল। তবে মেহজাবিন কিছু বলছে না, অন্য এক মেয়ে রোবটের মত বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে।
“দুঃখিত! কাঙ্খিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। Sorry the number is dial (এরপরের ওয়ার্ডগুলো আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি)
কি এক মুসিবত। কত শত প্ল্যান করে ছোট বোনকে (তিতলী) ম্যানেজ করে নাম্বারটা যুগিয়েছে শুধু মাত্র মেহজাবিনের ভয়েস শোনার জন্য। কিন্তু তা আর হলো কই? সব গুলিয়ে গেছে।
ঐ তো বিকেলে নিজের সব ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা মেহজাবিনের উপর চাপিয়েছে না; ফলস্বরূপ এখন আর কিছু কাজে আসছে না।
সকালে মেহজাবিনের বাবা এসেছে। এখন আর অভিমান করে নেই। খুব হাসি মুখেই মেহজাবিনের সাথে কথা বলছে। তখন মেহজাবিনের খুশি আর দেখে কে। বাবার জন্য নাস্তা বানিয়ে এনে দেখে বাবা প্রাণখোলা হাসি হেসে মাকে কিছু বলছে। আর মেহজাবিনের মা’ও হা করে কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছে। মেহজাবিন ওখানে গিয়ে নুডলসের বাটিঁটি বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। ওর বাবা তখন খেতে খেতে বলছে,
‘কিরে মা, এতো কিছু হয়ে গেল অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না?
‘কি হয়েছে বাবা?
‘তাজ কাল রাতে কল করেছিল। আধা ঘন্টার মতো কথা বলার পর বলেছি, ‘বাবা আমি এখন এক জায়গায় কাজে এসেছি। কাল বাসায় যাব, তখন সামনাসামনি না হয় তোমার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করবো। তুমি আগামীকাল আমার বাসায় এসো।’ তাজও রাজি হয়ে গেছে। আজ রাতে আসবে মনে হয়। সবকিছু নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। গুছিয়ে রাখিস।
‘তাজ? কোন তাজ? আর কি বিষয় নিয়ে আলাপ করবে?
‘কিরে, না জানার ভান করছিস যে? তোরা নাকি একে অপরকে পছন্দ করিস? শুধু আমার ভয়ে নাকি ওকে পাত্তা দিস না। এসবই তো বলল। এটুকু বলার পর বাবা মা’কে বলতে থাকলেন,
‘বুঝলে, অতটুকু কথা বলায়ই বুঝলাম ছেলেটা বড়ই সাদা মনের। আর খুব মিশুক প্রকৃতির। নিজেদের কোম্পানি, গাড়ি আর ঢাকায় নিজস্ব আটতলার বাড়ি আছে। বাবার একটামাত্রই ছেলে, আর একটা ছোট মেয়ে আছে। মায়ার ক্লাসেই নাকি পড়ে। বাড়িতে কোনো ঝামেলা নেই। কাজকর্ম নাকি করতে হবে না। বাসায় দশ বারোটা সার্ভেন্ট খাটে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই এমন ভালো সম্বন্ধ কি কেউ হাতছাড়া করে বলো? খুব অবাক করা বিষয় যে, ছেলে একদম কোনো ভনিতা ছাড়াই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আর আমি ঠিক ভাবে ঔষধ খেয়েছি কিনা তাও জিজ্ঞেস করেছে। হাঃহাঃ
মেহজাবিন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। ঝটপটিয়ে ছটফটানোর মতো করে বলে উঠলো,
‘বিয়ের প্রস্তাব মানে? কার বিয়ের?
ওর বাবা একটু মিছে রাগ দেখিয়েই বললেন,
‘এ্যাই দেখো, এনি কিছুই জানে না। অথচ আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে রেখেছে। প্রস্তাব দেওয়ায় যেন আমি আর না করতে পারি।
মেহজাবিন মায়ার দিকে রাগি চোখে তাকালে, দেখতে পেল মায়া আগে থেকেই (?) এমন মুখ করে আছে। হঠাৎ ই বাবার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখে বাবার মুখের হাসি যেন আরো প্রসারিত হয়ে গেল।
‘আরে দেখ না। যার কথাই এতক্ষণ আলোচনা হচ্ছিল সেই এখন ফোনকলে হাজিরা দিচ্ছে। বাছাধন অনেক বছর বেঁচে থাকবে।
মেহজাবিন কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করে। এসব কি থেকে কি হচ্ছে, তা মেনে নিতে ওর মাথা তো পুরো জয়জব্বর হয়ে উঠছে।
সন্ধ্যার পরে তাজ ওর ফেমিলি মেম্বারস নিয়ে এসে হাজির। ওর বাবা, মা, তিতলী আর তাজ নিজে। আপ্যায়ন শেষে মেহজাবিনকে নিয়ে আসলে সবারই পছন্দ হয়। তাজের মা মেহজাবিনের গলায় একটা ডায়মন্ডের নেকলেস পড়ালে তিতলী সাথে সাথেই বলে উঠে,
‘এখন দু’জনকে একটু আলাদা কথা বলার ব্যাবস্থা করে দিলে ভালো হয়। মায়াও তিতলীর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপুর রুমেই নেয়া হোক। আমি আপুকে নিয়ে যাচ্ছি, আর তুমি তাজ ভাইয়াকে নিয়ে এসো। ওদের কথায় বাকি সবাইরাও সমর্থন করে।
ওদেরকে রুমে ঢুকিয়ে পাজি দুটো দরজার ওপাশ দিয়ে লক করে ফেলে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে মেহজাবিন ভয় পেয়ে ঘোমটা সরিয়ে মাথা উঠিয়ে তাকায় সেদিকে। তাজ তখন মেহজাবিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ! আর আপনার প্রতি শুকরিয়া যে, আমার উপর দয়া দেখিয়ে আপনাকে দেখার পরম সৌভাগ্যবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আরো শুকরিয়া আদায় করবো যদি আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে আমাকে ইসলামের পথে চলতে সাহায্য করেন। এতে আপনার মত আছে কি, বা কোনো অভিযোগ??
মেহজাবিন কিছু বলছে না। লজ্জায় ওর চোখ, নাক, মুখ বুজে আসছে। এতক্ষণ ভেবেছে লোকটাকে সামনে পেলে একগাদা কথা শুনিয়ে দিবে ওকে ওর বাবার কাছে ছোট করিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু এর অতি আনন্দের আহ্লাদী মাখা কথায় পেঁচিয়ে মেহজাবিন সব যেন ভুলে গেছে। শুধুমাত্র এখন লজ্জা পেতেই জানে।
‘শুনেছি নীরবতাই নাকি সম্মতির লক্ষণ। তাহলে কি আপনার এই নীরবতাই “হ্যাঁ” ধরে নিব?
মেহজাবিনের ঠোঁটের কোণে পাগল করা হাসি দেখতে পেল তাজ। আবেগে আপ্লুত হয়ে পাঞ্জাবির পকেটে থাকা রিঙের বক্সটা বের করে তা হতে রিংটা বের করে মেহজাবিনের আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল।
মেহজাবিন রিংটা দেখে বড়সড় চমক খেলো। আংটির ডিজাইনটা ঠিক এরকম–একটা ছোট্ট ছাতার উপর কয়েক ফোটা পানির ছিটা।
মেহজাবিন তাজের দিকে তাকালে তাজ ওর চোখে চোখ রেখে বলছে,
বৃষ্টি, ছাতার মাধ্যমেই তো আমাদের দেখার সূত্রপাত ঘটে। তাই এমনভাবে বানানোর খুব ইচ্ছে জাগলো। মন্দ কি? থাকুক না এরকম করে একটু স্মরনীয় হয়ে।
~~~সমাপ্ত~~~