হৃৎপিণ্ড_২ (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১০

0
524

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১০
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই দু’বার বমি হলো মুসকানের। হোক শারীরিক,হোক মানসিক মেয়েটা একেবারেই দুর্বল প্রকৃতির। দু’বার বমি হওয়ার ফলে একেবারেই নেতিয়ে গেছে। চোখ,মুখের অবস্থা ভীষণ খারাপ। শরীর’টা একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীনতায় ভুগছে।প্রচন্ড রাগ হলেও আপাতত নিজেকে শান্ত রাখছে ইমন। তারপর কিভাবে কি করে মুসকান’কে নিজের আওতায় আনা যায় বেশ ভালো করেই জানে সে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে একহাতে মুসকানের চোখে,মুখে পানি দিলো ৷ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় রাত করে গোসল, তার ওপর যদি হয় ঠাণ্ডা পানি মুসকানের অবস্থা কতোটুকু করুণ হতে পারে বেশ আঁচ করতে পারলো। তাই গরম পানি জমাতে থাকলো বালতিতে। ভীষণ চিন্তান্বিত হয়ে আদুরে স্বরে মুসকান’কে জিগ্যেস করলো,

” একা একা পারবি? ”

দুর্বল ভণিতায় মুসকান মাথা নাড়ালো। তবুও স্বস্তি পেলো না ইমন চিন্তান্বিত হয়ে বললো,

” এদিকে তাকা তোর জামাকাপড় তয়ালে সব আছে আর আমিও দরজার বাইরেই আছি বেশী ভিজবি না তাড়াতাড়ি শুধু প্রয়োজনীয় পানিটুকু গায়ে লাগাবি।”
.
খাবার গরম করে টেবিলে গুছিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো পারুল৷ মুসকান গোসল শেষে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো বিচলিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ইমন। মুসকান’কে দেখা মাত্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুসকানের হাত ধরে বললো,

” চট জলদি খেতে হবে এবার। ”

মুসকান আড়ষ্ট হয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ঘাড় বাঁকিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ইমন। মুসকানের লালচে আভায়িত স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,”হোয়াট?”

মুসকান মাথা নিচু করে এক ঢোক গিলে দৃঢ়চিত্তে দুর্বল পায়ে এগোতে লাগলো। ইমনও ঘুরে এগিয়ে গেলো ডায়নিং টেবিলের দিকে মুখে তার রহস্যময় হাসি৷ যে হাসির অর্থ এটাই তার প্রেয়সী বেহুঁশ সে উন্মাদ রূপটির পদত্যাগ ঘটিয়েছে।

মুসকানের দিকে প্লেট এগিয়ে নিজেও বসলো। তারপর খাবার মুখে তুলে মুসকান’কে ইশারা করলো খেতে। মুসকান এক পলক ইমন’কে দেখে নিয়ে থম মেরে বসে রইলো৷ মাথাটা বেশ ভারী ভারী লাগছে তার। গা গুলাচ্ছে কেমন চোখ বুজে বিকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা ধীরে ধীরে মনে করার চেষ্টা করতেই গা শিউরে ওঠলো ভয়ে। ডান হাত ওঠিয়ে গালে স্পর্শ করতে বুকের ভিতরটা চিন চিন করে ওঠলো৷ মুখ বন্ধ করে মুসকানের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীরে ধীরে খাবার চিবুচ্ছে ইমন। মুসকান যখন গালে হাত ছোঁয়ালো ইমন মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। বললো,

” খাবার খেয়ে নিতে বলেছি আমি নিজের করা অপকর্মের কথাগুলো বসে বসে ভাবতে বলিনি। ”

কান্না পেয়ে গেলো মুসকানের। মুরাদ তাকে মেরেছে ভাবতেই অসহনীয় যন্ত্রণা হলো বুকে। মিনমিনে গলায় বললো,

” আমার খিদে নেই আমি বাড়ি যেতে চাই। ”

” অপরাধী অপরাধের শাস্তি না পেয়ে আমার থেকে মুক্তি পাবে না। ”

বড়োসড়ো এক ঢোক গিললো মুসকান। ধুরুধুরু বুকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কম্পিত গলায় প্রশ্ন করলো,

” কিসের অপরাধ? ”

” অপরাধ কি সেটা নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখ। আর হ্যাঁ সকাল সকাল বাবা,মা’কে সরি বলবি। স্পেশালি মা’কে সরি বলবি কান ধরে বলবি আর কখনো এমন ভুল হবে না। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মুসকান ইমন খাবারে ইশারা করে খেতে বললো। কিন্তু মুসকান হাত গুটিয়ে বসেই রইলো সে কোনমতেই খাবেনা। ইমনও আর কিছু বললো না নিজের খাবার শেষ করে চেয়ার টেনে একদম মুসকানের কাছে চলে গেলো। চমকে ওঠলো মুসকান৷ ইমন তার প্লেট বা’হাতে ওঠিয়ে তার দিকে আরো একটু চেপে বসে ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলো। পা থেকে মাথা অবদি অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো মুসকানের টলমল দৃষ্টি’তে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো ইমনের শুভ্র মুখপানে। ইমন শান্ত গলায় বললো,

” খেয়ে নিন ম্যাডাম ইমন চৌধুরী’র হাতে খাবার খাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। ”

নিঃশ্বাস ঘন হয়ে গেলো মুসকানের। বক্ষঃস্থলের তীব্র কম্পন সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেললো। ইমন বিরক্ত হয়ে মৃদু ধমক দিয়ে বললো,

” সমস্যা কি তোর? বেশী বেশী হচ্ছে না… আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিস না, আমার ওপর রাগ হবে, অভিমান হবে বলে এই না তুই একদল ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবি, তাদের সঙ্গে মদের আসর বসাবি। এতটুকু সহ্য করবো যদি ভেবে থাকিস খুব বড়ো ভুল হয়ে যাবে। আমি এতোটাও ভালো বা এতোটাও ধৈর্য্যশীল নই। মাথা গরম করাবিনা খাবারটা খেয়ে নে আর আমাকেও শান্ত থাকতে দে। নয়তো যা সব করে বেড়াচ্ছিস এতে এতোক্ষণে আধমরা হয়ে হসপিটাল বেডে থাকার কথা ছিলো! ”

শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নত করে ফেললো মুসকান। ইমন খাবারটা একদম মুখের কাছে ধরতেই অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হা করলো সে। ইমন খাবার তুলে দিয়ে এক আঙুলে মুসকানের ওষ্ঠজোড়া চেপে দিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভয়ে ভয়ে কিছুক্ষণ খাবার টা চিবালেও গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। ইমন বুঝতে পারতেই গ্লাস এগিয়ে ধরে দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” পানি দিয়ে গিল।”

বুকটা ধক করে ওঠলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে গ্লাস নিয়ে পানি দিয়ে খাবার গিললো। এভাবে প্রায় পুরো খাবারটাই গেলালো ইমন। তারপর বললো,

” আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়। ”

মুসকান আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না৷ আর না এক মূহুর্তের জন্য সেখানে দাঁড়ালো। এক আকাশ সমান অভিমান নিয়েই উপরে ওঠে গেলো। ইমনও গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত ধুয়ে উপরে চলে গেলো।
.
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে মুসকান। ইমন আলাদা রুমে ঘুমাতে চাইলেও যদি মুসকান একা রুমে ভয় পায় তাই ভেবে রুমে এসেছে। কারণ মুসকান সম্পর্কে বেশ ভালো ভাবেই অবগত সে৷ প্রচুর ভীতু এই মেয়ে। ছোট থেকেই ভূতে ভয় তার। বড়ো হওয়ার পর বুঝেছে ভূত বলে কিছু নেই তবু রাতের আঁধারে একা একা কোথাও থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। নিজ বাড়িতে রুমে একা থাকলেও সারারাত লাইট অন রাখতে হয়। মাঝরাতে কখনো মুরাদ কখনো মরিয়ম আক্তার,কখনো বা রিমি গিয়ে তাকে দেখে আসে। তাই আলাদা বাড়িতে ভয় পাবে এটা একেবারেই নিশ্চিত। সব কিছু বিবেচনা করেই ইমন রুমে ফিরে আসে সিদ্ধান্ত নেয় সোফায়ই শুয়ে পড়বে। যদিও পুরুষ মানুষ ভালোবাসার মানুষ’টিকে এতো কাছে পেয়ে মনের ভিতর অবাধ্য অনুভূতি গুলো যুদ্ধ শুরু করবে তবুও নিজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা তার রয়েছে। এতোগুলো বছর যখন একটা দিনের জন্যও নারী সঙ্গের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। একত্রিশ বছর বয়সী প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হয়েও, এতো টাকা পয়সা ক্ষমতাধীন হয়েও নিজের পুরুষত্বে কালী মাখায়নি। এমন স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষ হয়ে আজ এটুকুতেই দূর্বল হয়ে পড়বে? তাচ্ছিল্য হেসেই রুমে ঢুকে ইমন। দেখতে পায় দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছে মুসকান। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে এগিয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে,

” ঘুমাতে বলেছি আমি। ”

” আমার এভাবে ঘুম আসেনা। পারছি না ঘুমাতে। ”

তখনি ইমনের মনে পড়ে যায় মুসকান স্লিপিং পিল ছাড়া ঘুমাতে পারে না। কিন্তু এখন তো সে এসে গেছে তার থেকে বড়ো মেডিসিন আর কি হতে পারে? কোন কিছু না ভেবে বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে বসে মুসকানকে স্পর্শ করলো ইমন। বিনিময়ে মুসকান এমন একটা ভাব করে সরে গেলো যেনো ইমন তার ইজ্জত হরণ করার জন্য স্পর্শ করেছে। মেজাজটা খিঁচে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো ইমন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

” বাংলাদেশে একত্রিশ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষ বহু সংখ্যক পাওয়া যেতে পারে কিন্তু একত্রিশ বছর বয়সী অতি সুদর্শন ভার্জিন পুরুষ বোধহয় আমি ব্যতিত একটাও পাওয়া যাবে না। তাই ঢং না ধরে শুয়ে পড় ঘুম কি করে না আসে তাই দেখবো আমি। ”

সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে কান গরম হয়ে গেলো মুসকানের। লজ্জায় চোখ,মুখ খিঁচে বিছানার চাদর খামচে বসে রইলো। ইমন হাবভাব দেখে বিরবির করে বললো,

” শালার কপাল ঐ দেশের ললনাগুলো রাত দিন বিকিনি পড়া অবস্থায় গায়ের ওপর ঢলে পরে আর এই ভদ্রমহিলা ভদ্র প্রস্তাবেও মূর্ছা ধরে!”

বিরবির করে কথাগুলো বললেও মুসকান ঠিক শুনতে পেলো। তাই অভিমানে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

” রাত দিন বিদেশী মহিলা’দের সঙ্গে থাকতে? ”

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ফেললো ইমন। লাল টকটকে ওষ্ঠজোড়ার নিম্নস্থানে কামড়ে ঈষৎ হেসে বললো,

” শুয়ে পড় মুসু আমি মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি ঘুমাতে সাহায্য হবে। ”

মুসকান চুপচাপ ভঙ্গিতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো। ইমন আধশোয়া হয়ে তার পাশে বসে মুসকানের মাথা থেকে তয়ালে খুলে ফেললো। তারপর মুসকান’কে ইশারা করলো চোখ বুজতে। কারণ সে মুসকান কে প্রাণ ভরে দেখতে চায় সেই সাথে গল্প করতে চায় তার প্রতিটি নির্ঘুম রাতের কথাগুলো। তার বিদেশী জীবনযাপনের পুরোটা জুড়েই যে সে ছিলো তাই জানাতে চায়। অত্যন্ত আদুরে স্পর্শে মুসকানের মাথায় চার আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে গল্প করতে শুরু করে ইমন। সে গল্পের এক পর্যায়ে মুসকান জানতে পারে তাদের বিয়ের সমস্ত শপিং কমপ্লিট আর সেসব ইমন নিজ হাতেই করেছে। বিয়ে, বিয়ের পরবর্তী বছরগুলো কেমন কাটবে সমস্ত প্ল্যান করা শেষ৷ সব কিছুই গোছানো হয়েছে কেবল মাত্র পাত্র পাত্রীর তিন কবুল বলা বাকি।

মাথায় বিলি কেটে দেওয়াতে খুব আরাম পেলো মুসকান৷ সেই সাথে ইমনের আদুরে স্পর্শ, মনোমুগ্ধকর কন্ঠে বলা তার তিনটে বছরের জীবনী শুনতে শুনতে আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে নিশ্চিন্ত মনে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো বুঝতেও পারলো না৷ ইমন যখন বুঝতে পারলো তার অভিমানী পাগলীটা ঘুমিয়ে গেছে তখন গল্প বলা থামিয়ে দিলো। দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো তার মুগ্ধময়ীর পানে। সেভাবে ঠিক কতোটা সময় পার করে দিলো জানা নেই ইমনের। কিন্তু যখন চারদিকে আজান ধ্বনি ভেসে আসলো চমকে ওঠে আচমকাই হেসে ফেললো সে। চোখ বুজে রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মুসকানের কপালে ভালোবাসাময় কিছু স্পর্শ লেপ্টে দিয়ে ওঠে গেলো। সোফায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে বিরবির করে বললো,

” নেশা টা ঠিক কে করেছিলো? নেশা করলো সে আর নেশা ধরে গেলো আমার! ”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here