#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৪৩
নধরকান্তি সবুজ ঘাসের বুকে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে ভ্যালবেটের কৃষ্ণাভ চুড়িগুলো। ভাঙে নি একটাও। পা টা মাড়িয়ে জুতার তলানিতে ঠাঁই দিল তাদের লম্বাটে এক পুরুষ। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার চকচকে একটি নোট বের করে বাড়িয়ে দেয় প্রবীণ দোকানির দিক। টাকাটা হাতে নিতে ধানাইপানাই করল বৃদ্ধ, নিতে তাঁর ভীষণ দ্বিধা। নিশাতের রোগাটে দেহ নিজের বক্ষস্থলে বেঁধে রেখে বলল সেই পুরুষ,
” আপনার কর্কশ কণ্ঠে মিথ্যা শুনে ভয় পেয়েছে আমার বউ। চুড়ি একটাও ভাঙে নি,সবে নষ্ট করলাম আমি৷ ক্ষতি না করে জরিমানা দেওয়া যায় না,তাই করেই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি,নিয়ে নিন। ”
সামনের মানুষকে দেখে মুখের রং উড়ে গেল দোকানীর,কুঁচকানো চামড়া হয়ে যায় বিবর্ণ। চিনতে পেরে আমতা আমতা করে,”ঘাসের ওপর পড়লে কি ভাঙে নাকি? কথার কথা কইয়া লাইছি। টেহা দিওন লাগব না স্যার। আপনের আব্বার বদৌলতেই প্রতি বৎসর মেলায় দোকান দিতে পারি। এই মাইয়্যা যে আপনের বউ এইডা জানতাম না। ”
নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে প্রহরকে দেখল। মানুষটা শুকিয়ে গেছে খুব। চোখ দুটি কোটরাগত। ঠোঁট কালচে,চোয়াল শক্ত। উজ্জ্বল শ্যামলা রংটা প্রায় মলিন হয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের সময় থেকে এমপি হবার সময়টুকু পর্যন্ত নিজের প্রতি চরম অবহেলার দরুন এমনতর দশা বুঝতে বাকি থাকল না ওর। পুতুলের ন্যায় মিশে রইল বুকে। মেলার উৎসুক জনতা ওদেরই দেখছে। সবার উত্তেজনাপূর্ন দৃষ্টি জুড়ে এখন পুলিশ,বডিগার্ড, আর নেতা প্রহর এজায। নিশাত তার বউ এটা নিয়ে কানাঘুঁষা চলছে রীতিমতো। বুঝা গেল গ্রামের খবর উপজেলা অবধি আসে নি। মন্ত্রী বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হলো অথচ কেউই জানে না। অস্পষ্ট কানে আসছে কথাগুলো প্রহরের। নিশাতের মলিন মুখের দিকে চেয়ে দোকানিকে প্রশ্ন করে, ” ঝুড়ি আছে আপনাদের? থাকলে বিশ ডজন চুড়ি প্যাক করে দিন। তোর কোনগুলি পছন্দ নিশু? হাত দিয়ে দেখিয়ে দে। ”
নিশাত কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত চুড়ি দিয়ে কী করবে সে? শখের বশে ধরেই কেমন ফ্যাসাদে জড়িয়ে গেল।
” চুড়ি লাগবে না আমার। ”
ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল সে। প্রহর বক্ষবাঁধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,” কেন লাগবে না? মেলায় এসেছিস কেন তাহলে? অবশ্যই নিতে হবে তোর। শিমুল আর তোর ভাই কই? ড্রাইভার কাকা বলল তারা সহ আসছে। ”
নিশাত অবিন্যস্ত চোখে আশেপাশে তাকায়। কোথাও নেই দুজনে। গেল কোথায়! সে ভেবেছিল ওর সাথেই বোধহয় আছে,চুড়ি দেখায় এতই মত্ত ছিল যে ওদের ভুলেই বসেছিল। মিনমিন করে বলে,” আছে হয়ত এদিকেই। ”
প্রহর বাঁকা হেসে বলে,” চুড়ি দেখ তুই। শ্রদ্ধেয় মামুজানের আরেকটা হা**র্ট অ্যাটা**কের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ”
নিশাতের চমকিত কণ্ঠস্বর,” আব্বা হা**র্ট অ্যা**টাক করবে কেন?”
” তোর ভাইয়ের জন্য। ”
” ভাইয়া কী করেছে?”
” সময় এলে বুঝবি। চুড়ি চয়েজ কর।”
নিশাত লাল, সবুজ,সোনালি রঙের তিন ডজন চুড়ি দেখিয়ে বলল, ” এগুলোই নেবো। ”
প্রহর চোখ জোড়া সংকুচিত করে চাইল। তেজী গলা,” তোর জামাই কি কিপ্টে না-কি? কয়টা বাচ্চা আছে তোর যে তাদের ভরনপোষণর কথা ভেবে কিপ্টামি করছিস? সদ্য ম্যাট্রিক দেওয়া মেয়েদের এত হিসেবি হতে হয় না। মামুজানের অভ্যাস ছাড়। একমাত্র মেয়েকে অনুষ্ঠান করে তুলে দিতে পারবে না, সেকারণে ইন্টারের পর শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর অজুহাত দেখায়। ততদিনে মানুষজন অনুষ্ঠানের কথা ভুলে যাবে সেটা ভালো করে জানেন উনি। কেন রে? আমি কি বাঘ? খেয়ে ফেলব তোকে? মামুজান এমন বিহেভ করছে যেন তুই তুলতুলে কেক আর আমি রা””ক্ষস। ঠিকি আমার শ***ত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছিল। তখন কই ছিল এমন অজুহাত? যত কিপ্টেমি,শয়**তানি বুদ্ধি আমার বেলায়।
নিশাত কথার দাপটে বাধ্য হয়ে বলে,” সব চুড়ি নেবো,সব নিয়ে দিন। ”
প্রহর ওর হাত টেনে নেয় মুখের সামনে। ফর্সা হাতে সোনালি রঙা কয়েকটা চুড়ি পরিয়ে বলে,” এখন একদম প্রহরের বউয়ের মতো কথা বলেছিস সুইটহার্ট। ”
শিমুল দিশেহারা হয়ে খপ করে কা**মড় বসিয়ে দিল সৌরভের হাতে। সৌরভ হতভম্ব। ক্যাটকেটে স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ” কা**মড় কেন দিলি পাগলের জাত? ”
মাথায় রক্ত চাপল শিমুলের। ক্রোধান্বিত গলায় বলল,” আমি পাগ**লের জাত? আপনার সাহস কেমনে হয় আমারে টাইনা আনার?”
মেলার মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ঝিল আছে। তাতে অসংখ্য কচুরিপানার রাজত্ব। ঝিলের কোল ঘেঁষে চার-পাঁচটে ফুচকা,চটপটির দোকান বসেছে। দোকানগুলোতে মানুষের দুর্দান্ত হট্টগোল। সৌরভ অল্প দূরত্ব বজায় রেখে প্রচন্ড নরম কণ্ঠে শুধায়,” পা**গল হবি কেন? তুই হলি শরতের সকালের সুরভিত শিমুল ফুল। ”
শিমুল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। বলল,” ঢং কইরা শিমুল ফুল ডাকা লাগবে না। কী বলতে আনছেন, সেটা বলেন সৌরভ ভাই।”
” ব্লক খুলে দে,কলে কথা বলব তোর সাথে। ”
” আমার সাথে কেন কথা বলবেন?”
” সবসময় যে কারণে বলি। ”
” কোন কারণে বলেন?”
সৌরভ এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিম্নস্বরে বলে,” কোন কারণে বলি জানিস না?”
শিমুল অভিমান ভরপুর গলায় জবাব দিল,” না। আপনের সাথে আমার কোনো কথা নেই। ”
সৌরভ অসহায় চোখে চেয়ে বলে,” অনেক কথা আছে। একটু শোন।”
মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল শিমুল। হৃদয় সমুদ্রে উথালপাতাল ঢেউ উঠছে। কত আর অনুভূতি বুঝে চলবে মন? অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ না হলে কীভাবে এক হবে দুজনের পথ? ভবিতব্য পরিকল্পনা করার পূর্বে সম্পর্ক স্পষ্ট করা খুবই প্রয়োজন।
” জলদি বলেন। নিশুরে ফেলে আসছি,ফিরে যেতে হইব। ”
সৌরভের পুরুষালী কণ্ঠটা সমস্তা জড়তা,আশঙ্কাকে ঝেরে ফেলে দিয়ে পুরো শক্ত হয়ে বলল,
” তোকে গ্রহণ করলে আব্বা আমাকে নিঃসন্দেহে ত্যাজ্য করবেন। ভয় পাই না আর। তোকে চাইলে ফুপা-ফুপু, তোর দুই ভাই কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?”
শিমুলের ভেতর কেবল ‘ভালোবাসি’ শব্দখানা শোনার আশায় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গিয়েছে। অথচ সৌরভের মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে অন্যকিছু।
” আপনি কেন চাইবেন আমাকে?”
” ভালোবাসি বলে। ভালোবাসার মানুষকে চাইতে হয়,আগলে রাখতে হয়,নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করার বন্দোবস্ত করতে হয়। ”
সৌরভের সরল সোজা স্বীকারোক্তি শিমুলের মনের বাঁধ প্রবল জোয়ারে হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অতল গহ্বরে, যেমন করে ভয়ংকর জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের বালির বাঁধ। ধ্বক করে উঠল বুকটা। সময় থমকে গেল,আশাপাশ অচেনা রূপ ধারণ করল,অদ্ভুত অজানা অনুভূতিতে মুখরিত হয়ে গেল হৃদয় ভূমি। অভিমান, জেদের সমাপ্তি ঘটিয়ে একরাশ লজ্জারা হামলা চালায় শিমুলের অভ্যন্তরে। সৌরভ স্মিত হেসে বলল,
” আইডিয়া দে। কীভাবে বললে তোর পরিবার রাজি হবে? আপাতত শুধু রাজি করিয়ে রাখব,বিয়ে তুই আরেকটু বড় হলেই করব। ”
শিমুল একটু বুদ্ধি করে বলল,” নিশুকে বেঁধে রাখলে ভাইয়া রাজি হয়ে যাবে। ”
চোখ বড়সড় করে তাকাল সৌরভ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” তখন এগারো কি বারো বছরের ছিলাম। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে। তোর ভাই ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছিল একদিকে,আর আমরা হ্যান্ডবল। ক্রিকেট বল এসে আমাদের সাথের একজনের বুকে পড়ল। সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বল ফেরত দেবো না,স্যার বিচার করবেন,তারপর দেবো। কারণ স্যার বার বার করে বলেছে আগে হ্যান্ডবল চর্চা হবে তারপর ক্রিকেট। কিন্তু তোর ভাই সবসময় নিজেকে ওস্তাদ মনে করত। বল দেবো না বলে অসম্মতি জানালে সে সবার সামনে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আমার পায়ে আঘা**ত করে বসে। ব্যথায় টানা সাত দিন কাতরেছি আমি। সামান্য বলের জন্য এমন করেছে,বউ না দিলে আমাকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে শিউর থাক। গু**ন্ডা ছেলেরা কারো পরোয়া করে না। ”
” আপনি আবার আমার ভাইকে নিয়ে নিন্দা করছেন। ”
সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে উঠল শিমুল। সৌরভ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,” প্রশংসা করছি। অনেক সাহসী তোর ভাই। নইলে এমপি হওয়া এত সোজা? সাহসের অভাবে আমরা হতে পারলাম না। সে সাহসী পুরুষ বলেই হতে পেরেছে। ”
সৌরভ,শিমুলের অপেক্ষায় গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকল নিশাত। আগ্রহী দৃষ্টি ওদের খুঁজে চলেছে। অকস্মাৎ দুজনের লাপাত্তার ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও। পাশ থেকে ভরাট কণ্ঠের প্রশ্ন এলো,” তোর ভাই প্রেম করে?”
হতবাক সে। বিস্ফোরিত নয়নে প্রহরের দিক তাকায়। প্রেম! পিংকির সাথে করত। কিন্তু এখন এমন প্রশ্ন কেন করছে প্রহর! মিনমিন করে উত্তর দেয়,” না। ”
ওইসময় সৌরভ, শিমুল হাজির হলো। পেছনে বডিগার্ড। প্রহর খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিল। ভাইকে দেখে বুক ধড়ফড় করে উঠল শিমুলের। চোরা নজরে চেয়ে নিশাতের দিকে এগিয়ে গেল। সৌরভ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বোন জামাইকে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছিস?”
প্রহর ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি এঁকে জবাব দেয়, ” ভালো। কোথায় গিয়েছিলি তোরা?”
শিমুলের মুখশ্রী ফ্যাকাসে হয়ে গেল ভয়ের তোপে। ভাইয়ের গভীর চাহনিতে ধরা না পড়ে যায়! সৌরভ সামলে নিল।
নির্বিকার অভিব্যক্তিতে জানান দিল,” শিমুল ওয়াশরুমে যাবে বলল, নিয়ে গেলাম। ”
চারটে গাড়ি রাস্তার ধুলোবালি উড়িয়ে উপজেলা ছেড়ে গ্রামের পথে নামল। মজুমদার বাড়ির সামনে ব্রেক কষে থেমে যায় সবকটা ইঞ্জিন। রোকেয়া গেইট খুলে বেরিয়ে এলেন গাড়ির শব্দ পেয়ে। বিয়ের পর মেয়ের জামাই একমুহূর্তের জন্য আসে নি। সৌরভ গাড়িতে ফোন দিয়ে বলেছিল প্রহর এসেছে, সেই অনুযায়ী হরেক পদের রান্না শুরু করলেন। গাড়ি থেকে নেমে রোকেয়াকে সালাম দেয় প্রহর। আসার সময় প্ল্যান করেই এসেছিল আজ প্রথমে শ্বশুর বাড়িতে যাবে। শ্বশুরের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া আছে তার। সেই মোতাবেক মিষ্টি, ফলফলাদি নিয়ে হাজির বাড়িতে। প্রহর রোকেয়ার সাথে বাড়িতে প্রবেশ করে। নিশাত, শিমুল গুটি গুটি পায়ে আগায় পেছন পেছন। পিংকির মা শরবতের গ্লাস এনে হাসিমুখে বলে,” শরবত খা বাবা। ”
প্রহর হাতে তুলে নেয়,” ধন্যবাদ মেঝো মামী। পিংকি আসে না?”
” না। ও পোয়াতি। জার্নি করলে সমস্যা হই যদি এইজন্য কারিম আসতে দেয় না। ”
” বাহ! এটুকু বয়সে কি সুন্দর ঘর-সংসার করছে,স্বামীর বাধ্য হয়ে চলছে। অনেক মেয়েরা এ বয়সে বিয়ে বসলে সংসারের প্রতি অনীহা করে,অবুঝ সেজে থাকে। পিংকিকে আমার বেস্ট ঘরণী এওয়ার্ড দিতে ইচ্ছে করছে মামী। ”
পিংকির মা হেসে পা বাড়ালেন রান্না ঘরের দিকে। নিশাত বুঝল খোঁচার তীর তার দিকেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। সে সংসার করতে অনীহা করে নি৷ আব্বার কথারও নাকচ করতে পারছে না। তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছে। তবুও বিয়েটা মেনে নিয়েছেন উনি। শেষে একটা আবদার করেছে ইন্টার শেষ করলে প্রহরের হাতে তুলে দেবে,এতে কীভাবে না করা যায়?
রোকেয়া এসে ওকে স্কুল ড্রেস পাল্টে নিতে বলল। প্রহর তাঁর কাছে জানতে চায়,” মামুজান কোথায়? কিছু কথা আছে উনার সাথে। ”
রোকেয়া চিন্তিত হয়ে প্রতুত্তর করে,” ঘরে আছে। কী বলবি?”
” কথা বলে এসে জানাচ্ছি তোমাকে। ”
ঘরে বসে বাজার থেকে আনা পত্রিকা পড়ছিলেন রফিক আজম। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকিয়ে মেজাজ সপ্তমে পৌঁছে গেল। থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলেন,” কীজন্য এসেছ?”
” শ্বশুর বাড়িতে আসব না? নানার বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ ছিল,শ্বশুর বাড়িতে আসাও কি নিষিদ্ধ? ”
প্রহর চেয়ার টেনে বসল। গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ” ইম্পরট্যান্ট কথা আছে বলে আপনার ঘরে এসেছি মামুজান, বিয়ের দিন নির্বাচনের চিন্তায় বলা হয় নি। ”
রফিক আজমের কপালে কুঞ্চিত রেখার দেখা মিলল। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন,” কী কথা?”
প্রহর বেকায়দায় হেসে সাফ সাফ বলল,” যৌতুকের কথা। আপনার একমাত্র মেয়ে,মেয়ের জামাইকে যৌতুক দেবেন না? যৌতুক হিসেবে আমার এটা চাই। ”
প্রহরের বাড়ানো কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখলেন তিনি। তেতে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, ” এই উদ্দেশ্যে নিশাতকে বিয়ে করেছ তুমি তাই না? আমি আগেই জানতাম এমন কিছুই হবে। এজন্যই বাড়িতে আসতে দিতাম না তোমাদের। বেয়াদ**বদের পা এই বাড়িতে পড়ুক কখনোই চাই নি। ”
” আমি চাইলে আপনাকে নিঃশেষ করে দিতে পারি। রবিন মামা রাজি। আপনাকে বদনাম করার উদ্দেশ্য আমার নেই। আপনি পা**প করেছেন,মিথ্যা বদনাম রটিয়েছেন,আপনাদের ধ্বংস করা আমার জন্য মশা মা””রার মতো। কিন্তু সম্মান রক্ষার্থে আমি এমন কিছুই করি নি। গ্রামে লোকজন ডাকিয়ে সুন্দর করে ব্যাপারটা আগামীকাল মিমাংসা করবেন। আমি নিজের মতো করে আমার চাওয়া হাসিল করতে গেলে আপনার সম্মান দাফন হয়ে যাবে চিরতরে। আর নিশুকে বিয়ে করার আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল এবং আছে তা হলো,ভালোবাসা। ”
” তুমি যা চাইছো এরকম করব না। যুগ যুগ আগের ভেজাল কেন টেনে আনব আমি?”
” দম্ভ,হিংসা এসব বহন করে ধ্বংস ব্যতীত কিছুই পাবেন না। আপনি আমাদের অপছন্দ করেন বলেই হয়ত সৃষ্টিকর্তা আমাকে আপনার মেয়ের সাথে বেঁধে দিয়েছে, নতুন সম্পর্কও বাঁধতে চলেছে। আগামীকাল আপনার, আমাদের সম্মানের নতুন পথ তৈরি হবে আর নয়তো অধঃপতন হবে আপনার অহংকারের। গেট রেডি ডিয়ার মামুজান। ”
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল প্রহর। রফিক আজম কাগজটা নিয়ে বসে রইলেন দুশ্চিন্তায়। আগে আঁচ করতে পেরেছিলেন প্রহর গর্ত খুঁড়ে কেঁচো বের করার ছেলে। নিজের ফুপুর বিষয়টা দামাচাপা দিয়ে বিনা দোষে অন্যায় মাথায় নিয়ে থাকার পাত্র না সে।
শীতের আমেজ প্রায় শেষ। গ্রীষ্ম সদ্য জন্মেছে, খেলা করছে প্রকৃতির কোল জুড়ে। ঊষা বুনোফুলগুলো ছুঁয়ে দেখছে। প্রত্যয় হলদেটে একটা ফুল ছিড়ে নিয়ে তার কানের পাশে গুঁজে দেয়,তাকায় প্রগাঢ় দৃষ্টিতে। এই মুখ সে প্রতিদিন দেখতে পায় না,দেখার সৌভাগ্য হয় না। দূরত্ব আজও শেষ করে নি ঊষা। গ্রাম থেকে ফিরে এসে পুনরায় চলে যায় সে মেডিক্যাল হলে। গুঞ্জন কি-না জানে না তবে শুনেছে লন্ডনে চলে যাবে ঊষা। আজ নিজেই ফোন করে ঢাকা থেকে বাইরে নির্জন পরিবেশে ডাক পাঠিয়েছে তাকে।
” তোমাকে কেন ডেকেছি জানো,ভাইয়া?”
” জানব কীভাবে? বলিস নি। শাড়ি পরেছিস কেন? অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে। ”
” তোমার জন্যই পরেছি। তুমি আমার বর না? বউ মানুষ আমি,বরের জন্যই তো শাড়ি পরব। ”
প্রত্যয় ঊষার নরম গালে শক্ত হাত রাখে পরম আদর মাখিয়ে। টলমলে ভাসা ভাসা চোখে চোখ ডুবিয়ে বলে,” তোর মধুময় কথা আমার হজম হচ্ছে না ভোরের পাখি। দূরত্ব আরও বাড়াবি বলেই কি প্রেম দেখাচ্ছিস,মায়া দেখিয়ে দেহের মৃ**ত্যু ঘটাতে চাইছিস? আমার পা**পের শাস্তি হয়ে গেছে, তোকে ছাড়া পল-অনুপল ধুঁকে ধুঁকে ম–রে আমার মন। দেহটুকু বেঁচে আছে তোর পথ চেয়ে। হররোজ স্বপ্ন দেখি আমাদের ঘরে নতুন আরেক ভোরের পাখি জন্ম নিয়েছে। আমার স্বপ্নটা বাস্তব করে দে ঊষা। আমি মৃন্ময়ীর কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম,পাই নি তাকে। ”
ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করার মতো কঠিন কাজ আর কিছু নেই। যারা অবহেলা করে নির্ঘাৎ মূর্খ সে। ঊষা অবোধ, মূর্খ হতে চেয়েছে। ভাগ্যের ওপর অভিমান করেছে। মৃন্ময়ীর বিদায়কালীন দুটো বাক্য খান খান করে ভেঙে দিয়েছে তার রাগ,অভিমান, কষ্টের মজবুত প্রাচীর। এতদিন যাবত প্রত্যয়কে দূরে ঠেলে দেওয়া তার অন্যায় ছিল? মোটেও না। বরং দূরত্বের দেয়াল না তৈরি করলে সে নিজের করা অন্যায়,পাপ উপলব্ধি করতে পারত না, মনে অনুশোচনা জন্মানোর বদলে সেগুলো চাপা পড়ে থাকত। কৈশোর থেকে যৌবনে আসার সময়টাতে সঠিক পথে থাকাটা চাঁদ ছুঁতে পারার মতো দুরূহ বিষয়। প্রত্যয়ের জেদ, অবাধ্য চাওয়া মৃন্ময়ী, ঊষাকে নিপতিত করেছিল অন্ধকারে। কষ্ট পেয়ে যতই দূরে থাকুক ঊষা, প্রত্যয়ের জন্য ভালোবাসা কমে নি এক চিমটি। বরঞ্চ ভয়াবহভাবে বেড়েই চলছিল। প্রত্যয়ের খরখরে গালে হাত রাখে ও। চাউনি স্থির, গভীর। অস্ফুটস্বরে বলে,
” তুমি কি তোমার ভোরের পাখিকে আর কষ্ট দেবে ভাইয়া?”
হ্যাঁচকা টানে ঊষাকে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে নেয় প্রত্যয়। গালে গাল ছুঁয়ে কর্ণকুহরে বাতাসে মতো ফিসফিস করে বলল,” যতবেশি ভালোবাসলে তুই হাসিখুশি থাকবি,তার থেকে দ্বিগুণ ভালোবাসব তোকে ঊষা। তুই শুধু রাতের সমাপ্তিতে ভোরের পাখি হয়ে নেমে আসিস আমার বুকে,মিশে থাকিস প্রয়াণকালেও আমার সাথে। ”
” মৃন্ময়ী চলে গেছে, হারিয়ে গেছে বহুদূরে। ক্ষমা করে দিয়েছে সে তোমাকে। শূন্য হাতে এ শহরে এসেছিল, শূন্য হাতেই ফিরে গিয়েছে। ভাগ্য চরম বেই–মানী করেছে তার সাথে। ”
#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প প্রায় শেষের পথে। মৃন্ময়ীর রহস্য ব্যতীত কোনো অংশ খোলাসা না হলে আমাকে কমেন্টে জানাবেন। গল্পের ওপর মন্তব্য করবেন জোরালো। খারাপ লিখলেও বলবেন,ভালো লিখলেও। নয়ত কীভাবে বুঝব কেমন লিখছি? গল্পটার ওপর দিয়ে অনেক তুফান গেল,লেখার তাল হারালাম, রাইটিং ব্লকে পড়লাম,আরও কত কি। অবশেষে আপনাদের ভালোবাসা না দিয়ে থাকা যায়? ভালোবাসা অবিরাম।)