কে! ,পর্ব:৯+১০

0
3372

#কে!!

#৯ম_পর্ব

 

নীতি যখন সাগরের উত্তাল দেখতে ব্যাস্ত তখন অনুভূত হলো কেউ তার চোখ পেছন থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা-মা এই কাজটা করবে না। লোকটির স্পর্শ চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। তখন লোকটি তার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– বলোতো আমি কে?

 

কন্ঠটা নীতির খুব পরিচিত। মনের অজান্তেই কন্ঠটা শুনে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। চোখে হাতের বাধন খুলতে খুলতে বলে উঠলো,

– আপনি এখানে? জানলেন কিভাবে আমি এখানে আসবো?

 

লোকটা আর কেউ নয় স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধকে দেখে বেশ অবাক হয় নীতি। তাকে এখানে দেখবে কল্পনা করে নি নীতি। কিন্তু ভালোও লাগছে, লোকটাকে দেখতে আজকাল খুব ভালো লাগে নীতির। মনের গহীনে অজান্তেই লোকটাকে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। সেটা হয়তো নিজেও বুঝে নি। কেনো, কখন, কবে এই লোকটা তার অন্তরালকে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলেছে এটার উত্তর খোজাটা নীতির পক্ষে অসম্ভন। অবাক নয়নে আবারো স্নিগ্ধকে জিজ্ঞেস করে,

– বললেন না যে আপনি এখানে কি করছেন?

– ট্যুরে এসেছি। বন্ধুদের সাথে প্লান হলো তাই চলে এসেছি। তোমাকে এখানে দেখবো এটা যেনো সোনায় সোহাগা আমার জন্য।

– তাই বুঝি?

– হুম। এই দেখো না নীল সাগরের পাশে নীলাঞ্জনাকে কাছে পাওয়াটা সোনায় সোহাগা নয় কি?

– ফ্লার্ট করছেন?

– উহু, আমি ফ্লার্ট করতে পারি না। তোমার মনে হয় এগুণটা থাকলে আমার আজ সিংগেল থাকতে হতো?

 

স্নিগ্ধ এর কথাটা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নীতি। এই লোকটার সাথে থাকলে নীতির মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। হাসি থামিয়ে নীতি বললো,

– আপনার কখনোই কোনো গার্লফ্রেন্ড হয় নি এটা আমাকে মানতে হবে?

– মানা না মানা একান্ত তোমার ব্যাপার৷ এটা ভুল হবে বললে যে তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। এর আগেও আমি প্রেমে পড়েছি। তবে রিলেশনে যাওয়াটা হয় নি। আমি তো ফ্লার্ট করতে পারি নি। আমি যখনই কাউকে নিজের অন্তঃসত্তাকে উজার করে দেখাতে চাই তখন সে আমাকে একা ফেলে চলে যায়। খোলশ পরিহিত মানুষকে মানুষ খুব ভালোবাসে। কেউ ভেতরের মানুষটাকে ভালোবাসে না। আচ্ছা নীতি আমার কি ভুল যে আমি ছলনা করতে পারি না!!

 

নীতি চুপ করে স্নিগ্ধ এর সব কথা শুনছিলো। তার চোখের দিকে তাকাতেই কেনো জানে শুন্যতা অনুভূত হলো। যে চোখ তাকে সর্বদা মাতাল করতে ব্যাস্ত আজ সেই চোখে শুন্যতার হাহাকার অনুভূত হচ্ছে। স্নিগ্ধ এর শুন্যতা কোথাও না কোথাও তার হৃদয়েও বিধছে। মলিন হাসি হেসে বললো,

– অনেকেই আছে যারা খোলশকে নয় ভেতরের মানুষকে ভালোবাসে। আপনি হয়তো তেমন মানুষ খুজে পান নি।

– নীতি মুখে বলাটা অনেক কঠিন কিন্তু কাজে করাটা কিন্তু অনেক কঠিন। তুমি আমার সত্যিটা জেনে কখনোই আমাকে ভালোবাসবে না। বরং তোমার যে ভালোলাগাটুকু ছিলো সেটাও নষ্ট হয়ে যাবে।

 

কথাটা বলে সাগরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলো স্নিগ্ধ। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার। চোখের শুন্যতার হাহাকার সাগরের উত্তালতায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নীতি এক মনে তাকে দেখে যাচ্ছে। কোথাও না কোথাও তার শুন্যতার সাথে স্নিগ্ধ এর শুন্যতা মিলে যাচ্ছে। আজ এতোদিনের ভালোথাকার খোলশটা কেনো যেনো খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সব থেকেও কি আদৌ সব আছে তার!!

 

সকাল ১১টা,

বাবা-মার দরজার বাহিরে চিৎকার শুনছে নীতি। ভেতরে অকথ্য ভাষার কিছু কথা কানে আসছে নীতির। আদনান সাহেবের কলার টেনে ফারহানা বেগম বলছেন,

– ওই ****টার সাথে এখনো ফস্টি নস্টি করতে তোমার লজ্জা লাগে না। মেয়ে বড় হয়েছে, কোথায় এখানে মেয়েকে আমরা সঙ্গ দিবো তা না তুমি রয়েছো নিজের রঙ্গলীলা নিয়ে।

– মুখ সামলিয়ে কথা বলো ফারহানা।

– কি মুখ সামলাবো, অস্বীকার করতে পারবে,, ওই রেশমি এখানে আসে নি।

– আজিব তো রেশমি তার পরিবারের সাথে এসেছে। এখানে আমার কি সম্পর্ক?

– আসলেই তোমার কোনো সম্পর্ক নেই? তাহলে এই ছবিটার কি অর্থ বলো?

– তোমার আসলেই মাথায় সমস্যা আছে। একটা মানুষ কি একটা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না।

– ওহহ তাহলে বলছো তুমি তার সাথে শুধু কথাই বলছিলে, আমাকে ভূগোল বুঝাচ্ছো?

– বেশ হ্যা আমি ওর সাথে আমার মনের শখ মিটাতে কথা বলছিলাম। আমি এখন ও ওকেই ভালোবাসি। তোমার তাতে কোনো সমস্যা আছে? তোমার তো আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার নেই। ভুলে যেও না আমাদের স্বামী- স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র নীতির জন্য আমাদের এক সাথে থাকা। ডিভোর্স না হলেও আমি তোমাকে বরদাস্ত করছি শুধু নীতির জন্য।

 

আদনান সাহেবের কথায় ফারহানা বেগম একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। আদনান সাহেব একটি কথাও ভুল বলেন নি। মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে খাটে বসে পড়েন ফারহানা বেগম। নীতি সব শুনছে, বুঝতে পারছে তারা আবারো ঝগড়া করছে। কিন্তু আজ তাদের ঝগড়াটা কিউট রোমান্টিক ঝগড়ার মতো মোটেই মনে হচ্ছে না নীতির কাছে। ভেবেছিলো ভ্যাকেশনে এসে হয়তো শান্তি পাবে সে। কিন্তু হলো কোথায়? এখানেও একই অশান্তি। ভেবেছিলো বাবা-মা হয়তো বদলে যাবে। আবার সেই আগের তিনজনের পরিবার হয়ে যাবে তারা। কিন্তু সব যেনো গোলমেলে হয়ে গেছে। হারিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। কেনো যেনো মিলিয়ে যেতে মন চাচ্ছে সেখানে কেউ তাকে খুজবে না। যেখানে কোনো কষ্ট থাকবে না। চোখ ভিজে এসেছে নীতির। না চাইতেও আবারো কাঁদছে সে। যাদের ইমপোর্টেন্স তার জীবনে এতোবেশি, তাদের জীবনেই কোথাও তার কোনো গুরুত্ব নেই। নিজেকে আজ যেনো নিঃস্ব মনে হচ্ছে। নিজের মাঝেও কোথাও না কোথাও শুন্যতার হাতছানি পাচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকাটা সম্ভব নয় নীতির পক্ষে। ছুটে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ছুটতে ছুটতে হোটেলের সীমানার বাহিরে চলে গিয়েছে সে। নিজের আবেগের তাড়নায় ছুটছে। ছুটতে ছুটতে একটা সময় আশেপাশে তাকালে দেখে, হোটেল থেকে অনেক দূরেই চলে এসেছে সে। চারিপাশের অচেনা মানুষের ভীড়ে নিজেকেই যেনো হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলো নীতি। সামনে নীল সাগরের উত্থাল ঢেউ এর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে মন চাচ্ছিলো। নিজের আনমনেই হাটতে হাটতে কখন যে সাগরের পানির কাছে চলে গিয়েছিলো নিজেরও খেয়াল নেই। একটা ঢেউ এর আছড়ে পানির গভীরে তলিয়ে গেলো নীতি। হয়তো চেষ্টা করলে উঠে যেতে আরে সে। কিন্তু একাকিত্বের প্রভাবে আবেগে হারিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটুকু ও শেষ হয়ে গেছে তার। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে নীতি। হঠাৎ একজোড়া হাত তাকে ঝাপটে ধরে সেখান থেকে উঠিয়ে আনলো।

 

দুপুর ২টা,

জাহাজ এসে তীরে নেমেছে। একটা ব্যাগ কাধে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমেছে নির্ভীক। গন্তব্য নীতির কাছে। নীতিকে নিজের কাছ থেকে হারাতে চায় না সে। এক অজানা ভয় তাকে খেয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেনো একটা খটকা কাজ করছে। হাবীবের ফোনে খটকাটা সন্দেহে পরিণত হয়েছে। কেউ নীতির ক্ষতি করতে চায়। তাকে খুব বাজে ভাবে খুনের দায়ে ফাসিয়ে দিয়েছিলো। এখন যদিও প্রমাণ স্পষ্ট যে, নীতি খুনটি করে নি। কিন্তু প্রমাণের পরিমাণটা অনেক স্ট্রং ছিলো। আফরার কাছ থেকে কথাগুলো শুনার পর নীতির সামনাসামনি হবার প্রবণতা যত বেশি ছিলো। হাবীবের সাথে কথা হবার পর আরো নীতিকে দেখতে চায় সে। নীতির বাবার কাছ থেকে এড্রেস নিয়ে তাদের হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছে সে। হোটেলের কাছাকাছি এসে দেখলো ঝটলা বেধে আছে। ফারহানা বেগম কাঁদছেন। আদনান সাহেব ছুটাছুটি করছেন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে নীতিকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ভীক যে ভয়টা পেয়েছিলো সেইটা ঠিক হলো। তবে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললো নীতিকে সে!! না না নীতিকে খুজে বের করতেই হবে। যেভাবে হোক______

 

রাত ১১টা,

পিটপিট করে চোখ খুলে নীতি। আশেপাশের পরিবেশটা বড্ড অচেনা। কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। মাথায় ব্যাথা হচ্ছে। অসম্ভব ব্যাথা। কোথায় আছে সে? মরে গিয়েছে? নাহ জাহান্নামে তো খাট থাকবে না তাহলে কোথায় আছে সে। হঠাৎ…..

 

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

 

#কে!!

#১০ম_পর্ব

 

হঠাৎ দরজাটা ঠেলে কেউ ভেতরে আসতে দেখলে বেশ ঘাবড়ে যায় নীতি। একেই বেশ ঘেটে আছে, তার উপর অচেনা জায়গা। চোখ মুখ খিচে শুয়ে থাকাটাই বেশি সুবিধার বলে মনে হলো তার। মানুষটা নিঃশব্দে তার কাছাকাছি এসে পড়লে আরো ও ভয়ে শিটিয়ে যায় নীতি। লোকটা মৃদু কন্ঠে বলে,

– এতো ভয়ের কিছু নেই, আমি বাঘ না।

 

কন্ঠটি শুনেই এক লাফে উঠে বসে নীতি। লোকটি স্নিগ্ধ। আচ্ছা এই লোকটাই কেনো তার আশেপাশে থাকে। ব্যাপার টা বেশ খটকা লাগার মতো। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত যে সে বেঁচে আছে। আর স্নিগ্ধ তাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু সে আছে টা কোথায়!! অবাক নয়নে মিনিট পাচেক দেখে মুখ ফসকেই বলে উঠে,

– আমি কোথায়?

– আমার আস্তানায়, কেনো ভয় হচ্ছে?

– ভ….ভয় পাবো কেনো? আমি তো

– মরতে বসেছিলে, আমি না থাকলে তো হয়তো ভেসেই যেতে

– কেনো বাঁচালেন?

 

নির্বিকারভাবেই কথাটা বলে উঠে নীতি। চোখে মুখে গভীর দুঃখের ছাপ ফুটে উঠেছে। একাকিত্ব তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। চাইলেও কেনো জানে নিজেকে আর ভালো রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ডুবন্ত মানুষ নাকি খড়কুটোকেও আঁকড়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু কথাটা হলো নীতি এই খড়কুটো ও খুজে পাচ্ছে না। চোখের কোনে এক বিন্দু শিশির কণা জমতে দেখে স্নিগ্ধ ধীর পায়ে তার কাছে এসে বসে। আলতো হাতে মুখটি তুলে ধরে। নীতির চোখে কোনের বর্ষণ যে তার এক দম সহ্য হয় না। নীতির চোখের পানি তার কাছে রক্তক্ষরণের মতো লাগে। কোমল কন্ঠে বলে,

– তোমাকে কাঁদার ই অধিকার আমি দেই নি। মরার তো দূরের কথা। আমার জীবনকে চোখের সামনে মরতে দেখতে পারবো না আমি। তাই বাঁচালাম। নীতি আমাকে কি এক বার ও ভরসা করা যায় না? আমি তো আছি। কাউকে দরকার নেই আমাদের। না হয় আমি তোমার, তুমি আমার হয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবো।

– স্নিগ্ধ

– হুম?

– আমার ভয় হয়

– কিসের ভয়?

– একা থাকার ভয়।

– আমি থাকতে তুমি কখনো একা থাকবে না। আমি তোমার পিছু কখনোই ছাড়বো না। মরে গেলেও না।

– এতোটা ভালোবাসো?

 

নীতির গলা আটকে আসছে। শব্দ গুলো যেনো সব গলাতেই দলা পেকে আছে। চোখ বারংবার ভিজে আসছে। সব থেকেও একাকিত্বের হাতছানি তাকে অন্ধকারের একটি বেড়াজালে আটকে দিয়েছিলো। স্নিগ্ধ না কাছে একটি খড়কুটোর মতোই। ভালোবাসা পাবার লোভে আজ তার আবেগের যেনো সীমা থাকছে না। স্নিগ্ধ হালকা ম্লান হাসি দিয়ে বললো,

– জানো নীতি, তুমি আমার কাছে অনেকটা যক্ষের ধনের মতো। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি তোমার থেকে একা।

– কেনো আপনার পরিবার?

– নেই, কেউ নেই আমার। জন্মদাত্রী মা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন জানো?

 

কথাগুলো অস্ফুটস্বরে বললেও নীতির হৃদয়ে যেয়ে লাগছে। লোকটার চোখ ছলছল করছে। অশ্রুগুলো জমে বাধের মতো হয়ে আছে। এখনই যেনো চক্ষুজোড়াকে মুক্ত করে ঝড়ে পড়বে। লোকটার বুকের বেদনাগুলো আজ সকল বেড়াভাঙতে চাচ্ছে। নীতির বুকে ও অনুভব হচ্ছে তার কষ্টগুলো। অবাক নয়নে স্নিগ্ধ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নীতি আজ নাহয় অন্য কারোর বেদনার অংশীদার হোক। স্নিগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,

– আমি তোমাদের মতো কোনো পবিত্র সম্পর্কের ফসল নই। কেবল একটা ভূল ছিলাম। অপরিপক্ক বয়েসের অপরিণত ভালোবাসার ফল। যা একজনের কাছে কাম মিটানোর মাধ্যম ছিলো তো অন্যজনের কাছে ভালোবাসার প্রমাণ। আমার জন্মদাত্রী যখন আমার জন্মদাতাকে আমার অস্তিত্বের কথা বলেন তিনি সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তখন কয়েক মাসের ভ্রুণ। যখন তিনি আমাকে নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার জীবনের রিস্ক হবে বিধায় তিনি সেটাও করতে পারেন না। আমি দুনিয়াতে আসি। কিন্তু অবহেলার চরম পর্যায়ে আমার বেড়েউঠা হয়। আমার জন্য তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো বিধায় আমাকে বারংবার মেরে ফেলার চিন্তাও করেন। আচ্ছা নীতি আমার দোষটা কোথায় বলোতো? শেষমেশ আমাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর একা একা আমার বেড়ে উঠা। মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ ব্যাপারটা বয়সের সাথে সাথে আসে। কিন্তু ওই যে আমার আসল পরিচয়। যখন আমার মাতা-পিতার কথা জানতে পারতো আমাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। এর পর মেয়েদের প্রতি এক রকম বিরক্ত জন্ম হয়। আমার রুক্ষ্ণ জীবনে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় তুমি এসেছিলে। তাই তোমাকে হারাতে আমি রাজী নই নীতি।

– বিয়ে করবেন আমাকে?

 

নীতির এমন কথায় চোখ যেনো বিস্ফোরিত রুপ ন্যায় স্নিগ্ধ এর। এমন কিছু নীতি বলবে যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো। অবাক চোখে বললো,

– বুঝে বলেছো তো?

– বলুন না বিয়ে করবেন?

– হ্যা কিন্তু

– এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য, আমি কিন্তু ভেবেই বলছি।

– সত্যি তুমি আমার হবে নীতি? আমাকে কখনো একা ফেলে দিবে না তো?

 

মুচকি হেসে নীতি বলে,

– ডুবন্ত মানুষের কাছে খড়কুটোটাও অনেক বড় জিনিস। আপনি আমার কাছে আর আমি আপনার কাছে অনেকটা পরশ পাথরের মতো। আমি আর ওখানে ফিরে যেতে চাই না স্নিগ্ধ। আমাকে নিজের কাছে রেখে দিবেন?

– তুমি কথা দাও আমাকে ফেলে যাবে না?

– কখনোই না, কথা দিলাম

– যদি আমাকে ছেড়ে যেতে হয় তবে আমাকে মেরে ফেলো। আমি তোমার হাতে মরতেও রাজী থাকবো

 

স্নিগ্ধ এর কথা শুনে নীতি তাকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। স্নিগ্ধ ও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে তাকে। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে তার বাবুইপাখি।

 

সকাল ১১টা,

থানায় বসে রয়েছে নির্ভীক। ফারহানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল। সেন্ট মার্টিনের কোথাও নীতিকে না পেয়ে যেনো দিশেহারা হয়ে যান আদনান সাহেব, নির্ভীক এবং ফারহানা বেগম। ঢাকাতে ফিরেই থানায় রিপোর্ট করেন। কি লাভ হবে জানা নেই তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? নীতির বাবা-মা নিজেদের দোষারোপ করছেন। তার মেয়ের হারিয়ে যাবার পেছনে নিজেদের গাফেলতি বলেই তাদের ধারণা।

– নির্ভীক তুমি এখানে?

 

হাবীবের কন্ঠ পেয়ে নির্ভীক পেছনে ফিরে। একটা কাজের জন্য এই থানায় এসেছিলো হাবীব। নির্ভীককে দেখে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে। কাঁপা গলায় নির্ভীক বলে,

– নীতিকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না হাবীব সাহেব

– কিহ!!!!

 

নির্ভীকের কথায় হাবীব অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছায়। সব কিছু জানতে চাইলে নির্ভীক এতোদিনের সব ঘটনা হাবীব কে জানায়। নীতির রুমের ক্যামেরা, নীতির রুমে কারোর আসার আভাষ সব কিছু। সব শুনে হাবীবের যে খটকাগুলো ওই মার্ডার কেসে ছিলো আজ যেনো সেটা গাঢ় সন্দেহের রুপ নিচ্ছে। তবে কি নীতির কোনো ক্ষতি হতে চলেছে?

 

রাত ৮টা,

স্নিগ্ধ এবং নীতি বিয়ের পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। নীতির মনেই হচ্ছে না তাদের বিয়েটা হুট করে হয়েছে। স্নিগ্ধ প্রতিটি কাজ সুনিপুণ করে করেছে। কমতি ছিলো শুধু তার বাবা-মার, বন্ধুদের। মনে কোথাও যেনো একটা খারাপ লাগাও কাজ করছে। বাবা-মাকে না বলে বিয়েটা কি করা উচিত হয়েছে? কে জানে বুঝে উঠতে পারছে না। বন্ধুদের মাঝে নির্ভীককে আজ বেশ মনে পড়ছে। এতো সুখময় দিনে তাকেই জানানো হয় নি তার। পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে ভাবনার ছেদ ঘটে। মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,

– এভাবে ধীর পায়ে হেটে আমাকে চমকে দেওয়াটা থামান। ভয় লাগে তো।

– আমি আছি তো নাকি

 

মাথায় উষ্ণ পরশ একে দিয়ে স্নিগ্ধ কথাটা বলে। নীতিকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে কানে মুখ লাগিয়ে বলে স্নিগ্ধ,

– তোমাতে হারাতে চাই বাবুইপাখি, অনুমতি আছে?

 

বাবুইপাখি কথাটা খুব পরিচিত লাগছে নীতির কাছে। কিন্তু কথাটা কি স্বপ্নে দেখেছিলো নাকি বাস্তবে সেটা বুঝতে পারছে না।

– কি ভাবছো?

 

চিন্তার ঘনঘটা মাথায় চাপতে থাকলে স্নিগ্ধের কিথাটা তাকে আবারো বিচ্যুত করে চিন্তা থেকে। মুচকি হেসে বলে নীতি,

– তাড়া কিসের আমি তো আছি তাই না?

 

স্নিগ্ধ কিছু বলে না। সে জানে নীতি এখন তার। তাই জোর করার কি মানে!! কিছু সময় নিতে তো অসুবিধা নেই।

 

এক সপ্তাহ পর,

বিয়ের এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখন নীতির সকাল, সন্ধ্যা হয় স্নিগ্ধকে দেখে। একটা অদৃশ্য আকর্ষণ কাজ করে স্নিগ্ধ এর প্রতি। বাসায় এখনো ফোন করে নি নীতি। না জানি বাবা-মা হয়তো পাগলের মতো রাকে খুজছে। কিন্তু তার কাছে ফোন ও নেই। স্নিগ্ধ তাকে ফোন কিনে দেয় নি। আর আগের ফোনটা সেন্ট মার্টিন রেখে এসেছে। স্নিগ্ধ যে কোথায় রেখেছে, জায়গাটা যে কোথায় সেটাও জানে না নীতি। তবুও এখানে এক সপ্তাহ এখানেই আছে সে। একটা সম্বোহনের মতো কাজ করে স্নিগ্ধের সঙ্গ। সব ভুলিয়ে দেয়। স্নিগ্ধ যদিও বাহিরে যাবার আগে নীতিকে আটকে দিয়ে যায়। তাই বাসায় ঘুরা বাদে কোনো কাজ নেই নীতির। আজ সেই কাজ ই করছিলো নীতি, হঠাৎ একটি রুমের দরজা দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয় সে। দরজাটা কিভাবে খুলবে বুঝে পাচ্ছিলো না নীতি। হঠাৎ একটা কাঠের হাতলে হাত লাগতেই খুলে যায় দরজাটা। দরজার ভেতরে ঢুকতেই……….

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here