মায়াবতী কাঞ্চনা পর্ব ৫

0
534

#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৫

রনচন্ডীর রুপ ধরে সোফার উপর বসে আছে কাঞ্চনা।চোখ দিয়ে রাগের চিহ্ন হিসেবে অশ্রু ঝরছে।একপাশে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে সুজন মির্জা। আর কহিনুর রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাপছে।ঝোকের বশে কথাগুলো বলা যে তার ভীষণ অনুচিত হয়েছে তা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে এখন সে বুঝছে।

আমি কি খুব বেশী বোঝা হয়ে গেছিলাম তোমার কাছে?

সুজন মির্জা ছলছল চোখে বোনের দিকে তাকালেন।বোনকে ভালোবেসে আজ ত্রিশ বছরেও নিজের সংসারের কথা ভাবে নি যদি বোনকে ভাইয়ের বউয়ের থেকে অত্যাচারিত হতে হয় সেই ভয়ে।আর এই বোন কি করে এরকম কথা টা বলতে পারলো।

ভাইয়ের নিরবতা পেয়ে কাঞ্চনা পুনরায় বললো-

আমাকে আগেই জানাতে পারতে যে আমি এতটাই কুৎসিত যে কেউ খালি হাতে ঘরে তুলে নেবে না।আমার সঙ্গে পাচ লাখ টাকা দেওয়ার পরেই তারা নিতে রাজি হয়েছে
থেমে,
কি দরকার ছিলো এমনটা করার।বেশী বোঝা হয়ে গেলে আমাকে বললেই পারতে চলে যেতাম।তাই বলে এভাবে অপমান না করলে কি হতো না।হাওলাদার বাড়ির সবার চোখে তুমি আমাকে ছোট করে দিয়েছো ভাইজান।এরপর গ্রামের সবাই বলাবলি করবে হাসাহাসি করবে আমায় নিয়ে।আমি এতটাই তুচ্ছ ভাইজান।ভালো করেছো বিদায় করে।আর জ্বালাবো না তোমায়।আসি।

কথাগুলো বলেই এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল কাঞ্চনা।কহিনুর বেগম নতজানু হয়ে বললো-

আমি বুঝি নাই আব্বা,ঝোকের বশে কইয়া দিছি।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফার উপর বশে পড়লো সুজন।সেতো এমনটা চায়নি কখনো।

দুপুর দুইটা।গোসল করে উঠোনের সামনে টাঙানো রশিতে কাপড় মেলছেন মজিদ হাওলাদার।ক্ষিপ্ত কাঞ্চনা ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল তার মুখ।রাগে,ক্ষোভে মজিদ হাওলাদারের সামনে এসে বললো-

ছিঃ!আপনার লজ্জা করলো না এমন একটা কাজ করতে।নিজের ছেলেকে মাত্র পাচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিলেন।এত কম মূল্য আপনার ছেলের।লজ্জা করা উচিত আপনার।কি করে খরচ করেছেন ছেলে বিক্রির টাকা?

ঠাস করে থাপ্পড় পড়লো কাঞ্চনার গালের উপর।রাগে/ক্ষোভে খিচতে খিচতে সেলিম বললো-

তোমার সাহস কি করে হয় আব্বার সাথে এইভাবে কথা বলার।মির্জা বাড়ির মেয়ে বলে।সেই ক্ষমতা এই বাড়ির চৌকাঠের বাইরে রেখে আসবে।এ বাড়িতে থাকতে হলে নরম হয়ে বউদের মতো চলতে হবে।কোনোপ্রকার তেজ চলবে না।সেভাবে থাকতে পারলে থাকবে নইলে এক্ষুণি বের হয়ে যাও।

ছলছল চোখে সেলিমের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কাঞ্চনা।যেন এই আচরণ টা তার কল্পনার অতীত ছিলো।বিয়ের পাচ দিনের মাথায় স্বামীর থেকে পাওয়া আঘাত এ যেন তার সমস্ত আত্নসম্মান কে ভেঙে-চূড়ে,চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল।গালে হাত দেওয়া অবস্থাতেই মাথা নিচু করে ঘরে চলে গেল কাঞ্চনা।

ক্ষোভে ফেটে পড়লো সেলিম।বাবার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো-

আব্বা,কি বলছিলো কাঞ্চনা?আমাকে বিক্রি করেছেন মানে..

নিচুমুখো হয়ে সব কিছু বলে দিল মজিদ হাওলাদার। আজ নয় তো কাল সেলিম সবটা জানতেই পারবে।তাতে আরো কষ্ট হবে তার।তার চেয়ে এখন জানাই ভালো।

বাবার মুখে কথাগুলো শুনে বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিল সেলিম।বললো-

আমাকে মির্জা বাড়ির জামাই হিসেবে বিক্রি করার আগে একবার জানানো উচিত ছিল আব্বা।খুব বেশীই কি দেনা ছিল। চাকরীটা পাওয়ার পর তো বছর ও লাগতো না এই দেনা দিতে।কি দরকার ছিল সারাজীবন আমাকে শশুড়বাড়ির সামনে ছোট করে রাখার।

মজিদ হাওলাদার নিচু মুখে অনুসোচনার সুরে বললেন-

বুঝি নাই বাপ।ভাবছেলাম তোর মায়রে ভালো ডাক্তার দেহামু,কিন্তু আর তো হইলো না।তোর মায় ই চইলা গেল।
ছলছল চোখ নিয়ে কথাগুলো বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন মজিদ হাওলাদার। চুপচাপ খোলা বারান্দায় গিয়ে শুয়ে রইলেন আকাশের দিকে তাকিয়ে।

দুপুর তিনটা।ঘরে ঢুকতেই সেলিমের মেজাজ গরম হয়ে গেল।কাঞ্চনাও ঘুমিয়ে আছে নিবিড়ভাবে। দ্রুতপায়ে হেটে গিয়ে একটানে হেচকা মেরে ওঠালো।ঘুমন্ত অবস্থায় এমন ধাক্কা সইতে পারেনি কাঞ্চনা।এই প্রথম ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সেলিমকে।

আব্বা রে এখনো খাইতে দেও নাই কেন?বুড়ো লোকটা সেই আরো এক ঘন্টা আগে গোসল কইরা আসছে। তোমার মিনিমাম এই জ্ঞান টুকুও নাই।যাও!!!এক্ষুনি গিয়ে খাইতে দাও।(চিৎকার করে)

বেশ ভয় পেয়েই কোনো উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে গেল কাঞ্চনা।সকালেই রান্নাবান্না করে তারপর বাবার বাড়িতে গেছিলো।উদ্দেশ্য ছিল কিছুদিন বেড়াবে।কিন্তু ভাগ্যে সইলো না।খাবার বেরে শশুর আর স্বামীকে ডেকে খাওয়ালো।পেটে ক্ষিধে থাকায় খাওয়ার সময় খেয়াল না করলেও হাত ধুতে গিয়েই সেলিমের স্মরণ হলো কাঞ্চনা খায়নি।বাবা খেয়েই দোকানে গেছে।

না খেয়ে আছো কেন?

এটো প্লেট গুলো জড়ো করে ধোয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বললো সেলিম।সেদিকে একবার নজর দিয়ে পুনরায় প্লেট নিয়ে ঘাটে এলো কাঞ্চনা।অভ্যাস হয়ে গেছে তার ঘাটে নামার।প্লেট পরিষ্কার করে করে ঢুকতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।সেলিম নিজে হাতে তার জন্য খাবার বাড়ছে।তাকে দেখতেই টেবিলের উপর খাবার রেখে হাত ধরে টেনে চেয়ারে বসালো।শান্ত কন্ঠে বললো-

সব সময় সবকিছুর জবাব দিতে নেই কাঞ্চনা।তাতে পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যায়।আব্বা যে কাজটা করেছেন সেটা অবশ্যই উচিত হয়নি।কিন্তু তাই বলে তার সাথে বাজে ব্যাবহার করার কোনো অধিকার ছিল না তোমার।তুমি ঘটনাটা নিয়ে আগে আমার সাথে কথা বলতে পারতে।
থেমে,
আব্বা মাকে ভালো জায়গায় চিকিৎসা করার জন্য তোমার ভাইয়ের থেকে টাকাটা এনেছিলো।হয়তো সেটা যৌতুকের রুপ ধরেই।যাই হোক,আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো।চিন্তা করো না,চাকরী টা পাই।তোমার ভাইয়ের সব টাকা শোধ করে দেব।তোমায় কারো সামনে ছোট হতে দেব না।
(হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে)
আমার টিউশনের সময় হয়ে গেছে।আসতে সন্ধ্যা হবে।খেয়ে নিও।

কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেল সেলিম।কাঞ্চনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনলো।ছলছল চোখে-হাসি-মুখে খাবারটা বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেল।এভাবেই কেটে গেল প্রায় দুই মাস।ধীরে ধীরে সম্পর্ক টা আরো গভীর হতে লাগলো কিন্তু পরিস্থিতি সেটাকে মুহূর্তের মধ্যে পালটে দিল।

___________
___________
শুক্রবার,সাপ্তাহিক ছুটির দিন।বাড়ির যাবতীয় কাজ-কর্ম শেফালী চাচী করলেও নিজের জামা-কাপড় কখনো তাকে দিয়ে ধোয়ায় নি সেলিম।বড় হবার পর মাকে দিয়েও ধোয়ায় নি, নিজে ধুতো।ভীষন অসস্তি কাজ করতো অন্যকে দিয়ে কাপড় ধোয়াতে।তবে কাঞ্চনা আসার পর থেকে হাসিমুখে কাপড় গুলো কাঞ্চনাকে দিয়ে ধোয়ানোর জন্য জড়ো করে রাখতো।মাঝে মধ্যে ধোয়া কাপড়-চোপড় ও ভিজিয়ে রাখতো কাঞ্চনাকে জ্বালানোর জন্য।এতে যেন এক অদ্ভুত তৃপ্তি পেত সেলিম।পুরনো কথা মনে আসতেই ঠোট এলিয়ে হেসে দিলো।সে খুব কম হাসে।আর যতটা হাসে সেটাও সবার অগোচরে।মাঝেমধ্যে পুরনো ডায়েরীর পাতা পড়ে,আবার কখনো পুরনো স্মৃতি মনে করে।কাপড় চোপড় ধুয়ে বালতিতে ভরে শুকানোর উদ্দেশ্যে ছাদে উঠলো সেলিম।

সকাল সাড়ে দশটা।মির্জা বাড়িতে বিয়ের আমেজ।চারপাশে আত্নীয়-স্বজনের আনাগোনা।আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে কাঞ্চনাকে দেখতে এসেছে সুমন।খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে শেষ বারের মতো তার সাথে একান্তে কথা বলতে চায় সুমন।কোলের চার বছরের ছেলেকে বাবার কাছে দিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে সিড়িতে পা রাখল।ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে কাঞ্চনাও তার পিছু পিছু ছাদে আসলো।

ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনা।পাশেই হাত দুয়েক দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে সুমন।

জানেন কাঞ্চনা,ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সুজতাকে।বেশ সুখেই চলছিলো সংসার।কিন্তু ওই যে ভাগ্য!আরাভ(সুমনের ছেলে)হওয়ার সময়ই চলে গেল আমায় একা ফেলে।বেশ ভেঙে পড়েছিলাম।আত্নীয় স্বজনরা কতবার বলেছিলো বিয়ে করতে। কিন্তু করিনি।কেন জানেন?সৎ মা কখনো আপন মা হয় না।ছেলেকে নিয়েই কাটিয়ে দিলাম চার বছর।কিন্তু ওই যে বললাম ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই।

আপনি স্কুলে আসার পর থেকেই এক অদ্ভুত মায়া কাজ করতো আমার মনে।কেন যেন আপনার ব্যাক্তিত্ব,কথা-বার্তা,আচার-আচরণ সবকিছুর মধ্যে সুজতাকে খুজে পেতাম।তারপর আপনার সম্পর্কে সব খবর নিলাম।দেখলাম, আপনিও আমার মতো ভাগ্যের কাছে পরাজিত।ভাবলাম,একা একা তো আর চলা যায় না।শেষ সময়ে একজন সঙ্গীর খুব অভাব বোধ করছিলাম।দিয়ে দিলাম প্রস্তাব, আপনার ভাইয়ের কাছে।রাজি হয়ে গেলেন তিনি।

থেমে,
এতোগুলো কথা আপনাকে কেন বললাম জানেন?

অমনোযোগী কাঞ্চনা হু বলে হুশে আসলো।বললো-

কেন?

কাঞ্চনার ডানহাতের আঙুল গুলো বেশ অধিকারের সাথে জড়িয়ে ধরে সুমন বললো-

আপনি আমার আরাভকে একটু ভালোবাসুন কাঞ্চনা।আপনার পুরো পৃথিবী আমি ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবো।

ঠাস!!!করে বিকট শব্দ শুনতেই কাঙ্খিত স্থানে তাকায় কাঞ্চনা।হ্যা,এতোক্ষণ কাঞ্চনার ধ্যান ছিলো ছাদের দক্ষিণ দিকের ছোট্ট একতালা বাড়িটির ছাদে।সেলিম কাপড় মেলতে এসেই কাঞ্চনা আর সুমনকে একসাথে দেখে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।কিন্তু সুমন হাত ধরায় হয়তো আর নিজেকে সামলাতে পারেনি।বালতি ফেলে ছাদের দরজা বিকট শব্দ বন্ধ করে হনহন করে নিচে নেমে যায়।হয়তো কোনো কথা শুনতে পায়নি।পাবেই বা কিভাবে এখান থেকে চিৎকার দিলেই ও বাড়ি থেকে শোনা যাবে।এতো ধীর কন্ঠে বললে তা কখনোই বোধগম্য হবে না।

না চাইতেও মুখে হাসি ফুটলো কাঞ্চনার।সেলিম যে বেশ ঈর্ষান্বিত তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।এই ইর্ষা টাই তো কাঞ্চনা চেয়েছিলো আরো এক যুগ আগে।কিন্তু আফসোস! পায়নি সে।হেরে গিয়ে একাকিত্বের রাস্তা ধরতে হয়েছিলো তাকে।

চলবে?

বার্তা-রি-চেইক করা হয়নি।ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী 🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here