মায়াবতী কাঞ্চনা পর্ব ৪

0
518

#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৪

চারুর মৃত্যুর আজ তিনদিন কেটে গেছে।সবাই নিজেদের সামলে নিলেও ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে সেলিম।স্তব্ধ হয়ে একেক জায়গায় বসে থাকে।খাওয়া নেই,নাওয়া নেই,ঘুম নেই রক্তজবার মতো চোখ দুটো নিয়ে নিশিরাত ভাবনায় মশগুল থাকে।মায়ের অসুখে প্রায় দুই লাখ আশি হাজার টাকার মতো দেনা হয়েছে।তার উপর জায়গা-জমি বিক্রি তো বাদ।মায়ের জানাযার সময় সকল দেনা দেওয়ার ভার গ্রহণ করার সময় সেলিম অবাক হয়ে যায়।কেননা সকল দেনা নাকি বাবা মৃত্যুর আগেই পরিশোধ করে দিয়েছে।বড় করে মিলাদ দিয়েছে তার উপর বিয়েতেও তো কম খরচ হয়নি।এতো টাকা কোথায় পেল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এসবের জবাব বাবার থেকে নেওয়া যাবে না।

দুপুর দুইটা।আজ চুলো জ্বালিয়েছে বাড়িতে। কাঞ্চনা কাচা হাতে ভাত-ভর্তা আর ডাল রেধেছে।রান্না করে গোসলে যেতে ধরতেই তাকিয়ে দেখলো ভাই আজ ও বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছে।কাজ আছে বিধায় খাবার দিয়েই সে পাড়ি জমিয়েছে ঢাকার দিকে।

খাবারের প্লেট হাতে ধীর পায়ে নিজেদের কক্ষে ঢুকলো কাঞ্চনা।সেলিম বালিশে হেলান দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।কাঞ্চনার উপস্থিতি পেয়েও তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না তার।বিছানার এক কোণে প্লেট রেখে সেলিমের মুখোমুখি বসলো কাঞ্চনা।শান্ত কন্ঠে বললো-

আপনিও কি সবার মতো আমায় অপয়া ভাবেন?

চমকে তাকালো সেলিম।হ্যা এটা সত্য।গত তিন দিনে প্রতিবেশীদের মুখে কাঞ্চনাকে নিয়ে অজস্র কথা শুনেছে।এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পরেই শাশুড়ী মরেছে।সে অপয়া,অলক্ষী। এরকম অহরহ নিচু কথা কথা কানে গেলেও সেলিম প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা দেখায়নি।

কন্ঠে কাঠিন্য এনে জানালার দিকে তাকিয়ে কাঞ্চনার উদ্দেশ্যে সেলিম বললো-

এরকম নিচু কথা আমি কখনো ভাবি নি কাঞ্চনা।মা ক্যান্সারের রোগী।আজ হোক,কাল হোক মারা যেতেনই।বরং আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ,তিনি আমার মাকে বেশীদিন এই কষ্ট ভোগ করতে দেন নি।তবে একটা কথা জানো তো …..

থেমে,

এ বাড়িতে মায়ের ইচ্ছাতেই তোমায় বউ করে আনা।তুমি মায়ের সেবাযত্ন করবে,কখনো অবহেলা করবে না এটা ভেবেই মা আমাকে জোর করেছিলো তোমায় বিয়ে করতে।কিন্তু আফসোস!তোমার দেওয়া যত্ন তিনি নিতে পারলেন না।

কথাগুলো ভালো লাগলেও বুকের বামপাশ টা কেমন দু*মড়ে মু*চ*ড়ে যাচ্ছে কাঞ্চনার।শুধুমাত্র মায়ের সেবা করার জন্যই বিয়ে করেছে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার জন্য নয়।কাঞ্চনা বরাবরই স্পষ্টভাষী।এবারেও মনে আর কথা চেপে রাখলো না।ধীর কন্ঠে সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললো-

শুধুমাত্র মায়ের সেবা যত্ন করার জন্যই আমায় বিয়ে করেছেন?আমার প্রতি কোনো অনুভূতি/মায়া নেই আপনার।
থেমে,
সেবা করার জন্য হলে কাজের লোক রাখতে পারতেন,বিয়ে করার কোনো দরকার ছিলো না।আচ্ছা!আমি কি কালো বলেই এই অবহেলা?

জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কাঞ্চনার মুখের দিকে চাইলো সেলিম।শ্যামকালো মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোয়া।নেই কোনো সৌন্দর্যের ছিটে ফোটা আর নেই তো আকৃষ্ট করার মতো মায়া।মুখ সরিয়ে পুনরায় জানালার দিকে তাকালো সেলিম।থমথমে কন্ঠে বললো-

আমি তোমাকে মিথ্যা কোনো সান্তনা দেব না কাঞ্চনা।তোমাকে আমার পছন্দ নয়।তাই বলে যে অন্য কাউকে পছন্দ করি এমনটাও নয়।প্রত্যকে মানুষই সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়।আমিও তার ব্যাতিক্রম নয়।তাই বলে তোমার প্রতি যে আমি অবহেলা করবো এমনটাও ভেবো না।মায়া তৈরী হতে সময় লাগে।তুমি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছো।সময় দাও,সব সামলে নেব।

কথা গুলো বলেই খাবারের প্লেট হাতে নেয় সেলিম।স্থির হয়ে তার মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে।আজ প্রথম বার তার আফসোস হচ্ছে।নিজের গায়ের রঙের প্রতি।কি হতো যদি আরেকটু সুন্দর হতো সে।

সেদিন আর সেলিমের সামনে পড়েনি কাঞ্চনা।নিজের মধ্যে কেমন যেন হীনমন্যতার দেখা দিয়েছে।সব সময় মনে হয়েছে ওই লোকটার অযোগ্য সে।

রাত প্রায় বারোটা।সেলিম পড়ছে।স্বামী, শশুরকে রাতের খাবার খাইয়ে থালাবাসন পরিষ্কার করেছে কাঞ্চনা।তারপর বাকি তরকারি গুলো গরম করে একেবারে ঘুমুতে এলো।সেলিম শুয়ে পড়েছে।কাঞ্চনাও পাশে শুয়ে পড়লো কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই।রাত প্রায় দেড়টা।সেলিমের বুককে আকড়ে ধরে নিরবে কেদে যাচ্ছে কাঞ্চনা।কানের কাছে শুধু একটা কথাই বাজছে “তোমাকে আমার পছন্দ নয় কাঞ্চনা”।

সেলিম ঘুমায়নি।নিজের মধ্যেই দুপুরের কথাগুলোর জন্য বেশ অসস্তি হচ্ছে।কিছু একটা ভেবেই দুহাত দিয়ে কাঞ্চনার বাহু ধরলো।

শিউরে উঠলো কাঞ্চনা।অগোচরে কাদলেও যে সে কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।বিছানায় হেলান দিয়ে বসে দুহাত দিয়ে কাঞ্চনাকে আগলে ধরলো সেলিম।গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো-

আমি সবকিছু ঠিক করে নিতে চাইছি কাঞ্চনা।আমি চাই, তুমিও তাতে সম্মতি দাও।হুট করে বিয়েটা হয়েছে দেখে যে আমরাও এভাবে আলাদা থাকবো এমনটা না।আমি চাই তুমি আমার মায়ের অনুপস্থিতিতে এই সংসারটাকে আকড়ে ধরে বাচো।আর আমাদেরকেও বাচাও।

সেদিন দুজনার অনিচ্ছায় হলেও সমাজ,সংসার,দায়িত্ব বোধ থেকে প্রথমবারের মতো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে থাকা গভীর বন্ধনের সৃষ্টি করেছিল।

___________
সোজা হয়ে সিলিং য়ের দিকে তাকিয়ে আছে কাঞ্চনা।দুচোখের কোল ঘেঁষে বেয়ে চলেছে অজস্র অশ্রুকণা।আজ তেরো বছর পর সে পরিচিত মানুষটাকে দেখেছে।না চাইতেও ভেতর থেকে পুরনো অতীতেরা হানা দিচ্ছে বারবার।এরইমধ্যে আযানের মধুর সুর কানে হানা দিল।সারা রাত ঘুম হয়নি তার।বিছানা থেকে উঠে ওযু করে নামাজ পড়তে বসলো।

সকাল সাড়ে আটটা।নিজেকে পরিপাটি করে টিফিন বক্স এবং ব্যাগ হাতে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো কাঞ্চনা।এই চারদিন আগেই ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা থেকে এখানে এসেছে সে।এই এলাকারই একটি মাধ্যমিক স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা সে।গেট পেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ট্যাক্সিতে উঠতেই সামনের আয়নায় পরিচিত মানুষটাকে একবার দেখে নিল।বাইক নিয়ে ধেয়ে আসছে এদিকেই।হয়তো ডিউটিতে যাচ্ছে।চোখ দুটো পুনরায় ছলছল করে উঠলো কাঞ্চনার।

তিনতলা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে সপ্তম শ্রেনীর এক ছাত্র নিচে পড়ে গেছে।ভাগ্য সহায় থাকায় পুকুরের পাশে জড়ো করে রাখা ইটের স্তুপের উপর নয় পানিতে পড়েছে।ঘটনা শোনামাত্রই থানা থেকে পুলিশ এসেছে।ইনভেস্টিগেশন করে পিচ্ছিল থাকা ছাদের দরজা না খোলার হুকুম দেয় পুলিশ।পরবর্তীতে এরকম অবহেলার কারনে যদি শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের উপর চরম দুর্ভোগ নামবে এরকম হুমকি দিয়েই সেখান থেকে চলে যায় পুলিশ।

সেলিমের মাথা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে।অজানা কারনেই রাগে-ক্ষো*ভে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।ইনভেস্টিগেশনের পুরো সময়টা জুড়ে সে স্কুলে ছিলো।স্কুলেরই এক শিক্ষক সারা সময়টা জুড়ে কাঞ্চনার সাথে চিপকে ছিলো।যেটাতেই ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে যায় সেলিম।

কাঞ্চনা কালো,দেখতে ভালো না,তার সাথে কেউ মিশবে না,তাকে কেউ ভালোবাসবে না এটাতেই যেন এক অতৃপ্ত সুখ অনুভব করে সেলিম।কিন্তু আজ প্রথম বারে নিজের পরিচিত মানুষটার প্রতি অন্য পুরুষের সামান্য কেয়ারিং ভেতরে ভেতরে ভস্ম করে দিচ্ছে তাকে।কাঞ্চনার পাশেই অন্য পুরুষ টিচার রাও ছিলেন।কোনো রকম ভাবে তাদের সাথে কাঞ্চনার শরীর না ঘেঁষে সেটাকে লক্ষ করেই সেই টিচার কাঞ্চনাকে অন্যদিকে সরিয়ে দিয়ে নিজে দাড়িয়েছিলো সেই জায়গায়।এমনকি প্রশ্ন করার সময় ও সে কাঞ্চনাকে সেখানে যেন না দাঁড়িয়ে ক্লাসে যায় সেই হুমকি দিয়েছিলো।কোনোরুপ বাক-বিতন্ডা না করেই কাঞ্চনা তার কথায় সায় দিয়েছি।এটাতেই যেন সহ্যহীন হয়ে পড়েছে সেলিম।

কই তার সাথে থাকার সময় তো কখনো কারো কথা শোনেনি।বরং কোনো কিছুতে বারণ করলে খামখেয়ালি করে সেই কাজটাই করতো সে।তাহলে ওই লোকটার কথাই কেন শুনবে?কেন?

রাত দশটা।সারাদিনে নিজেকে কোনোমতে সামলে ডিউটি করেছে সেলিম।বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ই কানে আসে হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ।আর সেটাও কাঞ্চনাদের ছাদ থেকে।বেশ লোক-জনের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সেলিম।কিন্তু কেন?

ঘরে ঢুকে গায়ের ইউনিফর্ম খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানায়।টানা আধঘন্টা ধরে ভিজে নিজের রুমে ফিরে এলো।টেবিলে খাবার বাড়া। পাশেই নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে শেফালী চাচী।সেলিম নিজেকে শান্ত করে বিছানায় বসলো।চোখ গুলো অত্যন্ত লাল হয়ে আছে।ধীর কন্ঠে শেফালীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো-

মির্জা বাড়িতে অত আমেজ কিসের চাচী?কিছু জানো তুমি?

কথাগুলো বলার জন্য যেন ছট*ফট করছিলেন শেফালী।সেলিমের অনুমতি পেয়েই কথার ঝুড়ি খুলে বসলেন-

আর আব্বা কইয়ো না।ওই বাড়িতে তো বিয়া।আমিও বুঝি না বাপু,প্রায় তেত্রিশ/চৌত্রিশ বছর তো শেষ, এহন বিয়া কইরা কি লাভ।বিয়া বসবার ইচ্ছা থাকলে আগে বইলেই পারতি।আমি কি বলি আব্বা,তুমিও এইবার বিয়া ড কইরা হালাও।আর কত একা একা থাকবা।বয়স তো কম হইলো না।প্রায় বিয়াল্লিশ শেষ তোমার।এহন একটা বিয়া কইরা বাচ্চা কাচ্চা নিয়া সুখে থাহো।নইলে শেষে যখন বিছনায় পড়বা তহন দেখবো ক্যাডা কও?

সেলিমকে আরো বেশী শান্ত দেখালো।কতক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বললো-

বিয়েটা কার চাচী?

কার আবার, কাঞ্চনার।

কিছুটা চমকালো সেলিম।বলল-

কাঞ্চনার তো বিয়ে হয়ে গেছে।বাচ্চাও আছে শুনেছি।দেড়/দু বছরের একটা মেয়ে দেখলাম।

শেফালী-আরে না না, ওইডা তো ওর না।ওর বড় ভাইডার।একটা পোলা আর মাইয়া। আর কাঞ্চনা তো বিয়া করে নাই।এহন করবো হুনলাম।

শান্ত কন্ঠে শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলো সেলিম।

কার সাথে বিয়ে?জানো কিছু?

শেফালী-হয়,জানিতো।ওই যে উত্তর পাড়ার বজরুল আলমের পোলা সুমন।এহন তো হে মাস্টের কাঞ্চনাগো স্কুলের।হের লগে নাকি বিয়া হইবো।হেরাই প্রস্তাব দিছে।মনে তিন/চার দিনের মধ্যে বিয়া হইয়া যাইবো।আমিও বলি কি আব্বা,তুমিও কইরা হালাও বিয়াডা।তোমার হেই বান্ধবির তো তালাক হইয়াই গেছে।বিয়াডা করলে…….

সেলিম গম্ভীর কন্ঠে বলল…

তুমি এবার বাড়ি যেতো পারো চাচি।রাত হয়ে গেছে অনেক।আমি দরজা আটকে ঘুমাবো।

মুখের উপর কথাটা বলায় বেশ তেজ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন শেফালী।আর সেলিম?সে তো বিছানায় উপর সোজা হয়ে শুয়ে কিছু ভাবতে মশগুল।

চলবে?

সবাই দ্রুত সাড়া দিবেন।তাহলে লেখার উৎসাহ বাড়ে।🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here