মিঠা রোদ পর্ব ৫২

0
1949

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৫২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমি তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা।এইযে মাঝেমধ্যে বলে না পশ ফ্যামিলির সন্তান।রিচ কিড।আমি সেরকম একজন মানুষ।অনেকটা বনেদি পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম।মজার ব্যাপার হলো আমার মায়ের বয়সের অর্ধেক আমি।অতি সুন্দর ভাবে যেদিন আম্মুর বিশ বছরের জন্মদিন ছিল সেদিন আমার জন্ম।আরে তখন আব্বুর বয়সও তো বিশ বছর ছিল।”

কথাটি বলার সঙ্গে অদ্ভূতভাবে হাসলো তোশা।দীর্ঘ পয়তাল্লিশ মিনিটের নাটকের পর তাকে এখন স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে।পরনে বিকেলের সেই হাসিটা।কবীর এতোক্ষণে মেয়েটির এতোটা ক্লান্ত থাকার কারণ খুঁজে পেলো।

“আমার মা-বাবা ভালোবেসে খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল।এটাও নিয়েও তো এক সময় কথা উঠেছিল।তবে আমার মায়ের যোগ্য ও পিওর সন্তান আমি।কারো কথায় কী আসে যায়?দুটো মানুষ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল।কতোটা ভালোবাসা ছিল তাদের মধ্যে।আমি সবার আদরের তোশামণি।ছোটবেলার নিজের ছবি দেখে পুতুলের মতো লাগে।তাহলে এমন কোনো পা’ষা’ণ ব্যক্তি হয়তো ছিলনা যে আমাকে পছন্দ করেনি।সুখী একজন মেয়ে তোশা।কিন্তু সব সুখে গ্রহণ লাগা যেন আবশ্যক।বয়সের একটা সময়ে আম্মু-আব্বুর ডিভোর্স হয়ে গেলো।আব্বু চলে গেলেন কানাডা।আমার ছোট্ট আম্মু আমাকে আঁকড়ে থেকে গেলেন এখানে।তোশামণির দুনিয়া ছিল রঙিন।রোজ সকালে মা চুমু খেয়ে ঘুম থেকে ওঠায়,নানা আদর করেন।নানী বসে গল্প শোনান।খালামণি বাহিরে ঘুরাতে নিয়ে যান।মেকআপ শেখান।মামা দেশের সব প্রান্ত থেকে গিফট এনে দেয়।বছরের এক সময় কানাডায় থাকা বাবার থেকে ভারী রকমের গিফট বক্স আসে।যেখানে থাকে দামী ব্রান্ডের কাপড়,বারবি,খেলনা কতোকিছু।

পড়াশোনাতেও প্রথম তোশামণি।সকলের প্রিয়।স্বপ্নে মোহিত একজন মেয়ে।এতো কিছু পাওয়া মেয়ের জীবনে হুট করে একজন পা’ষা’ণ পুরুষের আগমণ ঘটে।আমার মায়ের বন্ধু,বাবার বন্ধু কবীর শাহ।বাজপাখির মতোন মানুষটাকে প্রথম দেখায় নিজের স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললাম।ওইযে স্বপ্ন দেখতে ভালোবেসেছি।কবীর শাহ কে দেখলে আমার বুকের ভেতর অদ্ভূত অনুরাগ তৈরী হতো।পনের বছরের তোশামণি যার কারণ খু্ঁজে পায়না।এক পা দুই পা করে সময় যায়।বুঝে গেলাম বাজপাখি নরম মনের ছোট্ট তোশাকে বহু পূর্বে নিজের করে নিয়েছে।মানুষটা অবশ্য তা মানতে নারাজ।

বাকী কাহিনী আপনারা দেখলেন।জেনেছেন।আমি জানি কিছু মানুষ তেঁতো মনোভাবে লম্বায় এই পাঁচ ফুট পাঁচ রোগা শরীরটিকে দেখছেন।মনে হচ্ছে কী মেয়ে নিজের বাবার বয়সী লোকের সাথে প্রেম করে?হ্যাঁ করেছি।তাকে ভালোবাসি।তিনিও আমাকে ভালোবাসেন।একটি সুন্দর সম্পর্ক আছে আমাদের।এই বলে আমি তার সুগার গার্ল নই।কবীর শাহ এর খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে আমি এমন মন্তব্য বহুবার পেয়েছি।দুঃখিত হয়েছিল মন।কিন্তু আমি ওমন মেয়ে নই।এই কথাটা চাইনা কেউ বলুক। আমার মা কষ্ট পাবে।এখন বলতে পারেন কাজটা এমন করলে কেন যাতে মা কষ্ট পাবে?তাদের কাছে একটি প্রশ্ন নির্জন অন্ধকারে দ্বীপে আলোর দেখা পেলে আপনি কী করবেন?উল্টো পথে দৌড়ে পালাবেন নাকী আলোতে উদ্ভাসিত করবেন জীবন?আমি আলো পেয়েছি সেই বাজপাখির মধ্যে।

কাওকে ভালোবাসা দোষের না যতোক্ষণ না সেটা অন্যায় করে পাওয়া হয়।কবীর শাহ চমৎকার একজন মানুষ।সেই চমৎকার মানুষটিকে আমি তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা ভালোবাসি।এতে কারো ক্ষ’তি হয়নি।অন্যায় হয়নি।কিংবা দেশের ইকোনমি সিস্টেমও ধ্বসে পড়েনি।তবে সেখানে দুটো মানুষকে কেন এভাবে জাজ করবেন?নিজের এই ঘটনাটি দেখানোর উদ্দেশ্য হলো সবাইকে জানিয়ে দিলাম আমি তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা এমন একজনকে নিজের করে চাই যাকে চাওয়ার বৈধতা সমাজ দেয়নি।তবুও আমি তাকে চাই।এবং সে আমাকে চায়।

কথাগুলো ব্যক্ত করতে গিয়ে তোশার নিশ্বাস উঠে গিয়েছে।খুব করে হয়তো কান্না আঁটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।নিজের অধর দং’শন করে পুনরায় বলল,

“আমি যদি কারো কাছে দো’ষী হয়ে থাকি তা আমার মায়ের কাছে।আম্মু সরি।আব্বু সরি।কিন্তু আমি..।”

তোশা থেমে পুনরায় বলল,

“আমি কবীর শাহ কে ভালোবাসি। এবং কবীর শাহ যিনি আমার থেকে বয়সে দ্বিগুণ সে ও আমাকে ভালোবাসেন।”

করুণ সুরের মাধ্যমে তোশার কথাগুলো শেষ হয়ে গেলো।কবীর খেয়াল করেছে মেয়েটি বহু প্রাণপণে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করেছিলো।হুট করে বাড়ির পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে গেলো।কবীরের মনে হলো প্রত্যেকে যারা এই নাটকটি দেখছিলো নিজেদের ঘরে বসে তাদের সবার মুখ থমথমে।কবীরের বাবা পরিবেশটি হালকা করতে বলল,

“তোশাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো তাইনা?”

সেলিমের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী যে কখনো তার উপর চড়াও হয়ে কথা বলেনি সে অদ্ভূত চিৎকারে শুধালো,

“আপনি কীভাবে ওকে সুন্দর বলতে পারেন?”

“সুন্দরকে সুন্দর বলবো না?”

“সব জানতেন তাইনা?কবীর কীভাবে নিজের বন্ধুর মেয়ের সাথে?”

মায়ের কণ্ঠের অবজ্ঞা কবীরকে নাড়াতে পারলো না।ওদিকে ফোনে অনবরত ভাইব্রেটে কারো কলের জানান দিচ্ছে।গম্ভীর শ্বাস নিয়ে স্ক্রিনে দেখতে পেলো তাহিয়ার নামটা।কবীরের অন্ত:করণে তীব্র বে’দ’না ফুঁটে উঠলো।এই কলটাকে সে ভয় পাচ্ছে।আশ্চর্য কিন্তু এমন কিছুর মুখোমুখি তো হওয়ার ছিল একদিন।অদ্ভূত উপায়ে যদিও বা তাদের বিষয়টা সকলে জানলো।সেতু আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো।কবীর হাত বাড়িয়ে থামতে বলল।

“তাহিয়া।”

“কবীর আমার মেয়ে কোথায়?”

তাহিয়ার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময়ের মুসাফির সে।অনেক দূর থেকে কথা বলছে।যার শব্দে প্রাণ নেই।কবীর ঘড়িতে দেখলো।রাত্রি প্রায় অনেকটা বাজে।

“বিকেলে এসেছিল আমার কাছে।মায়ানের বাসায় হয়তোবা।আমি ফোন করছি তাহিয়া।”

“ও কোথাও নেই কবীর।দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট ধরে খুঁজে চলেছি।কোথাও নেই।ওর বাবা,বান্ধুবী কারো কাছে নেই।আমার মেয়ে কোথায় কবীর?তোশা কোথায়?ও খুব ছোট একটা বাচ্চা।কখনো এভাবে বাহিরে থাকেনি।কোথায় আমার মেয়ে।”

“তাহিয়া শান্ত হও।ফোন করছি ওকে আমি।”

“ওর ফোন বন্ধ।কবীর তুমি কীভাবে পারলে আমার ছোট্ট মেয়ের সাথে।কীভাবে?আমাকে মেয়েকে এনে দাও।”

“শান্ত হও তাহিয়া।”

তাহিয়া ফোনটা রেখে দিলো।কবীর তৎক্ষনাৎ তোশার নাম্বারে ফোন করলো।আশ্চর্যভাবে মেয়েটা উবে গেলো নাকী?

(***)

কবীরের প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।কিন্তু কোনোমতন অসুস্থতার দোহায় দিয়ে নিজের রুমে এসেছে সে।সেতু আবার ছেলে বলতে পাগল।তাইতো বেশী রাগারাগি করেনি।কবীর উল্লাসের নাম্বারে ডায়াল করলো।কারণ সেই একমাত্র ব্যক্তি যে জানে তোশা কোথায়।দীর্ঘক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরলো উল্লাস।

“বিয়েটা তবে কোথায় করবেন কবীর শাহ?সিলেটে আমার সুন্দর একটা বাড়ী আছে।”

“এমনটা কেন করলে?”

কিছুক্ষণ নিরব থেকে উল্লাস বলতে শুরু করলো।ধীর, স্থির রহস্যময় কণ্ঠ তার।

“মায়ান চৌধুরী দীর্ঘ অনেক বছর পর দেশে আসার উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।সেখানে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু কবীর শাহ হুট করে তার মেয়েকে বিয়ে করে নিজেদের ভালোবাসার কথা জানাবেন।স্বাভাবিক কেউ পছন্দ করবেনা এবং সেদিন রাতে ইংল্যান্ডে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন নববধূকে।সেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ীর পরিচর্যা বেশ কয়েক মাস ধরেই করছেন।দিন যাবে একদিন তোশার বাবা-মা মেয়ের জন্য সব মেনে নিবে।কিন্তু আপনি এটা কখনো ভাবলেন না যে ঝামেলা করার আগে বিয়েটা করলে তোশাকে কোন লেভেলে নামিয়ে আনবে সমাজ?ও মিডিয়া জগতের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে।তাছাড়া ওর মাকে মানুষ কী বলবে?মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে।”

“দেখো আমি যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম সেটা হয়তোবা..।”

“কবীর শাহ এদেশে কখনো আপনাদের ভালোবাসার মূল্যায়ণ হবেনা।তাছাড়া আপনার উপর প্রশ্নও উঠতো না।সব দোষ আমার সখীর হতো।”

“উল্লাস,তোশা কোথায়?”

“সুস্থ আছে।বাট ভয় পেয়েছে।একটু দূরে থাকুক সকলের।এবং ভয় পাবেন না।মিডিয়াকে আমি ঘুরিয়ে দিবো।আপনাদের ক্ষ’তি আমি চাইনা।আর এটাও জানি নিজের বেলাডোনাকে বাজপাখি ভালোবাসে।তবে ওই পদ্ধতিটা খুব খা’রাপ ছিল।”

“তোশাকে বলো ওর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।কিংবা আমার সাথে।”

“আপনি কথা বলবেন?”

“হ্যাঁ।”

কবীরের কণ্ঠে আকুলতা।সময় যাচ্ছে মেয়েটির কণ্ঠ শোনার ইচ্ছা বাড়ছে।অথচ বিকেলেও তো তারা একসাথে ছিল।নিজের তামাটে ত্বকে তোশার উষ্ণতা এখনও আছে।অবশেষে দীর্ঘ এক মিনিট পর ওপাশ থেকে মিহি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,

“কবীর শাহ।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here