#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (১১)
অরুণিমা দরজা খুলে দেখল, একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় লাল ক্যাপ, মুখে লাল মাস্ক। হাতে বেশ বড়সড় একটি প্যাকেট। ডেলিভারি বয়’এর বেশভূষার আড়ালে থাকা মানুষটিকে এক পলকেই চিনে ফেলল। পেছনে দেখে নিয়ে ফিসফিস স্বরে বলল,
” আপনি! ”
মাইমূনের চোখজোড়ায় আশ্চর্য দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। এবার সেটি আনন্দের সাথে লুটোপুটি খেল। টান টান করে থাকা সিনাটা একটু নয়নীয় হলো। মাথাটা সামান্য ঝুকে বলল,
” কিছু সেকেন্ড পূর্বেও আমি আফসোস করছিলাম এটা ভেবে যে, তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকাওনি। অথচ মাত্রই আমার আফসোস দূর করে প্রমাণ করলে, শুধু ভালো করে না খুব ভালো করে তাকিয়েছ। নাহলে চোখ দেখে এত দ্রুত চিনে ফেল? অরুণিমা, আমার ভালোবাসা নামক চুম্বকে আটকে পড়েছ! ”
অরুণিমা এই আবেগঘন কথাবার্তাকে পাত্তা দিতে পারল না। তার হৃদয়ে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। বুক জুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখছে, মা আসছে নাকি। অন্যরা ঘুমিয়ে পড়লেও নাজিয়া বেগম এখনও সজাগ। আরও একবার পেছনে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” এখানে কী করছেন? ”
মাইমূনকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিল না। ফিসফিস কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্ত ও রাগ মাখিয়ে বলল,
” দুপুরে কী যেন বলেছিলেন? আমার আগে-পিছে ঘুরেন না। আমি বললেই আসেন, না হলে আসেন না। সেই কথার কী হলো? আমি কি আপনাকে ডেকেছি? ”
অরুণিমার অপ্রসন্ন মুখটায় চেয়ে থেকে প্রত্যুত্তরে মাইমূন বলল,
” যে কারণে ডেকেছিলে, সেটা তো সম্পন্ন হয়নি। ”
” তাই বলে আমার বাড়িতে চলে আসবেন? এত রাতে? ”
মাইমূন একটু অন্যরকম স্বরে বলল,
” কী করব! অর্ধেক আলাপটা মাছের কাঁটার মতো মনে ও মাথায় গেঁথে আছে। কিছুতেই সরাতে পারছি না, শান্তি হারিয়ে ফেলেছি। ”
অরুণিমার অস্থির দৃষ্টি স্থির হলো মাইমূনের চোখজোড়ায়। একটু আগের সেই দ্যুতিটা নেই। রয়েছে তীব্র ব্যাকুলতা! চঞ্চলতা। তার তাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হলেও প্রকাশ করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,
” কী করলে শান্তি ফিরে পাবেন। ”
মাইমূন এক মুহূর্তও দেরি করল না। সঙ্গে সঙ্গে উপায়টা বলল,
” প্রতিশ্রুতির পত্র পেলে। ”
অরুণিমা শুরুতে বুঝতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চাইতেই মনে পড়ে গেল, মাইমূন তার কাছে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল, বিয়েরও। বিনিময়েই তার চাওয়াটাও পূরণ হবে। সে ভাবনায় পড়ে গেল, মুক্তি চাইতে গিয়ে কি আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে যাবে? কথা দিলে কি ভেঙে ফেলা সহজ হবে? কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও নেই। আবার এই চিন্তাও আসল, সে কবে বিয়ে করবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ততদিন এখানে থাকবে নাকি তার নিশ্চয়তাও নেই। মাইমূন এই এলাকার মিয়াভাই। অন্য এলাকার জন্য না। অন্য কোথাও চলে গেলে, খুঁজে পাবে না। পেলেও ক্ষমতা থাকবে না, দাপট থাকবে না। সাধারণ মানুষের বিপরীতে দাঁড়াতে তার খুব একটা কষ্ট হবে না। এই অছিলায় মানুষটার থেকে দূরে থাকতে পারবে। কথা-বার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ ছাড়া কি ভালোবাসা বেঁচে থাকে? ছেলে মানুষ! মন বদলে যেতে পারে যেকোনো সময়।
” অরুণিমা? কে এসেছে? কার সাথে কথা বলছিস? ”
মায়ের গলা পেয়ে অরুণিমার চিন্তাভাবনার মালা ছিঁড়ে গেল। ভয় ও আতঙ্ক স্বরে দ্রুত জবাব দিল,
” ডেলিভারি বয়, মা। তোমাকে আসতে হবে না। ”
বলতে বলতে মাইমূনের হাত থেকে প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিল। মাইমূন এই সুযোগে জিজ্ঞেস করল,
” কথা দিচ্ছ তো? ”
নাজিয়া বেগম মেয়ের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েননি। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অরুণিমা পদধ্বনি টের পেয়ে দ্রুত বলল,
” হ্যাঁ। দিচ্ছি। এবার যান, এখান থেকে। মা আপনাকে চেনে। ”
মাইমূন অবাক হয়ে সুধাল,
” তাই নাকি? কীভাবে? ”
অরুণিমা উত্তর না দিয়ে দরজা আটকে দিল। পেছনে ফিরতে দেখল, মা একদম তার মুখোমুখি। সে ঘাবড়ে গেল। হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল,
” এটা দেওয়ার জন্য এসেছিল। ”
নাজিয়া বেগম প্যাকেটটা হাতে নিলেন। নেড়েচেড়ে বললেন,
” কী এটা? কে পাঠিয়েছে? ”
” কেউ না। আমি অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম, মা। ”
” ওহ, কিন্তু ভেতরে কী আছে? বুঝতে পারছি না। ”
অরুণিমা প্যাকেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিল। রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” তোমার বুঝতে হবে না। এগুলো আমার দরকারি জিনিস। ”
ঘন ঘন পা ফেলে ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। প্যাকেটটা খোলার পূর্বে তাকাল বড় খাটটায়, শূভ্রা ঘুমে অচেতন। অন্য পাশের ছোট খাটটায় নিয়াজও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে খুব সাবধানে প্যাকেটটি খুলল। উপুত করে ঢালতে একগাদা মেক-আপ সেট বেরিয়ে এলো তুষারপাতের মতো। সে আশ্চর্য না হয়ে পারল না! এতগুলো! প্রতিদিন সাজলেও বছর দুয়েক পেরিয়ে যাবে অনায়াসে। তার বিস্মিত চোখজোড়া একটি কাগজও আবিষ্কার করল। হাতে তুলে নিয়ে দেখল তাতে লেখা,
‘ প্রথম বারের মতো তোমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, উপহার না নিলে হয়? কিন্তু কী নেব চিন্তায় পড়তে মনে পড়ল, কয়েকদিন ধরে তুমি সাজগোজ করছ না। তাই এগুলো উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়েছিলাম। তুমি এত তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলে যে, দিতেই পারিনি। ‘
অরুণিমা পড়া বাদ দিয়ে মনে মনে বলল, ‘ এত ব্যস্ততার মাঝেও নজর সরেনি এক মুহূর্তের জন্য! এই মিয়া ভাইয়ের চোখ কি আমাদের মতো দুটো নাকি আরও বেশি? ‘ কাগজটির নিচে আরও লিখেছে,
‘ আমার খুব ইচ্ছে ছিল, এই ভারী সাজের প্রলেপের নিচের সৌন্দর্য টা দেখার, যা সৃষ্টিকর্তা সযত্নে সুনিপুণভাবে সাজিয়েছে। সেই ইচ্ছে আজ পূরণ করে দিলে। বিশ্বাস করিয়ে দিলে, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সৌন্দর্যের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। অরুণিমা, এরপর যখন আমার সামনে আসবে, তখন এমন সাধারণ, অগোছালভাবেই আসবে। সাজসজ্জাহীন তোমার পবিত্র, বরপ্রাপ্ত স্বর্গীয় সৌন্দর্যটুকু আমি চোখ দ্বারা পান করতে চাই। ‘
অরুণিমা একটানে কাগজটা দুই টুকরো করে ফেলল। জানালার একটা পাল্লা মেলে বাইরে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতে মোবাইলে একটি বার্তা ঢুকল। তাতে লেখা, ‘ ভালোবাসা, আমরা একে-অপরের প্রতিশ্রুতি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব। ‘
_________
‘ ছায়ানীড় ‘ এ তখন গভীর রাত। নীরব, নিস্তব্ধ। আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। স্বর্ণলতা তাহাজ্জুদ শেষ করে জগ হাতে রুম থেকে বেরুলেন। রান্নাঘরে ঢোকার সময় অভ্যাসমতো ছেলের রুমের দিকে তাকালেন। মুহূর্তে থমকে গেলেন। বন্ধ দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে। মুখের মধ্যে চিন্তার আগমন ঘটল। সঞ্জয়ান সময়কে মূল্য দেয় খুব। বাঁধা নিয়মে চলতে পছন্দ করে। সেই হিসেবে তার অর্ধেক ঘুম সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আলো দেখে মনে হচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে। স্বর্ণলতা ছেলের ঘরের দিকে এগুলেন। দরজায় টোকা দিতে সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” মা, ঘুমাওনি? ”
স্বর্ণলতা উত্তরে বললেন,
” আমারও একই প্রশ্ন। ঘুমাসনি এখনও? ”
সঞ্জয়ান মৃদু হাসল। মাকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল,
” ঘুম আসছে না। ”
” কেন? শরীর খারাপ? ”
মায়ের উদ্বিগ্নতা উড়িয়ে দিতে বলল,
” না। আমি একদম সুস্থ। কিছু হয়নি। ”
” তাহলে? কোনো ব্যাপারে চিন্তিত? ”
সঞ্জয়ান এক মুহূর্ত মায়ের মুখটায় চেয়ে থাকল। তারপরে অন্যমনস্ক হলো। উদাস গলায় বলল,
” মা, তোমার মনে আছে? ছোটবেলায় এক বাচ্চাকে আদর করার জন্য খুব জেদ করেছিলাম? ”
স্বর্ণলতার মাথায় খুব একটা চাপ দিতে হলো না। এই ঘটনা ভোলার মতো না। আয়নার মতো ঝকঝকে। তখন সঞ্জয়ানের বয়স মাত্র চার বছর। অন্যসব বাচ্চাদের মতো না। কথা-বার্তা, চাল-চলনে খুব চালু। সমবয়সীদের সাথে খেলা-ধুলা পছন্দ না। তার চেয়ে ছোট বাচ্চাদের দেখতে পারে না একদমই। তবুও মায়ের সাথে ‘ শিশুর যত্ন ‘ নামের সংস্থায় যাওয়া চাই। মা যখন সদ্য জন্ম নেওয়া কোনো বাচ্চাকে কোলে নিত তখন মুখ গোমড়া করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকত। খুব হিংসুটে ছিল যে! তেমনি একদিন কী হলো কে জানে! মাত্রই জন্ম নেওয়া এক বাচ্চাকে নাড়ি কেটে আতুরনিবাস থেকে যখন বেরুলেন তখনই সে বলে ওঠল, ‘ প্রথমে আমি কোলে নিব। ‘ স্বর্ণলতা অবাক হলেন। ভয়ও পেলেন। কারণ, বাচ্চাটি তখনও কান্না করেনি। শারীরিকভাবেও দুর্বল। বাবার সাথে দেখা করিয়ে হাসপাতালে নিযে যাওয়ার পরামর্শ দিবে। এর মধ্যে সঞ্জয়ানের কোলে দেওয়া ঠিক হবে না৷ তাই মানা করে দিল। কিন্তু সে মানল না। মায়ের কথা বুঝল না। বাচ্চাটিকে কোলে নেওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলছিল, ‘ আমি প্রথমে আদর করব। ভালোবাসব। ‘ এরমধ্যে বাচ্চার বাবা চলে আসে। এমন কাণ্ড চক্ষুদর্শন করে অনুমতি দিল, বাচ্চাটিকে প্রথমে তার কোলে দিতে। অনুমতি পেয়ে স্বর্ণলতা বাচ্চাটিকে ছেলের কোলে দিয়েছিল। সেই প্রথম সঞ্জয়ান কোনো বাচ্চাকে কোলে নেয়, চুমুতে ভরিয়ে দেয় চোখ-মুখ। স্বর্ণলতা ঝকঝকে স্মৃতির আয়না থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বললেন,
” হঠাৎ ঐ বাচ্চার কথা মনে হলো কেন? ”
” সেই বাচ্চাটির মতো আরেকজনকে দেখলাম। চেহারায় একই রকম মায়া! ভারি নিষ্পাপ। খুব আদুরে। চোখ ফেরানো যায় না। ফেরালেই বুকের ভেতর কিছু একটা হয়। আমারও হয়েছে। খুব যন্ত্রণাদায়ক কিছু। কিন্তু ব্যথা হয় না। আনন্দ হয়। আর শূণ্য শূণ্য লাগে। ”
ছেলের কথাগুলোকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেও ভালো করে বুঝতে পারলেন না। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে! কিসের সাথে কী মেলাচ্ছে সেটাই স্পষ্ট নয়। জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় দেখলি? কোলে নিয়েছিলি? ”
সঞ্জয়ানের হুঁশ এলো। জিভ কামড়ে বলল,
” না। কোলে নেওয়ার মতো না। ”
” কেন? বড় বাচ্চা? ছেলে নাকি মেয়ে? ”
” মেয়ে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ! কার বাচ্চা রে? আমি চিনি? ”
সঞ্জয়ান অন্য দিকে ফিরে গেল। কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে ধমকাচ্ছে। স্বর্ণলতা তার সামনে গিয়ে পুনরায় সুধালেন,
” কার মেয়ে? খুব রক্ষণশীল পরিবার নাকি? সেজন্যই হয়তো বাচ্চাকে কোলে দেয়নি। ”
সঞ্জয়ান চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” অসীউল্লাহর মেয়ে। ”
চলবে